মোহনেশা পর্ব-০১

0
1090

#মোহনেশা
#সূচনা_পর্ব
আফিয়া অন্ত্রীশা

বিগত ছয় মিনিট যাবৎ সিড়িরঘরে কানে ধরে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে মিতুল। কিছুটা সামনেই ইরফান মেঝেতে টুল পেতে হাতে বেত নিয়ে চোখ রাঙিয়ে মিতুলের দিকে তাকিয়ে আছে।

কিয়ৎক্ষণ আগে,

দাদীর পানের বাটা ছিন্তাই করে দৌড়ে পালিয়ে আসার সময় ঘপ করে পেছন থেকে মিতুলের হাত টেনে ধরে ইরফান। মায়ের কাছে ধরা পরে গেছে ভেবেই ভয়ে ঠকঠক করে কাপতে শুরু করে মিতুল। একরাশ ভয় নিয়ে পেছনে ঘুরে তাকাতেই ভয়ের মাত্রা যেন দশগুণ বেড়ে যায় তার।

-ইরফান ভাই আ…আপনি কেমনে মানে কখন আসছেন ঢাকা থেকে? (মিতুল)
-তোকে তা জানতে হবে না। আগে বল তোর হাতে নানীর পানের বাটা কেন? তোকে না আমি গতবার লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়ে গিয়েছিলাম যে, এবার যদি এসে তোর হাতে পানের বাটা দেখি বা পান খেতে দেখি তবে তোর খবর আছে? (ইরফান)

মিতুলের হাত থেকে খপ করে পানের বাটাটা কেড়ে নেয় ইরফান। মিতুলের কর্মকান্ডে ইরফানের বেশ রাগ অনুভূত হলেও তার মুখের হাবভাব দেখে হেসে লুটোপুটি খেতে মন চাইছে তার। পরক্ষণে সে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার নিজের মধ্যে গম্ভিরতা নিয়ে আসে।
এই মুহূর্তে মিতুলের ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটা ভিডিও ক্লিপের ডায়লগই বারবার বলতে মন চাইছে, “আমার ভুল হয়েছে আমাকে ক্ষমা করে দিন।“
ওদিকে মিতুলের দাদী তার রুমে বসে হাক ছেড়ে ছেড়ে তার মেঝো ছেলের বউ অর্থাৎ মিতুলের মাকে বলছে, “ও মেঝো বউমা আজকে আবার তোমার মাইয়া আমার পানের বাটা নিয়া ভাগছে।“ ঘটনা আঁচ করতে পেরে মিতুলের মা রান্নাঘর হতে হাতে খুন্তি নিয়ে বেড়িয়ে আসেন মেয়েকে ধরতে। মাকে তেড়ে আসতে দেখে মিতুলের গলা শুকিয়ে আসে আজ বুঝি প্রাণ পাখি ফুরুত করে উড়ে গেল বলে।

-মামি তুমি রান্নাঘরে যাও তোমার তরকারি বোধ হয় চুলার ওপরে। আমি দেখছি মিতুলকে। (ইরফান)
-এই মেয়েরে কি করে বুঝাবি দেখ বাপ। আমিতো কিছুতেই এই মেয়ের পান খাওয়া থামাতে পারছিনা। তুই গতবার ওয়ার্নিং দিয়ে যাওয়ার পরেও নিয়মিত পান খেয়েই যাচ্ছে। আমারই হয়েছে যত জ্বালা বাপু। (মালিহা বেগম,মিতুলের মা)

মালিহা বেগমের মুখে এহেন কথা শুনে ইরফান দাঁত কিড়মিড়িয়ে মিতুলের দিকে চায়।
-মামি তুমি যাও বললাম না। আমি দেখছি। ওর পান খাওয়া না ছুটিয়ে আমি আর ঢাকায় ফিরছিনা।


বর্তমানে,

-ও ইরফান ভাই? আর জীবনে কোনোদিন পান খাব না কথা দিচ্ছি। বুড়ি হয়ে গেলেও খাব না। এইযে দেখুন সত্যি বলছি একদম তিন সত্যি।
কানে হাত রেখে এক পায়ে দাঁড়িয়ে হেলতে দুলতে কথাগুলো বলে ওঠে মিতুল।

-পা নামাবিতো এই বেত দিয়ে ঠাস করে পায়ে বাড়ি দেব। একদম চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবি ২ঘন্টা। তোর পান খাওয়া আমি বের করছি অপেক্ষা কর। বলেই পকেট থেকে ফোন বের করে ক্যান্ডি ক্রাশ গেইম খেলায় মনোযোগ দেয় ইরফান।
ইরফানকে ফোনে মনোযোগী হতে দেখে পা টা হাল্কা করে মেঝেতে নামাতেই ইরফান ফোনটা রেখে বেত দিয়ে মেঝেতে সজোরে একটা বাড়ি মারে। ভয়ে কেঁপে উঠে মিতুল পুনরায় পা তুলে নেয়। যদিও বেত দিয়ে মিতুলকে আঘাত করবেনা ইরফান। কেননা মিতুল এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে। সুতরাং তার গায়ে হাত তোলা বড্ড দৃষ্টিকটু দেখাবে।

-কিরে আমি কি তোর সাথে ফাইজলামি করার জন্য এখানে বসে আছি? চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবি দুই ঘন্টা। (ইরফান)
-আমার ভুল হয়েছে আমাকে ক্ষমা করে দিন। আর কোনোদিন পান খাব না আমি।(মিতুল)

মিতুলের মুখে প্রথম কথাটুকু শুনে ইরফান কিঞ্চিত ভ্রু কুচকায়।
-কিরে তুই এই ডায়লগ কোথার থেকে শিখেছিস? (ইরফান)
-ফেসবুকে দেখেছি একটা ভিডিও ক্লিপ। বলেই জিভ কামড়ে ধরে মিতুল।

-কি বললি? তোর ফেসবুক একাউন্টও আছে? তোকে না বলেছি এসএসসি পাশ না করা পর্যন্ত কোনো প্রকার ফেসবুক একাউন্ট থাকা চলবেনা? এই বাড়ির একটা ছেলে-মেয়েকেও দেখেছিস যে এসএসসির আগে ফেসবুক ব্যবহার করেছে। আজকে তো আরও একদফা শাস্তি তুই ডিজার্ভ করিস তাহলে। মেহনাজ (মিতুলের ভাই) আসুক অফিস থেকে আরও সবগুলো আসুক তোর এই কাজের বিচার সব ভাই-বোনের সামনেই হবে।

মিতুলের এখন নিজের মাথায় ঠাস করে একটা বাড়ি মারতে মন চাইছে। নিজের পায়ে নিজেই কু/ড়া/ল মারলো সে। কি দরকার ছিল আগ বাড়িয়ে এত কথা বলার? তার চেয়ে বড় কথা এই লোকতো পুরো কাজিনগুষ্টির সামনে তার সম্মানকে সুজির হালুয়া বানাবে আর সবাইকে সার্ভ করবে।

-কিরে মিতুল তুই ওভাবে কানে হাত দিয়ে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ইরফান কি হলো কি করছে মেয়েটা? (ইয়াসমিস খানম,ইরফানের মা)
ফুফুকে দেখে একটু জোর বাড়ে মিতুলের। সাথে সাথে পা মেঝেতে নামিয়ে কান থেকে হাত সরিয়ে নেয়। বেশ কিছুক্ষণ একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকার ফলস্বরূপ ব্যথায় পা টনটন করছে।

-তোমার ভাইঝি যে এত পান খায় বারণ করতে পারোনা? অকালে দাতগুলো লাল বানিয়ে ফেলবে। তখন হাসলে কেমন বিদঘুটে লাগবে তা চিন্তা করছো? কোনো ছেলেও তো ওকে আর বিয়ে করবেনা। (ইরফান)

-অনেক হয়েছে শাস্তি। এখন ওকে ছেড়ে দে। ওর ১০টায় স্কুল শুরু। আর এখন বাজে সাড়ে ৮টার মতো। মেয়েটা খাবে রেডি হবে। এই মিতুল তাড়াতাড়ি আয়। (ইয়াসমিন খানম)
মিতুল ইরফানের দিকে এক নজর তাকিয়ে মুখ দিয়ে ভেংচি কেটে তার ফুফুর পেছন পেছন চলে যায়।

প্রতিদিনের ন্যায় আজও পরিবারের সকলে এক টেবিলে সকালের নাস্তা করতে বসেছে। মিতুলের বাবা চাচারা তিন ভাই ও এক বোন এক বাড়িতেই থাকে। এই বিশাল বাড়িটা তারা চার ভাই-বোন মিলেই তৈরি করেছে। যদিও বা ইরফানের মা ইয়াসমিন বেগম ইরফানের নানার প্রথমপক্ষের মেয়ে। খুব অল্প বয়সেই মাকে হারায় ইয়াসমিন বেগম। পরবর্তীতে ইরফানের নানা দ্বিতীয় বিয়ে করেন তার আপন শালীকে যেন বোনের সংসারকে তিনি আপন হাতে আগলে রাখেন। সেই হতেই বৃদ্ধা রুবিয়া বেগম স্বামী গত হওয়ার পরেও এই সংসারকে নিজ হাতে এখন পর্যন্ত গুছিয়ে রেখেছেন।ইয়াসমিনকে নিজের বড় সন্তানের মতোই পালন করেছেন। বৃদ্ধ মায়ের দাবি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের চার ভাই-বোনকে এক ছাদের নিচেই দেখে যেতে চান। তাই রান্নাবান্না সব এক হাড়িতেই হয়। ইরফানের বাবা গত হয়েছেন সাত বছর হতে চলল।

-তা ইরফান কয়দিনের ছুটিতে এসেছো এবার? (আজমির খান,মিতুলের বড় চাচা)
-এবার একমাসের ছুটিতে এসেছি মামা। (ইরফান)
-বাহ তাহলে তো এবার ভালোই হলো। আমাদের মেহনাজকে এবার বিয়ে করিয়ে দেব। তুমি ভালো একটা পাত্রী খোজো তোমার ভাইয়ের জন্য। (আজমির খান)
-আচ্ছা বড় মামা আমি দেখছি ব্যাপারটা। (ইরফান)
-তা ইরফান বিয়ের বয়স তো হয়েই গেছে তুমি বিয়ে কবে করবে ভাবছো? (আজমির খান)

এহেন প্রশ্ন শুনে হাত থেকে সদ্য পাকানো ভাতের দলাটা পুনরায় প্লেটে পড়ে যায় ইরফানের। হাসিখুশি মুখটা মুহূর্তের মাঝে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ইয়াসমিন বেগম বলে উঠেন, “আরে সবেতো চাকরিটা পেল। নিজেকে একটু গুছিয়ে নিক তারপর দেখা যাবে।“

খাওয়া শেষ করেই পাশ থেকে স্কুল ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ায় মিতুল।
-আমি যাচ্ছি। (মিতুল)
-বাহিরে দাড়া আমি দিয়ে আসব তোকে। (ইরফান)
-না না প্রয়োজন নেই আমি একাই যেতে পারব। (মিতুল)
-চুপচাপ বাইরে গিয়ে দাড়া। তোর স্কুলে আমারই বন্ধু ইশতিয়াক ইংলিশ টিচার হিসেবে আছে। ও আমার কাছে তোর নামে কিছু রিপোর্ট দিয়েছে। সব সামনাসামনি গিয়ে ভালো করে শুনব আজ। (ইরফান)

ইরফানের কথা শুনে মিতুলের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। আবার কিসের রিপোর্ট গেল তার নামে? এবার তো সে কিছু করেনি। মনে মনে শঙ্কিত হয়ে বিড়বিড় করে মিতুল বলে ওঠে, “ মিতুল আব তো তু গায়া কামছে ।“

-কিসের রিপোর্ট দিয়েছে তোমাকে ইরফান? আবার কি করেছে এই ফা/জি/ল? (মেহেরাব খান,মিতুলের বাবা)
-মেঝো মামা আমি বিস্তারিত শুনে এসে আপনাকে জানাচ্ছি। এখন উঠছি। (ইরফান)

ইরফান নিরবে অতি সাবধানে বাইক চালাচ্ছে। মিতুলের শরীর এখনো ভয়ে কাপছে। না জানি কোন বিপদের সংকেত এই নিরবতা।

-ইরফান ভাই বলুন না কি রিপোর্ট দিয়েছে আপনাকে স্যার? আমিতো কিছু করিনি। (মিতুল)
-আরে রিল্যাক্স মিতুল। কেউ কোনো রিপোর্ট দেয়নি। দেখলিনা কিভাবে বিয়ের কথা তুলছিল সবাই। তাই সেখান থেকে বের হয়ে আসার জন্যই একটা বাহানা দেখিয়ে দিলাম। (ইরফান)

এবার মিতুল কিঞ্চিত রাগের স্বরে বলে ওঠে, “তাই বলে আমাকে এভাবে অযথা ফাসিয়ে দেবেন?”
মিতুলের কথায় হোহো করে হেসে ওঠে ইরফান।
-তখন মায়ের জন্য তো তোর শাস্তি কমে গেল। এখন তা পুশিয়ে নিলাম। কেমন দিলাম? (ইরফান)
ইরফানের কথা শুনে রাগে দুঃখে চলন্ত বাইক থেকে ঝাপিয়ে পড়তে মন চাইছে মিতুলের।

স্কুল আর ব্যাচের পড়া শেষ করে শেষ বিকালে বাড়ি ফিরেছে মিতুল। সন্ধ্যার দিকে টিভিতে একটা হিন্দি গান ছেড়ে দিয়ে ভাতের প্লেট নিয়ে সোফায় এসে বসে মিতুল। কিছুক্ষণ বাদে আচমকা মিতুলের হাত থেকে রিমোটটা কেড়ে নিয়ে টিভি অফ করে দেয় ইরফান।

-এটা কি হলো ইরফান ভাই? (মিতুল)
-দেব কানের নিচে একটা। খাওয়ার সময় কাউকে এভাবে টিভিতে গান ছেড়ে দিয়ে খেতে দেখেছিস মিতুল? যেখানে খাওয়ার সময় দরকার ছাড়া কথা বলাও উচিত না ।এটা কোনো ভদ্রটার মধ্যে পড়ে? (ইরফান)
-ওকে কিছু বলে লাভ নেই ইরফান। ও জীবনেও আমাদের একটা কথা কানে নেয়না। (মিতুলের মা)

কথাগুলোতে মিতুলের কিছুটা অপমানবোধ হয়। আবার সে বুঝতেও পারে যে এমনটা করা তার উচিত নয়। তারপর আর একটা কথাও না বলে চুপচাপ খাওয়া শেষ করে মিতুল।

মিতুলের হঠাৎ মনে পড়ে সে তো আজ ছাদের গাছগুলোতে একদম পানি দেয়নি। এই সন্ধ্যাতেই দৌড়ে ছুটে যায় ছাদে। মায়ের ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে ছাদে প্রবেশ কররে সে।ফোনের আলো ছাড়াও চাঁদের মৃদু আলোতে চারপাশ বেশ স্পষ্ট আজকে। এককোণে রেলিং ঘেষে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয়ে চমকে ওঠে মিতুল। পরক্ষণেই নাকে সিগারেটের তীব্র গন্ধ ভেসে আসতেই ভ্রু কুচকে আসে তার। কয়েক পা এগিয়ে যেতেই মিতুল চলার গতি থামিয়ে দেয়। এমন দৃশ্য দেখে নিজের চোখকে সে যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা। বুকের মাঝে ধক করে উঠে মিতুলের। প্রস্থান করতে নিবে সেই মুহূর্তেই অবয়বটা বলে ওঠে, “দাড়া মিতুল।“

দাঁড়িয়ে যায় মিতুল। মনে একরাশ সাহস জুগিয়ে বলে ওঠে,
-আপনি সিগারেট খান ইরফান ভাই!

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে