মায়া পর্ব-০৫

0
1132

#মায়া
#পর্ব_০৫
#ওয়াহেদ_মাহমুদ

ফ্যানের সাথে উর্না বেঁধে গলায় ফাঁস লাগিয়ে দেয় সুরাইয়া। ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়ার সময় ঠিক তখনি পূর্ণতা কান্না করে উঠে। এতোক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল কিন্তু হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ার কারণে কান্না করতে থাকে। পূর্ণতার কান্নার আওয়াজ শুনে গলার ফাঁস খুলে নিচে নেমে আসে সুরাইয়া। গলায় ফাঁস লাগিয়ে আর ঝুলে পড়া হলো না সুরাইয়ার। নিচে নেমে পূর্ণতাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ঘুম পাড়াতে থাকে পূর্ণতাকে আবারও।

পূর্ণতার ঘুমিয়ে যাওয়ার পর অঝোরে কান্না করতে থাকে সুরাইয়া। কিছুক্ষণ আগে আত্মহত্যা করতে যাওয়াটাকে মনে করতে থেকে কান্না করে দেয় সুরাইয়া। আর মনে মনে ভাবতে থাকে আজ যদি আমি আত্মহত্যা করতাম তাহলে পূর্ণতার কি হতো, আমি ছাড়া এই দুনিয়াতে পূর্ণতার আর কেউ নেই। মেয়ে হওয়ার কারণে বাবা তো আগে থেকেই তো ছেড়ে দিয়েছে তার মধ্যে, তারপর থাকে এখনতো পূর্ণতার সব দায়িত্ব আমার উপর।

রাতে কান্না করে আর পুরনো দিনের কথা ভেবে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে উঠে দেখে আফসানা বমি করছে, প্রথমে সবাই ভেবেছিল হয়তো পেটের সমস্যার জন্য বমি করছে কিন্তু কয়েকবার বমি করার পর হাসপাতালে নিয়ে যায় শাশুড়ি আর ওয়াহেদ। কিছুক্ষণ পর আফসানা ওয়াহেদ এবং শাশুড়ি হাসপাতাল থেকে বাসায় আসে। ওয়াহেদের কাছে পরে জানতে পারে ডাক্তার চেকাপ করে বলেছে আফসানা প্রেগন্যান্ট।

বাসায় সবাই খুশি কারণ আফসানা প্রেগন্যান্ট সবাই আল্লাহর কাছে দোয়া করে আফসানার যেন, একটা সুন্দর ফুটফুটে ছেলে হয়। আফসানা যেন, ছেলে হয় সেই জন্য মসজিদে দশ হাজার টাকা দান করেছে ওয়াহেদ। আর শাশুড়ি মা ছেলে হওয়ার পর ছাগল দান করবেন মাজারে বলে রেখেছেন আগে থেকেই।

স্বামী শাশুড়ী সবাই বেশ ভালই আদর যত্নে রাখছে আফসানাকে । প্রেগনেন্সির প্রথম সপ্তাহ চলছে আফসানা এখন থেকে বেশ আদর যত্নে রাখছে আফসানাকে, বাসার সবাই কোন প্রকার কাজ করতে দিচ্ছে না। এভাবে বেশ অনেক দিন চলে যায়। প্রায় তিন সপ্তাহ।

আজ সকালে মেয়ের বাসায় যাওয়ার কথা ছিল শ্বাশুড়ির। মেয়ের বাসায় যাবে কয়েকদিন থাকবে। তাই সব কিছু গুছিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু শ্বাশুড়ি কানের দুল খুঁজে পাচ্ছে না। যেটা তৈরি করেছিল নিজের মেয়েকে দেয়ার জন্য। কিন্তু আজ হঠাৎ খুঁজে পাচ্ছে না। শ্বাশুড়ির মাথায় কাজ করছে না কে নিতে পারে এটা। বাসায় তো কেউ আসেনা বাইরে থেকে। বাসায় তো চোর ঢোকা একদম অসম্ভব প্রায়। বাসায় শুধু মাত্র আফসানা, ওয়াহেদ আর সুরাইয়া আছে। নিলে এদের মধ্যে কেউ নিবে। কিন্তু এরা নিবে কেন। শ্বাশুড়ি সবাই কে রাতে ডাক দেয়। তারপর ঘটনা খুলে বলে।

শ্বাশুড়ির কথা শেষে আফসানা বলে আপনার কি কারোর উপর সন্দেহ হয় মা। আপনার কি এমন মনে হয় যে আমাদের মধ্যে কেউ নিতে পারে?

শ্বাশুড়ি কিছুক্ষণ ভেবে বলে। তোমাদের কারোর উপর সন্দেহ আমার হয় না। কিন্তু বাসায় তো বাইরে থেকে কেউ আসেনি। তাহলে কি নিবে?

আফসানা বলে তাহলে সবার রুম তল্লাশি নেয়া দরকার আপনার। ওয়াহেদ তখনি আফসানাকে চুপ করিয়ে বলে কিসব কথা বলো এগুলা। নিজের ছেলে আর ছেলের স্ত্রীর ঘর তল্লাশি করা হবে। আমাদের মধ্যে এমন জঘন্য কাজ কেউ করবে না। আর করার কথা ভাবতেও পারে না। আফসানা ওয়াহেদকে বলে তল্লাশি নেয়ার দরকার আছে‌। তল্লাশি নিলে আমাদের কারোর সম্মান নষ্ট হবে না। এতে সন্দেহ দূর হবে‌। সুরাইয়ার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলে আমার মনে হয় চোর এই বাসাতে আছে। আজ কানের দুল চুরি হয়েছে কাল না জানি কি চুরি হবে।

শ্বাশুড়ি সবার রুম তল্লাশি করছে প্রথমে আফসানা আর ওয়াহেদের রুম। কিন্তু কিছু খুঁজে পেলেন না। তারপর সুরাইয়ার রুমে তল্লাশি করে। সুরাইয়ার রুমের বেডের নিচে থেকে খুঁজে পেলেন কানের দুল টা।

এটা দেখে সুরাইয়া একদম অবাক এটা কিভাবে হতে পারে। এখানে কানের দুল কিভাবে আসতে পারে। শ্বাশুড়ি রাগি দৃষ্টিতে সুরাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। আর আফসান মিটমিট করে হাসতে থাকে।

ওয়াহেদ এমন অবস্থা দেখে সুরাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলে ছি ছি ছি সুরাইয়া আমার ভাবতেই অবাক লাগে তুমি এতটা নিচে নেমে গিয়েছ। আম্মার রুম থেকে কানের দুল চুরি করলে। সুরাইয়া ওয়াহেদকে বোঝানোর চেষ্টা করছে আমি এটা করিনি দুল টা এখানে কিভাবে এসেছে আমি জানি। কিন্তু কেউ সুরাইয়ার কথা বিশ্বাস করছে না। আফসানা সুরাইয়াকে বলে যদি আপনি চুরি না করে তাহলে কানের দুল টা এখানে কিভাবে আসল। এটার তো আর পা হয়নি যে, হেঁটে হেঁটে এখানে চলে এসেছে।

শ্বাশুড়ি সুরাইয়া কে পরিষ্কার ভাবে বলে দেয় তুমি যদি চুরি না করো তাহলে এটা প্রমাণ করো। তুমি যদি চুরি না করো তাহলে তো এই বাসায় কেউ এটা তোমার বেডের নিচে রেখে দিয়েছে। তাহলে তাকে ধরে প্রমাণ করো আমি তাকে নিজ হাতে শাস্তি দিব। আর যদি প্রমাণ করতে না পারো তাহলে কালকেই এই বাসা থেকে চলে যেতে হবে তোমার। প্রমাণ করার জন্য আমি তোমাকে একদিন সময় দিচ্ছি। সুরাইয়া কিছু বলছে না চুপ করে আছে। কথা বলার মতো কোনো মুখ নেই। প্রতিবাদ করার মতো কোনো প্রমাণ ও নেই। পরিস্থিতির জন্য চুপ করে থাকতে হচ্ছে।

সবাই চলে যায় আর সুরাইয়া কান্না করতে থাকে। আর ভাবতে থাকে দশ বছর ধরে আমি এই বাড়িতে আছি।‌ কোনো কিছু চুরি করা তো দুরের কথা এমন কাজ করার কথা আমি ভাবতেই পারি না।‌ দোষ না করার পরেও আজ সবাই আমাকে চোর বলে অপবাদ দিচ্ছে। দশ বছর ধরে ওয়াহেদের সাথে সংসার করছি কিন্তু সেও আমাকে বিশ্বাস না করে অবিশ্বাস করলো। কিন্তু বিয়ের রাতে বলেছিল সব খারাপ সময়ে আমি তোমার পাশে থাকব।

আজ রাতে সুরাইয়ার কপালে খাবার জুটে নাই। সবাই একসাথে বসে খাওয়া দাওয়া করে যে যার মতো রুমে চলে যায়। কিন্তু সুরাইয়া কে এক বারের জন্য ডাক দেয়নি। এমন কি ওয়াহেদ ও না। আর শ্বাশুড়ি সবার সমানে বলে দিয়েছে কোনো চোরের জায়গা আমার বাড়িতে নেই এমনকি খাবারের টেবিলে না।

মেয়ে পূর্ণতাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে যায় সুরাইয়া। রাতের খাবার টা খায়নি সুরাইয়া। এবার মনে হয় সুরাইয়া কে এই বাসা থেকে চলে যেতে হবে। কাল তো প্রমাণ করতে পারবে না কানের দুল চুরির আসল চোর কে। আর শ্বাশুড়ি বলে দিয়েছে প্রমাণ করতে না পারলে এই বাসা থেকে চলে যেতে হবে। তাই সকালে উঠে নিজের ব্যাগ তৈরি করছিলেন সুরাইয়া। এমন হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনতে পারে সুরাইয়া।

আফসানা পা পিছলে পড়ে গিয়েছে বাথরুমের মধ্যে। বাথরুমের মধ্যে থেকে জোরে শব্দ শুনে সুরাইয়া দৌড়ে ছুটে যায় । গিয়ে দেখে পা পিছলে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে আফসানা। তখন বাসায় কেউ ছিল না,

“”শাশুড়ি গিয়েছিলেন পাশের বিল্ডিংয়ে কোনো এক কাজে। ওয়াহেদ ছিল অফিসে।””

বাসায় শুধুমাত্র ছিল সুরাইয়া আর আফসানা। বাসায় শুধুমাত্র একা থাকায় বুঝতে পাড়ছে না সুরাইয়া কি করবে। বাথরুম থেকে তুলে নিয়ে এসে সোফায় বসিয়ে দেয় আফসানাকে। তারপর রান্নাঘর থেকে পানি নিয়ে এসে আফসানার মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়। কিন্তু তাও জ্ঞান ফিরে না আফসানার।

তাড়াতাড়ি করে ওয়াহেদকে ফোন দেয় সুরাইয়া। ওয়াহেদকে সবকিছু বিস্তারিত বলে। আর একটা এ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দিতে বলে অতি জরুরী।

তারপর শ্বাশুড়িকে ডেকে নিয়ে আসে সুরাইয়া। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই এ্যাম্বুলেন্স চলে আসে। আফসানাকে এ্যাসুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যায় শ্বাশুড়ি আর সুরাইয়ার। হাসপাতালে পৌঁছে ওয়াহেদ কে ফোন দিয়ে জরুরি হাসপাতালে আসতে বলে। বিশ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালে চলে আসে ওয়াহেদ। ডাক্তার ভিতরে আফসানার চিকিৎসা করছে। বাইরে সুরাইয়া, ওয়াহেদ আর শ্বাশুড়ি বসে আছে।‌সবার মুখে চিন্তার ছাপ, বিষন্নতা ফুটে উঠেছে।

কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বাইরে এসে বলে চিন্তার কোনো কারণ নেই আফসানা ঠিক আছে‌ বেবি ও ঠিক আছে। আপনারা যথাসময়ে এসেছেন আর একটু দেরি হলে অনেক বড় একটা সমস্যা হতে পারতো। আপনি অনেক ভালো করেছ সুরাইয়া যথাসময়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। ওয়েল ডান সুরাইয়া।

ওয়াহেদ আর শ্বাশুড়ি মুগ্ধতার দৃষ্টিতে আছে সুরাইয়ার দিকে।আজ যদি সুরাইয়ার না থাকতো তাহলে না জানি কি কত বড় ঘটতে পারতো।

এখন কি স্বীকার করবে কেউ যে, কানের দুল চুরি করে কে রেখেছিল সুরাইয়ার বেডের নিচে? নাকি সুরাইয়া চুরি করেছিল? সুরাইয়ার কি এই বাসায় জায়গা হবে নাকি বাপের বাড়িতে চলে যেতে হবে?

চলবে,,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে