#শিশির_বিন্দুর_জীবন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৩
কেটে গেছে দুইদিন…
ইশরা এখন রাহাতের বাসায় আছে। ইশরা রাদের কাছেই থাকতে বেশি পছন্দ করে। রাদও সময় দিচ্ছে ইশরাকে। এখন ইশরা অনেকটাই সুস্থ।
রাদ নিজের বিছানায় বসে ইশরার সঙ্গে খেলছিল। হুট করেই তার ফোন বেজে উঠলো। রাদ ফোন রিসিভ করে গম্ভীর কন্ঠে বলল
-“হেলো, কে বলছেন?”
অপর পাশ থেকে রিনরিনে কন্ঠে ভেসে এলো
-” আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া!”
রাদ শোয়া থেকে উঠে বসে বলল
-“কে!”
অপর পাশ থেকে আফরিন বলল
-“ভাইয়া আমি আফরিন। আন্টিকে ফোন দিছিলাম। আন্টি নাকি কাজে ব্যস্ত তাই আপনার ফোন নাম্বার দিলো। আর ইশরা নাকি আপনার কাছে। একটু ভিডিও কল দেওয়া যাবে। আসলে ওকে অনেকক্ষণ দেখিনি তো। তাই একটু দেখতে মন চাচ্ছিল।”
এক নিশ্বাসে কথা বলেই জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়লো। আফরিনের এমন কাজে হাসি পেলো রাদের। ওর কথার ধরন দেখেই রাদ বুঝতে পারলো মেয়েটা তাকে ভয় পায়। রাদ কিছু না বলেই ধপ করে কল কেটে দিলো।
হুট করে রাদ কল কেটে দেওয়ায় আফরিনের খুব খারাপ লাগলো। তাহলে কি ইশরার সঙ্গে কথা হবেনা। অনেক দিধা নিয়ে কল করেও কি ব্যর্থ হবে সে।
ভাবনার মাঝেই ছেদ পড়লো ফোন বাজার শব্দে। আফরিন দেখলো রাদ ভিডিও কল দিয়েছে। আফরিনের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে দ্রুত কল রিসিভ করতেই ইশরার চকলেট মাখানো মিষ্টিমুখ ভেসে উঠলো। ইশরা আফরিনকে দেখেই বলে উঠলো
-“মামুনি”
ইশরাকে দেখে আফরিনের বুকটা প্রশান্ত হয়ে গেল। আফরিন প্রফুল্ল হাসি নিয়ে বলল
-“মামুনি, তুমি কেমন আছো? কি করছো?”
ইশরা চকলেট খাওয়াতে মনোযোগ দিয়ে বলল
-“চককেট খাচ্ছি। তুমি খাবে!”
আফরিন হাসি নিয়েই তাকিয়ে রইলো ইশরার দিকে।
খানিক সময় পার হয়ে যেতেই রাদ গম্ভীর কন্ঠে বলল
-“মিস, কথা না বলে শুধু তাকিয়ে থাকলে হবে!”
আফরিন হুট করে রাদের এমন কথায় চমকে উঠেও নিজেকে সামলে নিলো। আফরিন জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে বলল
-“ভাইয়া ইশরাকে একটু আমার কাছে নিয়ে আসতাম। কিন্তু আন্টি কিছুতেই রাজি হচ্ছেনা। আপনি একটু কিছু বলবেন।”
রাদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল
-“তুমি এসে ঘুরে যাও।”
আফরিন নাকোচ করে বলল
-“না ভাইয়া, আমি না হয় গিয়ে ওকে নিয়ে আসি।”
রাদ ফুস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল
-“আচ্ছা ঠিক আছে কাল সকালে ওকে দিয়ে আসবোনি তোমাদের বাসায়।”
আফরিন খুশি হয়ে বলল
-“ধন্যবাদ ভাইয়া”
———————–
নিশব্দ নিঝুম রাতে অনেকক্ষণ পর পর একটা দুটো গাড়ি শো করে চলে যাচ্ছে। চারপাশে হিমেল বাতাস। শহরের অসহ্য গরমে এই রাতের প্রশান্তিময় বাতাস বরাবরই মানুষকে মুগ্ধ করে আসছে। দূর থেকে ভেসে আসছে বেলিফুলের মিষ্টি সুভাষ। শহরের ব্যস্ত রাস্তা এখন ফাঁকা মাঠের মতো পড়ে আছে।
এতো মুগ্ধতার মধ্যেও একরাশ মন খারাপ এসে বাসা বেধেছে রাদের মনে। ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই। কিন্তু আজ তা আর বাধা মানছে না রাদের। অঝোর ধারায় নোনা জল গড়িয়ে পরছে। চিৎকার করে কান্না করতে মন চাচ্ছে। ছোট থেকে কতো স্মৃতিময় কাহিনী ঘটেছে এই একই জায়গায়। হাসিঠাট্টা,খুনশুটি,রাগ,অভিমান কতো কিছুই না হয়েছে এই একই জায়গায়। কিন্তু আজ পাশে নেই তার প্রাণপ্রিয় ভাই।
রাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলতে লাগল
-“কেন এমন করলি ভাইয়া! কেন করলি! সব এমন এলোমেলো করে ছেড়ে গেলি আমাদের। তুই তো এতো দূর্বল ছিলিনা রে। তুই তো সবসময় আমাকে সাহস জোগাতি। আর তুই আজ…”
পকেটে ফোনটা অনবরত বেজেই চলছে। কিন্তু ফোনটা ধরার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই রাদের।
————————-
আফরিন চিৎকার করে বলে উঠলো
-“তোমরা কি পেয়েছ বলো তো! আমাকে তোমাদের মানুষ বলে মনে হয় না। নাকি আমি চুপচাপ থাকি তাই আমাকে নিজেদের হাতের পুতুল ভেবে নিও না। আমার বোনের মেয়ে ইশরা। আমিও ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। তাই বলে এই নয় যে আমি নিজের লাইফটাকে নষ্ট করে দিবো। বিয়ে না করলে যে আমি একা ইশরাকে সামলাতে পারবোনা এমনটা তো না। তোমরা এই বিয়ে বিয়ে করে আজ রাহাত ভাইয়া এমন একটা কাজ করলো। আর এখন রাদ ভাইয়াকে বিয়ে করা নিয়ে..,ছি।”
আফরিনের মা আফরিনের কাছে গিয়ে আফরিনের কাধে হাত রাখতেই আফরিন ঝাড়া দিয়ে ফেলে দেয়। আফরিনের মা বলল
-“ছেলেটা তো খারাপ না আফরিন!”
আফরিন রক্ত লাল চোখে আবার ও চেচিয়ে বলল
-“ভালো না খারাপ তা আমি বলতে চাইনি। আমি শুধু এইটুকুই বলছি আমি এখন বিয়ে করতে পারবোনা। আম্মু আমার সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। আমার লাইফটা সেট করতে দেও। আমি না করেনি আমাকে একটু সময় দেও। আর আমি ইশরাকে সামলাতে পারবো সমস্যা হবেনা বলছি তো।”
আফরিনের মা কিছু বলতে নিবে তার আগেই আফরিনের বাবা আফরিনের মাকে থামিয়ে বলল
-” অনেক হয়েছে। আমি এতোদিন তোমার অনেক বাড়াবাড়ি সহ্য করেছি। তুমি তো নিজের হাতে নিজের মেয়েটাকে শেষ করে দিচ্ছো। আমি তোমার আর একটা কথাও শুনতে চাই না।”
বাবার কথায় কিছুটা সস্থিরতা ফিরে পেল আফরিন। আফরিন আর কিছু না বলে না শুনে গুটিগুটি পায়ে চলে যায় নিজের রুমে। ইশরা ঘুমিয়ে আছে বিছানার মাঝখানে ঘুমিয়ে আছে। কি শান্ত মিষ্টি সেই ঘুমন্ত শিশুটির চেহারা। রাদ আজ সকালেই ইশরাকে দিয়ে যায় এই বাসায়।
আফরিন ওড়নাটা ঠিক করে বারান্দায় গিয়ে বসে। বাহির নিরব রাত্রি প্রতি মুহূর্তে জানান দিচ্ছে যে এখন রাত অনেকটা হয়েছে। হালকা বাতিসে আফরিনের খোলা চুল উড়ছে মৃদু।
হুট করেই ডুকরে কেঁদে উঠলো আফরিন। জীবনটা তো অন্য রকমও হতে পারতো। এমন এলোমেলো না হলেও পারতো। গোছানো জীবনটা হুট করেই অগোছালো হয়ে গেল। সামনে পরীক্ষা তার। তার বোন কতো আশা করেছিল সে তাকে সফল হতে দেখবে। আজ সে নেই। কল্পণাও করতে পারেনা সে এখনো। আজ দুইবছর হয়ে গেল তার বোন নেই। চোখে সামনে যে ভাইকে কষ্ট পেতে দেখেছে। সেও নেই। চলে গেছে অনেক দূরে।
আফরিন চোখের পানি মুছে বিরবির করে বলল
-“না না ভেঙে পড়লে হবে না। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে সফল হতে হবে তাকে।”
আফরিন ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বই খাতা নিয়ে বসলো।
——————-
রাবেয়া বেগম ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছে ছেলে আর ছেলের বউয়ের ছবির দিকে। তার কি সুন্দর সাজানোগোছানো সংসার ছিল। মিষ্টি একটা বউ সারাদিন মা মা করতো। কত শখ ছিল বাড়িতে নতুন মেহমান আসবে। কিন্তু মিষ্টি মেয়েটা যে এমন করে চলে যাবে তা কে জানতো। আজ ছেলেটাও নেই।
কাধে কারো স্পর্শ পেতেই রাবেয়া বেগম বললেন
-“এখনো ঘুমাসনি।”
রামিজা তার মাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল
-“না মা ঘুম ধরছেনা। আর ছোট ভাইয়া তো ফিরলোনা।”
রাবেয়া বেগম চোখ মুছে মেয়ের দিকে ঘুরে মেয়েকে বুকে টেনে বললেন
-“ফিরে আসবে। আমি জানি ও কোথায়। ওর মেনে নিতে সময় লাগছে। ছেলেটা ছোট থেকে ভাই পাগল ছিল..”
বলেই থেমে গেলেন ওনি। রামিজাও মায়ের অবস্থা টের পেয়ে কিছু বলল না। চারপাশে পিনপতন নিরবতা।
—————————-
সকালের আলো ফুটেছে রাদ বাসার দরজার সামনে আসতেই ওর মা দরজা খুলে দিলো। এতে রাদ অবাক হলো না। রাদ জুতা খুলে নিজের রুমে যেতে যেতে বলল
-“মা আমি আর বিদেশ যাবোনা। আমি এখানেই সিফট করবো।”
রাবেয়া বেগম ছেলের কথা শুনে খুশি হলেন। এক ছেলেকে হারিয়েছে আর এক ছেলেকে দূরে পাঠিয়ে মোটেও শান্তি পেতেন না তিনি।
রাদ ওয়াশরুমে গিয়ে লম্বা একটা শাওয়ার নিলো। একটা টাওজার পড়েই এসিটা অন করে শুয়ে পরলো সে। ঘুমটা এখন প্রয়োজন তার।
—————-
দীর্ঘ সাতদিন পরে আজ কলেজে আসলো আফরিন। কয়েকদিন পর টেস্ট পরীক্ষা তার। এই কয়েকদিনের ঘটনায় অনেকটা সময় গিয়েছে। সে ধীর পায়ে গিয়ে নিজের ক্লাসে গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ পর ধপ করে তার পাশে এসে বসলো আফরিনের ফ্রেন্ড আরুশা।
আরুশা কপাল কুচ করে আফরিনের দিকে তাকিয়ে বলল
-“কিরে এতো কিছু হয়ে গেল। আমাকে একবার জানালিনা। আন্টি যখন বলল আমি তো অবাক হয়ে গেছি একবারে!”
আফরিন রিনরিনে কন্ঠে বলল
-“আসলে আমি অনেকটা ডিপ্রেশনে ছিলাম। তোকে সব কিছুই বলতাম।”
আরুশা ফোস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল
-“তুই টেনশন নিস না। আল্লাহ আছে। তুই আল্লাহর উপর ভরসা কর। আর মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা কর।”
আফরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাতা কলম বের করলো।
হুট করেই একটা ছেলে আফরিনের সামনে আসলো। ছেলেটা আফরিনের ক্লাসমেট। ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে কপাল কুচকে আফরিন বলল
-“কি হয়েছে আবির! কিছু কি বলবে?”
আবির জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল
-“আজ ক্লাসের ব্রেক টাইমে কলেজের ক্যান্টিনে একটু দেখা করো তো।”
আফরিন কিছু বলতে নিবে তখনই টিচার চলে আসে। টিচার আসতেই আবির চলে যায়।
——————
রামিজা স্কুল ড্রেস পড়ে রাদের রুমে এসে দেখে রাদ ঘুমাচ্ছে। রাদকে ঘুমাতে দেখে রামিজা আর কিছু বলল না। নিশব্দে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল।
রাবেয়া বেগম মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন
-“বাসায় আসার আগে কলেজ ভবনে গিয়ে আফরিনের সঙ্গে দেখা করে আসিস তো। আর শুনে আসিস তো মেয়েটার টেস্ট পরীক্ষা কবে। ইশরাকে এই বাসায় নিয়ে আসবো ভাবছি। মেয়েটাকে পড়াশোনার সময় দেওয়া উচিত।”
রামিজা হ্যাঁবোধক জবাব দিয়ে চলে গেল স্কুলের উদ্দেশ্যে।
#চলবে