শিউলি পাওয়া পর্ব-০৪

0
4

#শিউলি_পাওয়া <চতুর্থ পর্ব>
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৭>
ব্যান্ডেল চার্চের উল্টো দিকেই বেশ কয়েকটা রেস্টুরেন্ট আছে | ভূমি আর অনিন্দ সেই রকমই একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়ালো | অনেকদিন বাদে অনিন্দর মনে আজ একটা ভালো লাগার রেশ কাজ করছে | তাই একটু হাসি মুখেই কথাটা বলে ফেললো ,
” থ্যাঙ্কস ভূমি | তুমি এতো কিছুর পরেও আমার সাথে রেস্টুরেন্টে এলে |”
কথাটা শুনে ভূমির আবারও এক কথায় উত্তর , ” মানবিকতা | বুঝলে |”
” কি ? মানে ? ” ,.. অনিন্দ যেন আকাশ থেকে পড়লো |
ভূমি এবার একটু হেসেই বললো , ” মানবিকতা মানে হিউম্যানিটি | জানো নিশ্চয়ই | তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও আসতাম | কারণ আমি চাই না পুজোর সময় কারোর শরীর খারাপ হোক | আর কিছু ?”
অনিন্দ মুখের ওপর এই রকম একটা কঠিন উত্তরও এক্সপেক্ট করেনি | আর এরপর আর কিছু বলাও যায় না | তাই চুপ করে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকে গেলো | কিন্তু সেখানেও ওর জন্য একটা টুইস্ট অপেক্ষা করছিলো | দুজনে একসঙ্গে এখানে এলেও ভূমি গিয়ে বসলো একটা অন্য টেবিলে | ওয়েটারটা তো অবাক ! … ভূমির সামনে গিয়ে বিস্ময় ভরা মুখ নিয়ে বললো ,
” কি ব্যাপার ম্যাডাম ? আপনারা তো একসঙ্গে এলেন | কিন্তু আলাদা টেবিলে বসলেন যে ! ”
এই প্রশ্নটা শুনে ভূমি বেশ রেগে গিয়েই উত্তর দিলো , ” তাতে আপনার কি ? ওই টেবিলে ওনার জন্য একটা ফ্রেঞ্চ টোস্ট , আর আমাকে এক কাপ কফি |”
ভূমির এই রকম রাগী রাগী মুখে উত্তর শুনে ওয়েটারটাও আর কথা বাড়ালো না | আর তারপর যেটা হলো সেটা ইতিহাস | দুই প্রাক্তন , একই রেস্টুরেন্টের দুটো আলাদা টেবিলে বসে ফ্রেঞ্চ টোস্ট আর কফি খেলো | ব্যাস , গল্প শেষ |

আর ওই দিকে দীপ আর কথা এখন ব্যান্ডেল চার্চের ছাদে | তখন প্রেয়ার রুম থেকে ওরা ইচ্ছে করেই কেটে পড়েছিল | ঐভাবে বেপাত্তা না হলে অনিন্দ আর ভূমিকে আলাদা স্পেস দেয়া যেত না ! এবার একান্তে নিশ্চয়ই ওরা ওদের ঝামেলা মেটানোর চেষ্টা করবে | না , কথার প্ল্যানটা খারাপ না | এবার যেন সব ঠিকঠাক মতন ওয়ার্ক করে | এইসবই ভাবছিলো দীপ, আর আনমনে তাকিয়েছিলো দূরে বয়ে চলা শান্ত গঙ্গার দিকে | এখান থেকে পুরো শহরটার ই একটা ভিউ পাওয়া যায় , অদ্ভুত সুন্দর দেখতে লাগে সেটা | ইশ , আগে জানলে ক্যামেরাটা সঙ্গে আনতো | এক সেকেন্ডের জন্য কথাটা মনে হয়েই আবার মিলিয়ে গেলো | না বাবা, আনেনি , ভালোই হয়েছে | সামনে যা একজন দাঁড়িয়ে আছে ! নেচার ফটোগ্রাফার থেকে ওকে ফ্যাশন ফটোগ্রাফার বানিয়ে যেন শান্তি ! অদ্ভুত ঝগড়ুটে মেয়ে | তাই তো যখন থেকে ওরা একা হয়েছে , দীপ চুপ করে আছে | এর সাথে কথা শুরু করারই দরকার নেই , কারণ শেষটা কথা শুনে হয় | তবে বেশিক্ষন এইভাবে চুপচাপ থাকতে পারলো না যদিও , চার্চের ছাদের নিঃস্তব্ধ পরিবেশটা ভেঙে কথা হঠাৎ বলে উঠলো , ” না , আর সম্ভব না | এইভাবে চুপ করে থাকা জাস্ট ইম্পসিবল |”
দীপ এই কথার কোনো অর্থই খুঁজে পেলো না ! অদ্ভুতভাবে কথার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো , ” মানে ? কি হলো আবার ?”
” মানে আমি দশ মিনিটের বেশি কথা না বলে থাকতে পারি না | প্রবলেম আছে আমার | তাই সামনে যে রকমই পাবলিক থাকুক না কেন , আমাকে তার সাথে বকতেই হয় | বাধ্যতামূলক |”
কথাগুলো শুনে দীপ নির্বিকার মুখে বললো , ” কথা , এই ভাবে রোজ রোজ ইনস্টলমেন্টে ইনসাল্ট না করে একদিনেই পুরোটা করে দিতে পারো | বেটার হয় , তাই না |”
” মানে ?”
” মানে আমি কি মঙ্গল গ্রহ থেকে এসেছি ! ‘এই রকম পাবলিক’ কথাটা তো তুমি আমাকেই ইন্ডিকেট করে বললে , আমি কি বুঝি না কিছু !”
এটা শুনে কথা এবার হেসে ফেললো , ” না মানে তুমি এই গ্রহেরই বাসিন্দা | এই নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই | কিন্তু কি বলো তো , তুমি ঠিক আমার টাইপের না | মানে এই ধরো এতক্ষন কি রকম চুপচাপ থাকতে পারো | তাই |” ..
কথাটা শুনে দীপের পারদ আরোও এক কাঠি চড়লো , ” তো কি বলবো ? আমাদের মধ্যে আলোচনা করার মতন আছে টা কি ?”
এটা শুনে কথার এক লাইনের প্রশ্ন , ” তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে ?”
আচমকা এই প্রশ্নটার কোনোই মানে খুঁজে পেলো না দীপ | এই মেয়েটা যে কি বলে , কেন বলে , দীপের সেসব কিছুই মাথায় ঢোকে না | আর দীপকে ওই রকম চুপ থাকতে দেখে কথাই ওর হয়ে উত্তরটা দিয়ে দিলো , ” চুপ করে আছো , তার মানে নেই | জানতাম আমি |”
” কি ? তুমি জানতে মানে ? হ্যাঁ , আমার গার্লফ্রেন্ড নেই | কিন্তু তুমি এই ব্যাপারে এতো সিওর হলে কি করে ?” .. দীপ এক নিঃশাসে প্রশ্নগুলো করে গেলো | কথা এবার কনফিডেন্সের হাসি হেসে বললো , ” তোমাকে প্রথম দেখেই বুঝেছিলাম | যেই ছেলে প্রাকৃতিক দৃশ্যের নামে সুন্দরী মেয়েদের ফটো তোলে , তার গার্লফ্রেন্ড থাকতেই পারে না | তার ওপরে আবার ঝগড়ুটে |”
এটা শুনে দীপের রাগ মাত্রা ছাড়িয়েছে , একটা যোগ্য জবাব এবার দিতেই হবে ওকে | তাই এক সেকেন্ড ভেবে নিয়েই বললো ,” ফার্স্টলি , তুমি সুন্দরী নও | আর সেকেন্ডলি আমি সেইদিন তোমাদের ফটো তুলছিলাম না | এটা আর কত রকম ভাবে বোঝালে বুঝবে ? এন্ড বাই দ্যা ওয়ে , আমার গার্লফ্রেন্ড না থাকার কারণ তো এতো এক্সপ্লেন করে বললে , তা তোমার ও তো বয়ফ্রেন্ড নেই | এবার আমি বলি কারণটা ?”
এটা শুনে কথা অবাক ! ” তুমি কি করে জানলে আমার বয় ফ্রেন্ড নেই ? বুঝেছি নিশ্চয়ই অনিন্দদা বলেছে |”
এবার দীপ একটু সেই কনফিডেন্সের হাসি হেসে বললো , ” না , কেউ বলেনি | আর বলার দরকারও নেই | প্রথম দেখাতেই বুঝেছি | এই রকম গায়ে পড়ে যে ঝগড়া করে , আর লোকের মাথা অলমোস্ট চিবিয়ে খায় বকবক করে , তার বয়ফ্রেন্ড থাকতেই পারে না |”
না | এরপর আর না | এই ছেলেকে সহ্য করার সব লিমিট এখন পেরিয়ে গেছে কথার | ওর পক্ষে আর এক সেকেন্ডও এখানে থাকা সম্ভব না | তাই গলায় বেশ জোর এনে বললো ., ” ভালো | তাতে তোমার কি ? চললাম আমি | অনেক হয়েছে | যদি দিদি আর অনিন্দদার ঝগড়ার ব্যাপারটা না থাকতো , তাহলে তোমার সাথে কখনো একটাও কথা বলতাম না |”
এবার দীপও সৌজন্যের একটা হাসি হেসে বললো , ” সেম উইথ মি .. দরকার না থাকলে আমিও তোমার সাথে একটাও কথা বলতাম না |” ….
এরপর আর কেউই ব্যান্ডেল চার্চের ছাদে আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ায়নি, কারণ দুজনেই বুঝেছিলো , আর একটুক্ষণ একসঙ্গে থাকলে হয়তো এখানেই ওয়াল্ড ওয়ার থ্রি শুরু হয়ে যাবে |

সেইদিন ওরা যখন ব্যান্ডেল চার্চের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল তখন অনিন্দ আর ভূমিও একসঙ্গে উল্টোদিকের রেস্টুরেন্টের দরজা দিয়ে বেরিয়েছিল | ব্যাপারটা দেখেই কথার মুখে হাসি | যাক, এতক্ষন ধরে এই ঝগড়ুটে ছেলেটাকে সহ্য করাটা বৃথা যায়নি তাহলে | দীপেরও ব্যাপারটা দেখে মনটা বেশ খুশি খুশিই হয়ে গেলো | নিশ্চয়ই ওদের মধ্যে তাহলে সব ঠিক হয়ে গেছে , তাই তো একসঙ্গে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোলো ! এইসব ভাবনার ভিড়েই ভূমি আচমকা কথার কাছে এসে ওর হাতটা ধরে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রিস্কাটাতে উঠে গেলো | দীপও এবার আর উত্তেজনা ধরে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললো অনিন্দকে , ” কি রে ? রেস্টুরেন্ট অব্দি পৌঁছে গেলি ? মিটে গেলো সব ঝামেলা ?”
অনিন্দ এবার একটু হেসে একটা সেনটেন্স এ উত্তর দিলো , ” ইট’স কল্ড হিউম্যানিটি .. বুঝলি |”

<৮>
পরের দিনের সূর্য ষষ্ঠীর সকাল নিয়ে বাঙালির দরজায় হাজির | সবার মনে আজ একটা আনন্দ , পুজো শুরু হওয়ার আনন্দ , ঢাকের আওয়াজে চারটে দিন কাটানোর আনন্দ | মার ঘরে আসার আনন্দ | কিন্তু এতো আনন্দের ভিড়েও কথা আর দীপের মুখ ভার | কালকের প্ল্যানটা যে এইভাবে ভেস্তে যাবে , ওরা একেবারে ভাবতে পারেনি ! শেষে কি না মানবিকতা | কোনো মানে হয় | এইসব ভাবতে ভাবতেই আনমনে কফির কাপে চুমুক দিলো কথা | গঙ্গার ধারের এই কফি শপটায় এখন ও আর দীপ বসে | দুজনের মুখই বেশ গম্ভীর | আজকে তো আর ঝগড়া করার মতনও এনার্জি নেই | যতক্ষণ না অনিন্দ আর ভূমির মধ্যে ঝামেলাটা সল্ভ করছে ততক্ষন যেন কিছুতেই শান্তি আসছে না মনে | দীপ এইসব গভীর ভাবনার মধ্যেই ডুবে ছিল সেদিন , তখনই কথার কথায় চিন্তার রেশটা থেকে বেরিয়ে এলো ,
” আচ্ছা , আজ তো ষষ্ঠী , আজ ঠাকুর দেখতে গেলে কেমন হয় ?”
” কি ? ঠাকুর দেখবো , তা ও আবার তোমার মতন মেয়ের সাথে ! সরি , পারলাম না |” … এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো কথাটা দীপ |
” ওহ , হ্যালো , তোমার সাথে ঠাকুর দেখার কোনো রকম ইচ্ছে আমারও নেই | ঝগড়ুটে পাবলিক একটা | আমি প্ল্যানের কথা বলছি | কেমন হয় যদি আমি আর দিদি ঠাকুর দেখতে যাই , আর রাস্তায় তোমার আর অনিন্দদার সাথে দেখা হয়ে যায় ! তাহলে আবার ওরা একসাথে কিছুটা সময় পাবে |”
কথার এই প্রস্তাবটা মন্দ লাগলো না দীপের | আইডিয়াটা ভালোই |.. কিন্তু একটা চিন্তা মাথায় আসতেই ও বলে উঠলো , ” তবে এবার কিন্তু ওদের আর একা ছাড়া যাবে না | তাহলে প্রেমের বদলে মানবিকতাই হবে | লাভ স্টোরিটা এক ইঞ্চিও এগোবে না |”
এটা শুনে কথাও নাইন্টি ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘাড় হেলালো, ” একদমই তাই | আর একা ছাড়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না | এবার যা হবে আমাদের সামনেই হবে | নো মোর প্রাইভেসি .. ”
এইসবের পর সেইদিন বাড়ি ফিরেই কথা ড্রেসিং টেবিলের সামনে | ঠাকুর যখন দেখতে যাবে তখন সাজগোজটা তো মাস্ট | ভূমি যদিও তখনও খাটের এক কোণায় এলোমেলো চুলে একটা গল্পের বইকে সঙ্গী করে বসে ছিল | তবে বেশিক্ষন বসে থাকতে পারলো না | কথা হাত থেকে বই টা কেড়ে নিয়ে অর্ডার দিলো একটা , ” তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে | ঠাকুর দেখতে বেরোব | ষষ্ঠীর দিন কেউ কি বাড়িতে বসে থাকে না কি ?” …. ভূমিও আর বেশি প্রতিবাদ করলো না | মনটা সকাল থেকেই খারাপ | বুকের মধ্যে একটা পাথর যেন চেপে আছে | অনিন্দর সাথে আবার দেখা হওয়াটাকে কিছুতেই একসেপ্ট করতে পারছে না ও | তবে মন খারাপ কে সঙ্গী করে পুজোটা কাটিয়ে দিলে তো আর চলবে না | মন ভালো করার চেষ্টা ওকে করতেই হবে | তাই ঠাকুর দেখতে বেরোনোর আইডিয়াটা খারাপ না | এইসব ভাবতে ভাবতেই রেডি হওয়ার জন্য আলমারিটা খুললো | আর সামনে ঝোলানো নীল শাড়িটার দিকে ওর চোখটা আটকে গেলো | নীল রং অনিন্দর খুব পছন্দ ছিল | তাই একটা সময় মাঝে মাঝেই নিজেকে নীল রঙে সাজিয়ে নিতো ভূমি | তবে আজ না | অনিন্দ নেই , তাই অনিন্দর কোনো রং ও ওর জীবনে আর নেই | এটা ভেবেই পাশে ঝোলানো কালো শাড়িটা তুলে নিয়ে আলমারিটা বন্ধ করে দিলো ভূমি |
সেইদিন সকাল এগারোটার মধ্যে ওরা আখনবাজারে হাজির | এখান থেকেই ঠাকুর দেখা শুরু করা যাক | আর চুঁচুড়া মানেই তো আখনবাজারের পুজো আর তার সাবেকি প্রতিমা | এইসব ভাবনার ভিড়েই চারিদিকে ছড়ানো সোনালী রোদের দিকে মন চলে গেলো ভূমির | আজকের রোদটা একদম শরতের রোদ | এই রোদ দেখলেই মন ভালো হয়ে যায় |
এইসবের মধ্যে ওরা প্যান্ডেলে ঢুকতে যাবে তখনই হঠাৎ ভূমির পা টা থমকে গেলো | দূর থেকে সেই চেনা মুখটা এখন ওর দিকেই এগিয়ে আসছে | সঙ্গে আবার কালকের সেই ছেলেটা | কি যেন নাম বলেছিলো কথা ! হ্যাঁ , দীপ | কিন্তু এরা এখন এখানে কি করছে ? ভূমির পেছনে অনিন্দ কোনো গোয়েন্দা লাগিয়েছে না কি , যে ও যেখানেই যাচ্ছে অনিন্দ এই বন্ধু সমেত এসে হাজির হচ্ছে ওর সামনে ! এইসব ভাবনার ভিড়েই কথা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো |
” আরে তোমরা ? এখানে ? ”
এর উত্তরে দীপ বেশ হাসি মুখেই ওদের দিকে এগিয়ে এসে বললো , ” তোমরাও এখানে ঠাকুর দেখতে এসেছো ? হোয়াট এ কোইন্সিডেন্স ! খুব ভালো হলো তোমাদের সাথে দেখা হয়ে , নইলে আমি আর অনিন্দ তো একা একা বোর ই হচ্ছিলাম | এবার একসাথে ঠাকুর দেখা যাবে |” ….
দীপের এই অসাধারণ প্রস্তাব শুনে কথার মুখে এক চিলতে হাসি আসলেও ভূমির মুখ রাগে লাল | সব হয়েছে ওই মেয়েটার জন্য | কোথায় ওদের দেখে মুখ ঘুরিয়ে নেবে , তা না যেচে পরে ডাকছে | আর একটা দুদিনের আসা ছেলের সাথে কথার এতো বন্ধুত্বই বা কিসের যে একসাথে চার্চে ঘুরতে হবে , ঠাকুর দেখতে হবে ! কি অদ্ভুত | কিন্তু যা ই হয়ে যাক , আজ ভূমি কিছুতেই ওদের সঙ্গে ঘুরবে না | এই ভেবে কথাকে সাইডে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুব দৃঢ় গলায় বললো ., — ” দ্যাখ , তোর যদি ওদের সাথে ঘুরতে হয় ঘুরতে পারিস | আমি কিছুই বলবো না | কিন্তু আমি ওই অনিন্দর সঙ্গে কোনোভাবেই ঠাকুর দেখতে যেতে পারবো না | আমি বাড়ি চললাম |”
ভূমির এই রিয়্যাকশনের ব্যাপারে কথা আগে থেকেই জানতো , তাই কিছু ডায়লগ ওর রেডি করাই ছিল , এক্সপ্রেশন দিয়ে বলে ফেললো ,
” দেখ দিদি দীপ তোর আর অনিন্দদার ব্রেক আপের ব্যাপারে কিছুই জানে না | তুই যদি এইভাবে হঠাৎ চলে যাস তাহলে আমাকে হাজারটা প্রশ্ন করবে | আর অনিন্দদা তো এটা দেখে খুশিই হবে , যে ওর থাকা না থাকা তে তোর এখনো এতো যায় আসে | ও তোর লাইফে আজও এতটাই ইম্পর্টেন্ট যে তুই ঠাকুর না দেখে একা একা বাড়ি ফিরে যাচ্ছিস | তুই এটা করিস না , বরং একসাথে ঠাকুর দেখে এটা প্রুভ করে দে যে অনিন্দদা তোর লাইফে আর ম্যাটারই করে না | বুঝলি |” ..কথাটা বলেই কথা ভূমির হাতটাকে শক্ত করে ধরে এগিয়ে গেলো |
না, সেইদিন ভূমি বাড়ি ফিরে যায়নি আর | অনিন্দর থেকেও বেশি ও যেন নিজেই নিজের কাছেই প্রমান করতে চেয়েছিলো যে হারিয়ে যাওয়া ফেলে আসা সময় , আর এই পুরোনো মানুষটা ওর জীবনে আর কোথাও নেই | ওর থাকা না থাকতে ভূমির কিছুই যায় আসে না | তাই নির্বিকার মুখ করে হেঁটে যাচ্ছিলো | চারিদিকে ঢাকের আওয়াজ , মাইকের গান , প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ভিড় , এইসবের মধ্যে ভূমি নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চাইছিলো | তবে অনিন্দর মনে আজ যেন একটা খুশির রেশ | স্কুলে পড়ার সময় ও আর ভূমি সাইকেলে করে সারা চুঁচুড়া ঘুরে ঠাকুর দেখতো | তারপর মাঠের ধারের ফুচকা আইসক্রিম খেয়ে বাড়ি | এটা যেন ওদের একটা রুটিন হয়ে গিয়েছিলো | আজকে কতদিন বাদে আবার ওরা এক সঙ্গে ঠাকুর দেখছে ! যদিও সেদিনের ছবির সাথে আজকের ছবির কোনো মিল নেই , তা ও ! এক সাথে এই চেনা রাস্তাগুলোতে পা তো মেলাতে পারছে | কথা নয় না ই বা হলো ! এইসব ভাবনার ভিড়ে কথা হঠাৎ একটা আইসক্রিমের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো |
” পুজোর সময় ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে আইসক্রিম না খেলে ঠিক জমে না | বলো কে কোন ফ্লেভারের আইসক্রিম খাবে ?”
কথার এই প্রশ্ন শুনে আনমনে অনিন্দ হুট্ করে বলে ফেললো , ” ভূমির জন্য স্ট্রবেরি আইসক্রিম নে , ওর অন্য কোনো ফ্লেভার বেশি ভালো লাগে না !” ,,, এরপর সবাই এক সেকেন্ডের জন্য চুপ | কিন্তু কথা আর দীপের মুখে মুচকি হাসি | এই একটা মুহূর্তের জন্যই তো এতো প্ল্যানিং প্লটিং , একসঙ্গে ঠাকুর দেখতে আসা ! তবে অনিন্দর কথাটা বলে ফেলে ভয় লাগছে , ভূমির পছন্দের কথাটা এইভাবে সবার সামনে বলে দেয়াটা ঠিক হয়নি | এতে হয়তো ভূমি আরো রেগে গেলো ! আর এইসবের মধ্যে ভূমির মুখটা অন্ধকার | তবে সেটা রাগের জন্য না | অদ্ভুত একটা কষ্টের জন্য ! এখনো মনে রেখেছে অনিন্দ এতো পুরোনো কথা | তাহলে কি অনিন্দ সত্যিই কিছু ভোলেনি ! ওদের ছোট ছোট মুহূর্তগুলো , ওদের টুকরো টুকরো কথাগুলো ! আর ভূমি নিজেও কি কিছু ভুলতে পেরেছে ! এই কটা বছরে কারণে অকারণে ওর মাঝেই মাঝেই অনিন্দর কথা মনে পড়েছে , কতবার স্বপ্নে ভেসে উঠেছে ওই মুখটা | অনিন্দ ওর মনের মধ্যে আছে বলেই হয়তো এখনো নিজের ফোন থেকে ওর নাম্বারটা ডিলিট করতে পারেনি | পুরোনো মেলবক্স এ রাখা মেলসগুলোকে ডিলিট করতে পারেনি ! আজ হঠাৎ যেন ফেলে আসা সময়গুলো ভূমির চোখের সামনে এসে ভিড় করছে | অনেকদিন বাদে আজ আবার ইচ্ছে করছে অনিন্দর সাথে কথা বলতে | কিন্তু আজ হয়তো আর কোনো কথা বাকিই নেই | কারণ দুজনের মাঝখানে তৈরী হয়েছে একটা কাঁচের দেয়াল | যেই দেয়াল দিয়ে একে অপরকে পরিষ্কার দেখা গেলেও , ধরা ছোঁয়া যায় না | তাই আজও ওরা চুপ করেই কাটিয়ে দিলো দিনটা | চেনা রাস্তায় পাশাপাশি দুটো অচেনা মানুষ হয়ে হেঁটে আর একটা দিন পার করে দিলো |
তবে সন্ধ্যেবেলা পুজো মণ্ডপে কথা আর দীপের মুখ গম্ভীর | আজ ষষ্ঠীর দিনটাও শেষ হয়ে গেলো , তা ও কিছুই হলো না ভূমি অনিন্দর | ঝগড়া শেষ হওয়া তো দূরে থাক , দুটো লাইন অব্দি দুজনে দুজনকে বললো না | এই ভাবে চললে তো বছর পার হয়ে যাবে , কিন্তু গল্প এগোবে না !
” ধুর ধুর | এদের দ্বারা কিছু হবে না | আইসক্রিমের ফ্লেভার বলতে পারে , পাশাপাশি হেঁটে ঠাকুর দেখতে পারে , কিন্তু ঝগড়া মেটাতে পারে না ! ” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলো কথা |
কিন্তু দীপ চুপ | যেন গভীর ভাবনায় ডুবে আছে | এটা দেখে কথা আরও অধৈর্য্য হয়ে উঠলো , ” উফ, কিছু তো বলো | কি হবে এবার ? এদের সাইলেন্ট মোড কবে শেষ হবে ? কি করবো এবার ?”
দীপ এবার একটু বিজ্ঞের মতন মুখ করে বললো , ” এইভাবে হবে না | শক ট্রিটমেন্ট চাই | ”
” কি ? শক ট্রিটমেন্ট ! মানে ?”

<চলবে>
( গল্প ভালো লাগলে পেজটাকে লাইক করুন, আর শেয়ার করুন বন্ধুদের সাথে )

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে