মেঘের ছায় পর্ব-০১

0
1086

#মেঘের_ছায়া (১)

আহ বলে চিৎকার দিতেই, মা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছেন। আমার হাতে রক্ত দেখেই মা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ কি করে কাটলো ফারা?’

আমি কিছুই বলতে পারলাম না, ব্যথা গিয়ে লাগছে বুকে, বুকের স্পন্দন দ্রুত বেড়ে গিয়েছে, হাত থেকে অঝোরে রক্ত পড়ছে। কাটাকাটিতে এক্সপার্ট আমি কিন্তু আজ সামান্য পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে ছুরিটা লেগে গেল বাম হাতে। বাসায় মেহমান আসবে বলে ভাবলাম মাকে একটু হাতে হাতে সাহায্য করে দেই। আশফাক ভাই অনেক বছর পর আমেরিকা থেকে দেশে ফিরেছেন।পড়া লেখার সুবাদে আমেরিকায় বড় হয়েছেন। ফুফু- ফুফা, আসফাক ভাই রাতে আমাদের বাসায় খাবেন বলে দাওয়াত করা হয়েছে । তাদের বাসা আমাদের বাসার কাছেই। মায়ের কথায় ঘোর ভাঙলো। মা উদ্ধিগ্ন কণ্ঠে বললেন, ‘ রুমে যা ফারাহ, তোকে আর কাজ করতে হবে না বাকিটুকু আমি করে নিব।’

নিজে রুমে চলে আসলাম।কিছুক্ষণ পর ছোট ভাই সৌরভ রুমে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘ দেখতো আপু আমাকে এই শার্টে কেমন লাগছে। আমি ভাইয়ের মুখ পানে একবার তাকালাম, উপর থেকে নিচে চোখ বুলিয়ে নিলাম।
ভাইকে দেখে মনে মনে হাসতে লাগলাম। শ ক্লাস ফাইভে পড়ে কিন্তু সে এমন সাজসজ্জা করলো না হেসে পারলাম না। লাল শার্ট এর সাথে লাল প্যান্ট লাল জুতো লাল সানগ্লাস। ছোট মানুষ কিছু বললেও মন ভেঙ্গে যাবে তাই আর কিছুই বললাম না।’
সৌরভ ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ নিশ্চয়ই ভালো লাগছে আমাকে তাই না আপু। আশফাক ভাই থেকে আমি কম কিসে বলতো? তবুও সবাই ভাইকে দেখবার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে। দাদুকে দেখ না, যেই শুনেছে আজ আশফাক ভাই আসবেন, তারপর থেকে উনি যেন উনি আমাকে চেনেই না।
ভালোই ভালোই আশফাক ভাই বিদায় হোক আমিও দাদুকে চিনবই না।’

ফারাহ ভাইকে এতটা রাগান্বিত দেখে শান্ত হতে বলল। ভাইকে কোলে বসিয়ে গালে আদর দিয়ে বলল, ‘ কে বলল আশফাক ভাই সেরা আমার ভাই তো হলো সবার সেরা সুন্দর। ‘

বোনের মুখে প্রশংসা শুনে সৌরভ খুশিতে খিল খিল করে হাসতে লাগলো। ফারাহ মুগ্ধ হয়ে দেখছে আর ভাবছে , ছোটদের অনুভূতি থাকে ছোট, সামান্য আনন্দেই তারা দ্বিগুণ খুশি হয়ে যায়।

মন মস্তিষ্ক ঠান্ডা করে বসে আছে ফারাহ। সন্ধ্যা হওয়ার অপেক্ষায় আছে সে। জানালার কিনারায় বসে বসে বিকেলের সাজানো ছায়ার খেলা আর বেলা শেষের নিশ্চুপ কলতান উপভোগ করছে আরো ভেসে আসছে পাখির কলরব।
সুমধুর কন্ঠে আযান কানে ভেসে আসতেই ফারাহ মাথায় ঘোমটা টেনে নিল। তড়িঘড়ি করে সে রুমে গেল। অজু করে এসে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। নামাজ শেষ হতেই সৌরভ এসে বলে গেল, আশফাক ভাই ফুফু ফুফা এসেছেন।

এক মিনিট নীরবতার মাঝে নিজের উত্তপ্ত হয়ে ওঠা মাথাটা শীতল করে মাথায় খুব ভালোভাবে হিজাব পরিধান করে নিজেকে খুব ভালভাবে ঢেকে নিল ফারাহ। ফুফু কে সে দেখা দিলেও ফুফা এবং আশফাক ভাইকে দেখা দেবে না ফারা। কেননা ফারার জন্য আসফাক ভাই হলেন নন-মাহরাম।
নন- মাহরাম হলো যার সাথে দেখা দেওয়া জায়েজ নাই। আসফাক ভাই ফারার জন্য পরপুরুষ। যা ইসলামে স্পষ্ট হারাম।

আসফাক ভদ্রতার সাথে বসে আছে সোফায়।মামা-মামী দাদুর সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করলো খুব আগ্রহের সাথে । সবার সাথে টুকটুক কথা সেরে সৌরভকে কাছে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আদর দিয়ে তাকে একটা খেলনা গিফট দিয়ে বললো, ‘ এইটা তোমার জন্য আমেরিকা থেকে নিয়ে এসেছি।’

আমেরিকা থেকে আনা হয়েছে শুনে সৌরভ দ্বিগুণ আগ্রহ নিয়ে খেলনাটা নিয়ে সন্তোষজনক হাসি হাসলো। সবার জন্য টুকটাক গিফট নিয়ে এসেছে আশফাক। অব্যক্ত চাহনি বারবার করে খুঁজে বেড়াচ্ছে একজনকেই শুধু। মুখ ফুটে কাউকে কিছুই বলতে পারছে না আসফাক। মনে রাগ পুষতে লাগলো। তাকে দেখবার জন্য মন যেন আরো বেশি ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। আশফাকের মস্তিষ্ক বারবার করে ওকে জানান দিচ্ছে
‘ বি কেয়ারফুল’ আশফাক।

দাদু মামা-মামী খুব যত্ন করে খাওয়াচ্ছে।
খাওয়ার পর্ব শেষ করে আসফাক দাদুর সঙ্গে গল্পআসরে বসলো। গল্পের মাঝে আসফাক দাদুকে সাত পাঁচ আর না ভেবে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, ‘দাদু ফারাহ কোথায়? সে কি জানে না আমি আসবো!’

দাদু হেসে জবাব দিল, ‘ ফারা কি এখন আর ছোটটি আছে যে, আগের মতো হইচই করে তোর সামনে আসবে। সে তো এখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। সে নন- মাহরাম মেনে চলে তাই তো সে তোর সামনে আসেনি।’

আসফাক দাদুর কথার আগা মাথা যেন কিছুই বুঝল না সে, চোখ বুঁজে অভিমানী মনে কিছু একটা ভাবল।

মাঝখানে ফুফু ফুফা ফারার কথা একবার জিজ্ঞেস করেছিল। ফারার মা কিছু একটা বলে তাদের বুঝ দিয়ে দিলো।ফারার মা জানে, পৃথিবী উল্টে গেলেও ফারাহ এখন নিচে নামবে না। কেননা তার মেয়ে যথেষ্ট পর্দা মেনে চলে।

আশফাকের লাগামছাড়া হৃদয় যেন ফারাহকে দেখা ছাড়া শান্ত হচ্ছেনা। তাই সে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, যা হবার হবে যে কোন মূল্যে সে ফারার সাথে দেখা করবেই। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আসফাক। দীর্ঘদিন আমেরিকা থাকবার ধরুন, আসফাকের কাছে পর্দাটা একটা হাস্যকর ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই নয়।

এদিকে ফারাহ রুম অন্ধকার করে বসে আছে। চাঁদের কিঞ্চিৎ আলো এসে ছড়িয়েছে রুমে। মনে মনে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে দোয়া করছে, তাকে যেন কোন বিপদে না পড়তে হয় আজ।
ফারাহ নিজের ভাবনায় মগ্ন থাকায় নিজের রুমে কারো আসার অস্তিত্ব টের পেল। কিন্তু কে এসেছে সেটা বুঝতে পারল না স্পষ্ট।সে উত্তেজনাপূর্ণ মৃদু কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কে’?

অপর পাশ থেকে কোন সাড়া পেল না ফারাহ।

আকস্মিকতা ঘটলো তখন।

হঠাৎ ফারার সঙ্গে আরও নিবিড় হয়ে এসে দাঁড়ালো কেউ। ওর মুখের উপর ঝুঁকে অভিমানী কন্ঠে জড়ানো চোখে তাকিয়ে ফারাহকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ যখন আমি তুমি একসাথে একাকী নির্জনে থাক না অন্য সব কথা এক কোণে। তোমারই জন্যই তো ছোটে এসেছি মরিয়া হয়ে।’

ফারাহ অচেনা কন্ঠ শুনে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে। সে দরদর করে ঘামতে লাগলো। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না অচেনা মানুষটা যে আর কেউ নয় এটা আশফাক ভাই।ফারাহ আরো বেশি চমকালো। উদ্ধিগ্ন কণ্ঠে ফারাহ জিজ্ঞেস করলো,

‘আশফাক ভাই আপনি এখানে?’

-‘তুই নিচে যাস নি কেন, আমার সাথে দেখা করিস নি কেন? তাই তো আমায় তোর কাছে আসতে হলো।’

ফারাহ ভেবে পাচ্ছে না তাই বলে আসফাক ভাই মনুষ্যত্বহীনতার পরিচয় দিতে উপরে চলে আসবেন।ফারাহ মনে মনে ভয় পাচ্ছেন এবং আল্লাহকে ডাকছে।

আসফাক একটু একটু করে ফারার কাছে আসছে লাগলো।ফারাহ তা বুঝতে পেরে আশফাককে সজোরে ধাক্কা মারলো । টাল সামলাতে না পেরে আসফাক ছিটকে পড়লো ড্রেসিং টেবিলের উপর।

ফারাহ চিৎকার করে বলল, ‘ আপনি জানেন না শয়তান মানুষের শিরা উপশিরায় চলাচল করে, কোন গায়ের মাহরাম মহিলার সাথে একাকি অবস্থানের সুযোগের মাধ্যমে অশ্লীল কাজে লিপ্ত করা শয়তানের একটি চক্রান্ত। এজন্যই শরিয়াতে উক্ত রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোন পুরুষ একজন মহিলার সাথে নির্জনের মিলিত হলে তাদের তৃতীয় সঙ্গী হয় শয়তান।
(তিরমিজি মিশকাত হাদিস নং- ৩১১৮)

তাই আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সতর্ক করতে গিয়ে বলেন,

-‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না, যে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাকে তো সেই অশ্লীল ও অন্যায় কাজেরই হুকুম দেয়।
(সূরা আন নুর আয়াত -২১)

আশফাক মনে মনে খুব লজ্জিত বোধ করলো, তার চোখমুখ শক্ত হয়ে আসছে। সে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সজোরে দেয়ালের সাথে ঘুষি মারলো এবং ফারার রুম ত্যাগ করলো।

-চলবে —

©আফরিন ইভা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে