রিয়া খাতুন – প্রিয় সর্বদৃষ্টির পতিতগণ,,

0
433

#গল্পপোকা_চিঠি_প্রতিযোগিতা_২০২০
চিঠি নং – ৩
কলমে – রিয়া খাতুন

প্রিয় সর্বদৃষ্টির পতিতগণ,,
কি বলবো আর কিভাবে শুরু করবো: অবগত নয়।‌ তবে কলমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং কালি ভর্তি করার উদ্দেশ্যে আমাকেতো বলতেই হবে। হ্যাঁ বলতে হবে তোমাদের উদ্দেশ্যে। লেখনী ক্ষুরধারের তাগিদে একপ্রকার…

প্রতিদিন মা যখন রন্ধনশালায় যায় তখন আমি মায়ের ঠিক পাশে বসেই দেখি মা কতটা কষ্টে, ঘর্মমাখা দেহে রান্না করে যাচ্ছে। সময় মতোই খাবার জুগিয়ে চলেছে। দিন- রাতের চক্রাকারে মায়ের পরিশ্রম যেন এক অনাহুত অগ্নিতে বারংবার ঘৃতাহুতি দেওয়ার ন্যায়। চার দেওয়ালের গন্ডীবদ্ধের আবদ্ধতায় স্পর্শ করতে পারিনি তমালির যন্ত্রনার প্রলেপ। ‌সবাই তাকে বারবনিতা বললেও শুধু ভাবতাম এর অর্থ বোধহয় বড্ড দুস্কর। তাই হয়তো সকলেই এই নামটায় টান বসাতে পারে।। সকলেই যোগবিয়োগ আর ভাগের বুলি আওড়াতে পারে।
পরিশ্রম ও উপহাস এবং পরিস্থিতি ও উপমা দুইটিকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই এক বিষাদের ছাঁয়ায় কিরনমালা চুম্বন করলো। রাত্রি ঘনীভূত মেঘের একজোটের সমাহার রূপ যেন এলোমেলো চুলগুলোকে কিছু আড়াল করছে। হঠাৎ করেই সেইদিন আমার চোখে পড়ে গেল রাজুকে নিয়ে কোলাহল‌। চোর অপরাধে তাকে খুন করা হয়েছে। বারংবার প্রশ্ন জাগছিল শীতের জঠরে মধ্যরাতে চুপিসারে মধু এবং গুড় বিক্রি করে উপার্জনকে কি চোর বলে! প্রকৃতি যদি তাকে চোর বলে উপাধি দেয় তাহলে মানুষতো দেবেই। কারোর দাখিলে না থাকা সত্ত্বেও যদি ধরিত্রীর বুকে দাঁড়িয়ে থাকা গাছদের মানুষ আশ্রয় করে জীবিকার পথ বাছে তাহলে হয়তো তাকে চোর বলে! বারংবার জীবন যেন সংজ্ঞাকে উপসংজ্ঞায় পরিণত করছে। হয়তো সৃষ্টিকর্তা সব কিছুই জোড়ার জোড়া বানিয়ে রেখেছে।

মায়ের আঁচলে মুখ নামিয়ে ভাবছিলাম তমালির কথা।
“কি রে রিয়া মায়ের আঁচলে মুখ লুকাচ্ছিস! আজ আমার মা নেই বলে নাহলে আমিও তোকে ধরা দিতাম না।” প্রতিটা কথা এখনো ভাসে। সেইদিন এক পড়ন্ত বিকাল থেমেছিল আমার সামনে। বুঝতে পারলাম জীবনে তিনি পরিস্থিতি কিছুটা অদ্ভূত করেছেন বোধহয়! তমালির হাতটা মুঠোয় নিয়ে মায়ের আঁচলে চাপা দিয়েছিলাম তবে পারলাম কোথায় সারাজীবন অনাথিনীর সহায় হতে!

বরাবরের মতো যখন কলেজে যেতাম তখন দেখতাম পথের পাশে কিছু অবলা প্রাণী বসে আছে। কোন পশুর সঙ্গে না তুলনা করলেও তারাও ভোগের স্বীকার অথবা পাশবিকতার খেলায় নিয়ন্ত্রিত। নিজেকে তাদের জায়গায় ফেলতে ইচ্ছা করতো আর মানুষকে কণ্ঠ ভেদ করে এটাই বলতে ইচ্ছা করত,, উপহাস যদি বিজীতের আশ্রয় হয় তাহলে সহায়ও থাকা উচিত তাদের আহ্বায়। উপহাস তারায় করতে পারে যারা যথেষ্ট প্রাপ্যতার অধিকারী। তাহলে বলতে গেলে ঈশ্বর সহায়ের মাধ্যমে উপহাসের যোগ্য করে। আর যোগ্যকারীরা আবার তৈরি করে উপহাসের পঙ্ক্তিমালা ; হাস্যকর!

চিঠির পাতায় ঘোর নেশা পুঞ্জীভূত হয়েছে। চোখটা যেন ইচ্ছা করে ঘুমের রাশকে শক্ত করছেনা!
“তুই অনেক পড়াশোনা করবি আর আমাকেতো বোধহয় কাজ করেই খেতে হবে রে। মামি আমাকে খুব কষ্ট দেয়। খুব পড়তে ইচ্ছা করে। মাধ্যমিকে লেটার পেয়েছিলাম তাতে আরও পড়ার নেশা বেড়ে গেল তবে জানি আমার পাঠ চুকছে। কয়দিন পর আমার বিয়ে। আচ্ছা রিয়া, বর পড়ালেখা করতে দেবে আমাকে!” তমালিকার হিসাবটা মেলাতে পারলামনা । হয়তো অভাগীরা পরিস্থিতির হিসাবে অথবা পুরুষদের ভাগ-বাটোয়ারার হিসাবে পরিণত হতে হয় বারবনিতায়। তাইতো আজ সে স্থান পেয়েছে বারখানায়।
আমার লেখা চিঠিটা বোধহয় কারোর উন্মেষনাকে উন্মোচিত করবেনা। না পরবে কোন ডাকবক্সে। তবে চিঠির ভাঁজে খাপে খাপে লেখাগুলো হয়তো চাইলেও মিথ্যা হতে পারবেনা। সত্য যদি সুন্দরের জন্য হয় তাহলে তার কোন পিওন লাগেনা আর না লাগে কোন প্রাপক।।

” ‘প্রহসন’ পতিতাদের সৃষ্টক সমাজ।
যাহাদের সংশোধন করিতে নরকূল নারাজ।।”

এই দুই লাইন তৈরি করেছি নিজ অন্তরে। যা প্রকাশে মূল্যহীন তা হৃদয়ে অমলীন। বারখানায় যেদিন তমালিকে প্রথম দেখেছিলাম আর কয়েকজনের মত ধারনা হয়নি কেন আজ চৌরাস্তায় কেন আজ এই অবস্থা! শুধু ভাবছিলাম সেদিন যদি বিয়ের বলিদানে ভাসতে না দিতাম তাহলে হয়তো দুই মুঠো অন্নের জন্য আজ রাস্তায় নামতে হতনা। তাহলে কি পরিশ্রম একবার নোংরামীর উপহাস! কেন কেউ বোঝেনা এই পথটা ছাড়া আর কোন আশ্রয় ছিলনা এই আশ্রয় না থাকলে হয়তো প্রাণটা থাকতোনা। সবাই ইতিহাস রচনা করে তবের ইতি – হাস এই বিশ্লেষণতা কেন কেউ বোঝেনা! আমি আর কি করবো,, আমার দ্বারা যদি সমাজের এই ময়লাগুলোকে স্যানিটাইজ করতে বলা হত তাহলে অন্তত দৃষ্টান্ত হিসাবে না থাকলেও দায়িত্ব পালনে অটুট থাকতাম।

কিছু সময় পর নূতন পঙক্তিমালায় নবপ্রভার সূচনা হবে। প্রতিদিন নতুনের শুভারম্ভ হয়‌ ভিড় জমে সেই পতিতালয়ে। রাজুর মতো প্রায়শই মরছে আর রাতের ঘন আঁধার বারবার তাই প্রমান করছে। চন্দ্রিমাকে ঢেকে দেওয়ার মতো কোন রোদেলা তেজ আসেনি, এসেছে একরাশ মেঘবদ্ধ; সমাহার।

প্রতিটাক্ষন মাকে দেখতে দেখতে পরিস্থিতি যেন সাবলীলতায় আকর্ষন করে। সত্যিই এই পরিশ্রম মায়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েক মা-বোনের প্রতি দ্যাখা যেত তাহলে…….
‘বারবনিতা’ বলে ভনিতা সৃষ্টকদের শুধু বলব তাদের এই বারবনিতার মূল উচ্চারণ হলো ‘বারভনিতা’।তারা ভনিতা করে তারা নোংরামীকে শ্রেয়তায় আনে তবে কোনদিনও বোঝেনা এই ভনিতা কি সত্যিই বারবনিতার অর্থে পড়ে! ছোট্ট ছোট্ট জোৎস্নার আলোয় অন্ধকার নামা অনাথগন, শত রাজুর দল শত পরিশ্রমী হয়েও কিছু পাশবিকদের কবলে নিজের জীবনটা শহিদের খাতায় লেখাতোনা!
অবমাননা যদি আমাদের রক্তের দোষ হয়, ভোগ যদি মনের ফুর্তি পূরণ করে, উপহাস যদি অবহেলায় পতিত করে তাহলে হয়তো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। তবে পরিস্থিতিকে নিজেরা নিয়ন্ত্রন করি তাহলে প্রতিটা পদক্ষেপ অতিক্রম করা সম্ভব।।

পারিনা এই কলমকে ক্ষুরধার করে এক নূতন পরিস্থিতিকে পরিস্থিতিতে আনতে?? পরিশ্রমকে উপহাস করে পরিস্থিতিকে উপমা করে গড়ে তোলাটা কি নিতান্তই সহজ মনে হয়?? তাহলে যাদেরকে নিয়ে এতটা সময় বের করে এইসব উপমা আনি তাহলে সেই সময়টাকে উপমেয়দের কথা একটু ভাবতে পারিনা!

ইতি-
তোমাদের চিন্তারোহী রিয়া

ভারতবর্ষ, পশ্চিমবঙ্গ
১৪.৮.২০২০

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে