#মায়া
#পর্ব_০৬
#ওয়াহেদ_মাহমুদ
চিকিৎসা করানোর কিছুক্ষণ পরে আফসানার জ্ঞান ফিরে আসে। আফসানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সুরাইয়ার, ওয়াহেদ আর শ্বাশুড়ি। ডাক্তার বলেছে বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে আফসানাকে কিন্তু কোনো প্রকার কাজ করা যাবে না। রেস্টে থাকতে হবে সময়। শ্বাশুড়ি আর সুরাইয়া এ্যাম্বুলেন্সে করে বাসায় চলে আসে আফসানাকে নিয়ে। ওয়াহেদ হাসপাতালের বিল পরিশোধ করতে যায়।
বিল পরিশোধ করতে আসার সময় সেই আফজাল সাহেবের সাথে দেখা যেই আফজাল সাহেব বলেছিলেন যে, সুরাইয়া কে ডিভোর্স দিয়ে দিতে কারণ বিয়ের দশ বছর পরেও এখনো বাচ্চা হয়নি। বদ্ধা মেয়েকে নিজের বোউ করে রাখলে জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হবে। সুরাইয়া কে ডিভোর্স দিয়ে অন্য একজনকে বিয়ে করতে বলেন। অত্যন্ত একটা সন্তান পাবেন। শুধু এটাই শেষ না। আরো বলেছিলেন এতো বছর পর বাচ্চা হয়েছে তাও আবার একটা মেয়ে। খোঁচা মেরে কথা বলেছিলেন। আফজাল সাহেবের সাথে দেখা হওয়া মাত্র ওয়াহেদ বললেন—
কি ব্যাপার ভাই আপনি এখানে অনেকদিন থেকে তো অফিসে দেখি না।
অফিসে আর যায়নি কারণ অফিস থেকে আমাকে বরখাস্ত করে দেয়া হয়েছে। কাজের প্রতি অনেক দিন থেকে অমনোযোগী ছিলাম। মানসিক সমস্যার কারণে কোনো কাজ করতে পারতাম না।
আর আমাদের বাচ্চা হচ্ছে না চেষ্টা করার পরেও। চেকাপ করে জানতে পারি আমি কখনো বাবা হতে পারব না কিন্তু আমার স্ত্রী চাইলে মা হতে পারবে। কিন্তু এতো কিছুর পরেও আমার স্ত্রী আমাকে ছেড়ে চলে যায়নি। এখানেই নার্সের চাকরি করে আমার স্ত্রী। আমার চাকরি চলে গিয়েছে প্রায় একমাস এখনো কোনো চাকরি পাইনি কিন্তু এটা নিয়ে আমার স্ত্রীর কোনো অভিযোগ নেই। হাসিমুখে আমার সাথে মানিয়ে নিয়েছে।
আমিই ভুল ছিলাম ভাই সেদিন আপনাকে বলেছিলাম বদ্ধা মেয়েকে ডিভোর্স দিয়ে দিতে হয় আর মেয়ে সন্তান না ছেলে সন্তান হলে ভালো হয় তাহলে বৃদ্ধ বয়সে বাবা মায়ের পাশে থাকে। আর মেয়েরা তো একদিন শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে বিয়ে হলেই মেয়েদের গুরুত্ব শেষ বাবা মায়ের প্রতি। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। একজন মেয়ে হয়ে যদি স্বামীর দায়িত্ব নিতে পারে হাসিমুখে। একজন মেয়ে হয়ে যদি তার স্বামীর পাশে থাকতে পারে এটা জেনে যে তার স্বামী কখনো বাবা হতে পারবে না শারীরিক ভাবে অক্ষম। সেই মেয়ে জাতির প্রতি কখনো অবহেলা করতে হয় না।
আজ আমি প্রতিনিয়ত আফসোস করি যদি আমি বাবা হতে পারতাম তাহলে আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম। আমার যেন একটা মেয়ে হয়।
আফজাল সাহেবের সাথে কথা বলে ওয়াহেদ অফিসে চলে যায়। কিন্তু অফিসের কোনো কাজে মন বাসে না। প্রতিনিয়ত শুধু সুরাইয়া আর আফজাল সাহেবের কথা ভাবতে থাকে। আজ যদি আফজাল সাহেবের মতো আমার পরিস্থিতি হতো তাহলে কি সুরাইয়া আমাকে ছেড়ে চলে যেত। না কখনো আমাকে ছেড়ে যেত না সুরাইয়া। এতো অবহেলার পরেও যখন আমাকে ছেড়ে যায়নি সব বিপদে আমার পাশে ছিল আর সব সময় আমার পাশে থাকতো। দশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে একটা সন্তানের জন্য। আমি চেয়েছিলাম একটা ছেলে সন্তান কিন্তু হয়েছে একটা মেয়ে, এটার জন্য তো আমি সুরাইয়ার প্রতি অনেক অবিচার করেছি। দ্বিতীয় বিয়েও করে এনেছি।
অনেক কথা ভাবতে ভাবতে রাতে বাসায় চলে আসে। বাসায় এসে মনে মনে খুঁজতে থাকে সুরাইয়াকে। কিন্তু কোথাও দেখতে পারছে না। ওয়াহেদ মনে করছে সুরাইয়া হয়তো রুমে রেস্ট নিচ্ছে। সুরাইয়ার রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় ওয়াহেদ কিন্তু কি মনে করে সুরাইয়ার রুমের দরজার ঠিক নিকট থেকে ফিরে আসে।
রুম এসে ফ্রেশ হয়ে নেয় ওয়াহেদ, তারপর আফসানার কাছে যায়। আফসানা ঘুমিয়ে আছে। আজ অনেক অসুস্থ বাথরুম থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছ তাই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। তাছাড়া এই সময়ে ঘুমানোর কথা না। ঘুমিয়ে যখন আছে তাহলে আর ডেকে তুলছি না।
মা রুমে আছে আজ বাহিরে কেউ নেই।
সুরাইয়া তো প্রতিদিন ডাইনিং এ এসে বসে থাকে আমার জন্য অপেক্ষা করে। আমি রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ না করলে সুরাইয়া খায় না। আজ কেমন জানি সব কিছু উল্টা পাল্টা লাগছে। অনেক কিছু চিন্তা করে ওয়াহেদ রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে সুরাইয়ার রুমের যায় ওয়াহেদ। কিন্তু সুরাইয়া রুম নেই সারা বাড়ি খুঁজে দেখে কিন্তু কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। ওয়াহেদ ভাবছে সারা বাড়ি কোথাও যখন নেই তাহলে নিশ্চয়ই ছাদে আছে কারণ আগে যখন সুরাইয়ার মন খারাপ থাকতো বা কিছু হতো তাহলে ছাদে গিয়ে বসে থাকে। ছাদে গিয়ে দেখে কিন্তু ছাদে নেই সুরাইয়া।
চিল্লাচিল্লি করে আম্মা কে ডাকছে ওয়াহেদ। ডাক শুনে বাইরে বেরিয়ে আসে আম্মা
কি হলো এতো চিল্লাচিল্লি করিস কেন?
সুরাইয়া কোথায় আম্মা। বাড়িতে কোথাও দেখছি না তুমি কি জানো কিছু?
কোথায় আবার থাকবে রুমে আছে দেখ।
না আম্মা সুরাইয়া রুমে নেই। সারা বাড়ি কোথাও নেই ছাদে ও দেখেছি কিন্তু নেই।
মনে হয় বাইরে গিয়েছে কোনো কাজে। চলে আসবে হয়তো পরে।
না মা সুরাইয়া এভাবে কোথাও যাবে না আমাকে না বলে। যদি কোথাও যায় তাহলে তো পূর্ণতাকে সাথে নিয়ে যাবে না। পূর্ণতাকে ঘুম পাড়িয়ে বাইরে যাবে , তাছাড়া না। অত্যন্ত আমাকে একবারে জন্য হলেও বলে যেত। দাঁড়াও তুমি আফসানা হয়তো জানে। আফসানার কাছে গিয়ে বলে কিন্তু আফসানা কিছু জানে না।
তাহলে কোথায় যেতে পারে। আবার সুরাইয়ার রুমে ফিরে আসে। বাসায় পূর্ণতা ও নেই। তারপর সুরাইয়ার ফোনে কল দেয়। কল দেয়ার পর রিং এর শব্দ শুনতে পাই মোবাইল টেবিলের উপর রেখে দিয়েছে। আর মোবাইলের নিচে একটা চিরকুট। ওয়াহেদ কিছুটা বিস্মিত হলো এটা আবার কিসের চিরকুট। ওয়াহেদের এতে কোন সন্দেহ থাকলো না এটা সুরাইয়ার লিখে রেখে গিয়েছে। চিরকুট টা খুলে ওয়াহেদ পড়তে থাকে। চিরকুট লেখা আছে।
প্রিয় ওয়াহেদ,
তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। দোয়া করি সব সময় ভালো থাকবে। শ্বাশুড়ি আমাকে একদিন সময় দিয়েছিলেন যে, প্রমাণ করো কানের দুল তুমি চুরি করোনি। আর যদি প্রমাণ করতে না পারো তাহলে এই বাসা থেকে চলে যাবে চিরদিনের জন্য, আর কখনো ফিরে আসবে না। আমি প্রমাণ করতে পারিনি। তাই আমি আজ এই বাসা থেকে চলে যাচ্ছি তোমাদের সবাইকে ছেড়ে।
তোমাদের সবার থেকে তুমি আফসানা শাশুড়ির থেকে অনেক লাঞ্ছনা কষ্ট পেয়েছি অনেক নির্যাতিত হয়েছি। কিন্তু এত কিছুর পরেও তোমাদের প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই।
আফসানা আর তুমি সব সময় খুশি থাকবে এই দোয়া রইল। তোমাদের একটা সুন্দর ছেলে বাচ্চা হবে আমি সব সময় চাই তোমার স্বপ্ন পূরণ হোক। তোমার অনেক ইচ্ছা তোমার একটা ছেলে সন্তান থাকবে। আর যদি তোমাদের ছেলে না হয় তাহলে আফসানাকে কখনো ছেড়ে দিও না কারন আমার মতন আফসানা সহ্য করতে পারবেনা।
একটা কথা সবসময় মনে রাখবে যেই মেয়ে সন্তানের জন্য তুমি আমাকে ত্যাগ করেছ সেই মেয়ের পেটেই কিন্তু দশ মাস দশ দিন থাকার পর, মা অনেক কষ্ট সহ্যের পরে একটা ছেলে সন্তানের জন্ম হয়।
সুরাইয়ার রেখে যাওয়া চিঠি পড়ে অঝোরে কান্না করতে থাকে ওয়াহেদ। নিজেকে মাফ করতে পারেনা। কাল রাতে যদি সুরাইয়া রুমে গিয়ে মাফ চেয়ে নিত তাহলে হয়তো সুরাইয়া এভাবে চলে যেত না।
ওয়াহেদের এমন পরিস্থিতি দেখে আফসানা বলে একটা চোরের জন্য এতো কান্না কেন করো। চলে গিয়েছে ভালো হয়েছে।
ঠিক তখনি ওয়াহেদ আফসানার গালে একটা থাপ্পর মেরে দেয়। আর বলে তুমি আর তোমার সন্তান বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ হল সুরাইয়া। কাল তুমি যখন বাথরুমে পড়ে যাও তখন তোমাকে হাসপাতাল একে নিয়ে গিয়েছিল জানো সুরাইয়া নিয়ে গিয়েছিল। কাল যদি সঠিক সময়ে সুরাইয়া তোমাকে নিয়ে হাসপাতালে না যেত তাহলে কত বড় বিপদে হয়ে যেত তুমি বুঝতেই পারতে না। আর তাকে তুমি চোর বলছো। লজ্জা করা দরকার তোমার।
চলবে,,,,,