শিশির বিন্দুর জীবন পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0
496

#শিশির_বিন্দুর_জীবন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৭(শেষ পর্ব)

রাদ রামিজার মাথায় গাট্টা মেরে বলল
-“হ আমারই বোঝার বয়স হয় নি। তুই তো বুড়া আন্টি। যা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।”

রাদ রামিজার রুম থেকে বেড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেল।

রামিজা মুখ ভেংচি দিয়ে চলে যায়।

————————

কেটে গেছে অনেকটা দিন

আফরিনের পরীক্ষা শেষে ভালো রেজাল্টারে পর ভালো একটা ভার্সিটিতে চান্স ও হয়ে গেছে। কথাবার্তা বলে বিয়ে টাও ঠিক হয়ে গেছে রাদের সঙ্গে। আফরিন আর অমত করেনি।

রাদ রেডি হচ্ছিল আর ইশরা ড্রেসিং টেবিলের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। চোখ ছোট ছোট করে ইশরা ললিপপ খেতে খেতে বলল
-“বাবাই তুমি একটু একটু করে হাসছো কেন?”

রাদ অবাক হয়ে তাকালো ইশরার দিকে। ওর গাল ‍টেনে দিয়ে বলল
-“বাবাই তুমি তো তোমার লিপস্টিক খেয়ে ফেলেছো।”

ইশরা আয়নায় দেখে বলল
-“তোমার পকেটে আছে দেও তো আমি আবার দেই।”

রাদ ইশরাকে কোলে তুলে বলল
-“না বাবাই এখন তার দিতে হবে না। তোমার মামুনি আসলে দিও কেমন।”

ইশরা হাসি দিয়ে বলল
-“মামুনি কখন আসবে বা‍বাই!”

রাদ ইশরার চুল ঠিক করে দিতে দিতে বলল
-“এই তো আমরা এখনই যাবো আনতে।”

———————-

আফরিনকে সাজানো হচ্ছে। আরুশা তো সেজেগুজে রেডি। আরুশা চিপস খেতে খেতে বলল
-“কিরে বিয়ে করছিস তাহলে। আমি তো মনে করছিলাম এ জন্মে তোর বিয়ে খেতে পারবো না।”

আফরিন গরম চোখ করে তাকালো আরুশার দিকে আরুশা দাঁত বের করে হাসলো। আর বলল
-“আবির আমারে প্রোপজ করেছে কাল।”

আফরিন অবাক হয়ে তাকালো আরুশা ফুস করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল
-“কি আর বেচারা তোরে তো রাদ ভাইয়া নিয়ে যাচ্ছে।”

আফরিন আরুশার কথায় লজ্জা পেয়ে বলল
-“সর তো এখান থেকে”

আরুশা হাসলো।

আফরিনের ফোন বাজছিল। আফরিন কল রিসিভ করে কানে নিলো। রিনরিনে কন্ঠে সালাম দিলো।

অপর পাশ থেকে শুধু তপ্ত নিশ্বাসের শব্দ পেলো। আফরিন হেলো হেলো করে বিরক্তি নিয়ে কেটে দিলো।

—————-

রাদ কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেল আফরিনদের বাসায়।

রাদ ভিতরে ঢুকতেই একটা চিঠি পেলো। চিঠিতে লেখা ছিল

-“বিয়েটা শেষ করে তোমাদের বাসায় গিয়ে ছাদে যাবে। কথা আছে তোমার সাথে আফরিনকে নিয়ে।”

রাদের কপাল কুচকে গেলো এমন চিঠি পেয়ে। কি দিলো এই চিঠি আর কেনই বা দিলো। আর আফরিনকে নিয়েই বা কি ‍বলবে।

রাদের ভাবনার ছেদ ঘটলো আরুশার ডাকে। আরুশা দাঁত বের করে বলল
-“কি দুলাভাই কি ভাবছেন! আরে মিয়া আজ আপনার বউকে পেয়েই যাবেন তো এতো ভাবনা কিসের। চলুন হবু শশুর ডাকছে।”

আরুশার কথায় রাদ সম্মতি দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো।

—————-

আফরিন ওর রুমে একাই বসে ছিলো। সবাই এসে বিয়ের আসরে নিয়ে যায়। রাদ পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে আফরিনের দিকে। আফরিনকে পাশে বসানোর কিছুক্ষণ পরেই রাদ ওর কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল

-“ও হৃদয়হরণী আজ তোমার সৌন্দর্যে আমি মুগ্ধ হয়ে বাক‍্যহীন হয়ে যাচ্ছি। আমার হৃদস্পন্দন জানান দিচ্ছে আমি এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। যার ঔষধ শুধু তুমি।”

রাদের এমন কথায় আফরিন লজ্জায় লাল হয়ে যায়। রাদ আবারো বলে
-“এমন করে লজ্জা পেলে কিভাবে হয় বলো তো। এভাবে লজ্জা পেলে যে তোমায় আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যার মতো লাগে।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজী চলে আসে। ভালোভাবেই আফরিন আর রাদের বিয়েটা হয়ে যায়।

————————–

রাদ ছাদের কার্ণিশ ঘে‍ষে দাঁড়িয়ে আছে। পূর্ণিমার চাঁদে ঝলমল করছে চারপাশের পরিবেশ। তার পাশেই দাড়ানো সুঠাম দেহের সুদর্শন পুরুষ। যদিও বা সেও সুদর্শন কোনো দিক দিয়ে তার থেকে কম নয়। চারপাশে পিনপতন নিরবতা ভেঙে রাদ বলল
-“আপনি কে! ঠিক চিনলাম না তো। আর আফরিনের ব‍্যাপারে কি বলবেন!”

লোকটা চাঁদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
-“জানো তো জীবনটা শিশির বিন্দুর ন‍্যায় ক্ষণস্থায়ী। কখন কার মৃত্যু সুখ দুঃখ আসে কেউ বলতে পারেনা।”

রাদ কপাল কুচকে বলল
-“কি বলছেন এগুলো!”

লোকটা বাঁকা হাসলো। চাঁদের আলোতে যা চোখ এড়ালো না রাদের। লোকটা আরো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
-” আমি রিসাদ। তোমার থেকে বয়সে বড় তাই তুমিই বলছি কিছু মনে করো না। কিছু মনে করলেও আমার করার কিছু নেই। জানো তো আজ নিজেকে ব‍্যর্থ বলবো নাকি সফল বলবো বুঝতে পারছিনা। সেই আফরিন যখন স্কুলে পড়ে তখন থেকে আমি ওকে ভালোবাসি।”

কথাটা শুনে রাদ থমকে গেলো। কেন যেন বুকে এক অজানা চিনচিনে ব‍্যথা অনুভব করলো সে। রিসাদ ওর থমকানো মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ‍আবারো বলা শুরু করলো
-“চিন্তার কিছু নেই। আমি ওকে দিয়ে দিছি তোমার কাছে। আমার বাবা অনেক ছোটবেলায় আমার মাকে ডিভোর্স দেয়। ডিভোর্সের কয়েকদিন পর আমার মা বুঝতে পারে আমার বোন হবে। মা আমার বাবাকে আর কিছু জানায় নি। যে মানুষটা নিজের স্বার্থের জন‍্য নিজের মা বাবাকে ছেড়ে সে আমার মাকে কি দেখবে। আমার মাও চলে যায় বোনকে রেখে। স্বার্থপর দুনিয়ায় আমি একা হয়ে পড়ি। মানুষ অবহেলা আর অনাদরে বড় হয়েছি। পরে নিজে কামাই করে বোনকে বড় করি। জীবনের প্রতি এক অনিহা চলে এসেছিল। কিন্তু তখনই আফরিনকে দেখি। পাগলের মতো ভালোবাসি ওকে আমি। আমি ওর সাথে দেখা করার জন‍্য প্রতিদিন ওর জন্য দাঁড়িয়ে থাকতাম। আস্তে আস্তে আমার টাকা পয়সা বাড়ি গাড়ি সব হলো। আফরিনকে পাওয়ার জেদ চেপে গেছিলো আমার মনে। আমি চেয়েছিলাম আজ বিয়ের আসর থেকে ওকে তুলে নিয়ে যেতে কিন্তু।”

রাদ চোখ ছোট ছোট করে শুনছিল রিসাদের কথা। রিসাদ কিছুক্ষণ পর কয়েকটা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলল

-“তুমি একদিন বৃষ্টির দিন একটা মেয়েকে বাঁচিয়েছিলে না।”

রাদ কিছুক্ষণ ভেবে সম্মতি দিলো। রিসাদ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল
-“ওটা আমার ছোট বোন ছিল। যে দুইদিন আগে এক্সিডেন্টে মারা যায়।”

রাদ অ‍বাক হয়ে বলল
-“কি বলছেন এগুলো। কিভাবে কি হলো!”

রিসাদ রাদের দিকে একবার তাকিয়ে সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল
-“ভার্সিটি থেকে আসার সময় একটা বাস…পরে ওকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। ওর শেষ ইচ্ছা রাখতেই আফরিন আজ তোমার।”

রাদ অবাক হয়ে বলল
-“মানে”

রিসাদ এক রহস্যময় হাসি দিলো। তারপর বলতে লাগলো
-“ও আমার পরিকল্পনা জেনে গিয়েছিল। ও ওর শেষ ইচ্ছে হিসেবে আমার কাছে চেয়েছিল যেন আমি আফরিনকে ছেড়ে দিই। তোমার সঙ্গে ওর বিয়ে হলে একটা বাচ্চার গতি হয়ে যাবে। ও বাবা মা পাবে। পরিবারের স‍বাই খুশি থাকবে। আমাদের তো আর পরিবার ছিল না। পরিবারের অভাব আমরা বুঝি।”

রাদ খেয়াল করলো রিসাদের চোখে পানি ঝলমল করছে। রিসাদ মুখে হাসি টেনে বলল
-“যাইহোক বাদ দেও। আফরিনকে ভালো রাইখো। ওকে কোনো কষ্ট পেতে দিও না।”

বলে একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে চলে গেলো।

রাদের কপালে সূক্ষ ভাজ পড়লো। কেন যেন মনে হচ্ছে রিসাদ সব কথা বলেনি। কিছু রহস্য ছেড়েই চলে গেলো। রাদ তাকিয়ে রইলো রাস্তার দিকে। রিসাদ হেঁটে চলছে সামনের দিকে। রাদ তাকিয়ে রইলো যতক্ষণ পর্যন্ত রিসাদকে দেখা যায়। রাদ পরপর কয়েক‍টা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিরবির করে বলল
-“থাক না কিছু অজানা রহস্য। যদি সেই রহস্যে শান্তিতে জীবন যাপন করা যায়।”

রাদ নিজের রুমে এসে দেখে আফরিন নেই। এইদিক ওদিকে তাকিয়ে আফরিনকে বারান্দায় দেখতে পায়। রাদ এগিয়ে যায় সেদিকে। পকেট থেকে বেলীফুলের মালা বের করে আফরিনের হাতে পড়িয়ে দেয়। পুনরায় পকেটে হাত দিয়ে আংটির বক্স বের করে পড়িয়ে দেয় আফরিনের হাতে। মাথাটা নামিয়ে নরম ঠোঁটে স্পর্শ বসিয়ে দেয় ওর হাতে। আফরিন লজ্জা নিয়ে নিচে তাকিয়ে আছে।

রাদ আফরিনের মুখটা উঁচু করে বলল
-“আচ্ছা তুমি কি শুধু ইশরার জন‍্যই বিয়ে করেছো। কখনো যদি কেউ তোমাকে এসে বলে সে পাগলের মতো ভালোবাসে। তাহলে কি!”

আফরিন রাদের গাল টেনে বলল
-“না মিস্টার, আপনাকে যদি আমার পছন্দ নাই হতো। তাহলে বিয়ে তো দূরের কথা। আপনি আমার সঙ্গে কথাই বলতে পারতেনা।”

রাদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো সে আফরিনকে জড়িয়ে ধরে বলল
-“জানো তো জীবন শিশির বিন্দুর মতো। তাই কখনোই ভবিষ্যতের কথা ভেবে বর্তমানকে নষ্ট করা ঠিক না।”

আফরিন মুচকি হেসে বলল
-“চিন্তা করেন না। একবার যখন নিজেকে আপনার নামে লিখে দিয়েছি তখন মরণ ছাড়া কেউ আমাকে আপনার পিছু ছাড়াতে পারবেনা।”

রাদ আফরিনের মুখটা নিজের দুইহাতে আবদ্ধ করে বলল
-“ভালোবাসি প্রিয়তমা। কখনো ছেড়ে যেও না।”

আফরিন রাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল
-“আমিও আপনাকে অনেক ভালোবাসি। প্রাণ থাকতে আপনাকে কখনো ছেড়ে যাবো না।

#সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে