শেষ বিকেলের আলো পর্ব-০৫

0
558

#শেষ বিকেলের আলো
#পর্ব_০৫
#নিশাত_আনজুম

শুক্রবার হওয়ায় হামিদ সারাদিন বাসাতেই আছে। সকাল থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় সে কোথাও বেরোয়নি। ভোরের দিকে শীত অনুভব হওয়ায় ঘুম ভেঙেছে একবার। তখন বিছানায় সেতুকে দেখেনি। রান্নাঘর থেকে টুংটাং আওয়াজ শুনে বুঝলো রান্নাঘরে। বুঝলো না এতো ভোরে রান্না ঘরে কী করছে সেতু। অবশ্য সে জানেও না সেতু কখন বিছানা ছাড়ে। হামিদ কিছু না ভেবে পায়ের কাছ থেকে কাঁথা টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লো। সেতু বেশ কয়েকদিন আগে থেকে শখের রান্নাটা আবারও শুরু করেছে। বিয়ের আগেও যে সেতুর ‘শখের রান্না’ নামে খাবারের একটা পেইজ ছিল সেটা হামিদ জানতো। বিয়ের পর যখন সেতু কাজটা চালিয়ে যাবে বলেছে তখন রুবিনা স্পষ্ট না বলে দিয়েছিল। বউ এনেছে সংসার দেখবে, সংসারের কাজকর্ম করবে। টাকা কামাই করতে তার ছেলে আছে। হামিদও মায়ের কথায় মত দিলো। সেতু তাদের কথা মেনে নিয়েছিল। হঠাৎ সেদিন খাবার টেবিলে সবার সামনে বলেছে সে রান্নার বিজনেসটা আবারও চালিয়ে যেতে চায়। হামিদের মা শুনে খুব রেগে বলেন। তখন সেতু বলেছে, ” মা, সংসারের কাজকর্ম করেই বাকি সময়ে আমি এটা করবো। আপনাদের, আমার ছেলের কোনো অযত্ন হবে না। আমি যদি দুইটা একসাথে না পারি তাহলে আমি নিজেই সরে আসবো। আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন। ”

হামিদের বাবা আর হাবিব সেতুকে সাপোর্ট করেছে। হামিদের বাবা বলেছেন দরকার পড়লে তিনি নিজে ডেলিভারি করবেন। সেতুর দুচোখ সেদিন চোখের পানিতে ভরে গিয়েছিল। সেই থেকে সেতুর কাজ শুরু। সংসারের কাজ সামলে সে খুব সুন্দর করে নিজের শখের রান্নাগুলো করছে। পূর্ব পরিচিত হওয়ায় ইতোমধ্যে বারোটা অর্ডারও পেয়ে গেছে সে। আজ নাকি সেতুর বড় অর্ডার ছিলো। হামিদ সেটা জানলো যখন বাবা আর সেতু ডেলিভারি দিতে যাচ্ছে তখন। সে বাবার হাতে অত বড় প্যাকেট দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, বাবা, কোথায় যাচ্ছো তুমি? তোমার হাতে এসব কী?”

” কেন তুই জানস না? বউমা আজ বড় অর্ডার পায়ছে। সেগুলো দিতে যাইতেছি।” হামিদ কিছু বলার আগে সেতু তাড়া দিলো বাবাকে। হামিদ জানালা দিয়ে দেখতে পেল সেতু বাবার মাথার উপর ছাতা ধরে হেঁটে যাচ্ছে দু’জন। দুজনের হাতেই প্যাকেট। সেতু বারবার ছাতাটা বাবার মাথার উপরে নিচ্ছে আর বাবা সেটা সেতুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। হামিদের হঠাৎ মনে হলে শ্বশুর- বউমার এতো সুন্দর মুহূর্ত সে কখনো দেখেইনি।

পরের দিনও অফিস বন্ধ ছিল পূজা উপলক্ষে। সকালে হাবিব এসে হামিদকে বলে গেল রেডি হতে। সে নাকি তার ফটোগ্রাফার বন্ধুকে দিয়ে তাদের কাপল ফটো তুলবে কাছের পার্কেই। সেতু এসে বললো, ” মেজো ভাইয়া নাকি তার বন্ধুকে বলে ফেলেছে আসতে। বলেছি কাপল ফটো তোলার দরকার নেই, যাবো না। ভাইয়া শুনছে না।”

সেতুর ভাবসাব দেখে মনে হলে সে যেতে চায়ছে না। হামিদ বললে, ” বলে যখন ফেলেছে তাহলে চলো। আমরা না গেলে হাবিব আবার বন্ধুর কাছে ছোট হবে।”

” হ্যা। মেজো ভাইয়াও সেটা বলছে। আচ্ছা আপনি রেডি হয়ে নিন।” বলে বাবুর জামাকাপড় বের করলো সেতু। হামিদ আলমারি খুলে সামনে রাখা পাঞ্জাবিটা হাতে নিয়ে দেখলো। এই কাপল সেটটা সেতু অনলাইন থেকে কিনেছে বাবুর জন্য সহ। রিমার বিয়েতে যাওয়ার সময় সেতু তাদের সাথে মিলিয়ে এটা পরতে বলেছিল হামিদকে। হামিদ সেটা না পরে অন্যটা পরে গিয়েছিল। আজ হাতের কাছে পেয়ে সেটাই পরে আগে রেডি হয়ে গেল। সেতু পরেছে অন্য শাড়ি। এর মাঝে আদিবা এসে কাপল সেটটা পরতে বললে সেতু বললো, ” এসব কাপল সেট ভালো লাগে না। এটাই ঠিক আছে। ”

হামিদ আড়চোখে সেতুর দিকে তাকালো। একই কথাটাই হামিদ সেদিন সেতুকে বলেছিল। এতোক্ষণ সেও ভেবেছিল সেতু তার সাথে মিলিয়ে পরবে।
ছবি তুলতে গিয়ে হামিদ অপমানিত বোধ করলো। সেতু কাপল ফটো নয় শুধু নিজের ফটোই তুলতে গেছে। বন্ধুটা যখন একসাথে দাঁড়াতে বললো তখন সেতু জবাব দিলো, ” উনি এভাবে ছবি তুলতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে না ভাইয়া। আপনি সিঙ্গেল ছবি নিন। ”
হামিদ যে ভেতরে ভেতরে রেগে আছে সেটা বুঝলেও পাত্তা দিলো না সে। তিনজনের একসাথে মাত্র দুই নাকি তিনটা ছবি তুলেছে। বাকিসব মা-ছেলের ছবি। ছবি তোলা শেষে হাবিব জিজ্ঞেস করলো, ” ভাইয়া, তোমরা কি কিছুক্ষণ থাকবে নাকি চলে যাবে? আমি রিকশা ডেকে দেবো? ”

হামিদ হ্যা বলতেই সেতু পাশ থেকে না না করে উঠলো। বললো, ” শাড়ি পরে রায়ানকে নিয়ে আমার সমস্যা হবে রিকশায় চড়তে।”

” এসময় সিএনজি পেতে সমস্যা হবে ভাবী। রিকশা এখান থেকেই নেওয়া যাবে।”

হামিদ বললো সে রায়নকে কোলে নেবে তাও সেতু গোঁ ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। সিএনজি এলেই যাবে সে। হামিদ সেতুর কাহিনি কিছুই বুঝলো না। মেয়েটা এমন ক্ষণে ক্ষণে পালটে যাচ্ছে কেন?

রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখনই সেতুর ফোনে কল এলো। সেতু তখন ওয়াশরুমে ছিলো। অনবরত রিং হওয়ায় হামিদ বিছানা থেকে উঠে দেখলো সবুজ নামে কেউ। ততক্ষণে কল কেটে গেছে। হামিদ বেশ অবাক হলো। সেতুর ফোনে পাসওয়ার্ড দেওয়া। বিয়ের তিন বছর পর হঠাৎ কী মনে করে পাসওয়ার্ড দিলো! সেতু ওয়াশরুম থেকে আসলে হামিদ জিজ্ঞেস করলো, ” সবুজ কে? এতো রাতে কল করেছে দেখি।”

সেতু তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে এসে ফোনটা নিলো। নিয়ে জবাব দিলো, ” সবুজ ভাই আর কী। চেনেন না? ওই যে আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতো। দীনা আপুর বন্ধু। ”

হামিদ বেশ ভালো করেই চিনেছে সবুজকে। মামাতো বোন দীনার বন্ধু হওয়ার সুবাদেই সেতুর সাথে হামিদের পরিচয়টা হয়েছিল।

“ও তোমাকে এতো রাতে ফোন করছে কেন? আর ওর সাথে তোমার যোগাযোগ হলোই বা কখন? ”

” আপনাকে আগে বলেছি না সবুজ ভাই ছোট থেকে আমাকে খুব হেল্প করতো! সবুজ ভাইয়ের পরামর্শেই তো পেইজটা খুলেছিলাম। এখন আবার পেইজটা রান করায় উনার সাথে যোগাযোগ করেছি।”

” তাই বলে বিবাহিত মেয়েকে এতো রাতে ফোন করবে?” হামিদ রেগে গেল।

” ও মা আপনার কলিগ সায়মা অফিসের কাজে রাত-বিরেতে এক বাচ্চার বাপ আপনাকে ফোন করতে পারে আর আমার কাজে সবুজ ভাই ফোন করতে পারবে না?”

কথাটা বলে সেতু ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। সেতুর কথায় পেছনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো হামিদ। সবুজের সাথে বিজনেসের বাইরেও অনেক কথা হলো৷ সেতু ইচ্ছে করেই কথা বাড়াচ্ছে। কথার মাঝে সবুজ নিজ থেকে সেতুকে যে প্রপোজ করেছিল সেই দিনটার কথা তুললো। পুরনো অনুভূতিগুলো আবারও শেয়ার করছে। এই প্রসঙ্গটা আসায় সেতু বিব্রতবোধ করলো।

” সেতু, হামিদ ভাই কী জেগে আছে নাকি ঘুমিয়ে পড়েছে?

” না। জেগে আছে।”

” আমাদের কথাগুলো শুনছে?”

“না।”

” আচ্ছা সেদিন তুমি কী যেন বলছিলে হামিদ ভাইকে নিয়ে! ”

” তেমন কিছু না ভাইয়া। আসলে…” সেতু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। অপর পাশে সবুজের ফোনে আরেকটা কল আসায় সেতু বললো, ” কল করছে বোধহয় আপনাকে কেউ।”

” হ্যা। দীনা করছে। সমস্যা নেই তুমি বলো।”

” অহ্ আচ্ছা। তাহলে রাখি ভাইয়া।” সেতু কল কেটে দেওয়ার আগে সবুজ বললো, ” তোমার সাথে কাল দেখা করা যাবে? ”

” সম্ভব হলে আপনাকে বলবো আমি। ”

কথা শেষে সেতু অনেকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাটালো। রায়ানের কান্নার আওয়াজ শুনে রুমে এসে দেখলো হামিদ বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ নড়ছে। সে যে জেগে আছে বেশ বুঝতে পারছে। অনেকক্ষণ পর হামিদ জানালো তার মাথা ব্যথা করছে। সেতু বললো, ” ড্রয়ারে ওষুধ আছে। একটু নিয়ে খেয়ে নিন। বাবুর জন্য উঠতে পারছি না আমি। ”

হামিদ না উঠে লম্বা হয়ে শুয়ে রইলো।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে