#মেঘের_আড়ালে_রোদ
#সিজন_2
#পর্ব_৫
লেখিকা #Sabihatul_Sabha
দুই ঘন্টা পর অপারেশন রুম থেকে বের হয় আহনাফ।
মহুয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল এক পাশে।
আহনাফ কোনো দিকে না তাকিয়ে চলে গেল।
মহুয়ার সামনে এসে একজন ডাক্তার বললো অপারেশন সাকসেসফুল।
দেহে প্রাণ ফিরে পেল। মিম জড়িয়ে ধরলো মহুয়াকে।
রাতে মহুয়া চুপচাপ বসে ছিল আলভির পাশে। মিমের ভীষণ খিদে পেয়েছে মহুয়া মিম কে আলভির পাশে বসিয়ে মহুয়া হসপিটাল থেকে বের হলো।
হসপিটালের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকিয়ে মোবাইল দেখলো কয়টা বাজে।
সামনে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কেউ পেছন থেকে ডেকে উঠলো ” মহুয়া ”
পা সাথে সাথে থেমে গেল মহুয়ার, হৃদপিন্ড ছেদ করে উঠলো।
পেছন ফিরে দেখলো ছোঁয়া তাকিয়ে আছে। ছোঁয়া কে দেখেই মহুয়ার চোখে জল জমা হলো ছোঁয়া ধীর পায়ে মহুয়ার কাছে আসলো। নিজের অজান্তেই ছোঁয়ার হাত মহুয়ার গালে চলে গেলো।
ছোঁয়া মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না একটা চিমটি দাও’
মহুয়া নিজেও স্তব্ধ হয়ে গেছে এখানে ছোঁয়া কে দেখে। সে কি বলবে! কি করবে বুঝতে পারলো না তার আগেই ছোঁয়া ওকে জড়িয়ে ধরলো। মহুয়া চমকে উঠলো।
ছোঁয়া বসে আছে আলভির পাশে। চোখে পানি মুছে আলভির গালে হাত রেখে বললো” ফুপিমণি ”
মহুয়া চুপচাপ তাকিয়ে ছোঁয়া কে দেখছে।
ছোঁয়া আলতু হাতে আলভির মুখে হাত বুলিয়ে মহুয়ার দিকে তাকালো।
মিম নিজেও অবাক হয়েছে ছোঁয়া কে দেখে। এক এক করে সবার সাথে দেখা হয়ে যাচ্ছে।
ছোঁয়াঃ তুমি কোথায় ছিলে মহুয়া.? কতো খুঁজেছি তোমাকে! কোথাও পাইনি।
মহুয়াঃ কেমন আছো.?
ছোঁয়া হাসলো, হেঁসে বললো,’ এই ত বেশ ভালো আছি’..
মহুয়া কিছু বললো না।
ছোঁয়া এসে মহুয়ার পাশে বসে বলে উঠলো, ‘ তোমাকে সবাই অনেক মিস করে। এভাবে হুট করে কি হয়ে ছিল!.? তুমি হারিয়ে গেলে ভাই পাল্টে গেলো.?
মহুয়া কে চুপ দেখে ছোঁয়া বলে উঠলো, ‘ প্লিজ আজ চুপ থেকো না। ‘
মহুয়া নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করেও পারলো না শব্দ করে কান্না করে দিল।
ছোঁয়া জড়িয়ে ধরলো মহুয়া কে। শান্ত করার চেষ্টা করলো। স্বামী কে সামনে দেখেও পালিয়ে বেরিয়েছে, জীবন থেকে প্রতি নিয়ত পালিয়ে বেড়াচ্ছে! কিন্তু কেনো!.?
ছোঁয়া ঘড়ির দিকে তাকালো, ডিউটির টাইম হয়ে গেছে৷
মহুয়া নিজেকে শান্ত করে চুপ করে রইলো।
মিম ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ আপনি এখন এখানে.? কেউ অসুস্থ!..?
ছোঁয়াঃ না, আমি এই হসপিটালের ডক্টর।
সময় গড়িয়ে রাত অনেক হলো। নিরুপমা কল দিয়ে জেনে নিলো ছোঁয়া কোথায় আছে.? খেয়েছে কিনা”.?
ছোঁয়া মহুয়ার কথা বলতে চাইলে মহুয়া নিষেধ করলো কাউকে ওর কথা বলতে।
ছোঁয়াঃ প্লিজ মহুয়া সবটা খুলে বলো।
মহুয়া লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বলে উঠলো, ‘ বিয়ের পর সব ঠিক চলছিলো, আহনাফ আর আমার মধ্যে ভালোবাসার কমতি ছিল না। কিন্তু বেশি দিন সেই ভালোবাসা আমার ভাগ্যে সহ্য হলো না, নজর পরলো এক নরপিশাচের। আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য মামা যখন ছবি দিয়ে ছিলো তখন সেই ছবি গিয়ে পড়ে ছিল মাহিনের হাতে। প্রথম দেখায় নাকি সে আমার প্রেমে পড়ে তারপর বিয়ের দিন পালিয়ে যাওয়া আমাকে আর খুঁজে পায়নি ও। যখন আবার মিম কে আনতে ওর শশুর বাড়িতে গেলাম সেখানে মাহিন আমাকে সামনাসামনি দেখে সেই পুরনো প্রেম জেগে উঠে। আমার বিয়ের কিছু দিন পর থেকে আমি লক্ষ করি কেউ আমাকে ফলো করে প্রথমে ভাবতাম হয়তো মনের ভুল। একদিন রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় হাতেনাতে ধরে ফেললাম মাহিন কে। জিজ্ঞেস করার পর বললো ওর ফলো করতে ভালো লাগে। কয়েকদিন এভাবে চলে একদিন রাতে আমার কাছে অচেনা নাম্বার থেকে কল আসে, কল রিসিভ করতেই আমাকে ভয় দেখানো হলো, আহনাফ কে ডিভোর্স না দিলে আমার অতীত সম্পর্কে শশুর বাড়িতে সব বলে দেওয়া হবে। আমি সেদিন ভীষণ ভয় পেয়ে ছিলাম, একটা সুন্দর গুছানো সংসার হারানোর ভয়, মায়ের মতো শাশুড়ী হারানোর ভয়, স্বামী হারানোর ভয়। তাও আমি কল কেটে সিম খুলে নিলাম।
তার দুইদিন পর একটা চিঠি আসলো, বেশ অবাক হয়ে ছিলাম এই যুগে এসেও চিঠি!!
চিঠি খুলে দেখলাম সেই একই কথা আহনাফ কে ডিভোর্স দিতে না হলে ওকে শেষ করে দিবে।
আমি ভয় পেলেও তা কাউকে বললাম না।
তারপর তোমার ভাইয়ের এক্সিডেন্ট হলো। আমি ভীষণ ভাবে ভেঙে পরে ছিলাম। অনেক চেষ্টা করেছি কে সে খুঁজে বের করার কিন্তু পারিনি। আমার মনে তখন আহনাফ কে হারানোর ভয় ঢুকে গিয়ে ছিল।
আহনাফ একটু সুস্থ হতেই আবার একটা গিফট বক্স আসলো সেখানে লেখা ছিল ‘ এই এড্রেসে না আসলে আহনাফ কে একদম শেষ করে দিবে, আস্তে আস্তে চোখের সামনে প্রিয় জনের মৃত্যু দেখতে হবে।” আমি ভয় পেয়ে গিয়ে ছিলাম কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।
সন্ধ্যার দিকে সেই এড্রেসে গেলাম, হোটেল নাম্বার ৩০৩ এ যেতেই দরজা খুলে গেলো। আমি ভয়ে ভয়ে রুমে প্রবেশ করতেই রুমের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে ছিলাম। কিন্তু সেই দরজা সারারাত খুলতে পারিনি ভেতরে কেউ ছিল না। আমি ভীষণ অবাক হয়ে ছিলাম শুধু মাত্র রুমে আটকে রাখার জন্য একটা মানুষকে কেনো এতো কিছু করে আনা হলো!.? সকাল হতেই দরজা খুলা পেলাম। কারো দেখা না পেয়ে জলদি হসপিটালে ফিরে আসলাম।
সেই দিনের পর থেকে আহনাফ বদলে গেল। আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হলো। আমার শরীর অসুস্থ থাকায় নিজেই হসপিটালে গেলাম আহনাফ ভীষণ ব্যস্ত আমার খবর রাখার সময় কোথায়! আমাদের দেখা হতো মাঝে মধ্যে একই বাসায়, একই ছাঁদের নিচে থাকলেও আমাদের কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল। হসপিটাল থেকে সব টেস্ট করিয়ে বাসায় এসে সব চেয়ে প্রথম খুশির খবরটা আহনাফ কে দিব বলে কাউকে কিছু বললাম না। আহনাফ আসলো রাত ১টায়। আমি অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে ছিলাম তাও ঘুম ভেঙে গেল। আহনাফ কে দেখে খুশিতে সেই খবর বলতেই মুখের রং বদলে গেলো ওর। বেশ রেগে গেলো ঝগড়া শুরু করলো। এক পর্যায়ে বলে উঠলো ” এই বাচ্চা আমার না” আমি সেই দিন নিজের কান আর নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। দিন দিন এতোটা দূরত্ব হয়েছে যে আজ আমার সন্তান কে অস্বীকার করছে! শুরু হলো আমাদের ঝগড়া। এতোদিন মেনে নিলেও সেই দিন আহনাফের এই কথা আমাকে ভেতর ভেতর শেষ করে দিয়ে ছিল।
প্রতিদিনের ঝগড়া এক পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ালো সম্পর্ক শেষ করায়। তোমার ভাইয়ের ধারনা ওইদিন আমি কারো সাথে হোটেলে.. বলেই মহুয়া কাঁদতে শুরু করলো। কে কি বলেছে আমি জানিনা! আহনাফ কার কথা শুনে ছিল তাও আমি জানতাম না, কি ভিডিও দেখেছিল তাও আমি জানতে চাইনি যেখানে বিশ্বাস শব্দটা নেই সেখানে আমি আর কি বলবো!
আমি নিজের মতো চেষ্টা করলাম সেই লোককে খুঁজে বের করতে। খুঁজে বেরও করলাম কিন্তু তাতে আরও সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো। আমি মাহিন কে জিজ্ঞেস করলাম কেনো সে এমন করছে.? এতে ওর লাভ কি.?
মাহিন বলে ছিলো, সব ছেড়ে ওর কাছে চলে আসতে। আমি থাপ্পড় মেরে বলে ছিলাম ওকে আমি ছাড়বো না। দূর থেকে আমাদের এক সাথে দেখে তোমার ভাই ভেবে নিলো অন্য কিছু। বাসায় আসতেই সে আমাকে ডিভোর্স পেপার ধরিয়ে দিল৷
আমি সবটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম কিন্তু আহনাফ কিছুই শুনতে চাইলো না। আমার মনে হলো সে মুক্তি চাচ্ছে দিয়ে দিলাম মুক্তি।
ছোঁয়াঃ ডিভোর্স পেপারে সাইন করে ছিলে.?
মহুয়াঃ নাহ্..
ছোঁয়াঃ মাহিন কে ছেড়ে দিয়ে ছিলে.?
মহুয়াঃ নাহ্.. আমি তোমাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে মেঘলার সাহায্যে ওর কাছে পৌঁছাই। ওর বুকে ছুরি মেরে ছিলাম, ওর হলো কৈ মাছের প্রাণ তাও বেঁচে গেছে। হসপিটাল থেকে মিথ্যা খুনের আসামী বানিয়ে সারাজীবনের জন্য কারাগারে পাঠিয়ে দিয়ে ছিল মেঘলা। তাও কিভাবে আজ ছাড়া পেয়ে গেলো!!…
ছোঁয়া অবাক হয়ে বললো,’ এতো কিছু হয়ে গেলো আর আমি বুঝতেই পারিনি।’
মহুয়াঃ বাদ দাও যা হয় হয়তো ভালোর জন্যই হয়। আমি আমার ভাগ্য মেনে নিয়েছি আমার ছেলে নিয়ে ভালো আছি। তোমার কি খবর.? বিয়ে করেছো?
ছোঁয়া মুচকি হেসে বললো,’ ভালো পাত্র পেলে করে নিব।’
মহুয়াঃ নির্জন!..
ছোঁয়াঃ আজ ওর বিয়ে..
মহুয়াঃ কি বলছো.? সত্যি.?
ছোঁয়াঃ হুম।
মহুয়াঃ সবাই তোমাদের সম্পর্কের কথা জানতো তারপর ও কিভাবে.?
ছোঁয়া প্রথম থেকে সবটা খুলে বললো মহুয়া কে।
মহুয়ার চোখে পানি চিকচিক করছে। সবার জীবনে এতো কষ্ট কেনো! কোথাও সুখ নেই..
____________
নির্জন রুমে গিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে বের হয়ে গেল। রাত দুইটা বাজে এখন ওকে ছোঁয়ার কাছে যেতে হবে, সব ঠিক করতে হবে, ছোঁয়া কি ওকে মেনে নিবে আর.? এইসব লুকোচুরি শেষ করতে হবে….
আহনাফ হসপিটাল থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় মহুয়াকে দেখেছে। সেই শাড়ি, চোখে চশমা, চুল বিনুনি করা নারীকে দেখে থমকে গিয়ে ছিলো প্রথম দিনের মতো.. এতো বছর পর কেনো.? আবার কেনো ফিরেছে এই শহরে..? এই বার যে আহনাফ কে দেওয়া প্রতিটা কষ্ট আহনাফ ফিরিয়ে দিবে। এমনি এমনি কিছুতেই ছাড়বে না সে মহুয়া কে৷ মহুয়ার জন্য কি অপেক্ষা করছে সে নিজেও কল্পনা করতে পারছে না।
চলবে….
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।