#মিস্টার_নার্সিসিস্ট পর্ব-১৫
#আরশিয়া_জান্নাত
আরুশের ঘুম ভাঙতেই দেখে ইসরা সব কয়টা আয়না থেকে কাপড় সরাচ্ছে। আরুশ উপুড় হয়ে বালিশে গাল রেখে ইসরার কর্মকান্ড দেখছে। ইসরা কাপড়গুলো একপাশে রেখে আরুশের দিকে তাকিয়ে দেখে আরুশ ঘুম থেকে জেগেছে। সে হেসে বলল, সুপ্রভাত
সুপ্রভাত। ঘটনা কি বলুন তো? সাত সকালে কি নিয়ে ব্যস্ত হলেন?
ইসরা আরুশের পাশে বসে বলল, একটা সত্যি কথা কি জানেন আরুশ? আপনি চোখ ধাঁধানো সুন্দর। মানুষ দু’দিকে সমান সুন্দর হতে পারে না। যারা হয় বুঝতে হবে এরা বিশেষ। আর এমন বিশেষ মানুষ নিজের সম্পর্কে একটু আধটু ঢোল পেটাতেই পারে!
তাই নাই! হঠাৎ এতো ভালো কথা? হজম হচ্ছে না যে।
আমি শুনেছি একজন মানুষ নিজেকে দেখতে পছন্দ করতো। কিন্তু আমার বলা বাক্য তাকে এতোটাই আহত করেছে, সে এখন আয়নায় মুখ দেখে না। ব্যাপারটা আমার জন্য খুবই লজ্জাজনক। কারো হাসিমুখের কারণ হতে না পারলেও মন খারাপের কারণ হতে চাই না।
আরুশ হেসে বলল, আপনি কি ভাবছেন এভাবে মিটমাট করে ফেলবেন? সমঝোতা করতে চাইছেন হুম?
সমঝোতা করতে চাইলে কি অন্যায় হবে?
অন্যায় হবে না, তবে যদি ভেবে থাকেন সমঝোতা হলেই ডিভোর্স দিয়ে দিবো, আর আপনি সিডনী উড়ে যাবেন। তবে ভুল ভাবনায় আছেন।
ইসরা ঈষৎ মুখ ফুলিয়ে বলল, আমি সেটা কখন বললাম!
এই ২/৩ মাসে আপনার কাছ থেকে যতবার শুনেছি আমি! আর কি আশা করবো? আচ্ছা একটা কথা বলুন তো সিডনীতে কেউ আছে?
কেন থাকলে বুঝি যেতে দিবেন?
উমম, ভাবতে হবে। তবে যদি থাকে বলতে পারেন।
কি করবেন?
তাকে নোটিস পাঠিয়ে দিবো, রুশফিকা এখন আরুশ এর প্রপার্টি। এদিকে তাকানোও নিষিদ্ধ।
বললেই হলো!
আলবাৎ। কাগজে কলমে প্রমাণ আছে।
আমি যদি বলি আমি মানি না,,
আরুশ ওর কোলে মুখ গুজে কোমড় জড়িয়ে বললো, না মানলে মানিয়ে নিবো। আমি জানি আমায় ভালো না বেসে কেউ থাকতেই পারবেনা।
ইসরা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলো, পরক্ষণে অনুভব হলো আজ আরুশের স্পর্শে ওর বিশেষ অস্বস্তি হচ্ছে না। আরুশ দ্রুত ওকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসলো। মাথা চুলকে বলল, স্যরি! আসলে হুটহাট কিসব যে করে ফেলি। ডোন্ট মাইন্ড প্লিজ…
ইসরা তার বোকা চাহনী দেখে মনে মনে হাসলো। মুখে কিছু বললো না। আরুশ বেচারা মন খারাপ করে ওয়াশরুমে গেল।
হাহ! তার মতো অভাগা এই পৃথিবীতে আর ক’জন আছে?
।
দার্জিলিং এর টিকিট টেবিলের উপর রেখে রাদিফ বলল, নে তোর বিয়ের গিফট। তবুও হানিমুনে আর লেট করিস না। সেই কবে শুনেছি দার্জিলিং যাবি এখনো তোর যাওয়া হলো না। তাই ভাবলাম আমিই টিকিট করে দেই।
না রে ব্যাপারটা সেটা না, সবকিছু গুছিয়ে আনতে সময় লাগছিল।
শোন আরুশ, প্রত্যেকটা ইভেন্টের একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। বলে না সময়ের একফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়ের সমান।
থ্যাঙ্কস দোস্ত।
থ্যাঙ্কস রাখ। ওখানে গিয়ে ভাবীকে মনের খবরটা বলে দিস। তুই যে কেবল রাগ থেকেই বিয়েটা করিস নি এটা ক্লিয়ার করিস।
হাহ! যে বোম্ব হয়ে থাকে সবসময়, ক্লিয়ার করার ফুরসত পেয়েছি?
দোষ তোরও আছে।
আমার কোনো দোষ নেই, আমি কথা বলতে গেলেই ত্যাড়ামী করে বসে। ভালো মুডে গেলেও মুডটা অফ করে দেয়।
রাদিফ ওর কাধে হাত রেখে বলল, মেয়েদের ন্যাচারই এটা। বুকের হাড় থেকে তৈরি তো, সোজা হবে না!
তা যা বলেছিস!
আচ্ছা যাই মিটিং আছে। পরে দেখা হবে।
ওকে,
আরুশ টিকিটটার দিকে চেয়ে হাসলো। ভাবতে লাগলো সেই দিনটার কথা,,,
Love at first sight বলে একটা বিষয় আছে এটা আরুশ কখনোই মানতো না। তার মনে হতো হুট করে দেখেই কারো প্রেমে পড়া সিনেমাতেই সম্ভব। কারো প্রেমে পড়া কি এতো সহজ? এই যে রোজ কত মানুষ আমরা দেখি, রাস্তায় চেনা অচেনা শতশত মানুষের ঢল। তাদের মাঝে কয়জনকে আমাদের চোখে পড়ে? কয়জনকেই বা আমরা মন দিয়ে দেখি?
যেহেতু বিজনেস ট্রিপে তাকে প্রায়ই দেশের বাইরে যেতে হয়, তাই এয়ারপোর্টে অনেক হৃদয়বিদারক দৃশ্য অবলোকন করার অভিজ্ঞতা তার হয়েছে। ইসরাকে সে তেমনি এক মুহূর্তে দেখেছে,, ওখানে এসব সাধারণ ব্যাপার হলেও ইসরাকে কেন জানি মনে ধরেছিল খুব। কেমন যেন সাধারণের মাঝে অসাধারণ একটা মেয়ে।
ছিমছাম গড়নের বাদামী বর্ণের বাঙালী মেয়ে। চোখে পড়ার মতো বিশেষ কিছু নেই, তবে মনে শান্তি অনুভব হবার মতো মাধুর্যতা ঐ চেহারায় আছে। কিছু মানুষ থাকে না ওদের দেখতেও আরামবোধ হয়? মনে প্রশান্তি আসে? তাকিয়ে থাকতে ক্লান্তি আসে না, মিঠে নরম রোদের মতো?ইসরাও ঠিক তেমনি একজন।
পরিবারের লোকেরা চোখের পানিতে তাকে বিদায় দিচ্ছে আর সে শক্তভাবে নিজেকে সামলিয়ে সবাইকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আরুশের প্রথমে মনে হয়েছে মেয়েটা ভারী নিষ্ঠুর তো! মেয়েরা এমন শক্ত হলে হয়? এরা কেঁদেকেটে নাকের পানি চোখের পানি এক করবে। এটাই তো তাদের সৌন্দর্য, মমতাময়ী হবার বহিঃপ্রকাশ। সৃষ্টিকর্তা তাদের যেভাবে কান্না করার ক্ষমতা দিয়েছেন; পুরুষদের দেন নি। পুরুষদের মন গড়েছেন এমনভাবে মেয়েরা কান্না করবে, আর তারা সেই কান্না দেখে মুষড়ে পড়বে, অস্থির হবে। মেয়েদের কান্না সহ্য করার ক্ষমতা পুরুষদের দেওয়া হয়নি। বলা যায় এটা হতে পারে তাদের অন্যতম হাতিয়ার। পুরুষের এই গুপ্ত দূর্বলতা প্রকাশিত হওয়া রোধ করতেই অনেক পুরুষ ব্যাপারটা অস্বীকার করেন। কিংবা পাত্তা না দেওয়ার ভান ধরেন। কিন্তু ভেতর ভেতর ঠিকই তারা পোড়েন।
সে যাই হোক,আরুশের মনে হলো হয়তো এই মেয়েটা ভিন্ন! সবাই তো এক নয়।
ইমিগ্রেশন পার করে আরুশ দেখলো একটু আগে যাকে নিষ্ঠুর বলে মনে হয়েছে সে আসলে নিষ্ঠুর নয়। বরং চাপা স্বভাবের মেয়ে। আরুশের কৌতুহলী দৃষ্টি চারপাশের সবকিছু ছাপিয়ে ইসরার দিকেই কেন্দ্রীভূত হয়। সেই প্রথমবার আরুশ কোনো মেয়ের প্রতি এতো আগ্রহ অনুভব করে। ইচ্ছে করে ধাক্কা খেয়ে ইসরার আকর্ষণ কাড়ার সস্তা ট্রিকস ফলো করে। ওতে বিশেষ কাজ হবে বা তার মনে থাকার মতো কিছু হবে বলে ভরসা পায়না বলেই নিজের গুণগান করতে শুরু করে। কিন্তু বেচারা ভাবেই নি ইসরা তার সকল পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দিয়ে তাকে হতাশায় ডুবিয়ে মারবে। কোনো মেয়ে তাকে এভাবে অবজ্ঞা করতে পারে এটা আরুশের জন্য ছিল অসম্ভব কল্পনা। সে ভাবতো এই গোটা পৃথিবীতে না হোক এই বাংলাদেশে অন্তত কোনো মেয়ে এমন হবেনা যে তাকে বাহ্যিকভাবে রিজেক্ট করতে পারে! ইসরার জায়গায় যদি অন্য কেউ ঐসব বলতো আরুশ হয়তো তোয়াক্কাই করতো না। কেননা ওর নিজেকে নিয়ে ১০০% আত্মবিশ্বাস আছে। ওর নার্সিসিজম এতো ঠুনকো নয় যে অল্পতে কুপোকাত হবে। মূলত প্রথম দেখায় যাকে ভালো লেগেছে তার চোখে নিজের ক্ষুদ্র অবস্থান দেখেই সে আশাহত। আরুশের মন ভেঙেছে; প্রথমবার অনাকাঙ্খিত ভাবে একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে তারই কাছে হেনস্থার স্বীকার হয়ে। মানুষ স্বভাবতই তাচ্ছিল্য সহ্য করতে পারেনা। এখন সে দেখতে যেমনই হোক। এ যে কি যন্ত্রণার ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ অনুভব করবে না,,,
“ভালোবাসা-প্রেম হয় শুধু দেখা ও চোখের ভালো লাগা থেকে, রাগ থেকে হয়, ঘৃণা থেকে প্রেম হয়, প্রেম হয় অপমান থেকে, এমনকি প্রেম হয় লজ্জা থেকেও। প্রেম-ভালোবাসা আসলে লুকিয়ে আছে মানবসম্প্রদায়ের প্রতিটি ক্রোমসমে। একটু সুযোগ পেলেই সে জেগে উঠে।” হুমায়ুন স্যার কথাটা ভুল বলেন নি! আরুশের প্রেমটা হবারই ছিল। হোক প্রথম দেখায় কিংবা অপমানে। মনের মাঝে আসন গেড়ে ইসরা নামক মানবীটা যে বসারই ছিল!!
আচ্ছা ইসরা শুনলে কি বিশ্বাস করবে-আরুশ তাকে মন দিয়ে বসে আছে কত আগে?
।
যে কাজটা দিয়েছি তা কতদূর এগোলো?
চিন্তা করবেন না বস, খুব শীঘ্রই আপনার কাজটা হয়ে যাবে।
কেয়ারফুলি করবে, যেন কোনো প্রমাণ না থাকে। আর একটা কথা নিউজটা সারাদেশে প্রচার হওয়া চাই।
নিশ্চিন্তে থাকেন, আপনি যেমনটা বলেছেন ঠিক তেমনি হবে। ভরসা রাখেন,,,
তোর উপর আমার ভরসা আছে বলেই কাজটা তোকে দিয়েছি। আমি ফেরার পরই যেন শুনি কাজটা হয়ে গেছে।
আরুশ ফোনটা রেখে ভেতরে গেল। ঘুমন্ত ইসরার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলল, আপনার মনের সব ইচ্ছে আমি যথাসম্ভব পূরণ করবো রুশফিকা! দার্জিলিং দিয়েই শুরু হবে সেই সফর….
চলবে,,,