মাইনাসে মাইনাসে প্লাস পর্ব-১৫+১৬

0
3308

#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ১৫)
নুসরাত জাহান লিজা

“ওইদিকে একটু সরে বসুন তো দেখি।”

লিলির কথায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে প্রশ্ন করল নেহাল, “কেন?”

“গল্প করব আপনার সাথে। একই ঘরে থাকছি, অথচ কেউ কাউকে চিনি না। তাই ভাবলাম আজ আড্ডা দেই।”

নেহাল এই সময়টার জন্যই মনে মনে যেন প্রতীক্ষার প্রহর গুনছিল। কিন্তু সাহস করে মুখ ফুটে বলতে পারছিল না। তবে আচমকা এই মেয়ের এতটা সুমতি কেন হলো সেটা ভেবে কিঞ্চিৎ আশঙ্কাও জন্মেছে।

তবুও নেহাল সরে বসে বিছানায় জায়গা করে দিলো। লিলি তড়িৎ বেগে পা গুটিয়ে বসতে বসতে বলল,

“আচ্ছা, চলেন আমরা একজন আরেকজনকে প্রশ্ন করি। পরস্পরকে দ্রুততম সময়ে জানার এটাই বেস্ট ওয়ে৷ আমি আপনাকে প্রশ্ন করব, আপনি উত্তর দেবেন। আবার আপনি আমাকে প্রশ্ন করবেন, আমি উত্তর দেব। ঠিক আছে?”

“আচ্ছা।”

“আগে আমার টার্ন। আপনি রেডি?”

নেহাল জানে না ওর জন্য কোন ধরনের প্রশ্নবাণ অপেক্ষা করছে। তবুও সে উত্তর দিল,

“রেডি।”

লিলি একটা বালিশ নিজের কোলের উপরে রাখল, এরপর তাতে কনুইয়ের ভর রাখল। এরপর হাতের তালুতে নিজের থুতনি ঠেকিয়ে অত্যন্ত সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,

“গুড। আপনি গান গাইতে পারেন?”

“না”

“আবৃত্তি করতে পারেন?”

“না।”

“ক্রিকেট খেলেছেন কখনো? ফুটবল?”

“একসময় খেলতাম৷ ভার্সিটি লাইফের পরে আর সুযোগ হয়নি।”

“কবিতা লিখেছেন কখনো?”

“নাহ্!”

“মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করেছেন কতবার?”

একটু ভেবে নেহাল উত্তর দিল, “একবারও না।”

“সেটা অবশ্য আপনার কথাবার্তা শুনেই বুঝতে পেরেছি। যে নিরামিষ লোক! আপনি তো দেখি কিছুই পারেন না! পারেনটা কী? শুধু ফ্যাচফ্যাচ করে কান্নাকাটি করতে? কমিউনিকেশন স্কিলও যাচ্ছেতাই।”

“আমি খুব ভালো কমিউনিকেট করতে পারি মানুষের সাথে। একজন ভালো কমিউনিকেটরের হিসেবে আমার রেপুটেশন আছে। আরেকটা কথা, আমি ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদি না কখনোই।”

“তার নমুনা তো নিজের চোখেই দেখলাম। ভালো কমিউনিকেটর হলে যা পারেন না বললেন, সেসব সোজা পারি না, না বলে এমনভাবে বলতেন যাতে মনে হতো না পারাটাই বুঝি বিশাল গুণের কাজ। এত নিরামিষভাবে কেউ কথা বলে? আচ্ছা, আপনি কি ভেজিটারিয়ান?”

“না।”

“যাক, একটা উত্তর তাও যুতসই হলো। এবার আমাকে প্রশ্ন করেন?”

“তুমি গান গাইতে পারো?”

“বি ক্রিয়েটিভ। আমার প্রশ্ন কপি করা চলবে না।”

“তুমি ইউটিউবে কন্টেন্ট বানাও দেখলাম। তাই না?”

“আরে, দারুণ একটা প্রশ্ন করেছেন তো। জানেন, আপনি প্রশ্ন না করলে আমি জানতেই পারতাম না, আমি ইউটিউবে হাবিজাবি কন্টেন্ট বানাই ফ্রেন্ডদের সাথে। বলি, এটা কোনো প্রশ্ন হলো?”

অপ্রস্তুত নেহাল কিছুক্ষণ ভেবে এরপর বলল, “আচ্ছা, ধরো, আমার সাথে বিয়ের আগে নিশ্চয়ই হাজব্যান্ড নিয়ে তোমার কিছু ফ্যান্টাসি ছিল! তোমার স্বপ্নের পুরুষের ছবিটা কেমন ছিল?”

“এই প্রশ্ন বিয়ের আগে করার দরকার ছিল।”

“আমি তোমাকে কল করেছিলাম। তুমি পাত্তা দাওনি।”

লিলি এটা নিয়ে আর ঘাটালো না। একটু ভাবুক হয়ে উত্তর দিল,

“তেমন কোনো ফ্যান্টাসি ছিল না। একটা বিষয় মাথায় কাজ করত, যাকে বিয়ে করব সে আমাকে শতভাগ বুঝতে পারবে। আমার কাজগুলোকে এপ্রিশিয়েট করবে। আমার খুব ভালো বন্ধু হবে। সেজন্য এরেঞ্জ ম্যারেজ আমার পছন্দ ছিল না। মনে হতো একটা প্রেম করব। ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং হলে এরপর বিয়ে। সেজন্য জেনারেশন গ্যাপ থাকুক তেমন একদমই ভাবিনি।”

“বয়সে বড় হলেই কি সবসময় সমস্যা হয়?”

“হয় না বলছেন? আমি একটা রিলেশনশিপে ছিলাম অল্প কিছুদিন। যদিও ওয়ার্ক করেনি সেটা। এই যে অকপটে বললাম, আমার জেনারেশনে এটা খুব সহজভাবে নেবে অনেকেই। আপনি নিতে পারবেন? মনে হবে না, মেয়েটা কেমন যেন? হাজব্যান্ডের কাছে এভাবে নিজের পাস্ট এ্যাফেয়ারের গল্প শোনাচ্ছে?”

নেহালের কৌতূহল হলো সহসা, সেজন্যেই কি এই সম্পর্ক নিয়ে এত অনীহা লিলির? যার সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল তাকে কি লিলি খুব ভালোবাসত? সে কি কেবলই একজন তৃতীয় পক্ষ হয়ে ঢুকে পড়েছে একেবারে অযাচিতভাবে! তবে এই প্রশ্ন করলে লিলি নিশ্চয়ই ওকে ভুল বুঝবে। ভাববে নিজের পৌরুষ দেখাচ্ছে। কিন্তু একদমই তা নয়।

ইতস্তত করে প্রশ্নটা করেই ফেলল নেহাল, “ওয়ার্ক করেনি কেন? আমার জন্য?”

“নাহ্! ওই ব্যাটা একটা ছ্যাবলা। প্রথমে বুঝিনি। তিন চারদিনের মধ্যে বুঝতে পারলাম, সপ্তাহ পুরার আগেই ব্রেকআপ।”

নেহাল খেয়াল করল একটা ভার বুক থেকে নেমে গেল যেন, ভীষণ স্বস্তি পেল।

“তাহলে আমার কোনো প্রবলেম হবার প্রশ্নটাই বা কেন আসছে? মানুষের পাস্ট থাকতেই পারে। বর্তমানে সেটা না থাকলে আমি কেন শুধু শুধু সেসব নিয়ে মাথা ঘামাব। তাছাড়া, বয়স বেশি হলেই যে সবসময় বন্ধুত্ব হবে না, তা তো নয়। সেটার জন্য বোঝাপড়া আর সদিচ্ছা প্রয়োজন বোধহয়, বয়স ব্যবধানের হিসাব করার ক্যালকুলেটর নয়।”

“বাহ্! বুলি ফুটেছে দেখছি। কথা তো অতটা খারাপ বলেন না। কিন্তু একটু ভুল আছে। রেজাল্ট খুব একটা ভালো না হলেও আমার মস্তিষ্ক কিন্তু ভীষণ শার্প। তাই এটুকু বয়সের পার্থক্যের বিয়োগ করতে আমার ক্যালকুলেটর লাগে না। আমাকে কি আপনার ব্রেইনলেস মনে হয়?”

“এখন আমার প্রশ্ন করার টার্ন ছিল যতদূর জানি।”

“ওকে, ওকে।”

“সম্পর্ক বলতে কি বুঝো?”

“সম্পর্ক তো অনেক রকম হয়। বাবা-মা, আত্মীয় পরিজন, প্রতিবেশি, বন্ধু…”

“না মানে…”

“প্রশ্ন হতে হবে স্পেসিফিক। আপনি অর্ধেক কথা মনে রেখে অর্ধেক ছুঁড়ে দেবেন, তাহলে তেমন উত্তরই পাবেন। বিয়ে এবং হাজব্যান্ড ওয়াইফ নিয়ে আমার কথা জানতে চাইছেন, অথচ বলতে পারছেন না। আমি কি বাঘ-ভাল্লুক নাকি শ্যাওড়া গাছের পেত্নী? প্রশ্ন করলে নিশ্চয়ই খেয়ে ফেলব না, তাই না।”

নেহাল চূড়ান্ত রকমের অপ্রতিভ হয়ে বেশ কয়েকবার কাশি দিয়ে নিজেকে লুকোবার বৃথা চেষ্টা করল। লাভ হলো না। মেয়েটার বয়স অল্প হলে কী হবে, সাক্ষাৎ একটা এ ট ম/ বো ম। প্রশ্নের বু ল ডো জা র ছুঁড়েই কুপোকাত করে ফেলতে পারার ক্ষমতা দারুণভাবে রপ্ত আছে।

লিলি এতটাই অকপট এবং স্পষ্টভাষী যে নেহাল নিজের ভবিতব্য নিয়ে চিন্তিত হলো।

“বুঝতে যখন পেরেছ, তখন উত্তর দিয়ে দাও।”

“আমি ভুল প্রশ্নের উত্তর দেই না। আগে কারেকশন করেন, তারপর উত্তরের আশা করবেন। নইলে এখন যেই ফরম্যাটে আছে সেটারই উত্তর পাবেন।”

“আচ্ছা করছি। আমাদের সম্পর্ক নিয়ে তোমার এখনকার ভাবনা কী?”

“এটার উত্তর দেবার সময় এখনো আসেনি।”

“লিলি, একটা কথা বলি?”

“বলুন।”

“তুমি কীভাবে নেবে জানি না। বিয়ে শুধু দুটো মানুষের মধ্যে হলেও তোমার মা, আমার পরিবার এর সাথে জুড়ে আছে। সবার জন্য, আমাদের নিজেদের জন্যও কি আরেকটু ভাবতে পারি না?”

লিলির প্রাণবন্ত মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল আচমকা। তবে মুহূর্তেই সামলে নিয়ে সপ্রতিভ ভঙ্গিতে সে বলল,

“ধৈর্য বলে একটা বস্তু আছে। আপনি আগে আমাকে ইমপ্রেস করেন। যদি সফল হন, তখন নাহয় ভেবে দেখা যাবে।”

“ইমপ্রেস করার জন্য কী কী করতে হবে?”

“সেটাও আমাকে বলে দিতে হবে? আপনি তো ভারি অদ্ভুত লোক। যাকে পটাতে চাইছেন, তার কাছেই টিপস চাইছেন? একটুখানি কমনসেন্স তো এপ্লাই করুন, ম্যান।”

নিজের বোকা বোকা প্রশ্নে নিজেই বিরক্ত হলো নেহাল। এই মেয়ে বলে কয়ে প্রত্যেকটা বলে বলে ওকে ক্লিন বোল্ড করে দিচ্ছে, নিতান্ত আনাড়ির মতো ও বারবার প্যাভিলিয়নের বাইরে চলে আসছে। চাপা স্বভাবের হলেও যথেষ্ট বুদ্ধিমান হিসেবে নেহালের সুনাম রয়েছে। বন্ধুরা ওর কোনো মতামতকে সবচাইতে বেশি গ্রাহ্য করে।

আজ কী হয়েছে ওর! এই মেয়ে নির্ঘাৎ জাদু টোনা জানে, মন্ত্রবলে নেহালের ব্রেইনের জায়গায় কোন পদার্থরূপী অপদার্থ ইমপ্ল্যান্ট করেছে কে জানে!

“চেষ্টা করলে গ্রিন সিগনাল পেতে পারি?”

“তা পারেন। কিন্তু তেমন আশা তো দেখছি না। আপনার যা পারফরম্যান্স দেখলাম আজ! একটা টিপস দিতে পারি, নেবেন?”

নেহাল উত্তর না দিলেও লিলি মাথাটা একটুখানি ওর দিকে এলিয়ে ষড়যন্ত্রীর মতো করে বলল, “বেশি বেশি সবুজ শাকসবজি আর মলা, ঢেলা, চ্যালা, প্যালা এমন যা কিছু খাবার আছে সেসব বেশি বেশি খান। মাথার গোবর থেকে সার পেলেও পেতে পারেন৷”

নেহালের মুখে আবারও সেই অসহায় অভিব্যক্তি ফুটে উঠতে দেখে লিলি বলল, “আরেকটা ফ্রি এডভাইস, ছিচকাঁদুনে ছেলে আমার একদম পছন্দ নয়।”

নেহাল এতক্ষণ সহ্য করলেও এবার ওর বাঁধ ভাঙল খানিকটা, গলায় ক্ষোভ নিয়ে বলল, “একদম বাজে কথা বলবে না। আমি মোটেও কান্নাকাটি করি না।”

লিলি ছবিটা বের করে নেহালের চোখের সামনে ধরল, “জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ আমার সামনে।”

নেহাল ছবিটা নেয়ার জন্য হাত বাড়াতে বাড়াতে লিলি ঝড়ের বেগে হাত সরিয়ে নিল।

“ওটা দাও প্লিজ।”

লিলির মুখে ট্রেডমার্ক দুষ্টু হাসি খেলে গেল, “এখন কেবল আমরা কয়েকজন জানি। আরেকবার এটা ফেরত চাইলে, আমি এটা আমাদের পেইজে আপলোড করে দেব। একটা কিউট টাইপের ক্যাপশনও মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি, ‘আমার ছিঁচকাঁদুনে বর’। সাথে অবশ্য আরেকটা সেলফি থাকবে।”

নিজের মোবাইলের ক্যামেরা অন করে নেহালের কাছে সরে বসল লিলি। এরপর নেহালের কাঁধে আলতো করে মাথা রেখে বলল,

“একটা রোমান্টিক হাসি দেন তো? তাহলে ছবি ফেরত দেয়ার ব্যাপারটা কনসিডার করা হতে পারে।”

নেহাল আচমকা লিলির এভাবে কাছে সরে আসায় বিব্রতবোধ করল, মুখে কিছুতেই হাসি আনতে পারল না। বরং একটা বোকাটে অভিব্যক্তি ফুটল নেহালের মুখে। লিলি সেলফি নিয়েই সরে গেল।

“এই ছবিতেও আপনাকে মারাত্মক কিউট দেখাচ্ছে। আলাভোলা সুন্দর ছেলে। আমাদের ফলোয়ার সংখ্যা ভালোই। পাশাপাশি ছবি দুইটা দিয়ে পোস্ট করলে আপনার ভাগ্য খারাপ থাকলে ভাইরালও হয়ে যেতে পারে। এসব আবার লোকে খায় ভালো।”

নেহালের মুখ এবার সত্যিই কাঁদোকাঁদো হয়ে গেল। সে প্রাণপণে নিজের সেই এক্সপ্রেশন লুকানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,

“এটা কোরো না, প্লিজ। আমি রিকোয়েস্ট করছি।”

লিলি বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বলল, “এদিকে একটু এগিয়ে আসুন তো, একটা জিনিস দেখব।”

নেহাল ভীত মুখ আর মন নিয়ে বিছানায় বসে থেকেও খানিকটা এগিয়ে লিলির নাগালের মধ্যে এলো।

লিলি আলতো করে নেহালের থুতনি ধরে নিজের মুখটা খানিকটা নামিয়ে ওর মুখের কাছাকাছি এনে প্রায় ফিসফিস করে বলল,

“আপনার এই এক্সপ্রেশন আমার পছন্দ হয়েছে। তাই এবারের মতো মাফ করলাম। ভবিষ্যতে ছবিগুলো চাওয়ার সাহস করবেন না কিন্তু। মনে থাকবে?”

চূড়ান্ত নাজেহাল নেহাল মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়া ছাড়া আর অন্য কোনো উপায় খুঁজে পেল না। একে তো লিলি এতটা কাছাকাছি, তার উপর নিজের অস্তিত্ব নিয়ে নিদারুণ সংকট। এমন গ্যাঁড়াকলে এই বত্রিশ বসন্ত পেরিয়ে আসা জীবনে এই প্রথম পড়েছে। সে মনে মনে একটা কথাই বলছে,

“ধরণী দ্বিধা হও”

লিলি ওর থুতনি ছেড়ে নিজের মোবাইল আর হাতে করে নিয়ে আসা ছবিটা নিয়ে বেরিয়ে গেল৷ এই ভয়ানক মেয়েটার প্রাণপণে চেপে রাখা হাসিটা নজরে এলো হতবুদ্ধি হয়ে বসে থাকা নেহালের। ভাগ্য ওর সাথে এমন পরিহাস করল! মান, সম্মান আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না। সত্যি সত্যি হাঁক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল ওর।

***
ঘর থেকে বেরিয়ে উঁকি দিয়ে নেহালকে আরেকবার দেখার লোভ সামলাতে পারল না লিলি। শিশুসুলভ সরলতা ছেয়ে আছে নেহালের চোখেমুখে, সবমিলিয়ে দেখার মতো চেহারা হয়েছে বেচারার। লিলি হেসে ফেলল সশব্দে। এতক্ষণ নিজের সাথে রীতিমতো যু দ্ধ করতে হয়েছে হাসি চেপে রাখতে।

একটা উপলব্ধি হলো ওর, নেহাল মানুষটা খুব একটা খারাপ না বোধহয়। ওকে সহ্য করার মতো অসীম ধৈর্যের পরীক্ষায় আজ পাশ করে গেছে ছেলেটা। কটু কথা বললে ওর নিজেরই কষ্ট হয় পরে। এভাবে হাসিমুখে যদি শায়েস্তা করা যায়, তাহলে বরং সব কূল রক্ষা হয়!
……
(ক্রমশ)

#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ১৬)
নুসরাত জাহান লিজা

আজ দুটো ক্লাস করে বাকিগুলোতে ফাঁকি মারতে ইচ্ছে হলো লিলির। তরী আর মিতু আগে থেকে এক পায়ে খাড়া ছিল, প্রস্তাব পেয়ে লুফে নিল। অনেকদিন ঘুরতে যাওয়া হয় না। আজ ঠিক করল সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত হুল্লোড় করবে। ভিডিওটার কাজটাও আজই হবে, কনসেপ্ট তৈরি আছে।

সোহানের এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছিল গেটের বাইরে। এসেছিল কিছু বলতে, ওদের কাছে পাত্তা পায়নি। কয়েকটা নম্বর থেকে মেসেজ পাঠিয়েছে, একবার নাকি কথা বলতে চায়।

“আরে আর বলিস না, সোহান ভাইয়ের সাথে আমার সেদিন দেখা হলো। আমাকে বলে কী জানিস?” এ পর্যন্ত বলে মিতু থেমে গেল। যেন ওর সাথে সোহানের কী কথা হয়েছে সেটা ওদের উপস্থিত না থেকে এবং ওর কাছে না শুনেও জানা সম্ভব হতে পারে। সঙ্গীরা জানে কী না, সেই উত্তর যেন খুব জরুরি, এটা নিয়ে আগে ওরা মজা করলেও ওখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। জানে কিছু অভ্যাস অবচেতনেই থেকে যায়।

“না, জানি না। জানার ইচ্ছেও নেই।” লিলি হাঁটতে হাঁটতে বলল।

“আরে শোন না!”

“তুই বলার হলে বলে ফেল না রে!” তরী এবার তাগাদা দিল।

“বলে কিনা একবার দেখা করতে বলো না তোমার ফ্রেন্ডকে। ও তো আমাকে ছেড়ে বিয়ে করে ফেলল। এখন আমি…”

মিতু বাকিটা বলার আগেই লিলি তেতে উঠল, “এখন এই কাঁদুনি গাইছে? মিথ্যা ব্লেম দিচ্ছে আমার উপরে, নিজে সিমপ্যাথি পেতে চাইছে। ওই বান্দরের সাথে তো আমি দেখা করবই। মাথার চুল যাতে একটাও মাথায় না থাকে, সেই ব্যবস্থা করব। আমাকে চেনে নাই। ওই ছ্যাচড়ের সাহস আমি কুচিকুচি করে চিড়িয়াখানায় বিলিয়ে দেব।”

“আমাদের সাথে রাখিস কিন্তু।” তরী তাল মেলায়।

“কিন্তু দেখা করা কি ঠিক হবে? শুধু শুধু একটা ঝামেলা।” মিতু একমত হতে পারে না।

“মোটেও শুধু শুধু নয়। আজ তোদের বলেছে, দেখগে আরও অনেককেই বলেছে। এখনই কিছু না বললে দেখা যাবে আরও বড় কিছু বলছে বানিয়ে বানিয়ে। এমন লোকদের প্রশ্রয় দিতে নেই।”

বিকেল প্রায় গড়িয়ে যাচ্ছিল, এতক্ষণে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল রোমেনা বেশ কয়েকবার কল দিয়েছিলেন। ওর মনে পড়ল আজ ফিরতে দেরি হবে বাসায় বলা হয়নি। রোমেনাকে সে ফিরতি কল দিতেই যাচ্ছিল, কিন্তু এরইমধ্যে নেহাল কল করেছে।

তরী আর মিতু ক্যামেরা আর ইন্সট্রুমেন্টগুলো গোছাচ্ছিল, যেগুলো তরীর বাসা থেকে নিয়ে এসেছিল ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে। লিলি একটু সরে গিয়ে কল রিসিভ করল।

“তুমি কোথায় এখন?”

“জবাবদিহি করতে হবে?”

“নাহ্! শুধু কি জবাবদিহি-ই চায় মানুষ? অপরপ্রান্তে কেউ তো চিন্তায় পড়ে যেতে পারে, রাস্তায় কত কী ঘটতে পারে। বাসার কেউ একজনের জানা থাকলে তখন তারা একটু নির্ভার থাকতে পারে৷ মা চিন্তা করছিল। কোনো সমস্যা হলো কিনা!”

লিলির প্রথম প্রশ্ন শুনে রাগ হয়েছিল ভীষণ, কিন্তু পরের কথায় সেটা মিলিয়ে গেছে। আকাশের দিকে তাকালো সে। সারাদিন উত্তাপ ছড়িয়ে ক্লান্ত সূর্যটায় রঙ ধরছিল। নরম হয়ে আসা সেই সূর্যের মতো লিলিও যেন শান্ত হয়ে গেল নিমিষেই। সেটা নেহালকে বুঝতে দিল না। বরং পরশুর সেই কান্ডের পরে ছেলেটাকে নানাভাবে নাজেহাল করতেই ওর বড্ড আনন্দ হয়।

“শুধু মা চিন্তা করছিল? মায়ের ছেলে কিছু ভাবছিল না?”

ওপ্রান্তে মুহূর্ত কয়েকের নীরবতা, খানিক বাদে নেহাল বলল, “মায়ের ছেলের কি সেই অধিকার আছে?”

“মায়ের ছেলে কি ভাবে? সেই অধিকার তার আছে নাকি নেই?”

“সে এই ব্যাপারে নিতান্ত অজ্ঞ।”

“বিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ নিন, অজ্ঞতা কাটান।”

“আমার আশেপাশে বিজ্ঞ লোক তেমন একটা দেখি না যারা টিপস দেবে এসব ব্যাপারে।”

“কী বেদনাদায়ক জীবন আপনার! ইশ!”

“তুমি কখন ফিরবে?” আর কথা খুঁজে না পেয়ে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল নেহাল।

“এই তো, বন্ধুদের সাথে এসেছিলাম ঘুরতে। এখন ফিরব, রাস্তায় যেতে যেটুকু সময় লাগে।”

খানিকটা থেমে লিলি আরও বলল, “এরপর থেকে এরকম হুটহাট প্ল্যান হলে মাকে জানিয়ে দেব। টেনশন করতে হবে না।”

“অনেক ধন্যবাদ, লিলি। সাবধানে এসো।”

গোধূলির রঙ আকাশ জুড়ে। লিলির প্রিয় মুহূর্ত দিনের এই সময়টা। আজ ওর মনে হলো কোনো কারণ ছাড়াই মুহূর্তটা যেন জৌলুশ পূর্ণ হয়ে গেছে। নাকি গভীর কোনো কারণ তৈরি হচ্ছে অবচেতনে, সে জানতেও পারেনি।

***
নওরীন আজ পুষ্পিতার মায়ের বাসায় এসেছে। কিন্তু বাসায় কেউ নেই। বাড়িওয়ালার কাছ থেকে জানলো অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে যাওয়ায় আজ ভোরের দিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

নওরীন বিস্তারিত জেনে নিয়ে ছুটল হাসপাতালে। মহিলা ওয়ার্ডে গাদাগাদি করে অনেকগুলো বেডের একটার পাশে পুষ্পিতাকে বসে থাকতে দেখে চিনতে আর অসুবিধা রইল না।

নওরীনকে দেখে পুষ্পিতার শুকনো মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটল। ওর মায়ের স্যালাইন চলছিল তখন। চোখ বন্ধ, কিন্তু পাতা কাঁপছিল। একজন প্রৌঢ়াও বেডের উপরে বসে আছেন। ইনি বোধহয় নানি।

নওরীন তাকে যেন কিছুটা ব্যাখ্যা দেবার মতো করে বলল, “আমি পুষ্পিতার স্কুলে পড়াই। ও অনেকদিন ধরে স্কুলে যায় না, তাই এলাম।”

“পূরবীর অবস্থা ভালো না। ডাক্তারও তেমন আশা দেয় না। আমার নাতিনডা কই যাইব তাইলে ভাইবা পাই না।” বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন।

“আহ্, মা। কী শুরু করলে? আপনি কিছু মনে করবেন না আপা।” পুষ্পিতার মা পূরবী নিজের মাকে কিছুটা ধমকের সুরে শাসিয়ে শেষের কথাটা বলল নওরীনের দিকে তাকিয়ে। তার কোটরে ঢুকে থাকা চোখের নিচে কালি, মুখ শুকনো, মলিন।

“না, না। আপনি ব্যস্ত হবেন না। এখানে আমার একজন ফ্রেন্ড আছে। ওকে বললে হয়তো কিছু ফেবার পাওয়া যাবে। আমি কি কথা বলব?”

“আপনি কেন করবেন আপা? এখন অনেক আপন মানুষই এসব ঝামেলা মনে করে।”

নওরীন এগিয়ে এলো, পূরবীর মাথায় আন্তরিক ভঙ্গিতে হাত রেখে বলল, “আপা ডাকলেন তো এইমাত্র। সব সম্পর্কে দেওয়া নেয়া থাকতে হবে কেন! পুষ্পিতাকে আমি খুব পছন্দ করি। মেয়েটার মুখে যদি একটু হাসি ফোটাতে পারি, আমার ভীষণ ভালো লাগবে।”

“আমার আর কোনো আশা নেই। জানি না কেন, সারাক্ষণ মনে হয়, আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। আমি হয়তো আরেকটু ভালো চিকিৎসা নিতে পারি। কিন্তু আমি এমনিতেও চলে যাব। মাঝখান থেকে ওর ভবিষ্যতটা সাথে করে নিয়ে যাবার কোনো মানে হয়!”

“আপনি যদি আর কিছুদিন বেশি করে বাঁচেন, মেয়েটার সাথে আপনার সময় আরেকটু দীর্ঘ হতো।”

নওরীনের মরিয়া হয়ে বলা কথাটায় পূরবীর কোটরে চলে যাওয়া চোখে যেন কিঞ্চিৎ হাসি ঝলকে উঠল। অদ্ভুত, এমন অবস্থাতেও মহিলার হাসিটা সুন্দর মনে হলো।

“উপর থেকে আল্লাহ আমাদের আয়ু নির্ধারণ করে দিয়েছে। যেটুকু আয়ু, চেষ্টা করলে কি তার বেশি বাঁচব?”

“আল্লাহ তো মানুষকে হাল ছাড়তে বলেননি। কার কতটা আয়ু সেটা তো আমরা কেউ জানি না।”

পূরবী নিজের মুক্ত হাতটা দিয়ে নওরীনের হাত ধরে ফেলল, “আপা, আপনার সাথে আমার একটু সময়ের পরিচয়। কিন্তু আপন মনে হচ্ছে। কী অদ্ভুত জানেন, বহুদিন একসাথে চললেও অনেককে আপন ভাবা যায় না। আপনি খুব ভালো মানুষ।”

হাঁপাতে হাঁপাতে বলল পূরবী। তার নিশ্বাস ভারি হয়ে আসছে।

“আপনি প্লিজ, কথা বলবেন না এখন। আমি আসছি এক্ষুণি।”

নওরীন বেরিয়ে এসে দ্রুত হাতে ফোন করল ওর বন্ধুকে।
…..
(ক্রমশ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে