মাতাল হাওয়া পর্ব-২+৩

0
677

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-২
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না।)

নাস্তা বানানো শেষ করে রান্নাঘর গুছিয়ে, মাথায় পেঁচিয়ে রাখা গামছাটা বাইরের বারান্দায় মেলে দিয়ে আসে চিত্রলেখা। আসার সময় হাতে করে টোস্টের ডিব্বা নিয়ে আসে। সকাল সকাল তাদের খালা-ভাগ্নির চা আর টোস্ট খাওয়ার অভ্যাস অনেকদিনকার।

চিত্রলেখা এসে খালার পাশে বসতেই নারগিস বেগম বলেন,

-আমার কাছে আয় হাতে নেড়ে চুলগুলো শুকিয়ে দেই।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে খালার সামনে নিচে বসে যায় চিত্রলেখা। কোমড় পর্যন্ত লম্বা মোটা গোছার চুল মাথা ভর্তি। খুব আহামরি ফর্সা সুন্দর দেখতে না হলেও চিত্রলেখার চুলের জন্য সবসময় সবার কাছে প্রশংসিত সে। এই চুলটাই যেন ওর সৌন্দর্যকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে। চিত্রলেখার মাথার চুল হাতে নাড়তে নাড়তে নারগিস বেগম বলেন,

-সবার জন্য দিনরাত এক করে চিন্তা করিস। নিজের জন্য কবে ভাববি তুই?

-নিজের জন্য আলাদা করে ভাবার কি আছে?

-ওমা! ভাবার কিছু নাই কে বলল? তোর বয়স হচ্ছে বিয়ে দিতে হবে না?

-তুমি আবার আমার বিয়ের কথা ভাবতেছো?

-তো ভাববো না? বয়ত কত হইছে সেই খেয়াল আছে তোর?

-আমি বিয়ে করে অন্যের ঘরে চলে গেলে এই সংসার কেমনে চলবে খালা?

-সেই চিন্তা এখন তোকে আর না করলেও চলবে। লিখন বড় হইছে। সংসারের দায়িত্ব এখন ও নিবে। তুই তো এতকাল কম করিস নাই।

-তুমি কি পাগল হইছো খালা? লিখনের উপর দায়িত্ব দিয়ে দিলে সংসার রসাতলে যাবে গা। তাছাড়া ওর পড়ালেখাও শেষ হয় নাই। আগে পড়ালেখা শেষ করবে, ভালো চাকরী পাবে তারপরে গিয়ে দেখা যাবে। চারু আর চয়নও তো আছে। ওদের দায়িত্ব কে নিবে? ওদের দু’জনের লেখাপড়া করাইতে হবে। আমার চয়নটা মেডিকেলে পড়তে চায়। আমি জানি চারু কোনোদিন মুখ ফুটে বলবে না ও নিজেও মেডিকেলে পড়তে চায়। আমার সামর্থ্য নাই বলেই কখনো মুখ ফুটে বলে না। ওরা জানে না, ওরা না বললেও আমি ওদের মনের সব খবর রাখি। আল্লাহ আমাকে আরেকটু তৌফিক দিলে কি হইতো খালা?

কষ্টে বুক ভার হয়ে আসে চিত্রলেখার। তবু নিজেকে সামলে নেয় সে। খালার সামনে নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করতে চায় না। কিন্তু না চাইলেও নারগিস বেগম বুঝে জান। মেয়ের মতো ভাগ্নির জন্য উনারও হৃদয় পোড়ে। উনার সামর্থ্য থাকলে চিত্রলেখাকে কোনোরকম কষ্ট করতে দিতেন না তিনি।

-তুই চিন্তা করিস না। কম তো করছিস নাই। বাকিটাও হয়ে যাবে।

-আর বাকিটা। কপাল জোরে এত বড় কোম্পানিতে চাকরীটা পেয়েছিলাম বলে, নাহলে কি হতো ভাবতে পারো? ভাগ্যিস তখন ইউনিভার্সিটিতে ফ্রি কম্পিউটার কোর্সের সুযোগ পেয়ে সেটা লুফে নিয়েছিলাম। নাহলে এত বড় কোম্পানির কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টে একজন এক্সিকিউটিভ হিসেবে চাকরী পাওয়া তাও আমার মতো ন্যাশনালে পড়া ছাত্রীর জন্য দিবাস্বপ্ন ছাড়া কিছুই না খালা।

-তুই এভাবে ভাবতেছিস কেন?

-সত্যি বলতেছি খালা। কম্পিউটার কোর্সটা না জানা থাকলে এই চাকরী আমি জীবনেও পাইতাম না। তুমি জানো অন্য আরও যে ৬ জন আছে ওরা তো ভালো ভালো ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করেছে। সে জায়গায় আমি কিছুই না।

নারগিস বেগম কিছু বলতে নেন কিন্তু তখনই চোখ ডলতে ডলতে চারু এসে উপস্থিত হয়। চিত্রলেখার কোল ঘেষে বসে বলে,

-আমাকে ডাকো নাই কেন আপা? একা একা সব কাজ করছো কেন?

চারুকে বুকে জড়িয়ে, বোনের চাদিতে চুমু খায় চিত্রলেখা। নারগিস বেগম আর কিছু বলেন না। দুইবোনকে দেখে চোখ জুড়ান।

সকাল সকাল নাস্তার টেবিলে বসে রওনক প্রথমেই চায়ের কাপে চুমুক দেয়। তা দেখে পাশে বসে থাকা তার মা দিলারা জামান খেঁকিয়ে ওঠেন। ছেলেকে ধমকের সুরে বলেন,

-তোর এই বাজে অভ্যাস কবে পরিবর্তন হবে রওনক? কতদিন বলেছি খালি পেটে চা খেতে হয় না৷ এসিডিটির সমস্যা হবে।

মায়ের ধমকের সাথে সাথে পরপর আরও দুই চুমুক চা খায় রওনক৷ তারপর চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বলে,

-তুমি জানো এটা আমার অনেক পুরোনো অভ্যাস। চাইলেও ছাড়তে পারবো না। তবু প্রতিদিন এক বিষয় নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতে ভালো লাগে তোমার? এত এনার্জি কোথায় পাও তুমি?

ছেলের কথা শুনে ইতোমধ্যেই রেগে গেছেন দিলারা জামান। কিন্তু আপাতত এই বিষয়ে আর রা করেন না তিনি। ছেলের সাথো ঝামেলা করতে চান না। আজকের দিনটা সুন্দর হোক এমনটাই চান তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলেন,

-তোরা আজ জলদি চলে আসিস।

তোরা বলতে যে দিলারা জামান রওনক ও উনার বড় ছেলের বউ তানিয়াকে বুঝিয়েছেন তা বুঝতে অবশ্য কারো কোনো অসুবিধা হয়নি। এই বড়িতে দুইজন মানুষই অফিস করেন তারা হচ্ছে রওনক জামান এই বাড়ির ছোট ছেলে, জামান গ্রুপের বর্তমান সিইও আর তানিয়া রহমান রওনকের বড় ভাই রাদিন জামানের বউ। তানিয়া কোম্পানির ফাইনান্স ডিপার্টমেন্ট হেড। চমৎকার ক্যারিয়ার ফোকাসড একটা মেয়ে। দিলারা জামানের দুইটাই ছেলে। রাদিন ও রওনক। ওদের বাবা মারা গেছে বছর পাঁচেক আগে। রওনকের বাবা বেঁচে থাকতে এই কোম্পানি তিনিই সামলাতেন। আচমকা একদিন হার্ট এ্যাটাক করে মারা যান পাঁচ বছর আগে। তখন থেকেই বাবার পজিশনে কোম্পানি সামলে আসছে রওনক। জামান কোম্পানির সাথে কেবল নামে জড়িত রাদিন। এছাড়া ব্যবসার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই তার। কিন্তু এর মানে এই নয় সে সারাদিন ঘরে শুয়ে বসে থাকে। রাদিক একজন সফল আর্টিস্ট। তার আঁকা চিত্রকর্ম দেশে এমনকি বিদেশেও অনেক খ্যাতি পেয়েছে। তার ধ্যানজ্ঞান সবটাই কেবল চিত্রকর্মের প্রতি, বাকি দুনিয়ার অন্যসব কিছুর সাথে তার সম্পর্ক ফর্মাল। এমনও হয়েছে মনের মতো ছবি আঁকতে সে দিনের পর দিন নিজেকে ঘর বন্ধি করে রেখেছে। কখনো বা কাউকে না জানিয়েই নিরুদ্দেশ হয়েছে। কাজ শেষে আবার ফিরে এসেছে কখনো পনেরোদিন পর বা মাস শেষে। এনিয়ে অবশ্য বাসার কেউ কখনো আপত্তি করেনি। আবার এমনও নয় বড় ভাইয়ের আগ্রহ নেই বলে রওনক জোরপূর্বক নিজের ইচ্ছাকে মাটি চাপা দিয়ে পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেছে। ইনফ্যাক্ট বলা যায় ছোটবেলা থেকেই সে তার বাবার মতো একজন সফল ও সুখ্যাতি প্রাপ্ত ব্যবসায়ী হতে চেয়েছে। বলাবাহুল্য গত পাঁচ বছরে কঠিন পরিশ্রম ও মেধা খাটিয়ে রওনক নিজেকে প্রমাণও করেছে। তার বাবা বেঁচে থাকতে কোম্পানির শেয়ারের যে ভ্যালু ছিল তা রওনকের বদৌলতে তিনগুন হয়েছে এখন।

দিলারা জামানের কথার বিপরীতে রওনক কিছু জিজ্ঞেস করার আগে তানিয়া জিজ্ঞেস করে,

-আজ কি বিশেষ কিছু মা?

-অবশ্যই বিশেষ কিছু, সেজন্যই তো বলছি।

-আজ কিসের অকেশান? আমাদের কারো জন্মদিন তো নয়।

-না না ওমন কিছু না। সাবাদের দাওয়াত করেছি ডিনারে।

-হঠাৎ সাবাদের দাওয়াত করার অকেশান কি?

-অকেশন তো কিছু একটা আছেই।

এবারে রাদিন বলে,

-সেটাই তো আমরা জানতে চাই মা। এত ভনিতা না করে আসল কারণ টা বললেই পারো।

দিলারা জামান ছোট ছেলে রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন,

-আমি আজ সাবার বাবা-মায়ের সাথে সাবা আর রওনকের বিয়ের কথা আলোচনা করবো। উনাদের মতামত জানতে চাইবো আর কি। আর উনাদের জানাবো আমি সাবাকে আমার রওনকের বউ করে আনতে চাই।

সাবার নাম শুনেই রওনক বুঝে গিয়েছিল এরপর তার মা কি বলবে। তাই সাবা প্রসঙ্গ উঠতেই তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু সকাল সকাল নাস্তার টেবিলে রওনক কোনো ধরনের সিন ক্রিয়েট করতে চায় না বলে এই বিষয়ে কথা বলে না। সবেই একটা চালের রুটি হাতে নিয়েছিল সে কিন্তু আজ আর খাওয়া হবে না তার। চায়ের কাপে আরেকটা চুমু দেয় সে। শাশুড়ির কথা শুনে তানিয়া একবার রওনকের মুখের দিকে তাকায়। তারপর শাশুড়িকে বলে,

-উনাদের এভাবে ইনভাইট করার আগে একবার রওনকের সাথে কথা বলে নিলে ভালো হতো না?

ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দিলারা জামান বলেন,

-ওকে আবার আলাদা করে কি জিজ্ঞেস করবো? আর কতদিন আপত্তি করবে ও? এভাবে কি সারাজীবন একা কাটিয়ে দিবে নাকি?

তানিয়া হয়তো আরও কিছু বলতে নিয়েছিল কিন্তু রওনক চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ায় সে আর কিছু বলে না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রওনক মিমি ও মিশকাতকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-তোমরা জলদি নাস্তা করে আসো, আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি।

মিমি, মিশকাত দু’জনেই বাধ্য বাচ্চার মতো মাথা নেড়ে বলে,

-ওকে ছোটপাপা।

এরা দুইজন হচ্ছে এই পরিবারের জান। রাদিন ও তানিয়ার ছেলেমেয়ে। রওনকের কলিজার টুকরো দু’জনেই। প্রতিদিনের রুটিন সকালে রওনক ওদের স্কুলে নামিয়ে দিয়ে তারপর অফিসে যায়। ওদের স্কুল শেষ হলে রওনকের ড্রাইভার বাসায় নিয়ে আসে। বাড়িতে আরও তিনটা গাড়ি থাকা স্বত্বেও ওরা দু’জন রওনকের গাড়ি ছাড়া অন্যকোনো গাড়িতে করে স্কুলে যাওয়া আসা করে না। এমনকি ঘুরতে, বেড়াতেও যেতে চায় না। ওরা দু’জনই রওনকের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাই ওদের যেকোনো আবদার সে মেনে নেয় বিনা বাক্য ব্যয় করে। রওনক নাস্তা না করেই চলে যেতে চাচ্ছে দেখে দিলারা জামান বলেন,

-সে কি রওনক তুই নাস্তা না করে চলে যাচ্ছিস কেন?

এই মুহূর্তে সে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চায়নি কিন্তু কিছু না বলেও পারছে না। জবাব না দেয়াটাও বেয়াদবি। তাই বাধ্য হয়েই চেয়ারে বসে পরে বলে,

-আমি তোমাকে আগেও নিষেধ করেছি এমন কিছু করতে।

-এটা কেমন কথা রওনক? আমি তোর মা, তোর ভালো-মন্দ দেখা আমার দায়িত্ব। তাছাড়া আমি তো সারাজীবন বাঁচবো না। একদিন আমিও তোর বাবার মতো মরে যাবো। তখন কে দেখবে তোকে?

-আমি নিজেই নিজেকে দেখবো মা। যখন তুমি থাকবা না তখনেরটা তখন দেখা যাবে এখন কেন এসব কথা আসছে। আমার কাউকে প্রয়োজন নেই আর কতবার বললে বুঝবা তুমি?

-দেখ রওনক, এবার তোকে বিয়ে করতেই হবে।

ফস করে জোরে একটা শ্বাস ছেড়ে রওনক চোয়াল শক্ত করে বলে,

-আমি আগেও বলেছি, এখন আবারও বলছি, আমি আর বিয়ে করবো না। সো এসব পাগলামি করার কোনো মানে হয় না।

নিজের কথায় বিরতি না দিয়ে, মাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রওনক তানিয়াকে বলে,

-আমি বাচ্চাদের নিয়ে যাচ্ছি ভাবী।

আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে যায় সে। রওনক বেরিয়ে যেতেই তানিয়া পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে বলে,

-এসব করার আগে আপনি আমাকে অন্তত একবার বলতেন মা। রওনক চায় না তাহলে কেন ওকে ফোর্স করছেন?

-তুমিও ওকেই সাপোর্ট করছো বউমা? এভাবে কতদিন একা থাকবে ও? তোমার তো উচিত ওকে বুঝিয়ে বলা। তা না করে উল্টা তুমি আমাকে বুঝাচ্ছো।

-আপনি আপনাকে বুঝাচ্ছি না মা। আমি জাস্ট বলতেছি এভাবে কাজ করলে রওনক কোনোদিনও রাজি হবে না। ওর সাথে কথা বলতে হবে ঠান্ডা মাথায়। ও প্রচন্ড জেদি তা তো আপনি ভালো করেই জানেন। ওর সাথে জেদ দেখালে পারবেন না।

বউকে সমর্থন করে রাদিন বলে,

-এমন করলে রওনক কোনোদিনও আবার বিয়ে করতে রাজি হবে না মা।

-ছয় বছর তো কম সময় না। অতীত ধরে বসে থাকলে কীভাবে সামনে আগাবে ও?

-আপনি ভুল ভাবছেন মা। আপনার ছেলে অতীত আঁকড়ে ধরে বসে রয়নি। ওর শুধু সময় প্রয়োজন।

-আমি বুঝি না তোমাদের এসব কথা। আর বুঝতেও চাই না। তোমরা আসলে আসবা, না আসলে নাই। আমি আজ সাবার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলবো আর এটাই ফাইনাল।

তানিয়া আর কিছু বলে না। সে ভালো করেই জানে তার শাশুড়ি উচ্চ লেভেলের ঢিট মানুষ। সহজ কথায় একে বুঝানো সম্ভব নয়। আপাতত আর চেষ্টাও করে না। এর চাইতে ভাবে অফিসে গিয়ে রওনকের সাথে কথা বলবে এই বিষয়ে। এটাও ঠিক ইটস হাই টাইম রওনকের আবার বিয়ে করা উচিত। এভাবে সারাজীবন একজনের পক্ষে একা থাকা সম্ভব নয়, এটা রওনককে বুঝতে হবে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৩
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না।)

সাড়ে আটটা নাগাদ বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে চিত্রলেখা। দশটায় অফিস কিন্তু দশ/পনেরো মিনিট আগেই উপস্থিত থাকে সে সবসময়। শুধু চিত্রলেখা একা নয়। অফিসের সবাই পনে দশটার মধ্যে ইন করে।

বাসা থেকে বেরিয়ে গলির মাথায় আসে চিত্রলেখা। মেইনরোডে এসে বাসে উঠবে বলে। প্রতিদিনের মতো আজও গলির মাথায় আসতেই তার পথ আগলে দাঁড়ায় মামুন। এটা এখন রোজকার নিয়ম হয়ে গেছে। শুক্র, শনি বাদে সপ্তাহের বাকি পাঁচদিনই মামুন এই কাজ করে। হোক শীত, গ্রীষ্ম বা বসন্ত একদিনও বাদ যায় না। এই এলাকার স্থানীয় ছেলে সে। চিত্রলেখার খালুর বাড়ির ঠিক ডান পাশের পাঁচতলা বাড়িটা মামুনদের। চার ভাইয়ের মধ্যে মামুন তিন নম্বর। মাধ্যমিক পাশ করার পর আর লেখাপড়া করেনি। পড়তে তার ভালো লাগে না। শুধু পড়ালেখা নয় কিছুই করতে তার ভালো লাগে না। মামুনের বাবা এলাকার প্রভাবশালীদের একজন। এই এলাকায় ওদের অবস্থা উচ্চপর্যায়ে। তিনটা বাড়ি আছে, বাজারে দোকান আছে আট কি দশটা। এছাড়াও কেরানীগঞ্জে মামুনের বাবার একটা কারখানা আছে। কিসের কারখানা সেটা অবশ্য চিত্রলেখা জানে না। কখনো জানার আগ্রহ হয়নি৷ ছোটবেলা থেকে চোখের সামনে চিত্রলেখাকে বড় হতে দেখেছে মামুন। আর দেখতে দেখতে কখন ভালোবেসে ফেলেছে তা সে নিজেও জানে না। এই পর্যন্ত কম করে হলেও শ’খানেক বার মামুন চিত্রলেখাকে তার মনের কথা জানিয়েছে কিন্তু প্রতিবার সে তা ভদ্রভাবে প্রত্যাখান করেছে। এতে মামুন কখনো উচ্চবাচ্য করেনি। হুমকি ধামকিও দেয়নি। বরং বেহায়ার মতো দু’বার তার মাকে পাঠিয়েছে চিত্রলেখার খালার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে। সেই প্রস্তাবও নাকচ করেছে সে। সুন্দরভাবেই বুঝিয়ে বলেছে ছোটভাইবোন-দের যার যার পায়ে দাঁড় না করিয়ে তার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়। মামুনটা ছোটবেলা থেকেই অলস, ভবঘুরে ধরনের। সহজ ভাষায় এলাকার লোকজন তার পিছনে তাকে ভাদাইম্মা বলে ডাকে। এই খবর মামুন জানে তবু কানে নেয় না। জীবনে কোনো কাজ সিরিয়াসভাবে করেনি সে কেবল একটা কাজ ব্যতীত আর তা হচ্ছে চিত্রলেখাকে ভালোবাসা। এই একটা কাজই সে মন-প্রাণ দিয়ে করেছে। শেষপর্যন্ত চিত্রলেখা তার হবে কিনা তা না জেনেই নিজের সবটুকু ভালোলাগা, ভালোবাসা মামুন চিত্রলেখার নামেই লিখে দিয়েছে।

চিত্রলেখা গলির মাথায় এগিয়ে আসতেই টঙ দোকানে বসে চা খেতে থাকা মামুন হাতের কাপটা নামিয়ে রেখে এগিয়ে আসে। অন্যপাশেই তার বাইট পার্ক করা আছে। দূর থেকে সেটা আগেই দেখে ফেলেছিল চিত্রলেখা। বাইক দেখে আন্দাজ করে ফেলেছিল বাদরটা আশেপাশেই আছে। তবু চেষ্টা করেছিল মামুন তাকে দেখে ফেলার আগে হটকে পড়তে। প্রতিদিন এই লোকটার সাথে দশ/পনেরো মিনিট ঘ্যানঘ্যান করে দেরি হয়ে যায় তার। সেজন্যই সাড়ে আটটায় বাসা থেকে বের হয় সে। নয়ত নয়টায় বের হলেও ঠিক সময় মতো পৌঁছাতে পারে। কিন্তু নিয়ম করে মামুন পথ আটকায় বলে বাধ্য হয়ে চিত্রলেখাকে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়। এভাবে প্রতিদিন দুইটা বাস মিস হয় তার।

মামুন পথ আটকে দাঁড়িয়ে কিছু বলার আগে চিত্রলেখা নিজেই বলে,

-মামুন ভাই আপনার কি কোনো কাজ নাই?

-আপাতত তো তোমার পথ দেখা ছাড়া আর কোনো কাজ নাই। তুমি চাইলে আমাকে একটা কাজ দিতে পারো।

-কিন্তু আপনাকে দেয়ার মতো কোনো কাজ আমার কাছে নাই।

-একটা কাজ আছে তুমি চাইলে আমি করতে পারি।

-কী কাজ?

-তোমাকে প্রতিদিন অফিসে দিয়ে আসা আর নিয়ে আসার কাজ। তোমাকে কষ্ট করে বাসে ঝুলে যাওয়া আসা করা লাগবে না। বাইকে সময়ও কম লাগবে।

-আপনার অনেক ধন্যবাদ মামুন ভাই কিন্তু আমি এমনি ভালো আছি। আমার কোনো বিশেষ সার্ভিসের প্রয়োজন নাই। আপনি শুধু দয়া করে আমার পথ আটকানো বন্ধ করেন। আপনার জন্য আমার প্রতিদিন দেরি হয়।

-তুমি আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেই তো আমি আর পথ আটকে দাঁড়াই না। আব্বা-আম্মা বিয়ের জন্য প্রেসার দিচ্ছে মায়া।

-আপনি আবার আমায় মায়া বলে ডাকলেন?

-আমি সারাজীবনই তোমায় মায়া বলে ডাকবো।

চিত্রলেখা হাত ঘড়িতে সময় দেখে। তার দেরি হয়ে যাচ্ছে। এই পাগলের সাথে কথা বলতে থাকলে এসব কথা শেষ হবে না। তাই কথার ইতি টানার চেষ্টা করে চিত্রলেখা বলে,

-আপনার বাবা-মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলুন মামুন ভাই। আমার আশায় থাকলে আপনাকে একাই বুড়ো হতে হবে।

চিত্রলেখার দেরি হচ্ছে দেখে পাশ কেটে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলে মামুন আর বাঁধা দেয় না। পেছন থেকে শুধু বলে,

-খালাম্মাকে বলে রাইখো শুক্রবার আব্বা-আম্মা তোমাদের বাড়ি যাবে।

এবার চিত্রলেখাই দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছন ঘুরে মামুনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,

-আমি আগেও বলেছি আমার পক্ষে এখন বিয়ে করা সম্ভব না। আপনি দয়া করে চাচা-চাচীকে পাঠাবেন না। প্রতিবার আমি উনাদের মুখের উপর না করতে পারবো না মামুন ভাই।

চিত্রলেখা কিছু বুঝতে পারার আগে মামুন হাত বাড়িয়ে তার একটা হাত ধরে বলে,

-এবার না করো না মায়া৷ চলো আমরা বিয়েটা করে ফেলি। আমি সত্যি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।

মামুনের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-কিন্তু আমি আপনাকে ভালোবাসি না। দয়া করে আমাকে আর বিপদে ফেলবেন না। চাচা-চাচীকে পাঠিয়ে আমায় আর অপমানের মুখোমুখি করবেন না অনুরোধ করছি।

মামুনকে আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না চিত্রলেখা। সোজা হাটা ধরে অফিসের দিকে। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে একা মামুন। মনে মনে ভাবে, ❝একদিন তুমি ঠিকই আমাকে ভালোবাসাবা মায়া।❞ চিত্রলেখাকে মায়া বলে ডাকে মামুন। এই নামটা তারই দেয়া। চিত্রলেখাকে দেখলেই নাকি তার মায়া পায়, ভালোবাসা পায়। একপৃথিবী উজার করা মায়া দেখতে পায় সে চিত্রলেখার মুখে। তাই ভালোবেসে, ভালোবাসার মানুষকে মায়া নাম দিয়েছে সে।

—————————————————————————-

মিমি মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলে, তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ে আর ম্যাশকাত পড়ে ডিআরএমসি-তে, পঞ্চম শ্রেনীতে। রওনকের অফিস পান্থপথে হওয়ায় প্রতিদিন শ্যামলী থেকে অফিস যাওয়ার পথে দু’জনকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যায় সে। কখনো এই নিয়মের পরিপন্থী হয় না। আজও ওদের নামিয়ে দিয়ে অফিস যাওয়ার পথে কলাবাগান মোড়ে সিগনালে পড়ে সে। পেছনের সিটে বসে গ্লাস না নামিয়ে বাইরে তাকালে, ঠিক তার গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বাস থেকে চিত্রলেখাকে নামতে দেখে রওনকের দৃষ্টি ওখানেই স্থির হলো বুঝি। সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির ফাঁক গলে ফুটপাতে উঠে যায় মেয়েটা। জোর পায়ে হেঁটে চিত্রলেখা সামনে এগিয়ে গিয়ে বামে মোড় নিয়ে হাওয়ায় হয়ে যায়। এখান থেকে তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। সেদিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সামনের দিকে তাকায় রওনক। সিগনাল কখন ছাড়বে সেই আশায়। কয়েক সেকেন্ড বাদেই সিগনাল ছেড়ে দিলে গাড়িটা ঠিক সেই পথ ধরেই আগায় যে পথ ধরে একটু আগে চিত্রলেখা নামক ছিমছাম দেখতে মেয়েটা হেঁটে গেছে ব্যস্ত ভঙ্গিতে। ওকে দেখলেই মনে হয় ওর দুই কাঁধে রাজ্যের সব দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। যেসব দায়িত্বের ভারে দিনকে দিন মেয়েটা হাসতে ভুলে যাচ্ছে। গাড়িটা স্কয়ার হাসপাতাল অতিক্রম করতেই রওনক আবার চিত্রলেখাকে দেখতে পায়। দূর থেকে দেখলেও চিনতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি তার। চট করেই ড্রাইভারকে বলে গাড়ি থামাতে। বাম পাশে গাড়িটা দাঁড় করালে নেমে গিয়ে ফুটপাতে দাঁড়ায় রওনক। অনেক খানিক দূরত্ব তাদের মাঝে। চিত্রলেখা হয়ত লক্ষই করেনি দূরে দাঁড়িয়ে কেউ একজন দেখছে তাকে। দেখবে কীভাবে সে তো ব্যস্ত নিজের ছেঁড়া জুতা ঠিক করতে। কলাবাগান সিগনালে বাস থেকে নেমে অফিস পর্যন্ত হেঁটে আসে সে। আজ আসার পথে দ্রুত হাঁটতে গিয়ে জুতাটা ছিঁড়ে গেছে। সেই ছেঁড়া জুতাই মুচির কাছে দিয়ে সেলাই করে নিচ্ছে। আপাতত হাতে সময় নেই জুতা কিনতে যাওয়ার। হয়ত লাঞ্চ টাইমে নয়ত অফিসের পরে কিনে নেয়া যাবে। আজকের দিনটা চালাতে পারলেই হলো। জুতা সেলাই করে নিয়ে আবার সামনের দিকে হাটা ধরে চিত্রলেখা ব্যস্ত ভঙ্গিতে। দশটা বাজতে খুব বেশি সময় নেই। জলদি পৌঁছাতে হবে তাকে। পেছনে দাঁড়িয়ে চিত্রলেখার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে রওনক। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় যতখানি রাগ হয়ে বেরিয়েছিল এই মুহূর্তে আর ততখানি রাগ অনুভব করছে না সে। অনেকটাই হালকা লাগছে নিজেকে। রওনককে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ড্রাইভার নেমে এসে জিজ্ঞেস করে,

-স্যার কি আজ অফিস যাবেন না?

-যাবো, কারো অফিস পৌঁছানোর খুব তাড়া। সে পৌঁছানোর পর যাবো।

-কার কথা বলছেন স্যার?

-তুমি চিনবে না?

আরও খানিকক্ষণ সামনের পথের দিকে তাকিয়ে থাকে রওনক। যতক্ষণ চিত্রলেখাকে দেখা যায় ততক্ষণ। এই তাকিয়ে থাকার, দাঁড়িয়ে থাকার অর্থ তার জানা নেই। মেয়েটার মধ্যে অদৃশ্য কোনো শক্তি আছে। তা মাস দেড় আগেই টের পেয়েছে রওনক, যেদিন তারা প্রথম একে-অপরের মুখোমুখি হয়েছিল। কিছু একটা মুগ্ধ করেছিল তাকে অজান্তে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে