#শূণ্যতায় পূর্ণতা
#নুরুন্নাহার তিথি
#পর্ব-২
বিভানের বড় ভাই ইভানের স্ত্রী রিমু সকাল সকাল তার শাশুড়ির জন্য আদা, লেবু দিয়ে চা করে এনে বলছে,
–দেখেছেন মা, আপনি আপনার ছোট ছেলের বউয়ের উপর ভরসা করে বসে আছেন! আপনি কি করে মানলেন যে সে নিজের জন্য সতীন খুঁজবে! অদ্রিকে মেয়ে খুঁজতে না দিয়ে যদি আমরা খুঁজতাম তবে ভালো মেয়ে অহরহ পেতাম। এই মেয়ে কখনো নিজের স্বামীর ভালো চাইবে না।
বিভানের মা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে শুনছে সবটাই। সে জানে তার বড় ছেলের বউ এখনো নিজের ছোট বোনকে বিভানের বউ করার ইচ্ছা পোষন করে। তবে রিমুর ছোট বোন শিমুর চাল-চলন বিভানের মায়ের পছন্দ না।
শাশুড়িকে মৌন থাকতে দেখে রিমু একটু ন্যাকা কান্না করে বলে,
–নিজের তিন তিনটা বাচ্চা নষ্ট হলো অদ্রির। শেষবারের তো ঢাকার বেষ্ট গাইনোকোলজিস্টের কাছে নিয়ে গেলো বিভান আর সেই বললো, বাচ্চা ওষুধের মাধ্যমে নষ্ট হয়েছে। আমার কি মনে হয় জানেন মা! অদ্রির তো খুব শখ বিদেশে থেকে ডিগ্রি নিবে। সেইজন্যই মনে হয় বাচ্চা নষ্ট করেছে। নাহলে বলেন, বিভান এতো শান্ত ভাবে মেনে নিলো! অদ্রি প্রতিবার প্রেগনেন্ট হবার পর তো বিভানকে খুশিতে কাঁদতে পর্যন্ত দেখেছি আর সেই বিভান অদ্রিকে কিচ্ছুটি বললো না!
বিভানের মায়ের ভ্রুঁ কুঁচকে আসছে। এর আগেও রিমু তাকে ইনিয়েবিনিয়ে এসব বলেছিল দুইবার। তবে উনি বুঝেন না, একটা মা কেনো নিজের সন্তানকে নষ্ট করতে চাবে?
রিমুর কথাগুলো অদ্রি দরজার বাহির থেকে শুনছিল। অদ্রিও তার শাশুড়িকে চা দিতে এসেছিল। তারপর সে মুচকি হেসে ভিতরে ঢুকে শাশুড়ির জন্য আনা চা টা বড় জা এর দিকে দিয়ে বলে,
–আমার স্বামীকে নিয়ে আপনি একটু বেশিই ভাবেন ভাবী!
রিমু বিরক্তি নিয়ে কপাল কুঁচকে তাকায়। অদ্রি তা দেখে আবারো মুচকি হেসে বলে,
–আপনার অবান্তর ধারনা থেকে বেরিয়ে আসেন। যদি পারেন! আই উইল নট ফোর্স ইউ। একজন মা সুস্থ অবস্থায় কেনো! অসুস্থ অবস্থায় হলেও নিজের বৈধ সন্তানকে নষ্ট করা বা মে/রে ফেলবে না। আর আমার যদি নষ্ট করারই থাকতো তবে আমি কেনো পরপর তিনবার কনসিভ করবো? প্রথমবারের মিসক্যারেজের কাহিনী জানিনা তবে দ্বিতীয়বার সিঁড়ি থেকে পা পিছলে পড়ে গেলাম। আর তৃতীয়বারেরটাও অজানা। কে বা কারা আমাকে ইনটক্সিসাইট করেছে তা আমি ক্লিয়ার না।
রিমু হঠাৎ অদ্রির মুখে শেষোক্ত কথাটা শুনে ঘাবড়ে যায়।তার মনে ভয় কাজ করছে। অদ্রি রিমুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে মুখের অবস্থা রক্তশূন্য। অদ্রি বাঁকা হাসে। তার ধারনা যদি সত্যি হয় তবে খেলা জমে যাবে। অদ্রি তার শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
–মা আপনি বিভানের বিয়ে দিতে চান তাই আমি একটা মেয়ে খুঁজেছি। পর্দানশীল। সামনের শুক্রবার দেখে আসতে পারেন। আমি তো পারলাম না আপনার ছেলেকে সন্তান সুখ দিতে! এটা জন্যই তো নতুন বউ আনতে চাচ্ছেন। তৃতীয়বার মিসক্যারেজের পর ডাক্তার বলেছে প্রেগনেন্সি রিস্কি কিন্তু অসম্ভব না। আপনার ছেলে সেই রিস্কটাই নিতে চায় না। এজন্য তার সুখের জন্য নাহয় নিজের মানসিক প্রশান্তি বিসর্জন দিলাম!
অদ্রি শাশুড়ির রুম থেকে বেরিয়ে যায়। তারপর ছাদে যায়। ভোর ৭টা বাজবে এখনি। সকাল ৮.৩০ তে তাকে অফিসে প্রেজেন্ট থাকতে হবে। স্বভাবের তাড়নায় সে আজও তার শাশুড়িকে চা বানিয়ে দিতে গেছিলো। প্রতিদিন অদ্রিই দেয়। তবে মাঝে মাঝে রিমু দেয়। রিমুর বলা কথা গুলো আবারো ভেবে হেসে উঠে অদ্রি।
বসন্তের সকাল। শীতকালের মতো অতো শীত নেই আর নেই কুয়াশার আচ্ছাদিত চাদর! মাঝে মাঝে কোকিলের ডাক ও ফুলের সুভাস জানান দেয় আজ বসন্ত।
অদ্রি আপন মনে বিড়বিড় করে আউরায়,
–এতোদিন ফাঁকা মাঠে গোল দিয়েছেন কিন্তু এবার মাঠের অপরপাশে অদৃশ্য প্রতিদন্ধি। মন তো চাইছে, আমার যা ক্ষতি করেছেন তার পাই টু পাই হিসেব নিতে। কিন্তু আমার স্বভাব যে খারাপ! ছটফট করাবো বাজে ভাবে যাতে নিজেকে ঘৃণা করতে বাধ্য হন। যেটুকু করেছেন সেটুকু করতেও চাইনা কারন আমি মানুষ। কোনো খু/নি না। তবে শা/স্তির সংজ্ঞা আমার ডিকশনারিতে সবটা মানসিক!
অদ্রি আর মিনিট পাঁচেক ছাদে থেকে নিজের রুমে চলে যায়। বিভান নামাজ পড়ে এসেছে মসজিদ থেকে। নামাজের পর একটু হাঁটাচলা করে সে। অদ্রিকে রুমে ঢুকতে দেখে বিভান জিজ্ঞেস করে,
–কোথায় ছিলে তুমি? মায়ের রুমে তো মা একা একা কোরআন পড়ছে।
অদ্রি বলে,
–ছাদে ছিলাম।
বিভান অদ্রির নির্লিপ্ত জবাবে আর কিছু বলেনা। অদ্রি অফিসের জন্য রেডি হয় বিভানের সাথে চলে যায়। আজ একটু জলদি রওনা হয়। অফিস বেশি দূরে না। ৫০-৬০ মিনিট লাগে সর্বোচ্চ। আজকে রিমুকে জাগ্রত দেখে সকালের নাস্তা বানায়নি ইচ্ছে করেই। বিভান ও অদ্রি বাহিরে খেয়ে নিবে।
অদ্রি ও বিভান দুজনেই ফার্মাসি নিয়ে পড়েছে। বিভান একটা ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করে। সকাল সকাল ইউনিভার্সিটির ল্যাবে কাজ আছে বলে যেতে হয়। ভার্সিটি লাইফ থেকে পরিচয় বিভান ও অদ্রির। অদ্রি যখন অনার্স ফাস্ট ইয়ার তখন বিভান মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে। বিভান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে জার্মান চলে যায় হায়ার স্টাডিজের জন্য। সেখানে ৫ বছরের পিএইচডির জন্য এপ্লাই করেছিল সে। পিএইচডির ৩ বছরের মাথায় বিভান তার প্রিয় স্যার মিস্টার রাসিফ আলীর থেকে অনুরোধ করে ১মাসের ছুটিতে দেশে এসে অদ্রিকে বিয়ে করেছিল। রাসিফ আলী বিভান ও অদ্রির সবটাই জানতো। তিনি বিভানকে যেমন স্নেহ করে তেমনি অদ্রিকেও বিভানের সুবাদে অনেকটা স্নেহ করে। বিভান বিয়ে করে আবার চলে যায়। তারপর আবারো এক বছরের মাথায় দেশে আসে শীতকালিন কিছু ছুটিতে। একমাস থেকে চলে যায়। বিভান যাওয়ার পর অদ্রি প্রেগনেন্ট হয়। ভিনদেশে বসে বিভান যখন এই খুশির খবরটা শুনে তখন সে প্রায় অনেকক্ষণ বাকরুদ্ধ ছিলো। তারপর প্রথম বাবা হতে যাবে সেই অনুভূতিতে ঘিরে ধরে তার চারিপাশ। অদ্রির সামনে বিভান খুশিতে কান্নাও করেছে আর অদ্রি ফোনের স্ক্রিনে সেটা দেখেই চোখে খুশির জলে পরিপূর্ণ করে ঠোঁটের কোনে স্নিগ্ধ হাসি হেসেছে।
কিন্তু নিয়তির খেলায় প্রেগনেন্সির ১১ সপ্তাহে অদ্রির মিসক্যারেজ হয়ে যায়। অদ্রি সেদিন রাতে খেয়ে ভালো মতোই ঘুমিয়েছিল কিন্তু মধ্যরাতে প্রচন্ড পেট ব্যথাতে চিৎকার করে উঠে। তখন সবার আগে রিমু দৌড়ে আসে অদ্রির রুমে। অদ্রি রুম ভিতর থেকে লক করে রাখতো না প্রেগনেন্ট হবার পর থেকে। শুধু নব ঘুরিয়ে রাখতো। সেই মধ্যরাতেই ইভান, রিমু মিলে নিয়ে যায় অদ্রিকে হসপিটালে। অদ্রির শাশুড়ি রাত করে হসপিটালে যায়নি আর তার ঘুমন্ত নাতি তো আর একা থাকতে পারবে না। তাই সে বাড়িতে থেকে যায়।
হসপিটালে ডাক্তার জানায় মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। কিন্তু কারন জানায় না। অদ্রি ভেঙে পরে সেই মূহুর্তে। রিমু অদ্রিকে শান্তনা দিতে থাকে। মিসক্যারেজের খবরটা রিমুই বিভানকে ফোন করে জানায় ওই মাঝরাতে। ভিনদেশে বসে বিভানের কিছুই করার ছিল না। এখন সে আর ছুটি পাবে না দেশে ফিরতে। অদ্রি বাসায় ফিরে এলে কেউ তাকে খারাপ কথা বলেনি। বিভান মানা করেছিল যাতে অদ্রির সামনে কেউ বাচ্চার কথা না তোলে। কিন্তু রিমু মাঝে মাঝে আফসোসের সুরে তুলতো মিসক্যারেজের ব্যাপারটা। অদ্রির কস্ট হতো কিন্তু তাও বলতো। অদ্রিকে বিভান ফোনের মাধ্যমে যতোটুকু সম্ভব হাসি-খুশি রাখার চেষ্টা করতো। অদ্রিকে মাস্টার্সে ভর্তি হতে বলে। অদ্রি মিসক্যারেজের পর উদাসীন হয়ে চুপচাপ প্রায়। আস্তে আস্তে পড়াশোনার ফ্লো তে নিজেকে মানিয়ে নেয়।
এভাবেই চলে যায় এক বছর। বিভান দেশে ফিরে আসে। অদ্রিরও তখন মাস্টার্সের আর একটা সেমিস্টার বাকি। বিভান ফিরে আসার পর থেকে রিমুর ছোট বোন শিমুও এখানে বেরাতে আসে বেশি বেশি। এর মধ্যে অদ্রির মাস্টার্স শেষ হলে আবার কনসিভ করে। অদ্রির জব করার ইচ্ছে আর বিভান ও তার মাও সেটা সাপোর্ট করে। বেবি হবার পরেই অদ্রি জবে জয়েন করবে। এমনিতে ওর রেজাল্ট ভালো।
হঠাৎ এক বিকেলে বিভানকে বাসায় ফিরতে দেখে অদ্রি ছাদ থেকে নামতে নিলে সিঁড়িতে তৈলাক্ত কিছুতে পিছলিয়ে পরে যায়। তৎক্ষণাৎ চিৎকার করে উঠে। এবারো রিমু ও শিমু জলদি আসে। বিভান বাড়িতে ঢুকার সময় অদ্রির চিৎকারে দৌড়ে সেখানে গিয়ে দেখে অদ্রির শরীরের নিম্নাংশ থেকে র/ক্তের স্রোত বইছে। ছাদের সিঁড়ি গড়িয়ে সে নিচে পড়েছে। একদম উপরের সিঁড়ি থেকে। বিভান সেই অবস্থায় অদ্রিকে কোলে তুলে নিয়ে হসপিটালে যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ,