শতরঞ্জির শত রঙ পর্ব-১+২

0
887

#গল্পের নাম: শতরঞ্জির শত রঙ
#পর্ব_১
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)

বড় খালার ওড়না চুড়ির অপবাদটা আমার ছোটো বোনের উপর পড়েছিল যখন ও সবে মাত্র ছয় বছরের। নানা নানী হজ্বে যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলেন তার সব ছেলে মেয়েরা যেন ঈদ এক সাথে তার বাড়িতে করে। সেই কথার রেশ ধরেই আমি, আমার মা এবং ছোটো বোন গেলাম নানা বাড়ি। ঝাঁ চকচকে বাড়ির গেট থেকেই আমার হীনমন্যতা শুরু হলো।সবার গায়ে দামী পোশাক আর আমাদের গায়ে নিম্নবিত্তের ছোঁয়া। বাড়ি ভিতরে প্রবেশ করে সবে মাত্র দাঁড়িয়েছি, বড় মামা তাগিদে দিলেন গরু কিনতে হাঁটে যেতে হবে। এমন একটা এলাহী কান্ড যেন আমাকে ছাড়া গরু কেনায় যাবে না।গরুর হাট থেকে ফেরার পথে সবাই রিক্সায় ফিরলেও আমাকে ফিরতে হলো পায়ে হেঁটে গরুর সাথে।তখন বয়স আর কত?সবে ক্লাস সিক্সে পড়ছি। গরুর সাথে আসার সময় জুতো গেল ছিড়ে।আমার জন্য কি গরু থামে?লজ্জায় জুতো হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।ফিরে দেখি বোনটা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কান্না করছে।বড় খালা গালে চড় মেরেছেন। বোন না কি তার সতেরো শত টাকার ওড়না চুরি করেছে।

শিথিলের কান্না থামানোর চেষ্টা না করে আম্মা তখন ব্যস্ত বোনের রাগ কমানোর চেষ্টায়।শেষ অবধি সিদ্ধান্ত হলো আমাদের ব্যাগ তল্লাসী করা হবে।হলোও তাই। ড্রয়িং রুম নামক সোফা ফালানো, টিভির ঘরটায় চার খালু,দুই মামা সমেত গোটা বিশ মানুষের সামনে আমাদের ব্যাগ তল্লাসী হলো।কিছুই পাওয়া গেল না। বড় খালা রাগে গজগজ করতে লাগলেন। সন্ধ্যের পর দেখা গেল তার বড় মেয়ে সেই ওড়না গায়ে বাড়িতে ঢুকছেন।ঘুরতে গিয়েছিল তারা।

মা কিছুই না বলে ব্যাগে কাপড় রাখলো।রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখতে পেলাম কাল ঈদের রান্নার সকল আয়োজন চলছে। মা ক্লান্ত শরীরে মশলা বাটছেন। ঘামে গা ভিজে উঠেছে। তবুও থামছেন না। মনের ভিতরে চাপা কষ্ট নিয়ে মায়ের কাছে বসে বললাম

“আমাদের এখানে আসা ঠিক হয়নি আম্মা।চলেন একটা বাহানা দিয়ে চলে যাই।”

“তোর খালার কথায় কিছুই মনে করিস না।বয়স হইতেছে তাই ওমন করে।”

মামার ডাকে কথা বাড়ানোর সময় পেলাম না।গরুকে খাবার দিতে হবে।আমি ছাড়া আর কে পারবে?বাকী সবাই তো শহরের।

রাতে খাওয়ার সময় চেয়ার টেবিল, সোফায় সবাই বসলো।জায়গা না থাকায় আমাদের দুই ভাই বোনকে নিচে বসতে বললেন বড় মামা।মামি তরকারি দিতে এসে আমার প্লেটে বেছে বেছে চার পাঁচ টুকরো আলু এবং একটা গলার হাড্ডি দিলেও বোনের প্লেটে কেবল ঝোল আর আলু পড়লো।ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে মেয়েটা তখন তাকিয়ে সমবয়সী খালাতো ভাইয়ের দিকে।যে মুরগীর রান চিবুচ্ছে। মা পাশে বসে সবটা দেখলেন।আমার প্লেট থেকে হাড্ডিটা তুলে বোনের প্লেটে দিতে দিতে আমাকে বললেন,

“আগামীকাল তুমি গরুর মাংস একটু বেশি খেও, আজ বোনকে দাও। তরকারি মনে হয় শেষ তো।কত মানুষ।”

অথচ আমি দিব্যি দেখলাম তরকারির বাটি হাতে মামি তার নিজ ছেলে মেয়েকে জোর করে মাংস তুলে দিচ্ছে।

#চলবে

#শতরঞ্জির_শত_রঙ
#পর্ব-২
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)

আমাদের জীবনে সেই ঈদের দিনটা না এলেই পারতো।অথচ এলো। ভোরবেলা ফজরের নামাজের আগেই আমাকে ডেকে তুলেছিল।কারণ গরুকে খাবার দিতে হবে। সারা রাত কিছু সময় পর পর উঠতে হয়েছে গরুর দেখাশোনা করার জন্য। সবার ধারণা আমি গ্রামের ছেলে গরু বাছুরে ভয় নেই।কিন্তু আমার মা জানতো আমি এসবে ভয় পাই।আমাদের গরু নেই, তাই কীভাবে যত্ন নিতে হয় তাও তখন অজানা।মা ঘুমিয়েছিল সেঝ খালার ঘরে। এই বাড়িতে সবার জন্য আলাদা ঘর বরাদ্দ আছে।আমাদের জন্যও আছে কিন্তু সেই ঘরে থাকছে বড় খালার মেয়ে এবং মেয়ের জামাই।নামাজে যাওয়ার আগে ছোটো মামা সবাইকে সালামী দিলেন। আমি আর শিথিল ও পেয়েছিলাম সমান অধিকার। একমাত্র ছোটো মামা ছিল আমাদের প্রতি সদয়। কিন্তু তার নিজেরো তেমন আয় রুজি নেই বলে পরিবারে কথা তেমন গ্রাহ্য ছিল না।ঈদের সেমাই খেয়ে নামাজে যাওয়ার আগে দেখলাম বড় মামা মায়ের সাথে রাগারাগি করছে।কেন বাবা আসেনি? মা তার ভাইকে বুঝ দিতে চেষ্টা করলেন,বাড়ি ঘর ফেলে সবাই তো আসা যায় না। বড় মামার হয়ে উত্তর দিলেন বড় খালু।স্পষ্ট খোঁচা মেরে বললেন বাড়িতে কি রত্ন পাহাড়া দিচ্ছে যে আসতে পারছে না?

মা কল দিয়ে বাবাকে জোর দিয়ে বললে বাবা এলো। তখন বাড়ির বাকী জামাইয়েরা নামাজ পড়ে ফিরেছে।বাবাকে যেন কেউ চোখেই দেখলো না। নাম মাত্র ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে বাবা বেরিয়ে এলো শিথিলের হাত ধরে। গরুর কাছে হুজুর চলে এসেছে। বাবাকে কল দিয়ে আনার কারণটা তখন বুঝলাম।তারা শহুরে মানুষ, গোস্ত কাটাকাটি তারা পারবে না।বাবা পুরো গরুর মাংস, ভূরি, পা সব ঠিক করে দিলেন।দুপুর বেলা মাংস বানানোর সময় বাকীরা যখন ফ্যানের নিচে বসে ক্লান্ত হয়ে সেভেন আপে চুমুক দিচ্ছে, বাবা তখন হাড় কাটতে গিয়ে হাতে ব্যথা পেলেন। জীবনে প্রথম সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম ‘ সমাজে কে কেমন ভালো মানুষ তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে টাকা।”

মাংস বানানো হলে বাবাকে আর কেউ কিছুই বলছিল না।আমি মায়ের কাছে গিয়ে বললাম,
“আম্মা? আব্বাকে খেতে দিবেন না?সেই সকালবেলা থেকে না খেয়ে কাজ করছে।”

আম্মার অসহায় দৃষ্টি আমি আজ অবধি ভুলিনি।সে বড় মামির কাছে দাঁড়িয়ে কিছু বলল।আমি মুখে আকাশ সমান বিরক্তি নিয়ে ফ্রিজ থেকে সেমাই বের করে টেবিলে রেখে বলল,

“ওখানে মুড়ি আছে।মুড়ি দিয়ে সেমাই দিয়ে খেতে দাও।”

কিন্তু বাবা খায়নি।বাড়ি খালি বাহানায় চলে গেলেন। মাংসের গন্ধে তখন পুরো বাড়িতে উৎসবের আমেজ।অথচ আমার বাবা এক টুকরো মাংসও খেতে পেল না।এবার আর যাওয়ার সময় কেউ আটকালো না।কেউ বলল না বাড়িতে কোনো মণি মুক্তো পাহাড়া দিতেই হবে।আমার নিন্মবিত্ত বাবা এক জোড়া চটি এবং সদাইয়ের ব্যাগ হাতে বেরিয়ে গেল।ভাগ্যিস সেদিন বাবার ব্যাগটা তল্লাশি করেনি তারা। তাহলে হয়তো দেখতে পেতো দুদিন থাকবে বলে কাপড় নিয়ে এসেছিল সে।

কষানো মাংস যখন সবার প্লেটে পড়ছে তখন আমরা সবাই একত্রে টিভি দেখছিলাম। সবার কোলেই প্লেট এলো কেবল কোনো দৈব কারণে আমি আর আমার বোন কারোর চোখে পড়লাম না। বড় খালার মেয়ের জামাই বিষয়টা আন্দাজ করে আমাদের দুই ভাই বোনকে কাছে ডাকলেন।দুই জনকে নিজের প্লেট থেকে মাংস তুলে দিলেন।রাতে বোন খাওয়ার বায়না ধরলে বড় মামি দুটো তেলের টুকরা আর একটা গোস্তের টুকরো দিলো।কিন্তু বোনের বায়না ছিল সে হাড় খাবে। নিরুপায় মা কেবল অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল এঁটো খাবারের দিকে।সেখানে কত অপচয়।

আজ এত বছর পর এসে আমার মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দেয়। আচ্ছা? মা ওই কয়েকদিন কি সত্যি সেইসব খাবার ভাগে পেয়েছিল?না কি সেও আমাদের মতো প্রায় অভুক্ত ছিল?

#চলবে

(এডিট ছাড়া।পেজে একদম রিচ নেই।তাই রেসপন্স করবেন। )

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে