মিস্টার নার্সিসিস্ট পর্ব-১৪

0
347

#মিস্টার_নার্সিসিস্ট পর্ব-১৪

#আরশিয়া_জান্নাত

হলুদের তত্ত্ব নিয়ে সারিকা সহ বেশ কিছু আত্মীয় আসে ইসরাদের বাড়ি। বাড়ির ছাঁদে জমকালো আয়োজন করা হয়েছে। এ বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা! নাচগান হৈ হুল্লোড়ে পুরো রাত কেটে যায় হলুদের অনুষ্ঠান। এসব হৈ চৈ এর মাঝেও ইসরার মন একদম ভালো নেই। অথচ ঠোঁটের হাসিটা এক মুহূর্তের জন্য সরেনি পুরোটা সময়। সুখী হবার অভিনয়ে ইসরা সেরা এ আজ নতুন নেই। বুকের ভেতর জমাটবাধা যন্ত্রণা সয়ে যে মেয়ে দিব্যি হেসেখেলে বেড়ায় সে। এ ঘটনাটা তো তার সামনে কিছুই না।
মেকাপ তুলে ফ্রেশ হয়ে ডিভানে গা এলিয়ে দেয় সে।এতোদিন জীবনে একটা আক্ষেপ ছিল। এখন নতুন করে আরেকটা শুরু হলো।আরুশকে সে ভালোবাসে না, না সে আশা রেখেছে তার মতোন কেউ তাকে ভালোবাসবে। মানুষের মন স্বভাবতই কল্পনাপ্রিয়। ইসরাও তার ব্যতিক্রম নয়। সে ভেবেছিল তার জীবনে এমন কেউ হয়তো আসবে যে অতীত শুনেও তাকে মেনে নিবে। ভালোবেসে আগলে রাখবে। দুঃস্বপ্ন দেখে সে যখন ছটফট করে বুকে জড়িয়ে বলবে, ভয় পেও না সব ঠিক আছে। আমি আছি তো,,,
কিংবা ঐ পিশাচটার জীবন নরক করে দিবে, যেমনটা নাটক সিনেমায় দেখায়!
কিন্তু বাস্তবে তেমন কেউ আসেনা। জীবনের গল্প ভিন্ন। এ গল্পের রচয়িতা সুখ দিতে কার্পন্য করে।
সুখকে মরিচীকা বানিয়ে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে রাখে,,,
আরুশ মাঝেমধ্যে হয়তো মনের ভুলে কিংবা সহজাত বৈশিষ্ট্যে তার যত্ন করে ফেলতো। অথবা এমন কোনো বাক্য বলে ফেলতো যাতে ইসরার মনে আঁকা সেই কাল্পনিক চরিত্রের মিল আছে। ইসরাও মনে মনে কখনো সখনো ভেবে বসতো আরুশ ই বুঝি সেই মানুষ! বিয়ে ভাঙতে বলার পরও সে অনড় ছিল। এটা কি ইগো নাকি অন্য কিছু? হয়তো বিয়ে ভাঙলে সে ব্যর্থতার গ্লানি ভোগ করবে বলেই এ পথে এগোয়নি। ইসরার ছোট্ট কিছু বাক্যে যে মানুষ মনে অনেক ঘৃণা পুষতে পারে, ইসরা তার সঙ্গে সংসার করতে ইচ্ছুক না এটাতে আরো বেশি রাগান্বিত হওয়া অস্বাভাবিক না‌। তাই ইসরা এই সম্পর্কে একটাও ইতিবাচক উপাদান খুঁজে পায়না। সে মনকে প্রস্তুত করে যা হবার হোক। সে বরাবরের মতোই শক্ত থাকবে।

একি ইসরা তুমি এখানেই ঘুমিয়েছ? তোমার না ব্যাকপেইন আছে। কতবার নিষেধ করেছি অমসৃন জায়গায় শুবে না।

আমি ঠিক আছি মা, টেনশন করো না। কখন চোখ লেগে এসেছে বলতে পারি নি।

ইসরার মা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আমার সোনা মেয়ে, মাঝেমধ্যে ভাবি আল্লাহ আমার গর্ভে এই রত্নটা কিভাবে দিলো? তোর জন্য গর্বে আমার বুকটা ভরে যায় সবসময়। পড়াশোনা নিয়ে কখনো দু’বার বলতে হয়নি, সবসময় নিজে নিজেই সব করেছিস। কিছুর জন্য ডাক দিতে হয়নি, সেই ছোট থেকেই তুই অনেক লক্ষি। তোকে নিয়ে আমাকে কখনোই বাড়তি চিন্তা করতে হয়নি। অথচ তুই যখন গর্ভে এলি কত টেনশন হয়েছিল। আমি নিজেই অপরিপক্ক তোকে মানুষ‌ করতে পারবো কিভাবে! প্রথম হন্তানের বেলা সব মায়েদের মনে যা আসে আর কি…

তুমি মা হবার পরীক্ষায় ব্যর্থ হও নি।

তোর শ্বশুর শাশুড়ি এই নিয়ে কতবার যে কল করেছে,, তাদের বৌমাকে ছাড়া নাকি তাদের চলছেই না। কি জাদু করলি রে তুই?

আমি কিছুই করিনি মা, উনারাই ভালো মনের মানুষ। আমাকে অল্প সময়েই আপন করে নিয়েছেন।

আমি অনেক খুশি হয়েছি মণি,তুই ভালোমতো সংসার করছিস এটা দেখে আমার মনে আর চিন্তা নেই। তোর কথাশুনে ঐদিন যা একটা দুশ্চিন্তা ভর করেছিল, কিন্তু সেদিন ভোরে জামাইয়ের আগমনের ঘটনা শুনে সেটাও চলে গেছে। আমার মেয়ে স্বামীসোহাগী এতে আমার সন্দেহ নেই,, আল্লাহুম্মা বারিক লাহু।

ইসরা চমকে বলল, তুমি কিভাবে জানলে?

জানবো না বলছিস? সে যাই হোক উঠে বিছানায় ঘুমা, আরো অনেক সময় আছে। ভালোমতো বিশ্রাম করে নে,,

ইসরা উঠে বিছানায় গেল। মনে মনে বলল, মা এবার তোমার সব ধারণা ভুল হলে কি বেশি কষ্ট পাবে??

ইসরার সঙ্গে আরুশের দেখা হলো একদম বিয়ের আসরে। কালো শেরওয়ানীতে তাকে একদম রাজপুত্রের মতো লাগছে। গোলাপী চেহারাটায় খুশি ঝলমল করছে যেন। চোখ দুটোও দীপ্তি ছড়াচ্ছে,, ইসরা অবাক হয়ে ভাবে এই মানুষটা এতো সুন্দর করে বর সেজে এসেছে কিভাবে? এদিকে ইসরা এতো মেকাপ করেও গ্লো করতে পারছেনা, একটু আগেও এলাইনা বলে গেল তোমায় দেখতে এতো ক্লান্ত লাগছে কেন? নববধূর মতো চোখেমুখে আলো ছড়াও তো,,,

এখন আরুশকে দেখে তার বড্ড হিংসে হচ্ছে!

আরুশ হাসিমুখেই তার পাশে বসে বলল, আমায় দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে এ আমি জানি। তবে তাই বলে এভাবে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকা কি ঠিক হচ্ছে? লোকে কি বলবে বলুন তো?

ইসরা চোখ সরিয়ে বললো, ইচ্ছে করে এমন কালার চুজ করেছেন যেন গায়ের রংটা ফুটে উঠে তাই না?

আরুশ চারদিকে তাকিয়ে বলল, বিয়ে বাড়িতে তো অনেক সুন্দরী রমণীর আনাগোনা আছে। দেখাতে হবে না ছেলে খাসা?

ইসরা রাগে নিজের হাত দুটো ঘষতে লাগলো। তাকে টেনশনে রেখে মানুষটা কত নিশ্চিন্তে আছে। মুখ ফুটে কিছু বলছে না কেন? বলে দিতে তো পারতো এই অনুষ্ঠানটা চুপচাপ করে নি তারপর দুজন দু পথে যাবো। তাকে এরকম ঝুলিয়ে রেখে কি হাইট বাড়াতে চাইছে? নিজে যেমন তালগাছ ইসরাকেও তালগাছ বানাবে?
যত্তসব!

রুশফিকা, আপনার কি ঠান্ডা লাগছে? হাত ঘষছেন যে?

না ঠিক আছি।

আপনি চাইলে আমার হাত ধরতে পারেন, এটা সবসময় গরম থাকে।

স্যরি?

ইটস ওকে।

আমি আপনাকে স্যরি বলিনি, জিজ্ঞাসা ছিল।

আরুশ আলগোছে তার হাতটা ধরে বলল, ওপস এতো ঠান্ডা আপনার হাত! আমার মুঠোয় রাখুন দেখবেন গরম হয়ে গেছে।

ইসরা ওর দিকে চোখ গরম করে তাকালো। আরুশ সেটার তোয়াক্কা না করেই শক্ত করে হাত ধরেই রেখেছে। যেন একটু ছাড় দিলেই ইসরা পালিয়ে যাবে,,

নীল সবুজ বাতিতে পুরো বাড়ি সাজানো। সেই আলোতে চারপাশ অদ্ভুত মায়াময় হয়ে উঠেছে। ইসরা বেলকনীতে দাঁড়িয়ে সেই নরম আলো উপভোগ করছে। আরুশ বেলকনীর কাঁচের দরজায় নক করে বললো, রুশফিকা!

ইসরা পেছনে ফিরে বলল, জ্বি?

আমি কি আপনার পাশে দাঁড়াতে পারি?

যে হুট করে চুমু খেতে জিজ্ঞাসা করেনা, সে পাশে দাঁড়াতে জিজ্ঞাসা করছে?

ওসব ইমোশনের ব্যাপার, পারমিশন নিয়ে করতে গেলে ইমোশন থাকবে?

তবে এখন পারমিশন নিচ্ছেন কেন? রুম আপনার, বেলকনীও আপনার চাইলেই যেখানে ইচ্ছা দাঁড়াতে পারেন।

আরুশ হেসে বলল, বেলকনীতে পাশে দাঁড়ানোর অনুমতি তো চাই নি রুশফিকা।

তাহলে?

আজীবন আপনার পাশে দাঁড়াতে চেয়েছি। একদম শেষ নিঃশ্বাস অবধি,,,

ভেবেচিন্তে বলছেন? এটা সহমর্মিতা বা করুণা থেকে আসা আবেগ নয়তো?

আরুশ তার পাশে দাঁড়িয়ে রেলিং এ হাত রাখলো। কিছুক্ষণ নিরবতা অবলম্বন করে বলল, আমি জানতাম আপনি আমার সিদ্ধান্তের ভুল অর্থ বের করতে চাইবেন। তাই আমি দুইদিন নিরব থেকেছি। তাছাড়া আপনি বলেছিলেন আমি যে সিদ্ধান্ত নিবো আপনি মেনে নিবেন।

একজন ধ*র্ষি*তাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে রাখতে চাইছেন আরুশ? তার শরীরে আপনিই প্রথম স্পর্শ করবেন না এটা মেনে নেওয়া সহজ?

এমন অনেক মেয়ে আছে যারা অনেকের সঙ্গে বেড শেয়ার করেও নিজেকে সতী দাবি করে। তাদের মতো আপনি তো‌ নন। ধ*র্ষিতাকে আমি দোষী ভাবি না, আমার কাছে ধ*র্ষ*ক ঘৃণার পাত্র। অন্যের অন্যায়ের শাস্তি আমি আপনাকে কেন দিবো? আর আপনিই বা কেন নিজেকে ছোট ভাবছেন? এখানে আপনার দোষ ছিল না রুশফিকা। আপনি আমার কাছে শিশিরভেজা শিউলির মতোই পবিত্র। এসব ঠুনকো অজুহাত দিয়ে আরুশের পিছু ছোটানো যাবে না। আরুশ কাঁকড়ার চেয়েও ডেঞ্জারাস।

আরুশ ভাবতে লাগলো সেদিনের কথা, ইসরা নিজের অতীত বলে কেঁদেকেটে কত সাবলীলভাবে চলে গিয়েছিল। অথচ সে পিছু ফিরে তাকালে দেখতো আরুশের চোখ ভিজে উঠেছিল, সেখানে বসে আরুশ বহুবছর পর দীর্ঘসময় চোখের পানি ফেলেছে। বুকের ভেতরে এতো কষ্ট হচ্ছিল যে প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পায়নি। না পেরেছে ইসরাকে সান্ত্বনা দিতে। ইসরার প্রতিটা বর্ণনা ওর চোখের সামনে স্পষ্ট ভাসছিল। তার মনে হচ্ছিল সে এখুনি ঐ জা*নো*য়ারকে খু*ন করতে। শরীর ক্ষ*তবি*ক্ষ*ত করে পুড়িয়ে ফেলতে। ওরকম লোকের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। ইনফ্যাক্ট কোনো ধ*র্ষকেরই বেঁচে থাকার অধিকার নেই।

ইসরার চোখ ভরে আসে, সে অশ্রু লুকাতে সরে আসছিল অমনি আরুশ তার হাত ধরে ফেলে।

ইসরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আরুশের দিকে তাকায়। আরুশ কাতরস্বরে বলে, রুশফিকা অনেক তো কেঁদেছেন, একা একা সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করেছেন। এখন থেকে আপনি আর একা নন। আমি আছি তো, আমাকে আপনার দুঃখের ভাগিদার করে নিন না? স্বামী না ভাবেন বন্ধু ভেবেই সঙ্গী করে রাখুন!

ইসরা ফ্লোরে বসে পড়লো, আরুশের হাতে কপাল ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি ঐ লোকটার পতন চাই আরুশ। আমি চাই সে ধ্বংস হয়ে যাক। তার জীবনটা নরকীয় হয়ে উঠুক। আমি চাই সে যন্ত্রণায় ছটফট করুক। আমার জীবনটা সে শেষ করে দিয়েছে আরুশ। আমি আর পারি না নিজেকে সামলাতে। আমার ক্লান্ত লাগে অনেক।

আরুশ ওর মুখোমুখি বসতেই ইসরা ওকে জড়িয়ে ধরেই অঝোরে কাঁদতে লাগলো। ইসরার কান্না দেখে তার চোখেও পানি ঝরতে লাগলো। আরুশ ইসরাকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে বলল, আমি আছি তো রুশফিকা, আপনাকে আর কিচ্ছু ভাবতে হবেনা। আপনি শান্ত হোন প্লিজ!

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে