#রাঙাবউ
অলিন্দ্রিয়া রুহি
পর্ব-০৪
ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে দক্ষিণ দিক দিয়ে। ঘরের দরজা খুলে আবছা আলোয় একটা বই পড়ছে প্রভা। উপন্যাসের বই, কাহিনীটা খুব সুন্দর। একটা ছেলে আর একটা মেয়ের ভালোবাসার গল্প। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে প্রভার জীবনে এখন পর্যন্ত ভালোবাসার পাখিটি উড়ে আসেনি। তাই এর অনুভূতি কী,সে বোঝে না তবে বোঝার চেষ্টা করে প্রতি মুহূর্তেই। মাঝে মাঝে নিকষ কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে,তার জীবনেও কেউ এলে খুব একটা মন্দ হতো না! গায়ের রংটা একটু চাপা, এটা ঠিক- কিন্তু মায়াময় একটা ভাব তো রয়েছে। এলাকার সবাই বলে,প্রভা সুন্দর। ওর ফেস কাটিং সুন্দর, এমনকী অনেক ফর্সা মেয়েদের মাঝে দাঁড়ালেও ও’কে আগে চোখে পড়ে। তবুও কোনো ছেলে আজ পর্যন্ত প্রভাকে ভালোবাসার বাক্য শোনায়নি। হতে পারে, ফর্সা চামড়ার গুরুত্বই বেশি! প্রভা এসব ভাবে,দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বই পড়ায় মনোযোগ দিলো। সেও প্রেম করবে একদিন, হতে পারে সেটা তার স্বামীর সঙ্গে! কিন্তু করবেই! প্রভার মন হুট করেই ভালো হয়ে গেল। ঠোঁটের কোণায় একটা নাই নাই হাসি। এমন সময়ে প্রভার মা ডাক দিলেন ভেতর থেকে,
-কীরে প্রভা,পড়া হয় নাই? খাইতে আয়।
প্রভা মৃদু শ্বাস ফেলে বই বন্ধ করে। উত্তর দেয়,
-আসতাছি…
ঘরের দুয়ার বন্ধ করে ভেতরে এগিয়ে যায় প্রভা। এই বাড়িটি ভাগ্যক্রমে তার বাবার সঞ্চয়ের বাড়ি। এছাড়া তাদের কাছে সম্পদ বলতে আর কিছুই নেই। বাড়ির অবস্থা যদিও খুব একটা ভালো না,তবুও দুই মা-মেয়ের দিব্যি চলে যায়। অন্তত মাস শেষে ঘর ভাড়া থেকে তো বাঁচা যায়! আজকাল বাসা ভাড়ার যে অবস্থা! আয়ের অর্ধেকের বেশিটাই চলে যায় ভাড়ার পেছনে, বাকীসবের কথা তোলাই থাক! প্রভার বাবা মারা যান খুব ছোট বেলায়। রেল লাইনে কাজ করতেন তিনি। সেই রেল লাইন-ই তার জীবন কেড়ে নিয়েছিল। তারপর থেকে প্রভা তার মায়ের ছত্রছায়ায় বড় হয়েছে। প্রভার মায়ের নাম পলি। পলির ভাইয়েরা তাকে পুনরায় বিয়ে দিতে চাইলেও সে রাজী হয়নি মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। সেই থেকে ভাইদের সাথেও সম্পর্ক ততটা ভালো না। পলি অবশ্য কারো ঘাড়েই বোঝা হয়ে থাকেনি। স্বামীর বানানো ছোট্ট টিনের ঘরেই মেয়েকে নিয়ে থেকেছে, সুখ-দুঃখের সময় কাটিয়েছি। বর্তমানে একটা নামী-দামী হাসপাতালে আয়ার চাকরি করে সে। মাস শেষে যা পায়, তাই দিয়ে দুই মা-মেয়ের চলে যায়। কিছু টাকা তিনি সঞ্চয়ও করছেন। একদিন না একদিন মেয়ের বিয়ে দিতে হবে যে! মেয়ে তো বড় হচ্ছে!
খেতে খেতে প্রভা বলল,
-মা, একটা টিউশনি পাইছি। হাসমত চাচার ছোট মেয়েটাকে পড়ানোর কথা বলছিল আমাকে। মাস শেষে এক হাজার দিবে। আমি বলছি, আগে মায়ের সাথে কথা বইলা নেই। তারপর জানাবো। তুমি কী বলো?
পলি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,
-তোর সব খরচ চালাইতে আমার তো এত কষ্ট হইতাছে না। তাইলে তুই শুধু শুধু এসব নিয়া মাথা ঘামাইস না। মন দিয়া পড় মা। আর কয়ডা ক্লাস… এরপর একটা ভালো জায়গায় তোর বিয়া টা দিতে পারলেই আমার দায়িত্ব শেষ।
প্রভা কাটকাট করে বলে,
-আগে আমি চাকরি করব মা,তারপর ওসব নিয়ে ভাবব। এত কষ্ট করে পড়তেছি কী রান্নাঘরের চুলা সামলানোর জন্য?
-মাইয়া মানুষ যতই পড়ালেখা করুক না ক্যান,তার কিন্তু রান্না কইরাই খাইতে হয়। আর শোন, যে রাঁধে হেয় কিন্তু চুলও বাঁধে।
-অস্বীকার তো করি নাই, কিন্তু আগে একটা চাকরি মা, তারপর না হয়…
-হইছে, খাওয়ানের সময় এত কথা কওন ভালো না। আগে পড়ালেখা শেষ কর, তারপর দেখা যাইবো। ভাগ্যে যা আছে,তাই হইবো।
প্রভা চুপ করে গেল। বাকীটা সময় গ্লাস-বাটির টুংটাং আওয়াজ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ হলো না।
প্রভাদের বাড়িতে দুটি রুম। একটিতে মা-মেয়ে থাকে,অন্য রুমটি তারা খাওয়া দাওয়ার জন্য বরাদ্দ করে রেখেছে। পলির ইচ্ছে আছে,প্রভার জামাইকে এই জায়গাটুকু দিয়ে বলবে, তোমরা তোমাগো পছন্দ মতো ঘরবাড়ি তুইলা লও। সামনে মাটির চুলার রান্নাঘরের জায়গাটুকুও নিয়া লও। এতে ভালো বড় বাড়ি হইবো।
তবে মাঝে মাঝে ভয় হয় কিঞ্চিৎ, কেমন না কেমন জামাই জোটে কে জানে! পরে যদি পলিকে না দেখে, তবে শেষ বয়সে কোথায় আশ্রয় হবে তার! পলি নিজেকে আশ্বস্ত করে, প্রভা তো তারই মেয়ে। জামাই ফেলতে পারলেও মেয়ে কী তাকে ফেলতে পারবে?
প্রভা চটজলদি বিছানা গুছিয়ে নিলো। আগামীকাল একটা গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা আছে ভার্সিটিতে। সে এইবার ভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। পড়াশোনা এবং ক্যারিয়ার ছাড়া আপাতত কোনো বাড়তি চিন্তা নেই তার মাথায়। তবুও মাঝে মাঝে একাকী জীবনের কথা ভেবে একটা বিষন্নতা ভর করে তার মধ্যে৷ তবে তা খুবই ক্ষীণ সময়ের জন্য..
পলি, প্রভা শুয়ে পড়েছে। ঘরের বাতি নেভানো। বাহিরে একটুখানি উঠান, উঠানের চারপাশে আরও অনেকের বাড়ি রয়েছে। সবারই টিনের ঘর, ঢাকার ভেতর হলেও দেখতে অনেকটা গ্রামীণ পরিবেশ। সবাই মিলে উঠানে বড় হ্যাজাক বাতি লাগিয়েছে সারারাত জ্বলে থাকার জন্য৷ যাতে কেউ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে বেরোলো তার সমস্যা না হয় কোনো। সেই হ্যাজাক বাতির মৃদু আলো এসে খেলা করছে দুয়ারের কাছটায়। প্রভা সেদিকে এক মনে চেয়ে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে গেল। ঘুমটা গাঢ় হবে হবে, ঠিক এমন সময় শোনা গেল দরজায় ঠকঠক শব্দ! প্রভার কপালে ভাঁজ সৃষ্টি হয়। এত রাতে কে! সে চোখ মেলার পূর্বেই শুনতে পেল পলির গলা,
-এই প্রভা,প্রভারে,কে যেন দরজায়..
প্রভা চোখে মুখে বিরক্তি ফুঁটিয়ে তাকাল। বলল,
-তুমি দেখো কে..
পলি সাহস নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মা-মেয়ে একা থাকে বলে অনেক সময়ে অনেক কিছুই হয়ে যেতে পারে। যদিও আশেপাশে যারা থাকে,তারা সবাই খুব ভালো। খুব সহযোগিতা করে যেকোনো কাজে। তবুও ভয় কী আর কমে! পলি উঁচু গলায় হাঁক ছেড়ে প্রশ্ন করে,
-কে? কে ওখানে?
দরজার ওপাশ থেকে একটা চাপাস্বর ভেসে এলো। কণ্ঠটি চেনা পরিচিত কারোর এবং একটি মেয়ে কণ্ঠ। পলি দ্রুত দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে ভেতরে প্রবেশ করল মিঠি। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত মিঠিকে দেখে মা-মেয়ে চমকে উঠল। প্রভা ততক্ষণে বিছানা ছেড়েছে। চাপাস্বরে বিস্ময় নিয়ে বলল,
-তুই!!
____
-আমি আগেই বলছিলাম এসবের দরকার নাই। কিন্তু আমার কথা তো শুনবি না তোরা। একেকটা হইছিস তো পশুর মতো। মেয়ে দেখলে আর মাথা ঠিক থাকে না। এখন কোন কেসে ফাঁসবো কে জানে! এই বিপদ থেকে কেমনে উদ্ধার হবো.. আল্লাহ রে..
সজলের আক্রোশ ভরা কথা শুনে বাদলের মেজাজ তুঙ্গে উঠল। সে প্রতিবাদের গলায় বলল,
-আমরা পশু,আর তুই কী? ভালো? তুই একটা মেয়েকে ভালোবেসে মাঝপথে ছেড়ে দিছোস আর ভালো মানুষি দেখাস এখন?
-আমি তো জাস্ট ব্রেকাপ করছি। মেয়েটার সর্বনাশ করতে চাইনি। আর না মেরে ফেলতে চাইছি!! তার উপর ও বিবাহিত।
-বিবাহিত! বিবাহিত মানে কী? তুই আমাদের তো এটা বলিস নাই।
-আমার ইচ্ছে হয় নাই তাই বলি নাই।
সজল থুতু ছুঁড়ে মারে। গটগট পায়ে একবার এদিক হাঁটে,একবার ওদিক- আশেপাশে তীক্ষ্ণ চোখ বুলায়। কেউ তাদের দেখেছে কীনা কে জানে! বাদল কতক্ষণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। মিঠি যে বিবাহিত সে জানত না। শুধু জানত সজলের টানে এতদূর এসেছে। এখন ওর বিবাহিত স্বামী যদি ওকে খুঁজে না পেয়ে একটা কেস টেস করে দেয়, তাহলে নির্ঘাত আজ হোক বা কাল, একে একে এরা চারজনেই ফাঁসবে। যেখানে ফাঁসার কথা ছিল শুধু সজলের সেখানে নিজেই নিজেকে জড়ালো সে! ভাবতেই বাদলের মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে নিজেকে কষিয়ে কয়েকটি গালি দিলো। ঠোঁট ভর্তি থুতু ফেলে সজলের দিকে তাকাল। এরই ভেতর খেয়াল হলো, এখানে তারা দু’জন বাদে আর কেউ নেই। কোন ফাঁকে কোন দিক দিয়ে অভি,তমাল জায়গা ছেড়েছে,তা বাদল একদম টের পায়নি! বাদল অস্ফুটস্বরে ডাকল,
-এই সজল।
-কী?
সজলের ত্যাড়া গলায় বলল। বাদল এবার আর রাগ দেখালো না বরং নরম গলায় জবাব দেয়,
-অভি, তমাল ভাগছে।
সজল চমকালো না। ওদেরকে সরে যেতে দেখেছে যখন তারা দু’জনে তর্ক করছিল তখনই। কিন্তু সজল তাদের বাঁধা দেয়নি। যাক, যতই মানুষ কমবে, ততই ভালো।
সজল বলল,
-এবার বুঝ কাদের কে নিয়ে তুই আমাকে আশ্বাস দিচ্ছিলি! আমি আগেই বুঝেছিলাম, একটা না একটা বিপদ আসবে। তাই বারবার মানা করছিলাম, কিন্তু তুই তো..
-দেখ, যা হওয়ার হইছে। এখন কী করব তাই বল। একটা বুদ্ধি দে প্লিজ..
বাদল এগিয়ে এসে সজলের মুখোমুখি হয়। তার কাঁদো কাঁদো গলার স্বর সজলকে পৈশাচিক সুখ দিলো। সজল কিছুটা সময় ভাবল তারপর বলল,
-ওর লাশটাকে খালের কিনারায় নিয়ে রেখে আসি। ওখানে কেউ যায় না। আর রাতের বেলা শিয়াল ওদিক দিয়ে হাঁটে কিন্তু৷এই লাশের ছিঁটেফোঁটাও থাকবে না সকাল অবধি। এরচেয়ে ভালো কিছু আপাতত আমার মাথায় আসছে না।
বাদল রাজী হলো। সজলের কথায় ঠিক, শিয়াল মানুষের শরীর এমনিতেই ভীষণ পছন্দ করে। রাতের অন্ধকারে ওরা কবর খুঁড়ে খুঁড়ে মৃত মানুষ বের করে আনে। আর আজ সেখানে জঙ্গলেই পেয়ে যাবে এত বড় দেহটা! হাড্ডি গুলোও থাকবে কীনা সন্দেহ! যদি লাশটাই না থাকে তবে আর কী দিয়ে হবে তল্লাশী? আর কীভাবেই বা খুঁজে বের করবে তাদের? বাদল মনে মনে একটু শান্তি পেল। সজলের সঙ্গে হাত লাগালো মিঠিকে তুলে নিতে। বাদল ধরল পা,সজল মাথার জায়গাটা। তারপর তুলে নিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটতেই পেয়ে গেল বড় খাল। এই খাল গিয়ে বড় নদীতে মিশেছে৷
খালের পাশে মিঠিকে শুইয়ে উপরে কিছু পাতা ফেলে দিলো সজল। মিঠিকে ঢাকবার ব্যর্থ চেষ্টা। বাদল আর হাত লাগালো না। ভীষণ গা ছমছমে জায়গা। এই ভর দুপুরেও এত নিস্তব্ধতা যে বাদলের গা শিউরে উঠছে বারবার। আশপাশে নজর রাখছে সে,কেউ যাতে না দেখে ফেলে কোনোভাবেই!!
মিঠিকে ঢাকা শেষে সজল থম ধরে বসে রইলো। তারপর হুট করেই মিঠিকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কান্নারত গলায় বলল,
-আমাকে মাফ করে দিও মিঠি। আমাকে মাফ করে দিও তুমি। আমি এরকমটা চাইনি। আমি তোমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম কিন্তু…
কতক মিনিট কান্নাকাটি করে সজল উঠে আসে। বাদলের সাহস হয় না সজলের দিকে তাকানোর। চোখের পলকে এতবড় অন্যায় করে বসবে কে জানত! বাড়ি ফিরে এলেও সারা দিন গুমোট হয়ে রইলো বাদল। খুব চিন্তা হতে লাগল নিজেকে নিয়ে। যদি ফেঁসে যায়! যদি এই সত্য সামনে চলে আসে কোনোভাবে! তখন.. তখন কী হবে! নিজেকে কোনোভাবেই স্থির রাখতে না পেরে রাতের অন্ধকারে টর্চ হাতে বেরিয়ে পড়ল সে। উদ্দেশ্য খালপাড়। জঙ্গলে ঢুকে হাতে বড় মোটা লাঠিও নিয়ে নিলো। যদি শিয়ালে আক্রমণ করে বসে তবে আত্মরক্ষার জন্যে। খাল পাড়ের যেখানে মিঠির লাশ ফেলে এসেছিল তারা,সেখানে গিয়ে চমকে গেল বাদল। সেই সঙ্গে ঠোঁটে হাসিও ফুঁটে উঠল। এখানে কোনো লাশই নেই। এমনকি, কোনো লাশ যে ছিল,তার চিহ্নটা পর্যন্ত নেই। নিশ্চয়ই সজলের কথামতো এতক্ষণে মিঠি চলে গেছে শিয়ালের পেটে। সেই সাথে বাদলের চিন্তাগুলোকেও নিয়ে গেল…
বোকা বাদল একদম বুঝলো না, মিঠির শরীর খেলে আশেপাশে রক্তের একটু চিহ্ন তো থাকত! তাও বা নেই কেন? ফুরফুরে ও চিন্তামুক্ত মেজাজ নিয়ে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে বাদল বেরিয়ে এলো জঙ্গল থেকে..
(চলবে)