#মিষ্টার_লেখক(৩)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
চোখের অশ্রু কণা গুলো টুপ করে ঝরে পড়লো ইমার। আজকে সে কোন অন্যায় করে থাকলে এ অপমান গায়ে লাগতো না। কিন্তু কোন অন্যায় কাজ না করেও মানুষজন কতো সহজে তার গায়ে চরিত্রহীনার তকমা লাগিয়ে দিল।
ঠিক এই কারণেই “মহাজাগতিক কিউরেটর” গল্পে দুইজন কিউরেটর পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে মনুষের কারণেই হ্রাস ঘটে যাচ্ছে ওজোন স্তরের মানুষই নির্বিচারে গাছ কেটে ধ্বংস করে চলেছে প্রকৃতির ভারসাম্য। পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে মানুষই নিউক্লিয়ার বোমা ফেলছে একে অন্যের ওপর। এই পরিস্থিতিতেও তারা পৃর্থিবীর বুদ্ধিমান বলে কথিত। মানুষ প্রজাতির নির্বুদ্ধিতায় তারা শঙ্কিত হয়। অবশেষে তারা পরিশ্রমী সুশৃঙ্খল সামাজিক প্রাণী পিঁপড়াকেই শনাক্ত করে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রজাতি হিসেবে।
মানুষ’ নামক প্রজাতি বিবেচনার ক্ষেত্রে কিউরেটর দুইজনের বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা মূলত কল্পকাহিনির লেখকের মনের কথা। তবুও লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার বাস্তবতা তুলে ধরেছেন তার এই গল্পটির মধ্য দিয়ে।
আমরা মানুষরা সৃষ্টির সেরা জীব হলেও সবচেয়ে নিকৃষ্টতম কাজ আমরাই করে থাকি।
যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে,তাঁরাই সৃষ্টির সেরা।[১] এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় সকাল মানুষ সৃষ্টির সেরা নয়।
.
ইমা হঠাৎ নিচে মহিন কে দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে পিছন ফিরে তাকালো।মহিন ছাদ থেকে কখন নেমে নিচে গিয়েছে ইমা জানে না, তার সম্পূর্ণ মনোযোগ নিচে ছিল তাই।
পাশের গ্রামের শরিফুলের মা যেই শুনেছেন ইমা’র বিয়ে ঠিক হয়েছে তখনি রাগে ক্ষুব্ধ হয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন।মাস খানেক আগে তার ছেলের বউ করার প্রস্তাব রাখেন ইব্রাহিম খলিলের কাছে। ইব্রাহিম খলিল এই প্রস্তাব নাকচ করে দেন। কারণ তার প্রবাসে থাকা ছেলে পছন্দ নয়।তার মতে ইউরোপ কান্ট্রি ছাড়া অন্যান্য দেশে যাওয়া ছেলেরা পাঁচ ছয় বছর পর পর দুই/তিন মাসের ছুটিতে দেশে আসে। এতে করে মেয়েরা স্বামীর মুখ দেখে না,সন্তান’রা তাদের পিতার মুখ দেখে না। পিতা তার সন্তানদের প্রাণ ভরে আদর সোহাগ করতে পারে না। এটা কোন সুখের জীবন নয়।
শরিফুল একজন প্রবাসী মাস শেষে ভালো টাকা দেশে পাঠায়। কিন্তু প্রবাসী বলে ইব্রাহিম খলিল এই বিয়েতে অমত করেছেন।
আর এই ক্ষোভ প্রকাশেই শরিফুলের মা ইমা’র নামে বদনাম রটাচ্ছেন।
তখন মহিন এসে বললো,
— আন্টি আপনার বলা শেষ হয়েছে? নাকি আরো বাকি আছে?
শরিফুলের মা এমন ধারা প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। তারপর নিজেকে সংযত করে বললেন,
— এই মাইয়ার দোষ একদিনে কইয়া শেষ করা যাইতো না। তুমি চাইলে গেরামের মাইনষেরে ডাইক্কা জিগাও আমি ঠিক কইতাসি নাকি ভুল । এইতো আমার লগে রেখার মাও আছে হ্যারেই জিগাইয়া দেহ।
ইব্রাহিম খলিল রেগে গেলেন মহিলার কথায়, সাথে গর্জে উঠে বললেন,
— আমার মেয়ে যদি এতই খারাপ ছিল, তাহলে সেদিন নিজের ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব কেন পাঠালেন?
মহিন কপালে স্লাইড করতে করতে বললো,
— আংকেল আপনি শান্ত হোন,আমি দেখছি ব্যাপারটা।
তারপর মহিলার উদ্দেশ্যে বললো,
আমি কি করবো ওটা আমার উপর ছেড়ে দিন। আপনার বলা আপাতত শেষ হলে আপনি আসতে পারেন এবার।আর হ্যা খুব বড় উপকার করলেন মেয়েটার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে “ধন্যবাদ” আপনাকে।
মহিনের এটুকু কথায় শরিফের মা যেন সন্তুষ্ট হলেন।তাই আর দেরি না করে সাথে আনা জা কে নিয়ে চলে গেলেন।
মহিলা যাওয়ার পর মহিনের মা রাজিয়া সুলতানা ছেলের উপর খুব বিরক্ত নিয়ে বললেন,
— তোমার কি এখনো ইচ্ছে আছে এখানে বিয়ে করার? আমি কিন্তু কখনোই মেনে নিব না বলে দিচ্ছি।
মহিন রাজিয়া সুলতানার দুই কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বললো,
— মা তুমি একজন শিক্ষিকা। এতো অল্পতেই গরম হলে চলবে বলো? তোমাকে সবকিছু বিচক্ষণতার সহিত ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তুমি জানো গ্রামে এমন কিছু মানুষ থাকে যারা একে অপরের ভালো সহ্য করতে পারে না।আর পারে না বলেই এভাবে বদনাম রটিয়ে বেড়ায়। কোন মানুষ যদি তোমার কাছে অন্যের সমালোচনা করে তখন তুমি প্রথমে এটা ভাববে যে যিনি সমালোচনা করছেন তিনি কতটুকু ভালো মানুষ?আর কেমন ভালো মানুষ হলে তিনি অন্যের সমালোচনা করছেন। যেখানে ইসলামে একে গিবত বলা হয়েছে।
তাছাড়া দেখলে তো আংকেল তখন মহিলাকে বললেন,
— “আমার মেয়ে যদি এতই খারাপ ছিল, তাহলে সেদিন নিজের ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব কেন পাঠালেন”? তখন কিন্তু ঐ মহিলা কোন প্রকার প্রতিবাদ করলেন না। কেন করেন নি জানো? কারন আংকেল সত্যি বলেছেন।আর তুমি ভেবে দেখ ঐ মহিলা তো জানেন ইমা ভালো মেয়ে নয় তাহলে কেন নিজের ছেলের বিয়ের জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন? ভেবে দেখেছো তুমি মা?
দূর থেকে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখলো ইমা।তার অবাধ্য চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। তবে কষ্ট থেকে নয়,এ পানি আনন্দের বন্যা বয়ে চলার।ইমা আল্লাহ তা’আলার কাছে এমন একজন মানুষ চেয়ে এসেছে যে কিনা ইমার নিরবতার ভাষা পড়তে পারে।তাই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে গিয়েছে সঠিক সময়ে সঠিক মানুষের আগমনের। হয়তো সেই সঠিক সময় উপস্থিত।
ইমার বড় বোনকে যখন পাত্র পক্ষ দেখতে আসতো তখন ও মানুষজন এভাবে বদনাম রটিয়ে দিতে।ইমার মনে আছে একবার পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে বলে ইব্রাহিম খলিল তাড়াহুড়ো করে ঘর সাজাতে ফার্নিচার নিয়ে আসেন। নতুন বিল্ডিং তৈরি করায় ঘরে ফার্নিচার আনা হয়নি।এর মধ্যে মেহমান আসবে তারা রুম ফাঁকা দেখলে কিনা কি মনে করে এই ভেবে ফার্নিচার আনা।অথচ পাত্রপক্ষ যখন ইমার বড় বোনকে পছন্দ করলো না তখন গ্রামের মানুষজন রটিয়ে দিল মেয়েটার বিয়ে ভেঙে গেছে। আফসোসের স্বরে বলে ফার্নিচার এনেছিল মেয়ের সাথে দিবে বলে তা-ও দেওয়া হলো না ।
মানুষজন কিভাবে তিল থেকে তাল করে সেদিন ই বুঝেছিল ইমা।
.
.
মাগরিবের আজান হয়ে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। ইব্রাহিম খলিল অনেক বললেন মহিনদের এখানেই আজ থেকে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তারা থাকবে না বললো। রাজিয়া সুলতানা ও মতলবের মেয়ে। এখান থেকে ত্রিশ মিনিটের পথ তার বাবার বাড়ির দূরত্ব।বাবা মা বেঁচে নেই তবে দুই ভাই আছে। বছরে একবার হলেও ভাইদের বাড়িতে ঘুরে যায় রাজিয়া সুলতানা।তাই আজকে ওখানেই যাবেন বললেন।
সবাই বিদায় নিয়ে রওনা হলে সাহারা মেয়েকে বললেন, ওদের সবাইকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য। মায়ের কথা মতো ইমা যায় এগিয়ে দেওয়ার জন্য। তখন গাড়িতে সবাই উঠে বসলে শুধু মহিন বাদ থাকে।ইমার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ আচমকা নিজের শক্ত মাথা দিয়ে ইমা’র মাথায় ঠুস করে ভারি লাগায়।ইমা আউচ শব্দ করে মাথায় হাত রাখে। তারপর সামনে থাকা ব্যক্তির অধরপল্লব জুরে অজস্র হাসি দেখতে পেয়ে নিজেও আনমনে হাসে।
একদিনের কিছু মূহুর্তে কতো আপন মনে হচ্ছে মানুষটাকে তার। মনে হচ্ছে কতো পরিচিত জন।
দুদিন পর,
কলেজে যায় ইমা। দ্বিতীয় ক্লাসে যখন মিস যখন নিরীক্ষা সম্পর্কে পড়াচ্ছিলেন তখন ক্লাসে শাহ আলম স্যার আসেন,যিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় ইতিহাস এর ক্লাস নেন। এবং এসে জিজ্ঞাসা করেন, এখানে ইমা বিনতে ইব্রাহিম কে?
স্যারের মুখে নিজের নাম শুনতে পেয়ে হকচকিয়ে যায় ইমা। কেননা আজকে সাড়ে পাঁচ মাস হলো ইমা ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছে।এই অবধি স্যারের সাথে তার কোন রকম কথা বার্তা হয়নি। এবং কি স্যারের ক্লাস মাত্র দুটো করেছে ইমা। তাহলে স্যার কিভাবে জানলেন তার নাম?
ইমা ইতস্তত বোধ করে দাঁড়ালো।তখন স্যার বললেন,
— তোমার বাসায় কোন ডাক্তার গিয়েছেন? না মানে তারা এসে তোমার সিভি নিলেন তাই জিজ্ঞাসা করছি।
পাশে থাকা ইমার বান্ধবী রিতা বললো,
— স্যার ডাক্তারের সাথেই তো ইমার বিয়ে ঠিক হয়েছে!কিরে ইমা বল?
স্যার বললেন,
— আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে খুব ভালো খবর। আসলে সেদিন খুব অনুরোধ করলেন তোমার সিভি দেওয়ার জন্য।তাই কৌতুহল বশত তোমাকে জিজ্ঞাসা করলাম।
তোমরা ক্লাস করো।
এই বলে স্যার চলে গেলেন,ইমা বুঝলো যে তারা কলেজ থেকে তার ঠিকানা সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু ইমার খুঁজ কিভাবে পেলেন? ভিশন ভাবনার বিষয়!
শুক্রবার দিন,
ইমা বসে বসে ফেবুতে নিউজ ফিড স্ক্রল করছে। তখন সাহারা ইমার সামনে ফোন ধরে বললেন,
— নে কথা বল।জামাই কল করেছে!
ইমা মায়ের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায়। এদিকে মহিন হাসতে হাসতে শেষ।ইমা কল কেটে দিতে চাইলে অনুরোধ করে বললো,কল যেন না কাটে।ইমাকে এই অবস্থায় দেখতে তার খুব ভালো লাগছে।
ইমা না পারছে কল কেটে দিতে আর না পারছে মহিনের সাথে কথা বলতে….
_______
রেফারেন্স:
[১]আল বাইয়্যিনাহ ৭
________
#চলবে… ইনশা আল্লাহ।