মরীচিকাময় ভালোবাসা পর্ব-১৯ এবং শেষ পর্ব

0
899

#মরীচিকাময়_ভালোবাসা
#অন্তিম_পর্ব
#লেখিকাঃদিশা_মনি

প্রত্যুষ ও মৌরীর দিন বেশ ভালো ভাবেই চলে যাচ্ছে। দুজনের মধ্যে হয়তো এখন কোন মায়া ভালোবাসা জন্ম নেয়নি কিন্তু একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা আর সম্মানবোধের কোন কমতি নেই। এরমধ্যে চলে গেছে ৪ মাস।

মৌ এতদিন চুপ ছিল৷ সুযোগ খুঁজছিল প্রত্যুষ আর মৌরীর সুযোগ খোঁজার। অবশেষে সেই সুযোগ পেল। মৌরী আর প্রত্যুষের কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের বিষয়ে কোনভাবে জানতে পেরে যায় সে। শুধু তাই নয় পরিকল্পনা করে ছদ্মবেশে তাদের বাড়িতে গিয়ে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের পেপারসও লুকিয়ে নিয়ে আসে। অতঃপর নিউজ পেপারে, সকল নিউজ চ্যানেলে খবরটা পুরোপুরি ভাইরাল হয়ে যায়।

প্রত্যুষ ও মৌরীকে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তাদের কোম্পানির শেয়ারও পড়ে যায়। সব মিলিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়ে দুজনে। ব্যাপারটা মেটানোর জন্য প্রত্যুষ ও মৌরী সবার সামনে ঘোষণা দেয় এটা একটা গুজব এবং তাদের মধ্যে কোন কন্ট্রাক্ট নেই। তবে এতে কোন কাজে দেয় না। কিছু কিছু সংবাদ মাধ্যম আবার মশলা মিশিয়ে নিউজ করতে থাকে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি দ্রুত বাড়ির বাইরে চলে যায়।

মৌ এসবে খুব খুশি হয়। প্রত্যুষ কিছুদিনের মধ্যে মৌরীকে বলে,
“আপনি কি সারাজীবন আমার সাথে থাকতে পারবেন?”

মৌরী কি বলবে বুঝতে পারছিল না। কিছুটা ভেবে বলে,
“আপনি নিশ্চয়ই নিজের কোম্পানির স্বার্থে এমন বলছেন? কিন্তু আমি এমনটা চাই না। আমার মনে হয় এই কন্ট্রাক্ট ম্যারেজে রাজি হওয়াই আমার উচিৎ হয়নি। এখন তো আমার পরিবারও সব জেনে গেছে। আব্বু আর বড়মা আমার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছেন।”

প্রত্যুষ নীরব থাকে। সে নিজেও এই সম্পর্ক নিয়ে দ্বন্দ্বের মধ্যে আছে। সে জানে না মৌরীকে সে ভালোবেসে ফেলেছে কিনা। কিন্তু তার প্রতি একটা মায়া ঠিকই তৈরি হয়েছে। এমনিতেও সে ক’দিন থেকে ভাবছিল এই কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ শেষ করে মৌরীর সাথে চিরকাল থাকবে৷ তবে মৌরী রাজি হবে কিনা এই নিয়েই তার যত চিন্তা ছিল। তবে বর্তমানে সে ভীষণ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।

★★★
মৌরী আজ সেজেগুজে তৈরি হয়েছে কোর্টে যাওয়ার জন্য। আজ দ্বিতীয় বারের মতো আরো একটা সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যেতে চলেছে সে। প্রত্যুষ মলীন মুখে মৌরীর সামনে এসে দাঁড়ালো। এই ক’দিনে সে উপলব্ধি করতে পেরেছে মৌরীকে সে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছে। এতে যথেষ্ট অবাকও হয়েছে সে। কারণ মৌ তাকে ঠকানোর পর মেয়েদের উপর থেকে বিশ্বাসই উঠে গেছিল। কিন্তু মৌরীর সাথে কিছুদিন থাকার পর তার ধারণা পুনরায় বদলে গেছে। তার মনে হচ্ছে হাতের পাঁচটা আঙুল যেমন সমান হয়না তেমনি সব মেয়েও এক নয়। প্রত্যুষ আজ সব দ্বিধা দ্বন্দ পাশে ঠেলে মৌরীর সামনে এসে বলে,
“আমরা কি এই সম্পর্ককে আরেকটা সুযোগ দিতে পারি না?”

মৌরী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“আমি আপনাকে আগেও বলেছি সেটা সম্ভব নয়। আমি জানি,আপনি নিজের কোম্পানির…”

“এতগুলো দিনে আপনি আমাকে এই চিনলেন মৌরী? আমি নিজের কোম্পানির জন্য নয় বরং নিজের জন্য আপনাকে চাইছি। আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন না এই ক’দিন থেকে কতোটা কষ্টের মধ্যে আছি আমি। আপনাকে ছাড়া থাকতে হবে এমনটা ভাবলেই আমার বুকটা ভারী হয়ে আসে। আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি মৌরী।”

মৌরী চুপ থাকে। কিছুক্ষণ নীরবে থেকে অতঃপর বলে,
“আমি এই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই না। আমি কখনো কারো সাথে সারা জীবন কা’টানোর কথা ভাবতে পারবো না। বিয়ে,সম্পর্ক এসবের উপর থেকে আমার বিশ্বাসটাই উঠে গেছে।”

“আপনি তো আমার অতীতটাও জানেন। এরপরেও তো আমি জীবনটাকে নতুন সুযোগ দিতে চাইছি…”

“আমি রাজি নই।”

প্রত্যুষ হাল ছাড়লো না। মৌরীকে বারংবার বোঝাতে লাগল। কিন্তু মৌরী নাছোড়বান্দা। প্রত্যুষ শেষে বলল,
“ঠিক আছে। আপনি যা চান তাই হবে। তবে আজকের দিনটা শুধু আপনার কাছে চাচ্ছি। আজ সারাদিন আমার সাথে একটু ঘুরবেন প্লিজ? কাল নাহয় আমরা কোর্টে যাব।”

মৌরী আর অমত করল না। প্রত্যুষ খুশি হলো। সারাটা দিন তারা খুব আনন্দ করে একে অপরের সাথে ঘুরে বেড়ালো। রাতে ছাদে বসে একসাথে চন্দ্রবিলাশ করছিল তারা। আজ পূর্ণিমা হওয়ায় আকাশের চাঁদটাও যেন বেশি সুন্দর হয়ে উঠেছে। জোৎস্নায় আলোকিত চারিদিক। প্রত্যুষ মৌরীর কাছে আবদার করে বলল,
“আমি কি আপনার কোলে মাথা রাখতে পারি মৌরী?”

মৌরী আর না করতে পারল না। প্রত্যুষ মৌরীর কাধে মাথা রেখে বলল,
“জানেন ছোটবেলায় আমার মায়ের কোলে মাথা রেখে এভাবেই চাঁদ দেখতাম। কত সুন্দর ছিল সেইসব স্মৃতি। আমার এখনো মনে পড়ে। মা বেঁচে থাকলে হয়তো আজ আমার জীবন আরো সুন্দর হতো।”

আবছা আলোর মধ্যেই মৌরী খেয়াল করল প্রত্যুষের চোখে জল। প্রত্যুষ খুব সন্তপর্ণে জলটুকু লেপন করে বলল,
“আমার জীবনে আমি যেই নারীকে সবথেকে বেশি ভালোবেসেছি তারাই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আপনি প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাবেন না মৌরী।”

মৌরী বলল,
“অনেক রাত হয়েছে। এখন আমাদের ঘরে ফেরা উচিৎ।”

প্রত্যুষ মৌরীকে আকড়ে ধরে বলে,
“আমার সাথে আজীবন থাকলে কি খুব অসুবিধা হয়ে যাবে?”

মৌরী আর থাকতে পারল না প্রত্যুষকে জড়িয়ে ধরে কেদে ফেলল। বলল,
“আমিও আপনার সাথে থাকতে চাই প্রত্যুষ। কিন্তু কি করব বলুন। খুব ভয় হয় যে। একবার জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছি। নতুন করে সেই কষ্ট সহ্য করতে পারবো না।”

“আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি কখনো আপনাকে বিন্দুমাত্র কষ্ট পেতে দেবো না।”

মৌরী ও প্রত্যুষ একে অপরের দিকে নেশাতুর দৃষ্টিতে তাকায়। প্রত্যুষ মৌরীকে কোলে করে নিজেদের ঘরে নিয়ে যায়। অতঃপর দুজনে একে অপরে মাতোয়ারা হয়ে যায়।

★★★
৩ বছর পর,
কোলে নিজের দুই বছর বয়সী মেয়ে প্রত্যাশাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মৌরী। অপেক্ষা করছে প্রত্যুষের আসার। কিছুক্ষণ পরেই প্রত্যুষ চলে এলো। প্রত্যুষকে দেখামাত্রই প্রত্যাশা তার কোলে যাওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। মৌরী প্রত্যাশাকে প্রত্যুষের কোলে দিতে দিতে বলল,
“টানা দশমাস কষ্ট করে পে’টে ধরে আমি তোকে জন্ম দিলাম। আর এখন আমার থেকে বাবার উওর দরদ বেশি।”

প্রত্যুষ নিজের মেয়েকে কোলে নিতে নিতে বলে,
“কেন তোমার হিংসে হয় বুঝি?”

“আমার হিংসা হতে যাবে কেন? আমারও পালা আসবে। খুব শীঘ্রই আমার জনও পৃথিবীতে আসবে।”

বলেই নিজের পেটের দিকে ইশারা করে সে। মৌরী দ্বিতীয় বারের মতো গর্ভবতী হয়েছে। তাই সে এখন বেশ খুশি। প্রত্যুষ বলে,
“চলো তাহলে এখন বিয়ের দাওয়াতটা খেতে যাই।”

“হুম চলো।”

চৌধুরী বাড়ির সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করালো প্রত্যুষ। অতঃপর মৌরীর উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠল,
“নামো আমরা এসে গেছি।”

মৌরী গাড়ি থেকে নামলো। অতঃপর প্রত্যুষ ও মৌরী বাড়ির ভিতরে গেল। আতিফা বেগম তাদের দুজনকে দেখামাত্র ছুটে এলো। প্রত্যাশাকে নিজের কোলে তুলে নিলো। প্রত্যাশা তো নিজের নানিকে পেয়ে খুব খু্শি হয়ে গেল। আজাদ চৌধুরীও এগিয়ে এলেন। মৌরী বলল,
“আব্বু তুমি কখন এলে?”

“এই তো একটু আগেই।”

“যার জন্য এলাম তারা কোথায়?”

“প্লাবণ আর ওর নতুন বউয়ের খোঁজ করছিস তো? চল আমার সাথে।”

আতিফা বেগম মৌরীকে নিয়ে চললো। প্লাবণ মৌরীকে দেখামাত্র বলল
“আমার বিয়েতে তো এলি না! এখন রিশেপসনে এলি!”

“তোমাকে তো বলেইছিলাম ভাইয়া। প্রত্যুষ আমি আমি জরুরি মিটিং করতে দেশের বাইরে গেছিলাম। তাই আসতে পারিনি। যাইহোক নতুন ভাবির সাথে দেখা করাবা না?”

“হ্যাঁ আয় এদিকে।”

মৌরী এগিয়ে গেলো। প্লাবণের স্ত্রীকে দেখে বলল
“বাহ, মাশাল্লাহ, তোমার বউ তো অনেক সুন্দরী।”

মেয়েটি লজ্জা পেয়ে যায়। মৌরী একটু থেমে বলে,
“তুমি তো বিয়ে করতেই চাইছিলে না। এখন দেখো কত সুন্দরী বউ পেলে।”

“এটাই বোধহয় ভাগ্যে ছিল।”

মৌরী বলে,
“আমাদের ভাগ্য সব সময় সুন্দরই হয়। কিন্তু আমরাই সবসময় মরীচিকার পেছনে দৌড়ে সময় নষ্ট করি। যেমনটা প্রথমে আমি করেছিলাম তারপর এতগুলো বছর ধরে তুমি করলে। তবে সব ভালো যার শেষ ভালো। শেষ অব্দি আমরা সবাই তো নিজেদের লাইফ নিয়ে খুশি। এটাই অনেক।”

“ঠিক বলেছিস।”

প্রত্যুষ প্রত্যাশাকে কোলে নিয়ে চলে আসে। প্লাবণের মা-বাবা আজাদ চৌধুরী সবাই আসে। সকলে একসাথে দাঁড়িয়ে ফটো তোলে। সুখ নিবাসে এতদিন পর যেন সত্যিকারের সুখ এসে ধরা দেয়।

☘️ সমাপ্ত ☘️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে