শেষ পরিণতি পর্ব-১৬

0
918

#শেষ_পরিণতি
( সিজন ২ পর্ব ৭)

প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে বাবার হাতে দিলাম।
বাবা প্রেসক্রিপশনে ওই ঔষধের নামটা দেখতে না পেয়ে বললেন,
-প্রেসক্রিপশনের কোথাও তো এ মেডিসিনটার নাম লেখা নেই। তাহলে মেডিসিনটা আসলো কোথা থেকে?
বাবার প্রশ্নের উত্তর আমরা কেউ দিতে পারছিলাম না।
বাবা এবার নার্সের দিকে ফিরে বললেন,
-দেখো মেয়ে, তুমি এ ঔষধের ব্যপারে যা জানো তা সত্যি করে সব বলো।
আমরা যদি তোমার আর ডাক্তারের নামে এখন কেস করি তাহলে তোমাদের সাজা হতে পারে।
ঝুমা এবার ভয়ে কেঁদে দিয়ে বললো,
-বিশ্বাস করেন এই ঔষধের ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। আমাকে নীলিমা ম্যাডাম এ ঔষধ দিয়েছেন এবং মাজেদা ম্যাডামকে খাওয়াতে বলেছেন। ডাক্তারের সাথে প্রায়শই নীলিমা ম্যাডাম কথা বলতেন।আমি তাই নীলিমা ম্যাডামের কথা শুনেছি এবং মাজেদা ম্যাডাম কে এ ঔষধ খাইয়েছি।
ঝুমার কথা শুনে আমরা সবাই নীলিমার দিকে তাকাই,
নীলিমা একটু থতমত খেয়ে বলে,
– ডাক্তার আমাকে এ ঔষদটা দিয়ে বলেছিলেন আন্টিকে যাতে খাওয়াই৷
নীলিমার কথা শুনে বাবা রাগান্বিত কন্ঠে বলেন,
-আমাদের কি বোকা পেয়েছো?
এই মেয়ে সত্যি করে বলোতো তোমার উদ্দেশ্য কি?
তুমি ডাক্তারের সাথে মিলে কোন ষড়যন্ত্র করছ না তো!
বাবার কথাশুনে আমি অবাক হয়ে বলি,
-বাবা আপনি শান্ত হোন। দুশ্চিন্তায় আপনার মাথা ঠিক নেই। তাই আপনি নীলিমাকে শুধু শুধু দোষারোপ করছেন।
বাবা উত্তেজিত কন্ঠে বলেন,
– না বৌমা। আমি মোটেও ভুল বলছি না।
বাবা নীলিমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
আমাদের বোকা পেয়েছো নাকি? সত্য করে বলো এই ঔষধের ঘটনা কি?আমার স্ত্রীর ক্ষতি করে তোমার কি লাভ?
বাবার প্রশ্নের উত্তরে নীলিমা কিছু বলার আগে, আমি বললাম,
-বাবা এবার প্লিজ চুপ করুন।
পুরো বিষয়টায় যদি কারও দোষ থেকে থাকে সেটা ডাক্তারের। সে কেন এমন করলো, এসব করে তার কি লাভ সেটা ডাক্তারই বলতে পারবে।
আপনি শুধু শুধু নীলিমাকে এমন জঘন্য অপবাদ কেন দিচ্ছেন?
আপনি আজ এসেছেন বলেই কিছু না জেনে এমন কথা বলতে পারছেন। আপনি বাদে আমরা সবাই জানি নীলিমা আন্টির আমার অসুস্থতার সময়ে কি কি করেছে!
নার্স থাকা সত্যেও দিনরাত এক করে শ্বাশুড়িমার,আমার সেবা করেছে, বাসার সবার খেয়াল রেখেছে।
বাড়িতে কাজের জন্য আলাদা লোক নেই। নীলিমা নিজের হাতে সব কাজ করেছে।
আপনি সেই মানুষটাকে কিভাবে এসব কথা বলতে পারলেন? বলার আগে কি একবারও ভেবে দেখেননি! এসব করে নীলিমার কি লাভ?
-বৌমা তুমি আমাকে ভুল বুঝছো। তুমি একবার শুধু মন দিয়ে ভাবো…
বাবার কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি বললাম,
-বাবা প্লিজ। আমি এই ব্যাপারে আর কিছু শুনতে চাই না। আপনি নিজেই শ্বাশুড়ি মায়ের শরীরে ভাইরাস পুশ করেছিলেন। এর থেকে জঘন্য অপরাধ আর হয়না। সবাইকে নিজের মত ভাববেন না। নীলিমা আমার বোন। তাকে অপমান করা মানে কি আমাকে অপমান করা নয়?
কথা বলার মাঝে আমার নিজের মা আমাকে ইশারা দিয়ে চুপ করতে বললেন, কিন্তু আমি সেদিকে লক্ষ না করল বললাম,
এখানে আসল দোষী যে ডাক্তার সেটা তো পরিষ্কার। আমাদের উচিৎ, নিজেদের ভেতরে ঝামেলা না করে ডাক্তারের কি করা যায় সেটা নিয়ে ভাবা।
এবার আর বাবা কোনো কথা বাড়ালেন না।
মার দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইলেন।
তারপর নীলিমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললেন,
-ডাক্তার তার কর্মের ফলতো পাবেই, এর শেষটাও আমি দেখে ছাড়বো।
কথাটা বলে বাবা হনহনিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন।
বাবা চলে যাওয়ার পর নীলিমাও মন খারাপ করে তার রুমে চলে গেলো।
.
.
.
.
বাবা চলে যাওয়ায় আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। বাবার জন্য কতোকিছু রান্না করেছিলাম আমি।
কিন্তু এই ঝামেলার জন্য বাবা কিছু মুখে না তুলেই চলে গেলেন। কতোদিন পরে এসেছিলেন, আমিও রাগের মাথায় তাকে পুরোনো বিষয় নিয়ে খোটা দিয়ে ফেলেছি। আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেলো।
আমি মার হাত ধরে বললাম,
-বাবাকে ওভাবে বলাটা ঠিক হয়নি তাই না মা?
কিন্তু কি করবো বলো, নীলিমাকে শুধু শুধু দোষারোপ করাতে আমি কথাগুলো না বলে থাকতেও পারছিলাম না।
তবে যাইহোক। তিনি আমার শ্বশুর । তাকে কিছু বলার আগে ভেবে বলা উচিৎ ছিলো।
আমার কথার প্রতিত্তোরে মা বললেন,
-যেটা করেছিস সেটাতো করেই ফেলেছিস। এখন কি সেই বিষয় নিয়ে কথা বললে ভুলটা শুধরে যাবে?
আজতো ওই মেয়ের জন্য তোর শ্বশুরের সাথে সাথে আমাকেও অপমান করলি।
কথাগুলো বলে মা উঠে চলে গেলেন।
আমি বুঝতে পারলাম মাও আমার উপর ভীষণ রাগ করেছেন।
মনটা আরও খারাপ হয়ে গেলো। নিজেকে কেমন যেন অপরাধী অপরাধী লাগছে।
পরমুহূর্তে আবার ভাবলাম,
ওভাবে বলা হয়তো আমার উচিৎ হয়নি, কিন্তু কোনো অন্যায় তো আমি করিনি।
কাউকে মিথ্যা দোষারোপে দোষী হতে দেখেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা কোনো ভালো কাজ হতো বলে করি না।
.
.
.
.
নীলিমা দৌড়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। রাজনের বাবার দৃষ্টিতে সে তীব্র রাগ দেখতে পেয়েছে।
নীলিমা এটা নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, বিষয়টা অতো সহজে তিনি ছেড়ে দেবেন না। ডাক্তারকে তিনি ধরেই ছাড়বেন। আর যদি ডাক্তার ধরা পরে তাহলে নীলিমার সবকিছুর সমাপ্তি।
তাই নীলিমা দেরি না করে দ্রুত ডাক্তারকে কল দেয়।
ঔষধ নিয়ে যা যা হয়েছে সবকিছু ডাক্তারকে খুলে বলে।
রাজনের বাবা “সাইফ আহমেদ ” সব জানতে পেরেছে বলে ডাক্তারকে সতর্ক করে দেয়।
.
.
.
.
নীলিমার উপর রাগ ও অপমানবোধ নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে সাইফ সাহেব চলে যান
হসপিটালের দিকে।
যতদ্রুত সম্ভব ডাক্তারের সাথে কথা বলতে হবে।
মাজেদা বেগমের সাথে এমন করে ডাক্তারের কোনো লাভ আছে বলে তো মনে হয় না সাইফ আহমেদের।
তাহলে কার কথায় ডাক্তার এমন করলো সেটা তার জানতেই হবে।
তিনি দ্রুত গাড়ি চালিয়ে হসপিটালে গেলেন।
রিসিপশনে গিয়ে ডাক্তারের নাম বলতেই একজন ডাক্তারের চেম্বার নং বলে দিলেন।
সাইফ সাহেব দ্রুতপায়ে ডাক্তারের চেম্বারের সামনে গিয়ে খুবই হতাশ হন।
তিনি দেখেন ডাক্তারের চেম্বার বন্ধ রয়েছে।
হসপিটালের স্টাফের কাছে চেম্বার বন্ধ থাকার কারণ জিজ্ঞেস করাতে তারা বলে,
-সকাল থেকে তিনি চেম্বারেই ছিলেন।
জরুরি কোনো কাজে তিনি কিছুক্ষণ আগেই ছুটি নিয়ে চলে গেছেন।
কখন আসতে পারে জিজ্ঞেস করলে তারা বলে,
“এ ব্যাপারে তাদের কিছুই জানা নেই। ”
স্টাফদের কথা শুনে সাইফ আশাহত হন।
তিনি বুঝতে পারেন হসপিটালে থেকে সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না এখন। তিনি নিশ্চিত ডাক্তার এখন আর হসপিটালে আসবেন না।
অগত্যা তিনি হসপিটাল থেকে বের হয়ে সোজা থানায় চলে যান।
থানায় গিয়ে ডাক্তারের নামে মামলা করে রাখেন।
.
.
.
.
নিত্যদিনের মতো আজও গভীর রাতে রাজন ও নীলিমা গভীর রাতে একত্রিত হয়।
কিন্তু রাজনের মুখটা আজ গম্ভীর।
নীলিমা রাজনের মন খারাপ বুঝতে পেরে, রাজনকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-আজ আমার বাবুটার মন খারাপ কেন? আজ কি সে আমাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দেবে না?
নীলিমার হাত ছাড়িয়ে রাজন গম্ভীর কন্ঠে বলে,
-নীলিমা আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করবো, আশা করি সত্যিটাই আমাকে বলবা।
নীলিমা বিস্ময় নিয়ে বলে,
-তুমি আবার কি প্রশ্ন করবে?
-সকালের বিষয়টা আমার কাছে কেমন যেন ঘোলাটে লাগছে। তুমি সত্যি করে বলো তো নীলিমা।
তুমি ওই ঔষধ সম্পর্কে কি কি জানতে?
আর বাবার কথাতেও যুক্তি আছে, ডাক্তার এমন ভয়ানক ঔষধটা তোমার হাতেই কেন দেবে?
রাজনের প্রশ্ন শুনে নীলিমা ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠলো।
উপরে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে, কপাল থেকে বেরিয়ে আসা ঘামের ফোঁটা মুছে বললো,
-তুমিও আমাকে সন্দেহ করছো রাজন?
আমি ভাবতেও পারিনি তুমি আমাকে এমন প্রশ্ন করতে পারো।
রাজন বললো,
-সন্দেহের কোনো কথা নয় নীলিমা। বিষয়টা আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। উত্তরটা তোমার জানা থাকলে বলো আমাকে। আমি একটু নিশ্চিন্ত হই।
রাজনের কথায় নীলিমা একটু রেগে গিয়ে জোরে বলে উঠলো,
-তোমাকে আমি ভালোবাসি বলে যা ইচ্ছে বলতে পারো না রাজন।
তোমার বাবার মতো তুমিও নিচ মন মানসিকতার পরিচয় দিলে।
-তুমি এতো হাইপার হচ্ছো কেন নীলিমা? আমি নরমালি প্রশ্নগুলো করেছি তুমি নরমালি উত্তরটাও দিলে পারতে। তা না করে এতো প্যাঁচানোর কোনো মানে তো হয় না।
নীলিমা বুঝতে পারলো রাজন বিষয়টা নিয়ে খুব সিরিয়াস। তাই ব্যাপারটা সামলাতে হলে তার এখন অভিনয়ের আশ্রয় নিতেই হবে।
ভাবনা অনুযায়ী নীলিমা অভিনয় করে কাঁদতে কাঁদতে বললো ,
-আন্টিকে আমি আমার মার মতো দেখি। শুধু আন্টি নয় এ বাড়ির সবাইকে আপন মনে করে দিনরাত সবার জন্য খেটে যাই। তবুও দিনশেষে আমার নাম নেই।
কিছু হলে এই মানুষগুলোই আমার দোষ দেয়।
-নীলিমা আমি তোমাকে দোষ দিচ্ছি না। আমি শুধু তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি। এখানে সবার জন্য খাটার কথা কেন আসছে?
এভাবেই দু’জনের কথা কাটাকাটি এক সময় ছোটখাটো ঝগড়ার রুপ নেয়।
.
.
.
মধরাতে পানির পিপাসায় আমার ঘুম ভেঙে যায়।
পানি খাওয়ার জন্য খাট থেকে নামতেই কিছু শব্দ ভেসে আসে আমার কানে।
আমি শব্দের উৎস খুঁজতে রুমের বাইরে বেরিয়ে আসি।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে একটু লক্ষ করাতেই, নীলিমা আর রাজনের কন্ঠ আমার কানে ভেসে আসে। বুঝতে পারি শব্দটা নীলিমার রুম থেকে আসছে।
ওদের মাঝে কিছু নিয়ে তর্কাতর্কি হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। তবে আশ্চর্য হই এটা ভেবে যে, এতো রাতে নীলিমার রুমে রাজন কি করছে!
আর কি নিয়েই বা ওদের মাঝে তর্কাতর্কি হচ্ছে।
বিষয়টা বুঝতে হলে আরও খুঁটিয়ে দেখতে হবে।আমি ধীর পায়ে ওদের রুমের দিকে এগিয়ে যাই
** চলবে…

– Tuba Binte Rauf

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে