শেষ পর্বের শুরু পর্ব – ৬

0
606

গল্প: শেষ পর্বের শুরু (ষষ্ঠ পর্ব)
__ ✍️ নীলিমা নওরীন মেঘলা

আজকের দিনটাই খারাপ। সকাল থেকেই টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। বাইরে বের হওয়ার উপায় নেই। এখন দিনকাল পাল্টেছে। আগে কখনো শীতকালে বৃষ্টি হতে দেখিনি, কিন্তু এখন হচ্ছে।

একপ্রকার মন খারাপ নিয়েই বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে আছি। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কাল রাতেও ভালো ঘুম হয়নি। বলতে গেলে প্রায় সারারাতই জেগে থেকেছি। তবে ইমলির জ্বালাতনের জন্য না। সারাদিন ঘুমানোর ফলে আর ঘুম আসেনি।
শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়েছি আর হামিদ সাহেবের নাক ডাকা উপভোগ করেছি। ইমলির জন্যেও অপেক্ষা করেছি। কিন্তু ইমলির কোনো দেখা মেলেনি৷
.

প্রায় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হাশমত ব্যাপারি ঘরে ঢুকলেন, হাতে কুল বরইয়ের পলিথিন সমেত। আমাকে দেখেই হাসতে হাসতে বললেন, ‘এক্কেবারে গাছের দেশি কুল। খাইয়া দেখেন, মজা পাইবেন।’

আমি সৌজন্যতা দেখিয়ে বললাম, ‘এত কষ্টের কী দরকার ছিল? শুধু শুধু বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ভরদুপুরে আসলেন।’

আমার কথা শুনে উনি আবারও হাসলেন। জবাব দিলেন, ‘এ আর এমন কষ্টের কী হইলো? বৃষ্টির দিন, বেচাকেনাও চলে না; তাই তোমার সাথে গল্প করতে আইলাম। তা হামিদ সাহেব কই? ওনারে তো দেখতে পাইতেছি না।’

‘উনি রান্নাঘরে। খিচুড়ি রান্না করছেন।’

‘খিচুড়ি? বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি একদম অমৃতের মতো স্বাদ। তাই না সাব?’

আমি বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললাম, ‘আপনি কখনো অমৃত খেয়েছেন?’

‘কী যে কন সাব। অমৃত কি খাওন যায়?’

‘মাত্রই বললেন যে।’

‘ওইটা তো কথার কথা।’

চোখাচোখি হতেই ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করে হাসার চেষ্টা করলাম। মুখে একটা কুল পুরে নিতে নিতে বললাম, ‘তারপর বলুন, দিনকাল কেমন যাচ্ছে আপনার?’

‘আমার দিনকাল তো ভালোই যায়। কিন্তু আপনার দিনকাল ভালো যাইতেছে না। রাতে নিশ্চয়ই ঘুমান না।’
বেশ রহস্য করেই কথাগুলো বললেন।

বেশ অবাক হলাম। ভ্রুকুটি নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার দিনকাল কেন ভালো যাবে না? আর রাতে ঘুমাইনি সেটা কীভাবে বুঝলেন?’

‘কাল কইলাম না, আমি আগে থেইকা সব বুঝতে পারি। তারপর বলেন আপনার ইনভেস্টিগেশন কতদূর?’

‘ইনভেস্টিগেশন? কিসের ইনভেস্টিগেশন?’

‘আমার সাথে চালাকি কইরা লাভ নাই সাব। আমি সবই জানি। আপনি তো হামিদ সাহেবের মাইয়ার তদন্ত করতেই এইখানে আসছেন। চাইলে আমি কিন্তু আপনারে সাহায্য করতে পারি।’

হাশমত ব্যাপারির শেষ কথায় আমি কিছুটা আশ্বাস পেলাম। সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সাহায্য? কেমন সাহায্য?’

এবার আগের থেকেও গলা নামিয়ে মিনমিনে গলায় বললেন, ‘আমি যা জানি, তা কইলে আপনি একদম চমকাইয়া যাইবেন। আসলে ইমলির চরিত্র তো বেশি ভালা ছিল না। প্রেম পিরিতি কইরা বেরাইতো। এইটা গ্রামাঞ্চল। বোঝেনই তো গ্রামে এইসব কথা কেমন দ্রুত ছড়ায়। অথচ হামিদ সাহেব কথাটা নির্ঘাত চাইপা গেছেন আপনার কাছে।’

লোকটাকে কিছুটা সন্দেহ হচ্ছে। আবার মনে হচ্ছে ঠিকও বলতে পারেন। কোনো বাবাই নিজের মেয়ের কুৎসা অন্যের কাছে করতে যাবেন না।

আমি চোখেমুখে কৌতুহল নিয়ে বললাম, ‘সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু এর সাথে মৃত্যুর কী যোগ?’

হাশমত ব্যাপারি একদম কানের কাছে মুখ নিয়ে আসলেন। ফিসফিস করে বললেন, ‘যোগ তো একটা আছেই সাব। শুনছিলাম ওই ইমলি নাকি পোয়াতি হইছিল। বিয়ার আগে পোয়াতি হওয়া, ব্যাপারটা বুঝছেন তো এইবার?’

শেষ কথাগুলো শুনে আমি পুরোপুরি চমকে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর?’

‘তারপর আর কী…ওই ছেলে নাকি অস্বীকার করছিল। লোক জানাজানির ভয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়া মরছে। পুলিশি কেস তো হয় নাই যে কেউ জানতে পারবো।’

হামিদ সাহেবের কথার সাথে কোনো কথাই মিলছে না। কাকে বিশ্বাস করবো ঠিক বুঝতে পারছি না।

আমি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় হামিদ সাহেব ঘরে ঢুকলেন। সবাইকে খাওয়ার জন্য তাড়া দিতে লাগলেন।
হাশমত ব্যাপারিও আমাদের সাথে খাওয়া পর্বে যোগ দিলেন।

আজকের খিচুড়িটা গত দিনের থেকেও দারুণ হয়েছে। তবে আমার কেন জানি ভালো লাগছে না খেতে। বারবার গলায় আটকে যাচ্ছে। হামিদ সাহেবের উপর ভীষণ মাত্রায় রাগ হচ্ছে। মানুষটা কি সত্যিই এসব জানেন না, নাকি সব জেনেশুনেই আমায় হয়রান করছেন?

খাবার বারবার গলায় আটকে যাওয়া দেখে পাশে থেকে হাশমত ব্যাপারি বলে উঠলেন, ‘খাওনের সময় এত চিন্তা করলে কি হয় নাকি? চিন্তাভাবনা বাদ দিয়া খাওনে মন দেন সাব।’

আমি আর কিছু বললাম না। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে বিছানায় গা এলিয়ে পড়ে রইলাম। হামিদ সাহেবও নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। হাশমত ব্যাপারি যাওয়ার আগে হুঁশিয়ারি করে বলে গেলেন, ‘ভুলেও এই কথাগুলো আবার কারো কাছে করতে যাইয়েন না। বিপদে পইড়া যাইবেন। যা সাহায্য লাগে আমি করমু। শুধু একবার ডাক দিলেই হইবো।’

‘বিপদে কেন পড়বো?’ প্রশ্নটা করতে গিয়েও করলাম না। শুধু সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালাম। উনি চলে গেলেন।
.

বিকাল চারটা নাগাদ বৃষ্টি পড়া বন্ধ হলো। আমিও কালক্ষেপণ না করে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কতক্ষণ এভাবে শুয়ে বসে কাটানো যায়!

আজও নদীর পাড়ে এসে বসলাম কিছুক্ষণ। তবে হামিদ সাহেব সাথে নেই। আসার সময় সারা বাড়ি খুঁজেও কোথাও পেলাম না। লোকটা থেকে থেকে কোথায় উধাও হয়ে যান কে জানে। এখানে আসার পর থেকেই কেমন পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি ওনার মধ্যে। সুযোগ বুঝে পুরোটা জেনে নিতে হবে।

নদীর পাড়ে হাঁটার সময় অদ্ভুত একটা জিনিস খেয়াল করলাম। এই পাড়টা বেশিরভাগ সময়ই নিস্তব্ধ থাকে। দিনের বিশেষ কিছু সময় ছাড়া লোকজনের আনাগোনা তেমন একটা লক্ষ্য করা যায় না।

হামিদ সাহেবের কাছে শুনেছি, এই নদীটা একসময় পানিতে টইটম্বুর থাকতো। এখন অবশ্য কিছুটা মৃতপ্রায়। তবে ছোট ছোট নৌকাগুলো এখনো সারাবছর চলাচল করে।

নদীর পানি একদম স্বচ্ছ পরিষ্কার। তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে। উপর থেকে দেখলে মনে হয় একহাত নিচেই বালি চিকচিক করছে। কিন্তু হাত দিলে বোঝা যায় গভীরতা আছে।

নদীর পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পেলাম কিছু একটা পড়ে আছে কিনারায়। দেখে মনে হচ্ছে কোনো বোতল হবে হয়তো। তবে নিত্যদিনের ব্যবহৃত কোনো পুরনো বোতল নয়। ভেতরে কিছু একটা দিয়ে ভর্তি। উপরে সিল করা। এই রকম বোতল কোথায় দেখেছি ঠিক মনে করতে পারলাম না।

সন্ধ্যা প্রায় হতে চলেছে। আমি বোতলটা হাতে নিয়েই বাড়ির পথে রওনা দিলাম। বাড়ি গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখতে হবে পুরোটা। যদি কোনো ক্লু পাওয়া যায়।
.

আজ অমাবস্যা। আকাশ ভরা অন্ধকার খেলা করছে যেন। আমি অনেক খুঁজেও চাঁদের নাগাল পেলাম না। চাঁদটা কোথায় ঘাপটি মেরে আছে কে জানে।
হুট করেই মনে পড়লো আজ তো ইমলির আমাকে সাহায্য করার কথা। এবার ঠিকঠাক ক্লু দেবে তো? নাকি আগের বারের মতোই ফাঁকি দেবে?
এতকাল শুনেছি মানুষ প্রতারণা করে। এখন দেখছি আত্মাও কোনো অংশে কম যায় না। বাবা-মেয়ে মিলে ভালোই নাচাচ্ছে আমাকে।
অবশ্য আগেরবার একটা ভুল করে ফেলেছিলাম। ইমলি বলতে নিষেধ করলেও হামিদ সাহেবকে সবটা বলে দিয়েছিলাম। এবার অবশ্য সেই ভুল আর করছি না।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে