মেঘবদল পর্ব-০৩

0
684

#মেঘবদল
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৩

ঝুম বৃষ্টির পর আকাশ গুমোট বেধে আছে। আবার যে কোন সময় শুরু হতে পারে বৃষ্টি। মৃন্ময়ী এখনও কাচের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। বাইরের রাস্তায় পানি জমে আছে। তার মধ্য দিয়েই একটা দুইটা করে গাড়ি চলছে।
–ম্যাডাম আর কিছু খাবেন?

ঘাড় ফিরিয়ে ওয়েটার ছেলেটার দিকে তাকাল মৃন্ময়ী। হ্যাংলা পাতলা একটা ছেলে। অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার উত্তরের জন্য। সে শান্ত গলায় বলল
–এক কাপ কফি দিতে পারবে?

তার কথায় যে ছেলেটি বেশ অবাক হল সেটা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কারন সে গত এক ঘণ্টায় তিন কাপ কফি খেয়ে ফেলেছে। এবারের টা দিলে চতুর্থ কাপ হবে। মৃন্ময়ী ছেলেটির অবাক হওয়ার কারন বুঝতে পেরেও খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–কফি দিতে পারলে দাও।

ছেলেটি মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। মৃন্ময়ী আবারো বাইরের দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। টেবিলে পড়ে থাকা ফোনটা কেঁপে উঠলো তীব্র শব্দে। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখল মিনা খালা ফোন করেছে। ফোনটা তুলতে মিনা অস্থির ভাবে বলে উঠলো
–মৃনু? ছেলেটা এসেছে? তুই কি এখনও হোটেলে বসে আছিস?

এতো বড় একটা রেস্টুরেন্টকে মিনা খালার হোটেল সম্বোধন মৃন্ময়ীর পছন্দ হল না। মিনা খালা মানুষটাই এমন। জায়গা না বুঝেই এমন কথা বলে ফেলেন যাতে মান অপমানের ব্যাপার হয়ে যায়। বেশ বিরক্ত হয়ে বলল
–এটাকে হোটেল বলেনা খালা রেস্টুরেন্ট বলে।

মিনা খালা মৃন্ময়ীর কথায় পাত্তা দিলেন না। বললেন
–অতো কিছু বুঝি না। যেখানে খাবার খায় আমরা সেটাকে হোটেল বলেই জেনে এসেছি। এখন তো কতো নাম বেরিয়েছে। আচ্ছা বল ছেলেটা কি এসেছে?

–না এখনও আসে নি।

মৃন্ময়ী হতাশ গলায় বলতেই মিনা খালা চেচিয়ে বললেন
–এখনও আসেনি তাহলে কখন আসবে? ছেলের কি কোন সেন্স নেই? একটা মেয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে অথচ সেই ছেলে এখনও আসে না। বিয়ের আগেই যদি এমন হয় তাহলে পরে কি হবে? আমি তোকে বলছি মৃনু তুই এই ছেলেকে না করে দে। তুই এখানে সুখি হবি না।

–খালা! বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিলো এতক্ষন। এই বৃষ্টিতে বাইরে বের হওয়া সম্ভব নয়। মাত্র বৃষ্টিটা কমলো। আর কিছুক্ষণ দেখি।

মৃন্ময়ীর শান্ত গলা শুনে মিনা বিরক্ত হয়ে বলল
–এটা কোন কথা না মৃনু। তুই বৃষ্টির আগে যেতে পারলে ছেলেটা কেন আসতে পারবে না? কি সব চাকরি করে বলে এতো ভাব? তুই চলে আয় মৃনু।

মৃন্ময়ী কিছু বলার আগেই ওয়েটার কফির কাপটা দিয়ে গেলো। মৃন্ময়ীকে চুপ করে থাকতে দেখে মিনা আবারো বলল
–তুই আমার কথা শোন মৃনু। তোর ভালো হবে।

একটা কাল রঙের টয়োটা গাড়ি রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়াল। সেদিকে মনোযোগ দিয়ে তাকাল মৃন্ময়ী। একজন সুদর্শন পুরুষ সেই গাড়ি থেকে নামল। সোজা রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকে গেলো। এদিক সেদিক তাকাচ্ছে অস্থির ভাবে। মৃন্ময়ী মৃদু সরে বলল
–খালা আমি রাখছি। পরে কথা হবে।

বলেই ফোনটা কেটে দিলো। মনোযোগ দিয়ে সেদিকে তাকাতেই চোখ আটকে গেলো মৃন্ময়ীর। সেই পুরুষের শত শত রমণীর দৃষ্টি কেড়ে নেয়ার ক্ষমতা আছে। তীক্ষ্ণ সৌন্দর্যের ধারক তিনি। মুহূর্তেই তার মন ভার হয়ে গেলো। মনে হল এই মানুষটার সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়ে থাকলে মানুষটার প্রতি চরম অন্যায় করা হবে। কারন সে শ্যাম বর্ণের এক রমণী। আর এই মানুষটা সাক্ষাৎ রাজপুত্র। লোকটাকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে মৃন্ময়ীর বুকের কাপন বেড়ে গেলো। হাত পাও কাঁপছে মৃদু। লোকটা এসে সামনে দাড়িয়েই জিজ্ঞেস করলো
–মৃন্ময়ী মজুমদার?

মৃন্ময়ী উঠে দাঁড়াল। অসাভাবিক ভাবে চোখের পাতা এদিক সেদিক ঘুরিয়ে মৃদু সরে বলল
–জি।

ঠোট এলিয়ে হেসে হাত বাড়িয়ে দিলো। মৃদু সরে বলল
–আমি নাহিদ। নাহিদ শাহরিয়ার।

হাত বাড়িয়ে দিতে অসস্তি হচ্ছে মৃন্ময়ীর। ভাবছে কি করবে। কিন্তু না বাড়িয়ে দিলেও বিষয়টা খারাপ দেখাবে। তাই ভীষণ অসস্তির মাঝেই হাত বাড়িয়ে দিলো। নাহিদ হাত ধরেই বুঝতে পারল সে কাঁপছে। তাই হাত ছেড়ে দিলো। অপ্রস্তুত হয়ে বলল
–সরি। আসলে অফিসিয়াল মিটিং এ এভাবে হাত মেলাতে হয় তো। তাই…।

–না না। ঠিক আছে।

নাহিদের কথা শেষ করার আগেই সে অতি ভদ্রভাবে উত্তর দিলো। নাহিদ হেসে বসতে ইশারা করলো। মৃন্ময়ী বসে পড়ল। নীরবে কেটে গেলো কিছু প্রহর। বাক্রুদ্ধ দুজনই। দুজনের জীবনেই এই পরিস্থিতি প্রথম। নাহিদ চোখ তুলে তাকাল। শ্যামবর্ণের মেয়েটি চোখ নামিয়ে বসে আছে। চেহারায় মিষ্টতা আছে তার। কিভাবে কথা শুরু করবে ভাবছে। ঠিক সেই সময় কফির কাপে চোখ পড়ল। কয়েক চুমুক হয়তো খেয়েছে। বাকিটা পুরোটাই পড়ে আছে। সেটার সুত্র ধরেই বলল
–কফি খাচ্ছিলেন বুঝি? ঠাণ্ডা হয়ে গেছে তো। আরেক কাপ দিতে বলি?

মৃন্ময়ী তাকাল। অস্থির ভাবে বলল
–না প্লিজ! আর খাব না।

আবার নিচের দিকে তাকাল। দুজনেই আবারো চুপ হয়ে গেলো। কয়েক মুহূর্ত কেটে যেতেই নাহিদ শান্ত সরে বলল
–আসলে আমি অফিসিয়াল মিটিং ছাড়া এভাবে মেয়েদের সাথে আগে কখনও কথা বলিনি। তাই একটু ইতস্তত বোধ হচ্ছে।

মৃন্ময়ী কোন উত্তর দিলো না। নাহিদ কিছুক্ষণ থেমে আবারো বলল
–এভাবে চুপ করে থাকলে কোন কথাই হবে না। আর বাসায় গিয়ে যখন জিজ্ঞেস করবে আমার মেয়ে পছন্দ হয়েছে কি না সেটার উত্তর দেয়া আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

মৃন্ময়ী চোখ তুলে তাকাল। অগোছালো ভাবে বলল
–কঠিন হবে কেন? সত্যিটাই বলবেন। যা আপনার মনে চলছে।

নাহিদ ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো
–কি চলছে আমার মনে?

মৃন্ময়ী ভীষণ অবাক ভঙ্গিতে বলল
–আমি কিভাবে বলবো আপনার মনে কি চলছে?

থেমে আবার বলল
–তবে আমি জতদুর আন্দাজ করতে পারছি পজিটিভ কিছু নয়।

নাহিদ মৃদু হাসল। শান্ত ভাবে বলল
–হয়তো আপনি ভাবছেন আপনাকে আমার পছন্দ হয়নি বলে কথা বলছি না। সেরকমটা কিন্তু নয়।

মৃন্ময়ী হেসে ফেললো। নাহিদের দিকে তাকিয়ে বলল
–আমি কিছুই ভাবছি না। আমার মনে হল তাই বললাম। বাকিটা আপনার মন জানে।

–আপনি মনের কথা জানতে চান না?

নাহিদের আবেগি কথা কানে লাগতেই অবাক চোখে তাকাল সে। মৃদু সরে বলল
–চাই।

নাহিদ মুখ ভরে হাসল। মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে বলল
–কি খাবেন?

মৃন্ময়ী মাথা নাড়াল। যার অর্থ সে কিছুই খেতে চায় না। নাহিদ তবুও ওয়েটারকে ডেকে কিছু খাবারের অর্ডার দিলো। ওয়েটার চলে যেতেই বলল
–আপনার কি এখন বিয়ে করার ইচ্ছা নেই?

মৃন্ময়ী চোখের পাতা পিটপিট করে তাকাল। নাহিদ আবারো বলল
–বাড়ি থেকে কি বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে? আপনি কি মানসিক ভাবে প্রস্তুত না?

মৃন্ময়ী চোখ নামিয়েই বলল
–সেরকম কিছু না।

–তাহলে কি রকম?

সে নাহিদের কথার উত্তর ভাবতে লাগলো। এর মাঝেই ওয়েটার খাবার নিয়ে এলো। নাহিদ প্লেটে খাবার তুলে নিয়ে মৃন্ময়ীর দিকে এগিয়ে দিলো। বলল
–খান।

খাবারের গন্ধে গা গুলিয়ে এলো তার। এতো গুলো কফি খাওয়ার ফল এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। নাহিদ তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। মৃন্ময়ী চোখ তুলে তাকাতেই নাহিদের চোখে চোখ পড়ল। সাথে সাথে নামিয়ে নিলো। নাহিদ বুঝতে পেরে বলল
–মিস মৃন্ময়ী। সব সম্পর্কের শুরুটা হয় বন্ধুত্ত থেকে। আমাদের মাঝে কোন সম্পর্ক হবে কিনা সেটা আমি জানি না। কিন্তু যদি হয়েই থাকে তাহলে সেটার শুরুটাও বন্ধুত্ত থেকে হবে। জিবনে আমরা কোন সম্পর্কে না জড়ালেও বন্ধুত্তের সম্পর্কটা কি অসম্ভব?

নাহিদের শেষের কথাটা অত্যন্ত ভরসা যোগ্য মনে হল মৃন্ময়ীর কাছে। দমিয়ে যাওয়া সাহস টা বেড়ে গেলো। হেসে ফেলে বলল
–সম্ভব।

———–
দুপুরের রোদ পড়ে যেতেই ঈশা বিছানা ছেড়ে নামল। এই মুহূর্তে এক কাপ চা হলে খুব ভালো হতো। রান্না ঘরে গিয়ে এক কাপ চা বানাল। চায়ের কাপ আর গল্পের বই হাতে নিয়ে ছাদে গেলো। বিকেলের হালকা রোদে বসে এক কাপ চায়ের সাথে গল্পের বই পড়বে। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেলো। ছাদে উঠেই দেখল তার মেজ চাচি সায়রা বেগম শুকনো কাপড় ভাজ করছে। ঈশা তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করলো
–চাচি কি করছ?

সায়রা কাপড় গুলো হাতে নিয়ে বলল
–আরে ঈশা। আমি তোর কাছে যাব ভাবছিলাম।

–কেন চাচি? কিছু বলবে?

ঈশার কৌতূহল দেখে তিনি পাশেই বসার একটা জায়গায় বসে পড়লেন। বেশ উদ্যমী কণ্ঠে বললেন
–জানিস আজ নাহিদ ঐ মেয়েটার সাথে দেখা করতে গেছে।

ঈশা অন্যমনস্ক হয়ে বলল
–কোন মেয়ে?

সায়রা বেগম বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকাল। বলল
–যেই মেয়েটার সাথে ওর বিয়ের কথা চলছিল ঐ মেয়েটা।

ঠোট এলিয়ে হাসল ঈশা। বলল
–তাই নাকি? ভাইয়া কি বলল? পছন্দ হয়েছে?

–এখনও তো আসেনি। আসুক আগে তারপর শুনবো কি হল। তুই কিন্তু আমার সাথেই থাকবি। দুজন মিলেই জিজ্ঞেস করব।

ঈশা মাথা নেড়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল
–মেয়েটার নাম কি চাচি?

–মৃন্ময়ী।

সায়রা আরও কিছুক্ষণ কথা বলে নিচে নেমে গেলো। সায়রা চলে যেতেই ঈশা এক পাশে বসে পড়ল। বই খুলে সেদিকেই পূর্ণ মনোযোগ দিলো। বই পড়ছে আর মাঝে মাঝে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। সারা বিকেল বই পড়েই কেটে দিলো সে। সন্ধ্যে নামার আগে নিচে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যা যা সাথে এনেছিল সবটা গুছিয়ে নিলো। ছাদের কার্নিশ ধরে শেষবার নিচে তাকাতেই দৃষ্টি থমকে গেলো। হৃদপিণ্ড চিনচিনে ব্যাথায় কাতর হয়ে উঠলো। ইভান রাস্তার এক পাশে দাড়িয়ে তনুর সাথে কথা বলছে। দুজনের মাঝে বেশ মধুর সম্পর্ক। প্রায় সময়েই তাদের এই হাস্যজ্জল কথোপকথনের দৃশ্য চোখে পড়ে ঈশার। ঠিক সেই সময় মনে হয় কলিজায় কেউ ধারাল ছুরি চালিয়ে দিচ্ছে। অজানা কষ্টে অস্থির হয়ে ওঠে ভেতর। তনুর কাছে শুনেছে ইভানের সাথে নাকি তার সম্পর্কটা অন্য রকম। বন্ধুত্তের চেয়েও বেশী। তার কথা বলার ধরন আর অর্থ বুঝতে ঈশার কষ্ট হয়নি। ইভান আর তনুর সম্পর্ক যে অনেকটা এগিয়ে গেছে সেটা তনুর ফোনে তাদের দুজনের ছবি দেখেও সে আন্দাজ করে নিয়েছে। পাশাপাশি দাড়িয়ে হাস্যজ্জল একটা সেলফি। যেটা দেখে যে কেউ বুঝে যাবে। চোখের কার্নিশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তেই ঈশা মুখ ঘুরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো। সে দৃশ্য দেখার সাধ্য যে তার আর নেই।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে