শূণ্যতায় পূর্ণতা পর্ব -০১

0
3170

#শূণ্যতায় পূর্ণতা
#নুরুন্নাহার তিথি
#সূচনা_পর্ব

–সত্যি করো বলতো অদ্রি! তুই কি সত্যি নিজের স্বামীকে আবার বিয়ে দিবি? বিভান ভাই তোকে অনেকটা ভালোবাসে যা তোরো জানা আর কাল উনার করুন কন্ঠস্বরে বুঝেছিলাম উনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে চান না।

–জানিনা!

রিহার কথার প্রতিউত্তর করে খানিকটা উচ্চস্বরে হেসে উঠে অদ্রি। খোলা মাঠের চারদিকে কেউ নেই। ঢাকার অদূরে এক খোলা মাঠে রিহা অদ্রিকে নিয়ে এসেছে। অদ্রিকে হাসতে দেখে রিহা হতবাক হয়ে বলে,

–পাগলের মতো হাসিস না। হেয়ালি না করে জবাব দে কথার। তুই নিজে কি করে তোর স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছিস? তুই তো বিভান ভাইকে অনেক ভালোবাসিস। আমার কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না। তোর ব্যাবহার সব দেখে মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে।

হাসি থামায় অদ্রি। ছলছল করে উঠে ওর নয়ন যুগল। তারপর হঠাৎ চিৎকার করে কান্না করে ভূমিতে হাঁটু গেড়ে বসে পরে সে। রিহা স্তব্ধ হয়ে গেছে। মাত্রই তো পাগলের মতো হাসছিল! এখন আবার পাগলের মতো আর্তনাদ করে কান্না করছে! সবটাই মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। রিহা অদ্রির পাশে বসে অদ্রিকে ভরসার আলিঙ্গনে আগলে নেয়।

আকাশে মেঘ করেছে। শরৎের আকাশে তুলোর মতো সাদা মেঘ থাকে কিন্তু এখন কৃষ্ণ মেঘের ঘনঘটা পুরো অন্তরীক্ষ জুড়ে। হুট করে আকাশের মন খারাপ হওয়ার কারনটা বোধগম্য হলো না রিহার। প্রকৃতির খেল বোঝা বড় মুশকিল। এই পরিষ্কার তো এই অন্ধকার! রহস্যময়তা যেনো প্রকৃতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
অদ্রিকেও এই প্রকৃতির মতো রহস্যময় লাগে রিহার কাছে। ওর কোনো কাজের হিনটস কেউ পায় না যতক্ষণ না অদ্রি নিজে তাকে দেয়। তবে অদ্রি সবসময় বিভানকে নিয়ে পজেসিভ। তাহলে অদ্রি কেনো এতো বড় সিদ্ধান্ত নিলো? জানেনা রিহা। এই মূহুর্তে অদ্রিই পারবে জবাব দিতে। রিহা অদ্রির পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। আস্তে আস্তে অদ্রি শান্ত হয়। এবার রিহা অদ্রির চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে,

–কি হয়েছে খুলে বল। কেনো তুই এসব করছিস? আমি তোর বেষ্টফ্রেন্ড। আমাকে বল।

অদ্রি এবার মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাত দিয়ে মুখ মুছে বলে,
–সব কিছুর পেছোনে একটা সত্য থাকে। সত্য সবসময় পরে প্রকাশ পায়। তবে এটা মনে রাখবি,
“চোখের সামনে যা দেখি তাই যে সত্য সেটা নাও হতে পারে। অন্তরালে অনেক কিছু লুকানো থাকে। সেই অন্তরালের সত্য যখন প্রকাশ পায় তখন সব কিছু ফিকে মনে হয়।”

অদ্রি আবারো হেয়ালি করে বলে,
–আমার শূণ্যতা যেদিন পূর্ণ হবে সেদিন সব সত্য প্রকাশ পাবে।

রিহা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তারপর নিজেকে অবাকের রেশ থেকে বের করে এনে অদ্রিকে জিজ্ঞাসা করে,

–যা করছিস বা করবি সবটা ভেবে-চিন্তে, বুঝে শুনে করছিস তো? পরে না আবার তোকে আফসোস করতে হয়! আরেকবার ভাব। এটা তুচ্ছ কিছু না। তোর ও বিভান ভাইয়ের সারাজীবনের ব্যাপার।

অদ্রি হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
–সব কিছু যে আমি জানি তা কিন্তু না! যদি সব জানতাম তাহলে নিজের স্বামীর আবারো বিয়ের জন্য নিজে মেয়ে দেখতাম না। তবে যেটুকু জানি সেটুকুর জন্য এসব করা। এখন বাকি সত্য জানার অপেক্ষা। এটুকু জেনে রাখ বিভান আমার তো আমার। তাকে আমি যতোটা ভালোবাসি ততোটা আল্লাহ্‌ তা’আলা ও আমার শ্বশুর-শাশুড়ি ব্যাতিত আর কেউ বাসে না। তাকে নিয়েই যখন রিস্ক নিচ্ছি তখন নিশ্চয় অন্তরালে কিছু লুকানো আছে যা আমারো অজানা তবে সন্দেহ হয় কিছুটা।

রিহা অদ্রিকে এসে জড়িয়ে ধরে। অদ্রিও তার বান্ধুবীকে জড়িয়ে ধরে। রিহা মলিন হেসে বলে,

–তোর যদি আমার থেকে কোনো সাহায্য লাগে তো আমি সবসময় তোর পাশে আছি। তুই আমার জীবনে কি তা আমি বলে বোঝাতে পারবো না। আল্লাহ্ তোর মাধ্যমে আমাকে সাহায্য করেছে। তুই যদি আমার বাবা-মাকে এসএসসি পরিক্ষার পর আমাকে পড়ানোর জন্য না বোঝাতি সাথে আমাকে কলেজ লাইফে বই কেনার টাকা তোর জমানো থেকে না দিতি আর তোর সব নোটস আমাকে না দিতি তবে আজ আমি ডাক্তার হতে পারতাম না। হয়তো বাবা-মায়ের ঠিক করা নিজের থেকে দ্বিগুন বয়সি লোকের বউ হয়ে নিজের সব স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হতো। আমি এডমিশন কোচিং করিনি কিন্তু তুই কোচিং থেকে যা পড়তি সব আমাকে দিতি সাথে মেডিকেলের ভর্তির ১৫০০০ টাকাটাও কিছুটা তুই জোগাড় করে তুই দিয়েছিস নিজের টিউশন করার পর জমানো টাকা ও আঙ্কেলের কাছ থেকে নিয়ে। আমার বাবা-মা তো আমি মেয়ে বলে বিয়ে দিয়ে বোঝা নামাতে চাইছিল। আমি তোর এই দুঃসময়ে সাহায্য কোনোদিন ভুলবো না। তোর জন্য আজ আমি জাবিরের মতো সাপোর্টিভ হাসবেন্ড পেয়েছি।

অদ্রি এভাবে রিহাকে ইমোশোনাল হতে দেখে বলে,
–প্লিজ ইয়ার! সেন্টি খাস না। আর তুই আমার বোন। আমি যা করছি আমার বোনের জন্য করছি। আর রইল জাবির ভাইয়ের কথা! এনাকে একটু সাহসী বানাস দয়া করে। এতো ভিতু আর ইনোসেন্ট হলে আমাকে সাহায্য করবে কে? আমার একজন বিশ্বস্ত পুরুষ সাহায্যকারী লাগবে। আর জাবির ভাই সবচেয়ে বিশ্বস্ত আমার কাছে। উনাকে পারলে রাতের বেলা ভূতের মুভি বা ক্রাইম থ্রিলার মুভি দেখাতে বসিয়ে দিবি। সাবধান তুই কিন্তু দেখবি না। আমার পুচকুটাকে যত্ন করবি। তুই ভয় পেলে তো পেটের ভিতর সেও ভয় পাবে। আমার পুচকুর কিছু হলে তোকে আমি দেখে নিবো!

দুই বান্ধুবী সমস্বরে হেসে উঠে। এরপর ওরা সেখান থেকে চলে যায়।

___________
–নো স্যার, বিভানকে আপনি ছয় মাসের জন্য ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে জব অফার করবেন। এক বছর অনেক বেশি সময়।

–বাট ডিয়ার, মাত্র ছয় মাস খুব কম সময়। এক বছর হলে ভালো হতো। তুমি ও বিভান আমার অনেক প্রিয়। যে কয়দিন ক্যালিফোর্নিয়াতে ছিলে সেই কয়দিন যেনো ভিনদেশে নিজের দেশের মানুষকে খুব আপন করে পেয়েছিলাম।

অদ্রি আলতো হাসে মিস্টার রাসিফ আলীর প্রতিউত্তরে। তারপর বলে,
–আই আন্ডারস্ট্যান্ড স্যার। তবে প্রথমে ছয় মাস কনফার্ম করুন। এরপর সেটাকে বিভানের মতামতের উপর ভিত্তি করে নির্ধারন করবেন। আফটার অল সে আপনার বাধ্যগত ছাত্র!

অদ্রি কল কেটে হাত পায়ে লোশন দিচ্ছে। সে খেয়াল করেছে বিভানের উপস্থিতি। বিভান ব্যালকনির দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। আড় চোখে ভাবশূন্য বিভানকে দেখে অদ্রি নিশ্চিত হয় যে বিভান অদ্রির ফোনালাপে কোনো আগ্রহ বা মনোযোগ দেয়নি। বিভান তো এক ধ্যানে তার প্রেয়সীকে দেখতে মত্ত। ব্যালকনিতে যে এতোক্ষন সিগরেট খেয়ে রাজকার্য উদ্ধার করেছে বিভান তা অদ্রি ভালোই লক্ষ্য করেছে। অদ্রির মনে মনে রাগ হলেও এখন তা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিলো। বিভানকে বুঝতে দিলো না সে রেগে গেছে। অদ্রি লোশনটা ড্রেসিংটেবিলের উপর রেখে নিজের ব্যাগ থেকে মাউথ ফ্রেশনারটা বিভানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

–এটা দিয়ে মুখের বাজে গন্ধ দূর করো। আর রুমে এয়ার ফ্রেশনার দিয়ে লাইট নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।

বিভান বিমর্ষ অবস্থায় তাকিয়ে আছে অদ্রির চোখের দিকে। এই মেয়েটাকে সে অনেক ভালোবাসে। মেয়েটার ভালোবাসার পাগলামিতে সে আসক্ত। তাহলে কেনো মেয়েটা এভাবে তাকে দহনে দগ্ধ করছে!
অদ্রি বিছানার দিকে যেতে নিলে বিভান অদ্রির হাত ধরে আটকায়। তারপর একটানে নিজের বুকের উপর এনে ফেলে। অদ্রি নির্মল চোখে তাকায়। মুখে তার ক্রুর হাসি। চোখ মুখে অবাকতার ছাঁপ নেই। যতবার অদ্রিকে বিভান নিজের দিকে টানে ততোবার বিভান অদ্রিকে স্নিগ্ধ ও নির্মল রূপে আবিষ্কার করে। মেয়েটা অবাক কেনো হয় না! এটাই বিভানের প্রশ্ন। তবে মানুষকে অবাক, হতবাক ও হতভম্ব করাতে বেশ পটু সে। বিভান মলিন কন্ঠে বলে,

–কেনো অদ্রি? কেনো আমাদের সম্পর্কের মাঝে অন্যকাউকে আনছো? বিয়ে কোনো ছেলেখেলা না। আমি যদি দ্বিতীয় বিয়ে করি তাহলে ইসলাম অনুসারে আমাকে আমার দুই স্ত্রীকে সমান অধিকার দিতে হবে। আমার কোনো স্ত্রী আমার জন্য কস্টে এক ফোঁটা চোখের জল ফেললে সেটা আমার জাহান্নামের কারন হবে। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমার পক্ষে সম্ভব না তুমি ছাড়া অন্যকাউকে ভালোবাসা।

অদ্রি মুচকি হাসে তারপর দুই হাত দিয়ে বিভানের গলা জড়িয়ে এক দৃষ্টিতে বিভানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
–আমার শূণ্যতার তো ক্ষমতা নেই তোমাকে পূর্ণতা দেওয়ার!

চলবে ইনশাআল্লাহ,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে