#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)
চারুর মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেন নারগিস বেগম। সপ্তাহে তিনদিন মাথায় তেল দেয়াটা বাধ্যতামূলক। চিত্রলেখার আদেশ অমান্য করার সুযোগ নেই। মাথায় তেল দিতে দিতেই চারু খালাকে জিজ্ঞেস করে,
-খালা, আপা কি কোনো কারণে চিন্তিত। তুমি কি কিছু জানো?
-কেন? কিছু হইছে?
-কি হইছে জানলে কি আর তোমারে জিজ্ঞেস করতাম?
-কি হইছে মানে কি দেখে তোর মনে হইলো তোর আপা চিন্তিত সেটা তো বলবি নাইলে আমি বুঝবো কেমনে রে মা?
-কাল সারারাত আপা ঠিক মতো ঘুমায় নাই। আমার যতবার ঘুম আলগা হইছে আমি খেয়াল করছি আপা ঘুমায় নাই। বারবার পাশ ফিরছে। মাঝরাতে উঠেও বসেছিল অনেকক্ষণ।
নারগিস বেগমের বুঝতে অসুবিধা হয় না আচমকা ঠিক কোন কারণে চিত্রলেখার রাতের ঘুম উড়ে গেছে। মনে মনে এসব নিয়েই চিন্তা হচ্ছিল উনার। চিত্রলেখা মুখে বলবে না কখনোই। একা একা নিজেই চিন্তা করবে। নিজের চিন্তা সে কারো সাথে ভাগভাগি করে না। ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন নারগিস বেগম। চারু আবার জিজ্ঞেস করে,
-তুমি কিছু জানো খালা?
-চিত্রলেখা তো আমায় কিছু বলে নাই। আজ আসুক কথা বলে দেখবো আমি। তুই চিন্তা করিস না।
—————————————————————————-
রিপাকে ধানমন্ডিতে নামিয়ে দিয়ে লিখন চলে এসেছে রায়ের বাজার। এক্ষুনি বাসায় যাবে না সে। বৃষ্টি ও নাঈমকে পড়াবে তারপর বাসায় যাবে৷ বৃষ্টি আগামী বছর উচ্চমাধ্যমিক দিবে আর নাঈম এবার ক্লাস নাইনে পড়ে। চারবছর ধরে ওদের পড়ায় লিখন। দুই ভাইবোনকে পড়িয়ে মাসে সাত হাজার টাকা পায়। আরও দুটো টিউশনি করে সে। ওদেরকে সপ্তাহের চারদিন পড়াতে হয়। বৃষ্টির মা অনেক ভালো, লিখনকে যথেষ্ট আদর করেন।
লিখন এসে পড়ার টেবিলে বসতেই দেখে নাঈম বইখাতা নিয়ে আগেই হাজির। বৃষ্টি দরজা খুলে দিয়ে ভেতরে গেছে এখনো আসেনি। ও না আসা পর্যন্ত নাঈমের দিকে নজর দেয় সে। জিজ্ঞেস করে,
-কি পড়ছো?
নাঈম নিজের বইটা এগিয়ে দেয়ার আগে বৃষ্টি এক প্লেট চিকেন বিরিয়ানি লিখনের সামনে রেখে বলে,
-ও পড়তে থাকুক তার আগে আপনি খাবারটা খেয়ে নিন।
মুখের সামনে এক প্লেট চিকেন বিরিয়ান দেখে মুখ তুলে বৃষ্টির দিকে তাকায় লিখন। তা দেখে বৃষ্টি বলে,
-ক্লাস করে আসছেন নিশ্চয়ই কিছু খান নাই। আগে খেয়ে নেন তারপর পড়া শুরু করি।
-আমার আজ পেট ভরা বৃষ্টি।
-এইটুকু খাবার আপনি খেতে পারবেন আমি জানি। তাছাড়া আম্মু বলে পুরুষ মানুষকে একটু বেশি খাইতে হয়। আপনি খাওয়া শুরু করেন আমি আপনার জন্য কোক নিয়ে আসতেছি।
বৃষ্টি কোক আনতে ভেতরে চলে গেলে পাশ থেকে নাঈম বলে,
-খান স্যার। আপু আপনাকে না খাওয়ায় ছাড়বে না। আপনি আলু পছন্দ করেন দেখে বিরিয়ানির সব আলু আপনার জন্য তুলে রাখছে। আমাকেও বেশি দেয় নাই।
নাঈমের চুপসে যাওয়া মুখ দেখে হাসি পায় লিখনের। কিন্তু হাসে না সে। এটা সত্যি এই বাসায় ভালো কিছু রান্না হলে বৃষ্টি তার জন্য আলাদা করে রাখে। লিখন আর আপত্তি করে না উঠে গিয়ে হাত ধুঁয়ে আসে। তাছাড়া সে ভালো করেই জানে তার আপত্তি বৃষ্টি শুনবে না। তাকে খাইয়েই ছাড়বে। এসব বিষয়ে বৃষ্টি ভালোই শাসন করে তাকে। তাই মেয়েটা কোক নিয়ে ফিরে আসার আগে হাত ধুয়ে খাবারে হাত দেয় সে।
—————————————————————————–
অফিস ছুটির পর নিচে নামতেই চিত্রলেখার জুতাটা আবার ছিঁড়ে যায়। কিন্তু এবার অন্য পায়েরটা ছিঁড়ে গেছে। আজকের দিনটাই যেন কুফাময়। সকালে আসার সময় এক পায়ের জুতা ছিড়লো, এখন আবার আরেকটা। ছেঁড়া জুতা হাতে নিয়ে একবার ডানে-বামে তাকায় সে। আশেপাশে মুচি আছে কিনা দেখতে। কিন্তু এখানে আশেপাশে কোনো মুচি দেখা যাচ্ছে না। তাকে অনেকখানি হেটে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। সকালে আসার সময় যেখান থেকে জুতা সেলাই করেছিল সেখানে যেতে হবে। অফিস বিল্ডিংয়ের পার্কিং থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে রওনক। চিত্রলেখাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ড্রাইভারকে বলে গাড়ি থামাতে। জুতা হাতে চিত্রলেখাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রওনকের বুঝতে বাকি থাকে না ঘটনা কি হতে পারে। সে মনে মনে ভাবে, এই মেয়েটা নিশ্চয়ই এখন মুচি খুঁজছে। রওনক ড্রাইভারকে বলে,
-ঐ মেয়েটাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো তো কোনো হেল্প লাগবে কিনা।
ড্রাইভার বেরিয়ে যেতেই নেয় তখনই বাইক নিয়ে পার্কিং থেকে বেরিয়ে আসে লাবিব। চিত্রলেখাকে দেখে তার সামনে বাইক দাঁড় করা সে। তা দেখে রওনক তার ড্রাইভারকে বাঁধা দিয়ে বলে,
-ইটস ওকে যেতে হবে না। হয়ত হেল্প পেয়ে গেছে।
চিত্রলেখাকে জুতা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লাবিব জিজ্ঞেস করে,
-এনি প্রবলেম?
হাতে থাকা ছেঁড়া জুতা দেখিয়ে চিত্রলেখা বলে,
-ছিঁড়ে গেল।
-কোথায় যাবা বলো আমি নামিয়ে দেই।
-না না ইটস ওকে, আপনি যান আমি ম্যানেজ করে নিবো। আপনাকে কষ্ট দিতে চাই না।
-আমার কোনো কষ্ট হবে না। আমি তো আর তোমাকে কাঁধে উঠতে বলছি না বাইকে উঠো নামিয়ে দিচ্ছি। তোমার বাসা তো রায়ের বাজার তাই না?
-আপনার উল্টো পথ হয়ে যাবে। দেরিও হয়ে যাবে অনেক।
-একদিন দেরি হলে কিচ্ছু হবে না। তুমি উঠো তো।
চিত্রলেখা ইতস্তত করে। তা দেখে লাবিব জোর দিয়ে বলে,
-উঠতে বলছি চিত্রলেখা।
আর আপত্তি করে না চিত্রলেখা। লাবিবের বাইকের পেছনে উঠে বসে। চিত্রলেখা উঠে বসতেই টান দেয় লাবিব। ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে রওনক।
সকালে যেখানটায় মুচির থেকে জুতা সারিয়েছিল সেই জায়গায় আসতেই চিত্রলেখা লাবিবকে বাইক থামাতে বলে। নেমে গিয়ে বলে,
-আমি জুতাটা সারিয়ে নিচ্ছি।
-আমি আছি তুমি সারিয়ে আনো।
-তার প্রয়োজন নেই। আপনি চলে যান। আমার আসলে একটু কাজ আছে দেরি হয়ে যাবে।
-আর ইউ সিওর?
-জি।
লাবিব আর কিছু বলে না, চলে যায়। চিত্রলেখা রাস্তা পাড় হয়ে অন্যপাশে চলে যায় জুতা সারতে। বাসায় তার আরও দু’জোড়া জুতা আছে। তাই আপাতত সে জুতা কিনবে না। আপাতত সেলাই করে নিলে বাসায় পৌঁছাতে পারলেই হলো।
রওনকের গাড়িটা স্কয়ার হাসপাতালের সামনে আসতেই জ্যামে আটকায়। যদিও এখানে কোনো সিগনাল নেই। অফিস ছুটির পরে এখানে জ্যাম হওয়াটা প্রতিদিনকার চিত্র। জ্যামে বসে থেকে গাড়ির উইন্ড দিয়ে ডানে তাকাতেই রাস্তার অন্যপাশে দেখতে পায় চিত্রলেখাকে। হেসে ফেলে রওনক। তার ধারনা একদম ঠিক হয়েছে। চিত্রলেখা ছেড়া জুতা সেলাই করাচ্ছে। রওনকের হাতে থাকা ট্যাবটা নামিয়ে রেখে সে গাড়ি থেকে বের হয়। তা দেখে ড্রাইভার জিজ্ঞেস করে,
-স্যার কিছু লাগবে?
-না, তুমি আশেপাশে কোথাও জায়গা দেখে গাড়ি পার্ক করো। আমার একটু কাজ আছে। হয়ে গেলে তোমায় ফোন করব।
আর অপেক্ষা করে না রওনক। রাস্তা পাড় হয়ে অন্যপাশে চলে যায়। যে পাশে চিত্রলেখা আছে। তাকে পাশ কেটে এগিয়ে গিয়ে একটা সুপার শপে ঢুকে সে। সুপারশপ থেকে বের হতেই রওনক দেখে চিত্রলেখা ওখানে নেই। ডানদিকে তাকালেই দেখে চিত্রলেখা হেটে যাচ্ছে সামনের দিকে। রওনকও তার পিছনে হাঁটা ধরে। মোড় পর্যন্ত এসে হিসাব মতো চিত্রলেখার ডানে চলে যাওয়ার কথা কিন্তু সে বামে চলে যায় রাস্তা পাড় হয়ে। ধানমন্ডি লেকের দিকে হাঁটা ধরে সে। তা দেখে রওনকও সেদিকেই হাঁটতে থাকে। চিত্রলেখার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে হাটতে হাটতে ডিঙি পর্যন্ত চলে এসেছে। বেখায়লে হাটছে চিত্রলেখা। দিনদুনিয়ার কোনো কিছুই যেন এখন তার মন-মস্তিষ্কে নেই। সে হেঁটে চলেছে আপন মনে। হাঁটতে হাঁটতে বেখায়লে পড়ে যেতে নেয়। কিন্তু পড়ে যাওয়ার আগেই দ্রুত কদমে বাড়িয়ে এগিয়ে এসে ওর একটা হাত ধরে টান দিতেই রওনকের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় চিত্রলেখা। ভয়ে কলিজা কামড়ে ওঠে তার। পড়ে যাবে ভেবে যতটুকু ভয় পেয়েছিল তার চাইতে বেশি ভয় পেয়েছে এই মুহূর্তে এভাবে রওনককে দেখে। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রওনক বলে,
-একটু দেখে হাটতে হয়। এক্ষুনি তো পড়ে যাচ্ছিলে।
এখনো রওনক চিত্রলেখার একটা হাত ধরে রেখেছে। রওনককে দেখে চিত্রলেখা কয়েক মুহূর্ত তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর চোখ নামিয়ে তার ধরে রাখা হাতের দিকে তাকায়। অবাক সুরে বলে,
-আপনি এখানে!
রওনক জবাব না দিয়ে চিত্রলেখার হাত ছেড়ে দিয়ে তার হাতে থাকা শপিং ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
-এটা রাখো।
-কি?
-একজনের জন্য কিনেছিলাম।
চিত্রলেখা ব্যাগটা হাত বাড়িয়ে নিচ্ছে না দেখে রওনকই হাত বাড়িয়ে ওর হাতে ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে পেছন দিকে হাঁটা ধরে। চিত্রলেখা একবার শপিং ব্যাগটার ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখতে পায় এক জোড়া জুতা। মুখ তুলে রওনকের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে ভাবলেশহীন চাহনি নিয়ে৷ মনে মনে চিত্রলেখার প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, কার জন্য জুতা কিনেছিল সে! অন্যকারো জন্য কেনা জুতা তাকে কেন দিয়েদিলো?
চলবে…
#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব- ৭
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)
চিত্রলেখা যখন বাসায় ফিরে তখন বাজে রাত আটটা। সাধারণত এত দেরি তার হয় না। এই কোম্পানিতে চাকরী করছে তিন বছরের বেশি সময় ধরে। খুব বেশি দিন তাকে রাত করে বাড়ি ফিরতে হয়নি। হাতে গোনা কয়টা দিন মাত্র। চিত্রলেখা ঘরে ডুকতেই তাকে দেখে চারু জিজ্ঞেস করে,
-আজকে এত দেরি হলো যে আপা?
শব্দ পেয়ে রান্নাঘর থেকে নারগিস বেগম চেঁচিয়ে বলেন,
-কে আসছে রে চারু? তোর আপা?
-হ্যাঁ খালা।
খালাকে জবাব দেয় চারু। চিত্রলেখার হাত থেকে তার ব্যাগ নিয়ে চারু জিজ্ঞেস করে,
-এই ব্যাগে কি আপা?
ততক্ষণে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ড্রইং রুমে চলে এসেছেন নারগিস বেগম। চারু ব্যাগটার ভেতরে জুতা দেখে তা বের করতে করতে বলে,
-এতদিনে জুতা কিনলা? তোমারে কতদিন ধরে বলতেছি এই জুতাটা এবার বাদ দাও যেকোনো সময় ছিঁড়ে যাবে।
-আজকে সকালে অফিসে যাওয়ার সময় ছিঁড়ে গেছিল।
বলে চিত্রলেখা। তা শুনে পাশ থেকে নারগিস বেগম বলেন,
-সেজন্যই জুতা কিনছিস, নাইলে তুই জুতা কিনতি না। তোরে তো আমরা চিনি।
-আপা তোমার কি জ্বরটর আসছে নাকি?
অবাক সুরে জিজ্ঞেস করে চারু। তা শুনে নারগিস বেগম ব্যস্ত হতে নিলে চারু তাকে জুতার ট্যাগটা দেখায়। দেখিয়ে বলে,
-দেখো খালা আপা নিজের জন্য ২৪০০ টাকা দিয়ে জুতা কিনছে।
-কিরে চিত্রলেখা! তোর এত সুবুদ্ধি কেমনে হইলো? তুই নিজের জন্য এত টাকা খরচ করলি!
জুতার দাম দেখে নারগিস বেগম নিজেও অবাক হয়েছেন। বোন ও খালার এক্সাইটমেন্ট দেখে ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে চিত্রলেখা। এরা তাকে ভালো করেই চিনে। সে যে নিজের জন্য এত দাম দিয়ে জুতা কিনবে না এটা সত্যি কথা। চিত্রলেখা জুতাটা বের করে দেখেনি তাই জানেনা এত দামী একজোড়া জুতা পেয়েছে সে। আর লুকোচুরি না করে চিত্রলেখা বলে,
-আমি কিনি নাই।
-তাহলে?
-একজন দিলো।
-কেউ তোরে জুতা কিনে দিলো?
-আমাকে না, অন্য একজনের জন্য কিনছিল তারপরে কাহিনি জানি না। শেষমেশ আমার পায়ে এসে জুটলো।
-কে এমন মানুষ যে তোর জন্য জুতা কিনলো?
-খালা বললাম তো আমার জন্য কিনে নাই।
নারগিস বেগম আর কিছু বলার আগে চারু বলে,
-আপা তোমার জন্য না কিনলেও সাইজটা কিন্তু একদম পার্ফেক্ট হইছে, তোমার পায়ের সাইজ।
জবাবে আর কিছু বলে না চিত্রলেখা। বরং বলে,
-তোর বেশি পছন্দ হইলে তুই রেখে দে। আমার আরও জুতা আছে আমি ওখান থেকে একজোড়া নামায় নিবো।
-পছন্দ তো হইছে তবে আমার সাইজে হবে না আপা। তোমার পায়ের মতো তো আমার পা লম্বা না।
-তো কি হইছে? রেখে দিবি। যখন পায়ে হবে তখন পরবি।
-তোমার মাথা খারাপ আপা? দুই বছর রেখে দিবো?
-রেখে দিবি। তো কি হইছে?
-কোনো দরকার নাই। তোমাকে দিছে তুমিই পরবা। রেখে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নাই। কেউ ভালোবেসে কিছু দিলে সেটা ভালোবেসে গ্রহণ করতে হয়। বুঝলা আপা?
ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে চিত্রলেখা। মনে মনে কেবল ভাবে, ‘ভালোবাসা!’ কিন্তু মুখে কিছু বলে না। নারগিস বেগম বলেন,
-অনেক হইছে তোদের জুতা প্যাঁচাল এখন যা ফ্রেশ হয়ে আয় কিছু খাবি।
চিত্রলেখা উঠতে উঠতে বলে,
-তুমি রান্নাঘরে কি করতেছিলা খালা?
-ভাত বসাইলাম রাতের জন্য।
-আমার আজকে আসতে অনেক দেরি হয়ে গেল। তুমি আর রান্নাঘরে যাইও না। আমি ফ্রেশ হয়ে রান্না চাপাইতেছি।
-তোরে অনেক ক্লান্ত লাগতেছে। আজকে নাহয় থাক আমিই রান্নাটা সারি।
-দরকার নাই খালা, আমিই পারবো।
আর কারো কোনো কথা না শুনে নিজের ঘরে চলে যায় চিত্রলেখা। নারগিস বেগম রান্নাঘরে চলে যান। সবকিছু এগিয়ে দিলে মেয়েটার জন্য সহজ হবে। হাজার ক্লান্ত লাগলেও সেটা মুখে প্রকাশ করবে না সে।
——————————————————————————
রওনক বাসায় ফিরে সরাসরি নিজের ঘরে চলে যায়। যদিও আজ তার জলদি বাসায় ফেরার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু বাইরে থাকার মতো কোনো কাজও আপাতত তার হাতে ছিল না। নিজের ঘরে ডুকতেই রওনক দেখে সাবা তার ঘরেই বসে আছে। সাবাকে দেখে রওনক নিজের কোর্টটা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করে,
-তুমি এখানে?
-আজ আন্টি আমাদের ডিনারের জন্য ইনভাইট করেছে জানো না?
-শুনেছি তবে আমার প্রশ্ন এটা ছিল না।
রওনকের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে সাবা ন্যাকামির সুরে জিজ্ঞেস করে,
-কি ছিল যেন তোমার প্রশ্নটা?
-আমি জিজ্ঞেস করেছি তুমি এখানে আমার রুমে কেন?
-তোমার রুমে কি আসতে মানা নাকি?
-আমার এবসেন্সে আমি কারো আমার ঘরে আসাটা পছন্দ করি না।
-সবাই আর আমি তো এক নই রওনক। তুমি জানো আজ আন্টি কেনো আমাদের ডিনারে ইনভাইট করেছে? জানলে নিশ্চয়ই এমন কথা বলতে না।
-সবাই আর তোমার মধ্যে বিশেষ আলাদা কিছু নেই সাবা। সবাই যেমন মানুষ, তুমিও মানুষ। আর ডিনারে যেহেতু আমার মা ইনভাইট করেছে তুমি বেটার তার ঘরে গিয়েই বসো নাহয়। আমি এখন ফ্রেশ হবো। আই নিড সাম প্রাইভেসি। ইউ মে লিভ নাও প্লিজ।
রওনক আর দাঁড়ায় না। বাথরুমের দিকে চলে যায়। পেছনে দাঁড়িয়ে সাবা নিজে নিজেই বলে,
-তুমি যতই আমার থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা করো না কেন এতে বিশেষ লাভ হবে না রওনক। ঘুরেফিরে তোমায় আমার কাছেই ফিরতে হবে। এই সাবা তোমায় ছেড়ে কোথাও যাবে না, কোত্থাও না।
সাবা আর দাঁড়িয়ে না থেকে রওনকের ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
দিলারা জামান কিচেনে এসে দেখে নেন সব আয়োজন ঠিকঠাক মতো হচ্ছে কিনা। কিচেনের আয়োজন দেখে বড় বউ তানিয়ার ঘরের দিকে যান তিনি। তানিয়ার ঘরে এসে দেখে সে ল্যাপটপে মুখ গুজে বসে আছে। তা দেখে দিলারা জামান বলেন,
-তুমি এখনো তৈরি হওনি?
শাশুড়িকে দেখে ল্যাপটপটা নামিয়ে রেখে তানিয়া বলে,
-একটু কাজ করছিলাম মা। এটা শেষ করে তারপর তৈরি হবো।
-কাজ সবসময়ই হবে। এখন জলদি তৈরি হয়ে একটু কিচেনে যাও। আমরা খেয়াল না রাখলে তো কিছুই ঠিকঠাক মতো হবে না।
-জাহানারা খালা কোথায়?
-কিচেনেই আছে।
-তাহলে আপনি আর কিসের চিন্তা করছেন? সব হয়ে যাবে সময় মতো ডন্ট ওয়ারি।
-চিন্তা কি আর এমনি এমনি করি? আজ এত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন অথচ কারো কোনো হেলদোল নেই। রওনকটা মাত্র বাসায় ফিরলো।
-রওনক ফিরেছে?
-মাত্রই ফিরলো।
-তাও ভালো ফিরেছে। আমি তো ভেবেছিলাম আজ হয়ত ও বাসায়ই ফিরবে না।
-ওকে একটু বুঝাও প্লিজ। এবার ওকে বিয়ে করতেই হবে। ওর আপত্তি আর শুনবো না আমি।
তানিয়া নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তা দেখে দিলারা জামান তাকে তাগাদা দিয়ে বলে,
-আর বসে থেকো না। তৈরি হয়ে নিচে আসো। সাবা অলরেডি চলে আসছে। উনারাও যেকোনো সময় চলে আসবে।
-আপনি নিচে যান আমি আসছি।
তানিয়াকে জলদি করার তাগাদা দিয়ে প্রস্থান করেন দিলারা জামান। শাশুড়ি প্রস্থান করতেই তানিয়া বলে,
-সবই ঠিক আছে কিন্তু এমন গায়ে পড়া স্বভাবের মেয়েকে রওনক বিয়ে করবে বলে আমার মনে হয় না।
আর চিন্তায় মগ্ন না হয়ে তানিয়া ল্যাপটপ বন্ধ করে চেঞ্জ করতে চলে যায়। মেহমান আসার আগে সে উপস্থিত না থাকলে পরে আবার তার শাশুড়ি গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে।
সাবার বাবা-মা চলে এসেছে অনেকক্ষণ কিন্তু এখনো রওনক নিচে নামেনি। সবাই যখন ড্রইং রুমে আড্ডায় মশগুল তখনই তৈরি হয়ে উপর থেকে নিচে নামে রওনক। শাওয়ার নিয়ে কাপড় বদলে নিয়েছে সে। সারাদিনের ফর্মাল কাপড় বদলে প্যান্টের সাথে হাফ হাতার টি-শার্ট পরেছে। চুলগুলো বেকব্রাশ করে জেল দিয়ে সেট করে নিয়েছে। ডান হাতে রোল্যাকসের দামী ঘড়ি। চাপ দাঁড়ি ও হালকা মোচ ওয়ালা ফর্সা চেহারাটা দেখতে আরও ফ্রেশ লাগছে। নিচে নেমেই ড্রইং রুমে উপস্থিত সাবার বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে সালাম দেয় সে। এগিয়ে এসে সাবার বাবার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে। দিলারা জামান তাকে বসতে বললে রওনক বলে,
-সময় নেই মা, আমি বসবো না।
-সময় নেই মানে? কোথাও যাচ্ছিস নাকি?
-বাইরে যাচ্ছি একটু। সাদমানের সাথে প্ল্যান আছে।
-বাসায় মেহমান রেখে তুই বাহিরে যাচ্ছিস!
-তোমার গেস্ট তুমি এটেন্ড করো। আমার আগে থেকে প্ল্যান ছিল ক্যান্সেল করতে পারব না।
-উনারা তোর আর সাবার জন্য এসেছে রওনক। আমি ইনভাইট করেছি উনাদের।
আর ভনিতা না করে রওনক সরাসরি সাবার বাবা আশরাফ আহমেদকে বলে,
-সরি আঙ্কেল আমাকে বের হতে হবে। মা আপনাদের কেন ডেকেছে আমি বলতে পারছি না। ক্যাজুয়াল ডিনার হলে ওকে ফাইন বাট যদি আমার আর সাবার বিয়ের বিষয়ে হয়ে থাকে তাহলে আই এম রিয়্যালি সরি। আমি বিয়ে করার বিষয়ে আপাতত কিছু ভাবছি না। বলতে পারেন এক্ষুনি বিয়ে করার কোনো প্ল্যান নেই আমার। আমি আসছি, আমার ফ্রেন্ড ওয়েট করছে।
দিলারা জামানকে অবাক করে দিয়ে বেরিয়ে যায় রওনক। পেছনে রাগে পারেন না ভাঙ্গচুর শুরু করেন তিনি। মেহমানের উপস্থিতিতে আপাতত নিজেকে সামলে নেন। রওনক বেরিয়ে যেতেই আশরাফ আহমেদ বলেন,
-আমি বলি কি ভাবি আমরা কথাবার্তা বলার আগে আপনি রওনকের সাথে ভালো মতো কথা বলুন। ও কি চায় সেটা জানার চেষ্টা করুন। আমরা জোর করে দেয়ার চাইতে দেরিতে হোক তবু যারা বিয়ে করবে তাদের ইচ্ছায় হোক সেটা বরং বেশি ভালো হয়।
বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আশরাফ আহমেদ আরও বলেন,
-আজ আমরা আসছি ভাবি। ডিনারটা নাহয় অন্য কোনোদিন হবে। আজ থাক।
আর অপেক্ষা করেন না আশরাফ সাহেব। স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যান। উনারা বেরিয়ে যেতেই হাতের সামনে থাকা একটা কাঁচের গ্লাস তুলে আছাড় মারেন দিলারা জামান। তারপর নিজের রুমে চলে যান। পেছনে তানিয়া একা বসে থাকে ড্রইং রুমে। তার মুখের দিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকেন জাহানারা।
চলবে….