রঙিন খামে বিষাদের চিঠি পর্ব-২৭+২৮

0
489

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ২৭
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৬৫,
বুধবার দিন সকালবেলায়। বাড়িতে হইচইয়ের আভাস পেয়ে চোখ ডলতে ডলতে রুমের বাইরে আসলো রিয়ানা। রুমের সামনেই রিফা, রোজা, অন্তি, আয়াতকে গোল হয়ে দাড়িয়ে কিছু একটা নিয়ে তর্কাতর্কি করতে দেখে সে আয়াতের পাশে এসে দাড়ালো। ওদের কথা শুনে জোড়ে আওয়াজ করে বললো,

“তোমরা কি নিয়ে আলোচনা করছো? কি হবে না না করছো? আবার একজন বলছো হবে? হয়েছে কি ক্লিয়ার করবে কেউ?”

আয়াত বোনকে খেয়াল করে বললো,

“আরে দেখ না রিয়ু, এরা আগামীকাল হলুদ মাখাবে বলে জিদ করছে। আমি না বলছি। শুনছে না।”

রিয়ানা আয়াতের কথার জবাবে বললো,

“সেসব নিয়ে আলোচনা করার অনেক জায়গা আছে। আমার রুমের সামনে কেন! ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছো সবাই।”

রিয়ানার কথায় সবার মুখ থমথমে হয়ে গেলো। রিফা হতচকিত হয়ে তোতলানো স্বরে বললো,

“আরে তুমি আয়াতের ছোটো বোন। তুমি বললে, আয়াত ঠিকি মেনে নিবে। এজন্য টেনে আনলাম। আর তুমি এত কাঠখোট্টা টাইপ কেন বলো তো? বোনের বিয়ে। একটুও আনন্দ নেই তোমার মাঝে।”

“আমার মাঝে আনন্দ আসবেও না। আমার বোনের বিয়ে হবে। মাথার উপর মায়ের ছায়ার মতো বোনের ছায়া হারাবে। অগোছালো আমি-টাকে কেউ গোঁছানোর চেষ্টা করবে না। আমি কি করে আনন্দ করবো?”

রিয়ানা কথা-টা বলে-ই রুমে চলে যায়। উদ্দেশ্য ফ্রেশ হওয়া। ঘুম হওয়ার আগে-ই ঘুম ভাঙায় মাথা-টা ব্যথায় ফেঁটে যাবার যোগার হলো তার। রিয়ানার প্রস্থানে অন্তি তেতেপুড়ে বলে উঠলো,

“এমনি কি এই মেয়ে-কে আমার সহ্য হয়না। সবকিছুতে শুধু নিরামিষ টাইপ। সহজ সুন্দর জীবন-টাকে একদম গাম্ভীর্যের চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে।”

অন্তি কথা-টা বলেই হনহনিয়ে নিচে চলে যায়। বাকি রিফা আর রোজা অসহায় চোখে আয়াতের দিকে তাকায়। আয়াতের দৃষ্টি রুমের দিকে স্থির। তার বোনের মাঝে ঝড়ের পূর্বাভাস টের পেয়ে ভেতর থেকে দমে গেছে সে। রোজা কাতর স্বরে বলে,

“অনেকদিন পর একটা বিয়ে বাঁধলো আয়াত আপু। আমরা কি একটু আনন্দ করবোনা?”

“হুম, তোমাদের যা করতে ইচ্ছে করে! আয়োজন শুরু করো। আমার আপত্তি নেই। আমার বোন যেন একটু আনন্দ করতে পারে। এমন কিছু করো।”

আয়াত কথা-টা বলে নিচে নেমে আসে। তার চোখ দু’টো অস্থির দৃষ্টিতে একজনকে খুঁজে চলেছে। মানুষ-টা রায়াদ। আর কেউ নয়। ড্রইং রুমে সবাই উপস্থিত। হানিফ, আরিফ হোসাইন দু-ভাইয়ের সাথে ইয়াসিন সাহেব বসে আয়াতের বিয়ের কিভাবে কি করা হবে আলোচনা করছেন সোফায় বসে। আসিফা বেগম, ফাতেহা খানম ডাইনিং টেবিলে সকালের নাস্তা সাজাচ্ছেন। অন্তি এক এক করে সব কিচেন থেকে এনে দিচ্ছে। সবার মাঝে রায়াদ অনুপস্থিত। এখনও কি ঘুম থেকে উঠেনি নাকি? সে ফাতেহা খানমের কাছে গিয়ে দাড়ালো। আসিফা বেগম আয়াতকে লক্ষ্য করে বললেন,

“কিছু লাগবে আয়াত মা?”

“না বড়-আম্মু। আসলে আন্টির সাথে একটু কথা ছিলো।”

আয়াতের কথা শুনে ফাতেহা খানম বললেন,

“হুম বলো আম্মু।”

“রায়াদ ভাই কোথায়? ঘুম থেকে উঠেনি?”

“হঠাৎ রায়াদের খোঁজ করছো?”

“কিছু জিনিস আনিয়ে নিতাম। বাড়িতে তো আর কাউকে দেখছিনা মার্কেটে পাঠানোর মতো।”

“সাজ্জাদকে বলতে পারো। ও এনে দিবে তো।”

আসিফা বেগম বললেম আয়াতের কথা শুনে। আয়াত বললো,

“আসলে বড়-আম্মু সাজ্জাদ ভাই এমনি অনেক ছুটোছুটির উপর আছে। তাই রায়াদ ভাইকে বলার জন্য খুঁজছিলাম।”

ফাতেহা খানমও জবাবে বললেন,

“ও একটু জুবায়েরের কাছে গেছে আম্মু। তুমি বরং কল দিয়ে বলো। আসার সময় নিয়ে আসতো!”

“রায়াদ ভাইয়ের নাম্বার নেই আমার কাছে।”

আয়াত চোখ বন্ধ করে বলে দিলো কথা-টা। ফাতেহা খানম নরমালই নিলেন কথা-টা। কোনো দরকার তো নেই যে রায়াদের নাম্বার থাকবে আয়াতের কাছে। তিনি বললেন,

“যে রুমে আমরা থাকছি, গিয়ে দেখো বেডের উপর আমার ফোন আছে। লকবিহীন ফোন। কন্টাক্ট লিস্টে পেয়ে যাবে ওর নাম্বার। নতুবা রোজা-কে বলো। দিয়ে দিবে।”

“আচ্ছা আন্টি।”

আয়াত প্রস্থান করলো ডাইনিং স্পেস থেকে। দরকার তো রায়াদের সাথে সরাসরি কথা বলার। নাম্বার দিয়ে সে কি করবে! এজন্য মাথা ঘামালো না আর।

৬৬,
ঘুম থেকে উঠে-ই রায়াদকে নিজের রুমে থাকা সোফায় বসে থাকতে দেখে চমকে যায় জুবায়ের। চোখ কচলাতে কচলাতে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে পায়ে স্যান্ডেল ঢুকিয়ে রায়াদের পাশে গিয়ে বসে পরলো। রায়াদ শান্ত, তার নড়চড় নেই। সে একধ্যানে ফোন দেখতে ব্যস্ত। জুবায়ের নিজের কপালে পরা চুলগুলো হাত দিয়ে পেছনে ঠেলে বলে উঠলো,

“সকাল সকাল আমার বাড়িতে, আমার রুমে। অবাক হয়ে গেলাম বন্ধু।”

“বিয়ে করতেছো! বন্ধুকে দাওয়াত দেওয়ার খবর নেই। তাই দাওয়াত নিজেই নিতে আসলাম।”

রায়াদের কথায় জুবায়েরের রীতিমতো বিষম উঠে গেলো। রায়াদের গলার স্বর বলে দিচ্ছে সে ভেতরে ভেতরে কতটা রেগে আছে। জুবায়ের রায়াদের রাগ কমাতে ওর এক হাত নিজের দুহাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,

“রেগে আছিস বুঝতেই পারছ। কিন্তু কি করবো বল? এক আয়াতকে নিয়ে একদিন গেলো। পরদিন এই বিয়ের শপিং। নিজেরও এই গরমে ছুটাছুটি করে ঠান্ডায় অবস্থা কাহিল। আ’ম স্যরি রায়াদ”

জুবায়েরের অবস্থা দেখে রায়াদ আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। হো হো করে হেসে উঠলো। জুবায়ের পুরো-ই হতভম্ব। কি করবে সে নিজেও বুঝতে পারলো না। বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। রায়াদ জুবায়েরের পিঠে কয়েক-টা কিল বসিয়ে বললো,

“আমি জানি তোর পরিস্থিতি। আমি এতটা অবুঝ বাচ্চা নই যে রেগে থাকবো। আমিও ব্যস্ত ছিলাম। আংকেলের ছেলে নেই। সাজ্জাদ ভাইয়ের সাথে আমি ছুটছি সবকিছুতে। আংকেল পুরো সুস্থ নয়। আবার আরিফ আংকেল আর বাবা-ও সবদিক সামলে উঠতে পারছেনা।”

জুবায়ের হাফ ছেড়ে বাঁচল যেন। সোফায় গা এলিয়ে বললো,

“আমার তো এক হিল্লে হলো রায়াদ। তুই কি করবি? সারাজীবন কি সিঙ্গেল থেকে মরবি?”

“ভাই রে বিয়ে কর। তোর বিবাহিত জীবনের সমাচার দেখে ভাববো কি করবো। মানুষ তো বলে বিয়ে করলেই জীবন ত্যানা ত্যানা। দেখি তোমার জীবন কি হয়! সুখের তাঁতের শাড়ি নাকি ঘর মোছার জন্য ত্যানা।”

জুবায়ের রায়াদের মজা করা দেখে হতাশ হলো। একটু বাচ্চামি মুখা ভঙ্গি করে বললো,

“ভয় দেখাচ্ছিস বিয়ের আগেই? আয়াত কিন্তু অনেক ভালো মেয়ে। ও আমায় ভালোবাসবে হুহ।”

“হ্যাঁ, সে তো ভালো মেয়ে। খালি রিয়ানার মতো মেয়ে না জুটলেই হলো। যার কপালে জুটবে! তার জীবন ইন্না-লিল্লাহ।”

“কেন? এমন কেন হবে? আমার হবু শালীকার সমন্ধে এমন কথা মানা গেলো না রায়াদ।”

“বাদ দে ভাই। আমি তার সম্পর্কে কিছু বলতেও চাইনা। একদম পাগল, তাড়ছিড়া। কিছু বলাও ভুল। যা বলবো! মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে অন্য-টা প্রকাশ করে।”

“কেন? কি হয়েছে খুলে বল।”

রায়াদ জুবায়েরের কথায় ছাঁদের ঘটনা আর সোমবার দুপুরের ঘটনা খুলে বলে। সব শুনে জুবায়ের একটু গম্ভীর থেকে জোড়ে শব্দ করে হেঁসে উঠে। রায়াদ হতবাক হয়ে শুধালো,

“হাসছিস কেন? তোর হাসি পাচ্ছে?”

“হাসবো না তো কি করবো? যার এক ধমকের সামনে আমি টিকতে পারিনা। সে কিনা বাচ্চা একটা মেয়ের সামনে লজ্জায় সরে যায়?”

” সে তো তোর ধমকের সামনেও কেউ টিকতে পারেনা। আর বাচ্চা কি? ২১বছরে পা দেওয়া মেয়ে বাচ্চা হয়?”

“আচ্ছা মানলাম ও বড়। কিন্তু আমার তো কাহীনি অন্য কিছু লাগে রে?”

“কি কাহিনী?”

“সামথিং সামথিং?”

“কিসের সামথিং সামথিং?”

“রিয়ানার প্রতি ফিলিংস জন্মাতে শুরু করেছে তোর।”

“হোয়াটট?”

৬৭,
রায়াদ একটু চিল্লিয়েই বললো। জুবায়ের রায়াদের মুখপানে তাকিয়ে বললো,

“দেখ, আমরা যা বুঝতে চাইনা। ঠিক সেটাই হয়ে থাকে। আমি ১ম ১ম রিয়ানাকে দেখার পর আমার ওর ভিন্নধারার ব্যক্তিত্ব দেখে ওর প্রতি একটু আগ্রহ, একটু মোহ সৃষ্টি হয়েছিলো। পরে যখন আবার জানলাম আয়াতের সাথে আমার বিয়ের কথা হয়েছিলো! আমি রিয়ানার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলি। মাথায় ঘুরে আমার, আয়াতের মাঝে কি এমন দেখলো আমার পরিবার! যে বিয়ে অব্দি কথা গড়ালো। দ্যান আমি আয়াতের বিষয় নিয়ে ভাবনা শুরু করলাম। এবং দেখলাম আমার আর ওর মিল একটু বেশি। রিয়ানার প্রতি আমার আগ্রহ দমে যায়। মূলত দমিয়ে দিই। কারণ এই আগ্রহ বেশি হলে ঠিকই কোনো না কোনো ভাবে একটা অনুভূতি সৃষ্টি হতো। এটার এক্সাম্পল হিসেবে তোর কথা-ই বলি। শুরুর দিক থেকে খেয়াল কর! তোর কিন্তু আয়াতের পার্সোনালিটি ভালো লাগতো। তাইনা? এরপর আমার কথা ভেবেই তো তুই আয়াতের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলছিস। তারপর হুট করেই রিয়ানার ডায়েরী দেখে তোর মনে হলো, এই মেয়ে-টার মাঝেও কিছু একটা আছে। যেটা তোকে এট্রাক্ট করছে। আর তুই বর্তমানে সেই এট্রাকশনের পেছনেই ছুটছিস। মেয়ে-টার পারসোনালিটি আর তোর পারসোনালিটির মাঝে মিল বেশি। অমিল-টা কম। আর কিছু মানুষের ক্ষেত্রে, যে যেমন, ঠিক তেমন একজনকেই পায়। কারণ সবাই যেমন, তেমন কাউকে পেলে বিচ্ছেদ বলে কোনো ওয়ার্ড এক্সজিস্ট করতো না। তাইনা?

জুবায়েরের কথাগুলোয় রায়াদ ভাবুক হয়ে বসে রইলো। জুবায়ের তার উরুতে চাপর দিতেই সে উদাস ভঙ্গিতে বলে উঠলো,

“কিছু-টা ঠিক তুই। আয়াতকে আমার ভালো লাগতো! এটা বললে চলে না। একটা মানুষের পার্সোনালিটি পছন্দ হতেই পারে। তার মানে তো এটা নয় যে তাকে আমি ভালোবাসার ভালো লাগা নামক অনুভূতিতে ভাববো। এমন-টা কখনও ভাবিনি। এটা ঠিক, রিয়ানার এই ত্যাড়ামি আমার পছন্দ না। কিন্তু পরে কোথাও একটা গিয়ে মনে হলো! এরকম তো সচরাচর কোনো মানুষ হয়না। কারণ একটা অবশ্যই থাকে। সেই কারণ-টা কি! এটাই জানার আছে আমার। একটু তো জেনেছি। বাকি-টাও আশা করি জেনে যাবো।”

রায়াদের জবাবে জুবায়ের বললো,

“কিভাবে জানবি? ভাষা অনুসন্ধান অভিযান সফল হয়েছে?”

“আমি চেষ্টা করেছি। আর রিয়ানা! তিনিও বলেছেন বাংলায় লিখে দেবেন। আমার চেষ্টায় দেখা যাবে কোনো অনুভূতি থাকবেনা। কারণ যে লিখে ডায়েরী! সে তার অনুভূতি ঢেলে লিখে।”

“হুম বুঝলাম। এবার চল ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করা যাক। ব্রেকফাস্ট করে এসেছিস বলে মনে হয়না।”

“রাস্তার মোড় থেকে চা খেয়েছি। ব্রেকফাস্ট পরে। আগে এই যে এতকিছু হলো! সবকিছু এখনও ক্লিয়ার করিসনি আমায়।”

জুবায়ের ফোঁস করে দম ফেললো রায়াদের কথায়। ধীরেসুস্থে লম্বা শ্বাস নিয়ে আয়াতকে বলা প্রতি-টা কথা জানালো। সব শুনে রায়াদ মৃদু হাসলো। জুবায়েরের কাঁধে হাত রেখে বললো,

“জীবনে যা হয় হয়তো ভালোর জন্য হয়। কিন্তু যা হয়, তা যে ভালো এমন টা বলবো না। সবকিছু ভালো হলে আমরা ভালোর মূল্য কখনও বুঝবো না। কারণ মনে হবে! এই তো! ভালো-ই হচ্ছে। আমাদের আর কি করার আছে? যত যাই হয়ে যাক! আমি তোর পাশে আছি।”

জুবায়ের মৃদু হাসলো রায়াদের কথায়। রায়াদকে জড়িয়ে ধরে ছেড়ে উঠে দাড়ালো। ফ্রেশ হওয়ার জন্য চলে গেলো ওয়াশরুমে। ফ্রেশ হয়ে এসে দুজনে ব্রেকফাস্ট করে বেশ কিছুদিন দুবন্ধু এক জায়গায় হওয়ায় জমিয়ে আড্ডায় মেতে উঠলো।

৬৮,
রাতের বেলায়। বাড়ির পুরুষ মানুষ সব সবাই খেয়েদেয়ে একপ্রকার শুয়েই পরেছে। শুধু আসিফা বেগম এবং ফাতেহা খানম জেগে আছেন। দুজনই রান্নাঘরে সমুচা, নুডলস, পাস্তা, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আরও কিছু খাবার বানাতে ব্যস্ত। কারণ ড্রইং রুমে মেয়েদের আসর বসেছে যেন। আয়াত, রিফা, অন্তি, রোজার সাথে আরও কিছু মেয়ে আছে। তারা রিফার ফ্রেন্ড+পাশের বাড়িতেই থাকে। মূলত সবাই হাতে মেহেন্দী লাগাতে বসেছে এই রাতে সব কাজ সেরে। সবাই উপস্থিত কিন্তু রিয়ানার দেখা না পেয়ে অন্তি বলে উঠলো,

“রিয়ানা, সে কোথায়? সবাই মেহেদী লাগাবে। সে লাগাবেনা?”

রিফা বিষয়-টা খেয়াল করে বললো,

“আমি ডাকছি ওকে।”

কিন্তু রিফার ডাকতে হলো না। এর আগেই সিড়ি দিয়ে রিয়ানাকে নামতে দেখা গেলো। তাকে দেখে সবাই অবাক যেমন, তেমনই মুগ্ধ। রিয়ানা সবার দিকে তাকিয়ে অসস্তিতে পরে গেলো। নিজের দিকে তাকালো সিড়ি বেয়ে নেমে। সাদা রঙের ব্লাউজের উপর হালকা টিয়া রঙের শাড়ি। শাড়ির মাঝে সাদার উপস্থিতি। সাদা আর সবুজের কম্বিনেশনে উজ্জল শ্যামা মেয়ে-টাকে আরও সুন্দর করে তুলেছে। একহাতে গোলাপ ও রজনীগন্ধার মিশ্রণে তৈরি গাজরা পেঁচানো। গলায় মালা এবং কপালে গোলাপের একটা কলি পরে রয়েছে। যেটা রজনীগন্ধার সাহায্যে টিকলির মতো বানানো হয়েচে। ফুলের গহনা সব তাজা গোলাপফুল এবং রজনীগন্ধার কলি দিয়ে বানানো।বাড়ির সব মেয়ের-ই এক সাজ। শপিং করতে গিয়ে কিনে এনেছে রিফা মেহেন্দীর আয়োজন করবে বলে। আয়াত ভেবেছিলো তার বোন এসব পরবেনা। এজন্য এতক্ষণ দ্বিধা নিয়ে বসেছিলো। অপেক্ষা করছিলো রিয়ানা আসার। সে আসতেই আয়াত মুগ্ধ দৃষ্টিতে নিজের বোনকে দেখছে। এই প্রথম বার রিয়ানাকে শাড়িতে দেখলো সবাই। ২১বছরের জীবনে রিয়ানা প্রথম শাড়ি পরলো। সেটা বোনের অনুরোধে। শাড়ি তো একদমই পড়তে পারেনা। আয়াত পরিয়ে দিয়েছে। রিয়ানার জিদ সে পরবেনা। পরে বোনের কথা ভেবে পরে তো নিয়েছে। আয়াত আসার আগে বলে দিয়েছিলো শাড়ি পরে হাঁটতে না পারলে খুলে রেখে আসবে। আয়াত রিয়ানার লেইট করা দেখে ভেবেছিলো তার বোন হয়তো শাড়ি পরে থাকবেনা। কিন্তু তাকে এত সুন্দর করে শাড়ি সামলে তার রেখে আসা ফুলের গহনা পরে নামতে দেখে আয়াত খুশিতে আত্মহারা। সে ছুটে এসে বোনকে জড়িয়ে ধরলো। রিয়ানা বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বললো,

“এগুলো পরে মানুষ? কেমনে হ্যান্ডেল করিস আপু। আমি রীতিমতো বিরক্ত।”

আয়াত কিছু বলবে তার আগে বাসার কলিং বেল বাজে। সবার দৃষ্টি দরজার দিকে যায়। আয়াত এগোতে ধরলে রিয়ানা ফের বলে,

“তুই গিয়ে বোস। আমি দেখছি কে?”

রিয়ানা গিয়ে দরজা খুলতেই দেখে রায়াদ। এদিকে রায়াদ দরজা খুলতেই সামনের দিকে তাকায়। তাকিয়ে রিয়ানাকে শাড়ি পরিহিত, ফুলে সজ্জিত, কোমড় ছুঁই ছুঁই এলোকেশী কন্যাকে দেখে পুরো-ই স্তব্ধ। এ তো পুরো অন্য ধাচের একটা মানুষ। দেশে আসার পর প্রথম রিয়ানাকে এই সাজে দেখে রায়াদ কথা বলার ভাষা হারিয়েছে। সে বিস্ময়পর সহিত প্রশ্ন করে বসে,

“টিয়াপাখির অবতারে সেজেছেন দেখছি। এত সুমতি কি করে হলো?”

“মিঃ রায়াদ শাহনেওয়াজ! সবসময় সবাইকে উপর থেকে যেমন-টা দেখা যায়! আদৎ এ সে তেমন হয়না সবসময়। আপনি ঠিক ততটুকু-ই জানবেন, দেখবেন, যতটুকু সে বলবে, দেখাবে। কোনো মানুষ নিজের আসল সত্তাকে লুকাতেও অন্য রকম ভাবে নিজেকে প্রকাশ করে। তার মানে এই নয় যে! সে সুমতি হীন।”

রিয়ানা দাঁত কিড়মিড়িয়ে কথাগুলো বলে দরজা ছেড়ে আয়াতদের দিকে আসলো। রায়াদ বাসায় ঢুকে দরজা লাগিয়ে আনমনে হেসে ভাবলো,

“নিজের এই সত্তাকে লুকিয়ে একটা মিথ্যা সত্তায় মুড়িয়ে রেখেছেন তবে! বেশ ইন্টারেস্টিং মিস রিয়ানা হোসাইন। আপনার সব সত্তাকেই জেনে ছাড়বো। প্রমিজ।”

চলবে?

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ২৮
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৬৯,
উপরতলা করিডরে বুকে হাত বেঁধে দাড়িয়ে আছে রায়াদ। দৃষ্টি ড্রইং রুমে সোফার সম্মুখে পাটি পেরে তাতে বসে থাকা সব মেয়েদের মাঝে রিয়ানার মাঝে আবদ্ধ। রিফা তার হাতে মেহেদী লাগিয়ে দিচ্ছে। তার বাম হাত বালিশের উপর রাখা। সে ডান হাত গালে দিয়ে ফোনে কিছু একটা দেখায় ব্যস্ত। অন্তি আর রোজা মিলে আয়াতের দু-হাত মেহেদীতে রাঙাতে ব্যস্ত। পাশের বাসার তিনজন মেয়ে তারা কখনও গান বলছে তো হাসাহাসির টপিক টেনে হাসছে। আসিফা বেগম এবং ফাতেহা খানম সোফায় বসে মেয়েদের আনন্দে শামিল হয়েছেন। রায়াদের ইচ্ছে করছেনা ঘুমাতে। একটুও ঘুম ধরছেনা তার। জুবায়েরের কথাগুলো মাথায় ঘুরে চলেছে রায়াদের। তবে কি সত্যি সত্যি সে কিছু ফিল করছে রিয়ানার জন্য? আবার মনে হচ্ছে কারোর প্রতি সহানুভূতি আসলেই কি তা ভালোবাসা বিষয়ক কোনো অনুভূতি হয়? সব মিলিয়ে রায়াদের অবস্থা পাগল প্রায়। এসব নিয়ে একটুও ভাবতে চায় না। কিন্তু ঘুরেফিরে ভাবনা এসে যায়।

“এখানে দাড়িয়ে কি ভাবছো ব্রো?”

আচমকা সাজ্জাদের উপস্থিতিতে ঘাবড়ে গেলো রায়াদ। সে ভেবেছিলো বাসার সবাই ঘুমিয়ে পরেছে। সাজ্জাদের সাথে রায়াদকে থাকতে দেওয়া হয়েছে। বাসায় মানুষ বেশি, রুম কম হওয়ায় অন্তি, রোজা, রিফা একরুমে আর রায়াদ সাজ্জাদের থাকবে বলে আসিফা বেগম বলে দিয়েছেন। সাজ্জাদকে ঘুমাতে দেখে রায়াদ এখানে এসে দাড়িয়েছে। বুঝতে পারেনি সাজ্জাদ উঠে পরবে। রায়াদ হাসার চেষ্টা করে সাজ্জাদের কথার জবাবে বললো,

“কিছু ভাবছি না। ঘুম ধরছিলো না। সবাই আড্ডা দিচ্ছে তাই দেখছি। মেয়েদের আড্ডা। সেখানে তো আর যাওয়া যায় না। তাই এখানে দাড়িয়ে।”

“দৃষ্টি একজনের দিকেই সীমাবদ্ধ ছিলো।”

রায়াদ ফের একদফা ঘাবড়ালো। ভ্রুকুটি করে তাকালো সাজ্জাদের দিকে। সাজ্জাদ সামনের রেলিঙে ভর দিয়ে দাড়িয়ে বললো,

“যার পানে দৃষ্টি আবদ্ধ! তোমার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও তার পানে তাকিয়েছি। তবুও দূর হতে দৃষ্টি নিক্ষেপ। সিউর নই আমার ভাবনাকৃত মানুষ-টিই কিনা!”

“কার কথা বলছেন?”

“এতগুলো মেয়ের মাঝে যে একদম আলাদা। রিয়ানা।”

রায়াদ ধরা পরে দৃষ্টি লুকানোর চেষ্টা করলো। সে বেহায়ার মতো একটা মেয়েকে দেখছিলো সেটাই তার বড় ভাইয়ের মতো মানুষের কাছে ধরা পরলে ভেবে অসস্তি হতে শুরু করলো রায়াদের। সাজ্জাদ বুঝতে পারলো রায়াদের চোখ মুখের ভাবভঙ্গি দেখে। সে হেসে বললো,

“তাকে তাকিয়ে দেখো, মায়ায় পরো, ভালোবাসো। কিন্তু কখনও বলতে যেয়ো না। এমন আঘাত করবে! সইতে পারবেনা। শত হোক সবাই সাজ্জাদ নয়। সবাই অবহেলা, আঘাত নিতে পারেনা। তুমি ছেলে-টা নিজেকে যত-ই কঠিন ভাবে প্রকাশ করতে চাও? বাস্তবে তত-টা নও। আমার অবজারভেশন বলছে, তুমি ভেতর থেকে একদম সরল সহজ একটা মানুষ।”

সাজ্জাদের কথার আগামাথা কিছু বুঝলো না রায়াদ। সে জিগাস্যু দৃষ্টিতে তাকালো সাজ্জাদের দিকে। সাজ্জাদ সব ভণিতা ছেড়ে বললো,

“ঐ মেয়ে-কে একসময় ভালোবেসেছিলাম বোধ হয়। জেদি, একরোখা, ঘাড়ত্যাড়া, ড্রেসআপ কখনও পেট বের করা, কখনও হাটুর উপরে শর্ট স্কার্ট, কখনও বা স্লিভলেস। মেয়ে-টাকে পাল্টাতে পারিনি। আমার ভালোবাসায় হয়তো খামতি ছিলো। অথবা তাকে পাল্টানোর ক্ষমতা-টা কারোর হয়নি। সে নিজের ইচ্ছে-ই না পাল্টালে কেউ পাল্টাতে পারবেনা। এই কথা-টা বলতো। সত্যিও হয়েছে। তার চাল চলনের জন্য সে আমার জীবনে এক আফসোসের নাম। আজ দেখো শাড়ি পরেছে। অথচ চার বছর আগে চেয়েছিলাম সে এমন হোক।”

৭০,
রায়াদের দৃষ্টিতে বিস্ময় প্রকাশ পেলো সাজ্জাদের কথায়। সাজ্জাদ হাসলো রায়াদের কাঁধে হাত রেখে বললো,

“যত-ই অফিসে, বাসায় এসে ছুটোছুটি করি! অন্তি? সে সবদিকে নজর রাখে। না চাইতেও তার দৃষ্টি সতর্কের সহিত রিয়ানার উপর নির্বাসিত থাকে। আমি মানুষ-টা একসময় যাকে ভালোবাসি বলেছি! সে মেয়ে-টা আমার বাসায়। অবশ্য এই বাসা তারও। সর্বক্ষণ সব জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার স্বামীর প্রথম আবেগ, মায়া, ভালোবাসা নামক অনুভূতি যে নারীকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছিলো? সেই নারীর প্রতি যেন তার স্বামীর আবার মন না ঘুরে সেই ভয়ে থাকে অন্তি। যার ফলে রিয়ানার উপর নজর রেখপ চলে। আমি বারণ করি, বোঝাই! সে বোঝে না। হয়তো তার ভালোবাসার ভীত শক্ত হচ্ছে আমার প্রতি! এজন্য হারানোর ভয় পায়। ওর মুখেই শুনেছি তোমার সাথে রিয়ানার ঝগড়া-ঝাটি, তার ডায়েরী পড়ার গল্প। ঐ ডায়েরী আমার জীবনের কাল ছিলো। জার্মানিতে গিয়ে ঐ ডায়েরী হাতে পরার ফলে মেয়ে-টার মুখে হাসি ফেরানোর চেষ্টায় নেমে আমি হাসি হারিয়েছিলাম। অন্তির সহচার্যে আমার হাসি, মনের শান্তি ফিরে আসছে একটু একটু। আমার বিশ্বাস একদিন আমার সব-টা জুড়ে অন্তি-ই থাকবে। তোমায় ভাই সাবধান করি, নিজের থেকে বেশি ভালোবাসতে যেয়ো না। নিজের প্রতি ভালোবাসা বাঁচিয়ে তাকে ভালোবেসো। আমি পারিনি তার বিষাদের চিঠির পাতায় রঙিন কিছু আনতে। তুমি না হয় তা করলে!”

সাজ্জাদের কথাবার্তা সব মাথার উপর দিয়ে গেলো রায়াদের। সে অবুঝ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সাজ্জাদের মুখপানে। সাজ্জাদ ফের বলে উঠলো,

“বুঝতে পারছো না তো? সহজ করে বলি। আমি জার্মানিতে টুরিস্ট ভুসায় গিয়েছিলাম। সেদিন ছাঁদে তুমি রিয়ানার ডায়েরী দিতে গিয়েছিলে। অন্তি কাপড় আনতে গিয়ে দেখে। পরে তোমরা কথা বলছিলে বলে সে চলে আসে। যার ফলে তোমরা ওকে দেখতে পাওনি। রাতে বাড়ি ফেরার পর অন্তি আমায় বলে, তোমার আর রিয়ানার মাঝে কিছু চলছে। বুঝতে না পেরে ওকে জিগাসা করতে-ই যা দেখেছে, শুনেছে এক্সপ্লেইন করে। তোমার আর রিয়ানার টুকটাক যা কথা হয় বা তোমরা একসাথে কোথাও মুখোমুখি হলে তা অন্তির নজরে পরলে আমায় বলে। দেখতে চায় জেলাস ফিল করি কিনা? আজও রিয়ানার প্রতি আমার অনুভূতি বেঁচে আছে কিনা? অথচ পাগলি-টা জানেনা আমিও চাই রিয়ানা ভালো থাকুক। আর বাকি ১০টা সাধারণ বাবা মেয়ের মতো ওর সাথে চাচ্চুর সম্পর্ক-টা নরমাল হোক। ও ১৫তম জন্মদিনে যে শক পেয়েছিলো চাচ্চুর থেকে তা ভুলে যাক। এর আগে আয়াতের থেকে শুনেছি, রিয়ানা হাসতো। সেই হাসি ফিরে আসুক। নরমাল মেয়েদের মতো সেও সুন্দর একটা লাইফ লীড করুক। ওর বেস্টফ্রেন্ড আছে একটা। ডায়েরীর প্রথম পেজের পর ৩-৪টা পেইজ লেখা সহ পেয়েছিলাম। তা জার্মানির ভাষায় ছিলো। ওর বেস্টফ্রেন্ডের থেকে ইংলিশে ট্রান্সলেট করে নিয়েছিলাম। ওর দুঃখগুলো মনের কোথাও একটা ছুঁয়েছিলো। চেয়েছিলাম নরমাল করতে, পারিনি। এখন তোমার দৃষ্টি দেখে আমার মনে হচ্ছে রিয়ানার জন্য তোমার ফিলিংস জন্ম নিয়ে ফেলেছে। সেটা বুঝতে দেরি করো না। ঐ পাথর মানবীর মন গলানোর চেষ্টায় নেমে পরো। নয়তো হারাবে একসময়। চিন্তা করো না। ও আমায় ভালোবাসেনি। ওর মনে আমার জায়গা হয়নি। তাই আমিও সব দাফন করে নিজের স্ত্রী-কে মনে প্রাণে ভালোবাসতে চাই। ভয় নেই, আমি তাকে কখনও ভালোবাসি বলা ব্যতিত হাত ধরেও দেখিনি ইচ্ছাকৃত। সে ফিরিয়ে দেওয়ার পর বিরক্তও করিনি। তুমি তাকে ভালোবাসতে পারো। একটা সুন্দর জীবন গুছিয়ে দিতে পারো। ও মেয়ে-টার মাঝে এক আকাশ সম বিষাদ জমা। তাতে রঙিন রংধনুর আবির্ভাব না হয় তুমি করলে! শুধু অনুরোধ ডায়েরীর পরের পাতাগুলো ওর মন জয় করে, ও ভালোবাসলে, তোমরা বিয়ে করলে পড়ে নিয়ো। এর আগে পড়বেনা। আমার অনুরোধ রইলো ভাই। বড় ভাই হিসেবে তোমায় আদেশ দিলাম। এটাও ভাবতে পারো।”

সাজ্জাদ কথাগুলো দম নিয়ে বলে রুমের দিকে পা বাড়ালে রায়াদ বলে উঠে,

“আমায় এতকিছু কেন জানালেন সাজ্জাদ ভাই?”

“সে আমায় একটা কথা বলেছিলো জানো। আমি ছাড়া তাকে কেউ ভালোবাসেনি। এই কথা-টা ভুল প্রমাণ করো তুমি। এটা চাই। তুমি তাকে ভালোবাসো। সে আবারও বলুক, আমি ছাড়াও তাকে কেউ ভালোবেসেছে।”

৭১,
সাজ্জাদ ঘাড় ঘুরিয়ে জবাব দিয়ে থামলো না। দ্রুতপদে রুমে এসে বিছানায় বসে পরলো। লম্বা শ্বাস নিয়ে কিয়ৎক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো। নিজের মন শক্ত করে ভাবলো,

“ও আমায় ভালোবেসেছে রায়াদ। এটা তুমি বিয়ের পর-ই জানো। এখন জানলে হয়তো ওর ভালোবাসার উপর, ওর মনের উপর জোড় চালাতে চাইবেনা। তোমায় দেখে এতটুকুই বুঝেছি আমি। ওর মনের দরজায় খিল পরেছে। কিন্তু তাই বলে ওকে কেউ ভালোবাসবে না এটা হয়না। ও ভালো থাকুক। আমার মতো ভালো থাকার চেষ্টায় নামুক। মুখে না বলুক। আমি তো জেনে গেছি ওর মনের কোথাও একটা আমি আছি। আমার অস্তিত্ব তখনই ওর জীবনে বিস্তার লাভ করলো! যখন আমি অন্য কারোর। আমায় ভালোবাসলে রিয়ানা হোসাইন। যখন আমি অন্য কারোর, ঠিক তখনই বাসলে। অন্তির মুখে তোমার ডায়েরীর কথা শুনে লোভ সামলাতে পারিনি। আবারও তোমার ডায়েরী চুরি করেছিলাম। যেমন-টা জার্মানিতে গিয়ে করেছিলাম। আবারও মাদালিনার হেল্প নিয়ে ইংলিশে ট্রান্সলেট করে নিয়েছি। মাদালিনার সাথে আজও আমার যোগাযোগ আছে। চলে আসার পর তার থেকেই তো তোমার খোঁজ রাখতাম। রিফার সাহায্য নিয়ে আমি চলে আসার পরের ডেইট গুলোর ছবি তুলতে বলেছিলাম ওকে। ও তোমার আড়ালে সুযোগ বুঝে আমায় ছবি তুলে দিয়েছে। আমায় মাফ করো। কিন্তু কখনও তুমি না জানো, তোমার ডায়েরী তোমার সব সত্যতা আমার জানা। অন্তিও না জানুক। সব আমার মনের মাঝেই দাফন হয়ে যাক। সবকিছুর মাঝে অন্তির দোষ নেই। আমিও বিবাহিত। তোমার কথা ভাবা মানেই অন্তিকে ঠকানো। আমি ওকে ঠকাতে চাইনা। রায়াদ তোমায় ভালোবাসুক। এজন্য তাকে এতকিছু জানাতে বাধ্য হলাম। আমায় ক্ষমা করো।”

পরেরদিন বেলা গড়িয়ে দুপুর। বাড়ির ছাদের আয়াতকে হলুদ মাখানোর তোড়জোড় চলছে। বাড়িতে বেশ মানুষের আনাগোনা। কাছের আত্মীয় স্বজনকে জানানো হয়েছে শুধু। আয়াতের মামার-খালার পরিবারকে, সাজ্জাদের শ্বশুর বাড়ির মানুষ, তার খালার পরিবারকে দাওয়াত করা হয়েছে। বড়-রা সব আগামীকাল আসবে। আজ সব কাজিন’স-রা হাজির। শুধু অন্তির মা আজকেই এসেছেন। আর আশেপাশের প্রতিবেশীদের দাওয়াত করা হয়েছে। দুপুর পেরিয়ে বিকেল হওয়ার পথে। আসিফা বেগম আয়াতের রুমে এসে আয়াতকে তখনও সাজাতে দেখে তাড়া দিলেন। বললেন,

“তোরা কি মেয়ে-টাকে হলুদে ভুত বানিয়ে রাতে গোসল করাবি? তাড়াতাড়ি কর বলছি।”

উনি হাতে কাজ থাকায় তাড়া দিয়ে-ই প্রস্থান করলেন। রিফা আয়াতকে দাড় করিয়ে তার হাতে চুড়িগুলো পরিয়ে দিয়ে আয়াতকে আয়নার সামনে দাড় করিয়ে কাঁধে দুহাত রেখে পেছনে দাড়িয়ে বললো,

“এই তো হলুদ পরিকে সাজানো শেষ।”

“আমার হিরো বন্ধুকেও আনা শেষ। এবার দুজনকে নিয়ে পাশাপাশি বসানো যাক?”

দরজায় রায়াদের কণ্ঠস্বর শুনে রুমে উপস্থিত সকলের দৃষ্টি ঘুরে তাকালো দরজায় দাড়িয়ে থাকা রায়াদ আর জুবায়েরের পানে। রোজা অবাক হয়ে দুজনের দিকে এগিয়ে এসে বললো,

“জুবায়ের ভাই এখানে কেন ভাইয়া?”

“ও বাড়িতে আগামীকাল বিয়ে। সেই আমেজ। হলুদের কিছু হচ্ছে না। ওর সাথে কথা বলে জানতে পেরে নিয়ে আসলাম। এবার জোড়া শুদ্ধ নিয়ে যা তো এদের। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”

রায়াদ চলে যায় সাজ্জাদের রুমের দিকে। জুবায়েরের দৃষ্টি সবাইকে উপেক্ষা করে আয়াতে আবদ্ধ৷ বাসন্তী রঙের শাড়িতে তাজা গোলাপ, গাঁদা ফুলের গহনায়, হালকা মেকআপ এ আয়াতের সৌন্দর্যে জুবায়ের ঘায়েল হলো যেন। রিফা তা লক্ষ্য করে মজা করে বললো,

“পরেও দেখতে পারবেন আয়াতকে। এবার চলুন আপনাদের ছাঁদে স্টেজ সাজানো হয়েছে। সেখানে বসানো যাক।”

আয়াতের দৃষ্টি ফ্লোরে আবদ্ধ। জুবায়ের তার দিকে তাকিয়েছে দেখে লজ্জায় সে চোখ নামিয়ে নিয়েছে। সবাই মিলে ওদের দুজনকে নিয়ে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো। এদিকে রিয়ানা রিফার রুম থেকে নিজের লেহেঙ্গা সামলে সবে করিডোরে পা ফেলার সাথে রায়াদের মুখোমুখি হলো। সে পাঞ্জাবির হাতা গোঁটাতে গোঁটাতে বের হচ্ছিলো রুম থেকে। রিয়ানাকে দেখে থমকালো রায়াদ। এ মেয়ের নতুন নতুন রুপ দেখে হার্ট অ্যাটাক করে মরবে নাকি সে! আজ আবার এক ভিন্ন রিয়ানা। সিম্পল ডিজাইনের লেহেঙ্গা পরেছে সে বাকি মেয়েদের বাসন্তী রঙের শাড়ির সাথে মিল রেখে। সিম্পল আর্টিফিশিয়াল ফুলের গহনায় সাজিয়েছে নিজেকে। মুখে সাজের বালাই নেই। ঠোঁটে শুধু লিপস্টিকের ছোঁয়া হালকা রঙের। এতেই এ মেয়ে-কে অন্য রকম লাগছে। রায়াদকে নিজের দিকে এক নাগারে তাকিয়ে থাকতে দেখে রিয়ানা কয়েক কদম হেঁটে রায়াদের সামনে দাড়িয়ে গালে তর্জনী আঙুল দিয়ে টোকা দিয়ে বললো,

“প্রেমে পরে যাচ্ছেন নাকি মি: রায়াদ। চলেন প্রেমে করি।”

রায়াদ বিষম খায় রিয়ানার কথায়। মুহুর্তে নিজেকে সামলে রাগের সহিত বলে,

“আপনার মুখে এসব উল্টাপাল্টা কথা আসে কিভাবে?”

“যেভাবে আপনি তাকিয়ে ছিলেন। আর একবার আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে এবার গালে হাত পরলো। এরপর সোজা চোখে আঙুল ঢুকে পরবে। খবিশ লোক একটা।”

রিয়ানা কথাগুলো বলে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো। রায়াদ ওখানেই দাড়িয়ে হতভম্বের ন্যায় তাকিয়ে রইলো রিয়ানার যাওয়ার পানে। তখনঔ সাজ্জাদ রুম থেকে বের হলো। রায়াদের কাঁধে হাত রেখে দাড়িয়ে বললো,

“এ মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে এ পটবে না ভাই। এ মেয়ে তার উপর গিয়ে মরবে, যে ওকে পাত্তা দিবে না। সো দূরত্ব রেখে মাইন্ড গেম খেলো। ও দুর্বল হলে সম্পর্ক বিয়ে অব্দি সে গড়াবে নিজ দায়িত্বে। তোমার কিছু করতে হবে না।”

সাজ্জাদ দরজায় দাড়িয়ে রিয়ানার কথাগুলো শোনায় রায়াদকে কথাগুলো বললো। রায়াদ সাজ্জাদের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বললো,

“এ নির্লজ্জ মেয়ে-কে জীবনেও ভালোবাসবো না আমি। আস্তো বেয়াদব। আপনি অন্য কাউকে ধরেন একে সোজা করতে।”

এরপর সেও পা বাড়ালো ছাঁদের দিকে। সাজ্জাদ অসহায় চোখে দুজনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিরবির করে বললো,

“আল্লাহ দুই টারে একটু হেদায়েত দান করো। পাগল হয়ে যাচ্ছি দুইটার চিন্তায়। একজন উইক হয়েছে এখন বুঝছেনা। আমি সরে আসার পর রিয়ানা যেমন নিজের অনুভূতি বুঝেছিলো। এই রায়াদ না আবার রিয়ানা জার্মানি চলে গেলে বুঝে তার অনুভূতি। কি যে হবে?”

চলবে?

ভুলত্রুটি মার্জনীয়, আসসালামু আলাইকুম।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে