মিস্টার নার্সাসিস্ট পর্ব-১৬

0
351

#মিস্টার_নার্সাসিস্ট পর্ব-১৬

#আরশিয়া_জান্নাত

দার্জিলিং নিয়ে ইসরার আলাদা একটা ফ্যান্টাসি আছে। সেই ছোটবেলায় শাহরুখ খানের মে হু না মুভি দেখে ইসরা ঠিক করেছিল দার্জিলিং যাবেই। কুয়াশায় ঘেরা শহরটায় ধোঁয়া সরিয়ে কিং খান যখন ট্রেন থেকে নামে,,,আহা সেই বিখ‌্যাত সেই সিন টা কি শিহরন ই না জাগিয়েছিল। ইসরা ভাবতো ওর জীবনে যখন বিশেষ মানুষটা আসবে তার সঙ্গেই দার্জিলিং যাবে। এর আগে নয়। দার্জিলিং নিয়ে তার এই ভাবনাটা কাউকেই কখনো বলা হয়নি। তবে ডায়েরীতে বেশ কয়েকবার লেখা হয়েছিল। তাই আরুশ যখন দার্জিলিং এর কথা বলে সে ভীষণ চমকে যায়।
ব্যাগপত্র সব গোছানো হয়ে গেছে। একটু পরেই তারা এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে। ইসরা ভীষণ এক্সাইটেড। অনেক বছর ধরে পুষে রাখা সুপ্ত মনোবাসনা কাকতালীয়ভাবে পূরণ হতে যাচ্ছে। এটা তার জন্য মোটেও সাধারণ ঘটনা নয়। ইসরাকে এমন প্রফুল্ল দেখে আরুশের বেশ ভালো লাগছে।

ম্যাম কোথায় হারালেন? এখানে আছেন তো?

হুম আছি।

দেখেতো মনে হচ্ছে আপনি এখানে নেই, উড়ে চলে গেছেন হিমালয়ের পাদদেশে…

তা যা বলেছেন! আমি আসলেই চলে গেছি!

আরুশ টিপ্পনী কেটে বলল,হানিমুন নিয়ে এতো এক্সাইটেড?

নাহ!

এইসব চলে মনে মনে তাই না!

আপনি আজীব!

হ্যাঁ যত দোষ নন্দঘোষ। যাক ভাই আমি কিছু বলবোনা।

লাগেজগুলো গাড়িতে তুলে সবাইকে বিদায় জানিয়ে তারা বেড়িয়ে পড়লো পাহাড়ী কন্যার দেশে,,,

বাকডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে দার্জিলিং রেজোর্টে পৌঁছানোর পথটা ছিল ইসরার কাছে ছবির মতো সুন্দর। পাহাড়ী সৌন্দর্য উপভোগ করতে সে এতোটাই মগ্ন হয়ে পড়ে পাশে যে আরেকজন সঙ্গী আছে বেমালুম ভুলে যায়। আরুশ ইসরাকে বিরক্ত করেনা, বরং নিজেও উপভোগ করতে থাকে প্রকৃতির নৈস্বর্গীক সৌন্দর্য।

হোটেলরুমে ঢুকে আরুশ সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে, ইসরা ফ্রেশ হয়ে এসে বলে, এভাবেই ঘুমিয়ে পড়বেন নাকি? ফ্রেশ হয়ে নিন ভালো লাগবে।

আমার জার্নি একদম পছন্দ নয়। জার্নি করলেই শরীর ছেড়ে দেয়। এখন আমি ঘুমিয়েই না হানিমুন বরবাদ করে ফেলি সেই টেনশনে আছি!!

ঢং যত আপনার।

আমার সবকিছুই আপনার কাছে ঢং। আমার অবস্থা বুঝলেন না…

শরীর বেশি ক্লান্ত লাগছে? হট শাওয়ার নিয়ে ঘুম দিন। সকালে দেখবেন অল ক্লিয়ার।

আরুশ অলস ভঙ্গিতে উঠে ওয়াশরুমে গেল। ইসরা বেলকনীতে গিয়ে দাঁড়ালো।

রুশফিকা?

জ্বি?

আমি টাওয়েল নিতে ভুলে গেছি, আপনি কি কষ্ট করে দিবেন?

ইসরা টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে সামনে দাঁড়িয়ে অন্যদিকে ফিরে হাত বাড়ালো। আরুশ টাওয়েল নিচ্ছেনা দেখে সামনে তাকাতে দেখে আরুশ ভেজা শরীরে ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। ফর্সা বুকে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে, না চাইতেও ইসরার অবাধ্য চোখ সেখানেই চলে যাচ্ছে। তাইতো ইসরা মন ঘুরাতে অন্যদিকে চেয়েছিল কিন্তু আরুশ তো নাছোড়বান্দা!

কি ব্যাপার টাওয়েল নিচ্ছেন না কেন?

রুশফিকা সিরিয়াসলি! মানুষ এই চান্স মিস করে?

স্যরি?

আপনার স্যরি হওয়াই উচিত। আনরোমান্টিক ভেজিটেবল একটা!

রাগে গজগজ করতে করতে আরুশ টাওয়েলটা নিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। ইসরা বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটার মতিগতি এই জীবনে সে বুঝবে না!

আরুশ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবে, আমি কি দেখতে আকর্ষণীয় না? এমন পেটানো পৌরুষালী শরীরটা দেখতে কি তার একটুও ইচ্ছে হয়না! কেমন রোবোটিক বৌ জুটলো তার কপালে? নাহ ওর আশায় থাকলে এই সম্পর্ক এমনি বোরিংভাবে চলতে থাকবে। এটা হতে দেওয়া যায়না। একদমই যায় না।

আরুশ বের হয়ে উঁকি মেরে দেখল ইসরা কি করছে। ইসরা তখন ফোন নিয়ে বিজি, আরুশকে ওমন উকি দিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ও বললো, আপনি গ্রামের মহিলাদের মতো এভাবে উঁকি দিচ্ছেন কেন? সরাসরি দেখলেই পারেন!

আরুশ সোজা হয়ে বললো, আমি মোটেও গ্রামের মহিলাদের মতো উঁকি দিচ্ছি না। আমার হাঁটুতে টান লেগেছে তাই নুয়েছি। তখনই আপনি দেখেছেন।

ওহ!

খাবার অর্ডার করেছেন?

হ্যাঁ।

গুড।

ইসরা নিজের চুলে জড়ানো টাওয়েলটা বেলকনীতে মেলে দিয়ে বললো, এখানে অনেক ঠান্ডা তাই না!

হুম। অনেক ঠান্ডা। তবে আমার বিশেষ ঠান্ডা লাগছেনা,,

আপনি ভাল্লুক বোধহয়! তাই লাগছেনা,,

ভাল্লুক আমি?

নয়তো কি?

রুশফিকা, আপনি কিন্তু গায়ে পড়ে ঝগড়া করছেন। আমাকে কিসব বলছেন!

ইসরা হেসে বলল, তাই বুঝি? আমি গায়ে পড়ে ঝগড়া করছি?

অবশ্যই। আমার মতো ভদ্র, সহজ সরল অবলা পুরুষকে একাপেয়ে ভাল্লুক পর্যন্ত বলে ফেলছেন! এটা কি ঠিক?

ইসরা কফি মেকার থেকে গরম কফি কাপে ঢেলে আরুশের দিকে এগিয়ে দিলো। ঠোঁটে রহস্যময়ী হাসি এঁটে বলল, শীতের শহরের ভাল্লুকের ওমে থাকতে পারলে মন্দ হয় না।

আরুশ হাত বাড়িয়ে বলল, তো আসুন না, বুক পেতে রেখেছি তো। ওম নিন,,,

তাহলে মানছেন আপনি সত্যিই ভাল্লুক? হাহাহা

আরুশ মুখ ভার করে হাত নামিয়ে চুল ঠিক করলো। ইসরা উঠে এসে আরুশকে জড়িয়ে ধরলো। আরুশের বুকে মাথা রেখে বলল, আসলেই তো বেশ উষ্ণ আপনি! মনে ই হচ্ছেনা সবে গোসল সেড়ে এলেন..
আরুশ ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে দু’হাতে ইসরাকে আরো নিবিড় করে ধরলো।

.

পরদিন সকালে তারা আশেপাশের দর্শনার্থী স্থানগুলোয় ঘুরে বেড়ায়। সারাদিন ঘোরাফেরা শেষে আরুশ ইসরাকে রুমে যেতে বলে কোথায় যেন চলে যায়। ইসরা রুমে ফিরে দরজা খুলতেই দেখে রুমটা খুব সুন্দর করে ডেকোরেশন করা। সুগন্ধি মোমবাতি আর লাল গোলাপের পাপড়ি দিয়ে খুব সুন্দর করে রুমটা সাজানো হয়েছে।
দরজা খোলার শব্দ পেতেই ইসরা পেছন ফিরে তাকায়। দেখে আরুশ একগুচ্ছ গোলাপ ফুল হাতে নিয়ে হাসিমুখে তার দিকে আসছে।

রুশফিকা! পৃথিবীতে আসার পর আমরা অনেক রকম অনুভূতির সম্মুখীন হই। এরমধ্যে সবচেয়ে বিশেষ হলো কারো প্রতি তীব্রভাবে আকর্ষণ বোধ করা। প্রথম দেখায় মন দিয়ে ফেলা। আমি জানি আপনি বিশ্বাস করতে চাইবেন না, তবে সত্যি বলছি। আপনাকে প্রথম যখন দেখেছি আমার মনে হয়েছে আপনি সাধারণ কেউ নন। আমার খুব চেনা অথবা মনের খুব কাছের একজন। এই টানটা বোধহয় ভাগ্যের ডোর একসঙ্গে লেখা আছে তারই পূর্বলক্ষণ! সে যাই হোক। এতোদিন আপনি জেনেছেন আরুশ আপনাকে ঘৃণা করে জেদের বশে বিয়ে করেছে। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ সত্যি নয়। হ্যাঁ জেদ ছিল, খানিকটা রাগও ছিল। অপমানের একটা ক্ষত ও ছিল। তবে সেসব পেরিয়ে আরেকটা গাঢ় অনুভূতি শুরু থেকেই ছিল। সময়ের সাথে তা ম্লান হয়নি বটে তবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে বুক..

ইসরা আরুশের মুখোমুখি দাঁড়ালো। আরুশ ইসরার মুখোমুখি হয়ে থেমে গেল। ইসরা ওর চোখে চোখ রেখে বলল, থামলেন কেন শেষ করুন,,

আরুশ আমতা আমতা করে বলল, রুশফিকা আসলে কথা হচ্ছে।

হুম বলুন

আমরা হানিমুন‌ প্যাকেজে এসেছি তো, তাই ওনারা এমন ডেকোরেশন করেছে। আমার হাতে এই ফুলগুলোও তারা ধরিয়ে দিয়েছে। এসবে আমার কোনো হাত নেই সত্যি!

ইসরা ঠোঁট চেপে হাসি আটকালো। আরুশ কেমন যে করে মাঝেমধ্যে না হেসে পারা যায়না। একটু আগে কি সুন্দর ফড়ফড় করে কথা বলছিল। যেই ইসরা ফিরলো অমনি সব হাওয়া ফুঁসস। আরুশ ফুলের তোড়াটা টেবিলের উপর রেখে বিরস মুখে বেলকনীর দিকে অগ্রসর হলো, ইসরা দ্রুত তার হাত ধরে ফেলে। আরুশ পেছন ফিরে তাকায়, ইসরা ফ্লোরে বসে ফুলের তোড়াটা এগিয়ে বলে, মিস্টার আরুশ, আমাকে কি আপনি স্ত্রী রূপে গ্রহণ করবেন? আমার বেশি কিছু লাগবেনা, শুধু ভালোবাসলেই চলবে।

আরুশ তাকে তুলে সোজা করে দাঁড় করায়। ইসরার মুখখানা আজলায় ভরে বলে, আপনাকে চেয়ে নিতে হবে রুশফিকা? আমি এমনিই আপনাকে অনেক ভালোবাসি! আর আপনাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেছি আরো আগেই,,,

ইসরা ওর হাতের তালুতে চুমু খেয়ে বলল, আপনি খুব বড় মনের মানুষ আরুশ! নয়তো আমার মতো কাউকে….. আরুশ তর্জনী দিয়ে ইসরার ঠোঁট চেপে ধরে, বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে কোমল ঠোঁটজোড়া স্পর্শ করে গাঢ় দৃষ্টিতে ইসরার দিকে তাকিয়ে বলে, হুসস! আপনার মতো কেউ হতেই পারবে না রুশফিকা। আপনি ভীষণ বিশেষ।

ইসরা শাড়ির আঁচল মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আরুশের তপ্ত শ্বাস তার মুখে পড়ছে, সারা শরীরের রোমকূপ যেন গভীর শিহরণে জেগে উঠেছে। হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। আরুশ ওর কপালে কপাল ঠেকিয়ে কাতরস্বরে বললো, রুশফিকা আমি কি থেমে যাবো? আপনার অস্বস্তি হচ্ছে? আপনি না চাইলে কিচ্ছু করবোনা, আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো নিজেকে সংযত রাখতে,,,

ইসরা আবেগের তীব্রতায় সবকিছু ভুলে আলতো করে আরুশের অধরে অধর ছোঁয়ালো। সম্মতি পেয়ে আরুশ তার মিহি ঠোঁটজোড়া দখল করতে দেরী করলো না। অনুভূতির জোয়ারে দুজন হারাতে লাগলো আদিম স্বর্গীয় সুখে….

.

মাশুক সাহেব আপনার সঙ্গে আমার বিশেষ কাজ আছে। আপনি কি ব্যস্ত আছেন?

আপনাকে ঠিক চিনলাম না?

চেনার কথা নয়, তবে আমি আপনাকে চিনি।

আমার কাছে কেন এসেছেন?

কাজ ছাড়া আসিনি এ নিশ্চয়ই বুঝেছেন, আপনি হলেন জ্ঞানী মানুষ। হা করলেই বুঝে ফেলে আব্বা বলবো নাকি আম্মা!

ভণিতা ছাড়ুন সোজা পয়েন্টে আসুন।

আমার আসলেই বুদ্ধি হলো না। আপনার মতো গণ্যমান্য ব্যক্তির কাছে সময়টা অনেক মূল্যবান এ কথা ভুললে চলে ? স্যার বেশিসময় নিবো না, শুধু একটা ভিডিও দেখাবো আর চলে যাবো।

মানে? কিসের ভিডিও?

তেমন বিশেষ না স্যার আপনার ছোট মেয়ের কিছু কুকর্মের সাক্ষী আর কি!

বললেই হলো! এখন ডিজিট্যাল যুগ অনেক কিছুই এডিট করা যায়। এসব কেউ বিশ্বাস করে নাকি!

কি যে বলেন না স্যার! মিথ্যে হোক কি সত্যি মানুষ এসব দেখে মজা নিতে। সম্মান গেলে আপনার যাবে তাদের কি?

আপনি কি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে চাইছেন? আপনি জানেন আমি কে? আমার ক্ষমতা সম্পর্কে আপনার আইডিয়া আছে?

উমম, আপনি কে?আয়হায় আপনি কে আমি বুঝিনাই? এতো বড় নালায়েক আমি ছি ছি ছি ছি!! দেখেছেন কত মূর্খ আমি। আপনাকে চিনলাম না কিভাবে?! আপনি যে নামকরা ধ*র্ষ*ক আপনাকে চিনলাম না আমি উফ উফ।

আজেবাজে কথা রাখুন, বের হয়ে যান এখান থেকে নয়তো আমি পুলিশ ডাকতে বাধ্য হবো।

লোকটা চেয়ারে হেলান দিয়ে টেবিলের উপর পা রেখে বেশ আয়েশ‌ করে বসলো। হাই তুলে বলল, কল করেন যাকে ইচ্ছা তাকে। আমার হাতে অফুরন্ত সময় আছে। আপনার নাটক দেখতে অসুবিধা নাই, চালু করেন।

মাশুক সাহেব অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছেন। এক অজানা আশঙ্কায় তার বুকটা শুকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু উপরে সেটা প্রকাশ করলেন না। শক্ত সেজে মোবাইলটা হাতে নিলেন, কাকে কল করা যায় দ্রুত ভাবতে লাগলেন।

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে