দহন পর্ব-২২ (২য় খন্ড)

0
529

দহন_ ২২ _( ২য় খন্ড )

” আমার চোখের ঘুম হারাম করে নিশ্চিতে শিকদার পরিবারে মুখোশ পড়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছো। কি করেছিলাম যারজন্য আমার জীবনকে বরবাদের পথে নেমে পড়েছিলে তুমি। জানো এই ০৪ টা মাস আমার কিভাবে গেছে? নিজের স্বামীকে ছেড়ে, নিজের বাবা-মা কে ছেড়ে থাকার যন্ত্রণা টা তো তুমি ভালো করে জানো? তাহলে একজন নারী হয়ে আরেকটি নারীর সাথে এইরকম জঘন্য খেলা ক্যান খেলছো তুমি? ”

” তুমি বেঁচে আছো নীলা আমিতো ভেবেছিলাম তুমি সেই অগ্নি দুঘর্টনায় মারা গেছো। তাহলে আকাশ ভাই ঠিক ছিলো। ”

” আমি তোমাকে এসব বলতে বলি নাই বৃষ্টি। আমার প্রশ্নের উত্তর দাও? আমি তোমাকে শূন্যতা থেকে পূর্নতা দিয়েছি। সেইতুমি আমার বিপদের কারণ হয়ে দাড়ালে? কি ভূল ছিলো আকাশের? যেই আকাশ তোমাকে সারাপৃথিবীর সাথে লড়াই করে নতুন জীবন দিলো? তার ক্ষতি করতে তোমার একটু বিবেকে বাঁধলো না? তোমাকে নতুন জীবন দিয়েছে আকাশ। সেই আকাশের সাথে এতো বড় প্রতারণা । ”

” তুমি এসব কি বলছো নীলা। আমি তোমার কোনো কথা বুঝতে পারছিনা। তুমি আমাকে কিডন্যাপ করে এভাবে বেঁধে রাখছো ক্যান? তুমি আমাদের নিজের লোক। নিজের লোক হয়ে আপনজনকে কিডন্যাপ করে কেউ? তুমি এতোদিন কই ছিলে? একটাবারো আমাদের খোঁজ নিছো। ভাই কেমন আছে মা কেমন আছে? তোমার বাবা-মা কেমন আছে? তুমি এতোটা সার্থপর হলে কি করে নীলা। ”

নীলা নিজের দুই হাতের তালু ঘষাঘষি করে হাতটা করম করলো। এরপরে ভ্রু কুচকে বৃষ্টির দুই গালে ঠাস ঠাস করে দুইটা চড় দিলো।

জয় ভাইয়া আরমান শিকদার কে এই রুমে নিয়ে আসুন তো?

আরমানের নাম শুনতেই বৃষ্টি ভয় পেলো। মুখের থুথু দিয়ে শুকনো ঢোক গিললো।

” কি হলো বৃষ্টি ভয় পাচ্ছো ক্যান? আর তুমি ভাবছো আমি আরমান শিকদার অব্দি কিভাবে পৌছালাম। শুনো বৃষ্টি আমি একজন এডভোকেট। সব জটিল কেইস তুড়িতেই সমাধান করি। ”

” কিন্তু তুমি আরমান শিকদার কে কিভাবে চিনো? আর আরমান শিকদার কে আমিতো জানিনা। ”

” আর নাটক করতে হবেনা বৃষ্টি। দয়া করে তোমার এই ওভারএক্টিং বন্ধ করো। খুব বাজে লাগছে তোমার ওভারএক্টিং। যেইটা পারোনা ঠিকমতো সেইটা করতে যাও কেনো? তোমার এই এক্টিং জোকারের মতো লাগছে? ”

বৃষ্টি মনে মনে বললো আমি কি তাহলে ধরা পড়ে গেলাম? নিজের চোখটা বন্ধ করে নিলো। জোড়ে নিশ্বাস ছাড়লো। এরপরে চোখ খুলে সামনেই আরমান শিকদারকে দেখতে পেলো। আরমান শিকদারকে দেখে বৃষ্টি ভয়ংকর চিৎকার করে । চোখ বন্ধ করে ফেলে?

” কি ব্যাপার বৃষ্টি ভয় পেলে? কি করবো ওনি কিছুতেই সত্যি টা সামনে আনতে চাইছিলো না। তাই এভাবে পিটিয়ে মুখ থেকে সত্যি টা বের করছি। নিজের এইরকম অবস্থা দেখতে না চাইলে ভালোই ভালো স্বীকার করো শিকদার কোম্পানিতে ক্যান আগুন লাগাইছো? ”

বৃষ্টি কিছু বলেনা মুখ বন্ধ করে চোখ বুঝে চেয়ারে বসে রয়। নীলার প্রচন্ড রাগ উঠে।

” এতদিন নীলার সৌন্দর্যের দিকটা দেখছো বৃষ্টি। নীলার হিংস্রতা দেখলে কেঁপে উঠবে। তাই ভালোই ভালো বলছি সত্যি টা স্বীকার করো। ”

” আমি এসব কিছু করিনাই নীলা। তুমি আমাকে ভূল বুঝছো!”

নীলা ঝাপিয়ে পড়ে বৃষ্টির উপর। বৃষ্টির চুলগুলো টেনে ধরে। জয়কে ইশারা করে বৃষ্টির হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিতে। জয় এসে বাঁধন খুলে দেয়। বৃষ্টির চুল মুটি করে ঘোরানি মেরে বৃষ্টিকে ফ্লোরে ফেলে দেয়। বৃষ্টি ফ্লোরে নেতিয়ে পড়ে। কারণ চুলে অনেক টান লেগেছে। চোখগুলো শুধু নীলার দিকে নিক্ষেপ করে আছে।

” ভালোই ভালো স্বীকার করো বৃষ্টি। অনেক বুঝাইছি তোমাকে, আমার ধৈর্যর পরীক্ষা নিয়োনা। ধৈর্য শেষ হয়ে গেলে আমি কতোটা বাঘিনী হই নিজ চোখে দেখলে তো। এরপরে যদি কিছু না বলো আরমান শিকদারের যে অবস্থা করছি। তোমারেও তাই করবো। ”

” বৃষ্টি গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। চোখগুলো বন্ধ করে ফেলে। বৃষ্টির হৃদপিণ্ড টা প্রচুর কাপাকাপি করছে। নিজের অন্যায় টা যদি প্রকাশ পায় সাফার কি হবে ভাবছে। ”

” সোজা কথায় কাজ হবেনা জয় ভাইয়া। চাবুক টা নিয়ে আসেন। চাবুকের আঘাত পড়লে তবেই কাজ হবে। জীবনে কার না বাঁচিবার সাধ আছে। বাচতে চাইলে সত্য বলতে হবে। ”

জয় চাবুক এনে নীলার হাতে দেয়। নীলা চাবুক টা ডান হাতে নিয়ে চার আঙুলে প্যাচাতে থাকে। মুখে ভয়ংকর ভাব প্রকাশ করে চাবুক উপরে তুলতে যাবে। তখন বৃষ্টি চাবুক ধরে বলে, নীলা আমাকে মেরো না। আমি সবটা বলছি? এই কথা শোনামাত্র নীলা চাবুক ফেলে দিয়ে বৃষ্টি কে ফ্লোর থেকে উঠিয়ে চেয়ারে বসায়।

” তোমাকে আমার মারার ইচ্ছে নেই বৃষ্টি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার সাথে এরকম করতে। কিন্তু কি করবো? কাছের মানুষ গুলো বড্ড সার্থপর হয়। শুধুমাত্র নিজের কথা সবাই ভাবে। জানো আরমান শিকদারের মুখে তোমার নাম শোনা মাত্র আমি যতোটা কষ্ট পেয়েছি। তার কাছে তোমার এই কষ্ট কিছুই নয়। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম তুমি শিকদার কোম্পানিতে আগুন লাগাতে পারো। কিন্তু যখন আরমান শিকদার আমাকে বিশ্বাস করার জন্য, তোমার আর আরমানের শিকদারের ফোনের কথপোকথন শুনালো। তখন নিজেকে জীবন্ত লাশ মনে হয়েছিলো। কি করবো তোমার সাথে ভেবে পাচ্ছিলাম না। এক সপ্তাহ লেগে গেছে তোমার ব্যাপারে ডিসিশন নিতে। তাই আজকে জয় ভাইয়া ও তার লোক দিয়ে শপিংমল থেকে কিডন্যাপ করাইছি! ”

বৃষ্টি নীলাকে বলে ___

” এক গ্লাস পানি হবে নীলা। গলাটা শুকিয়ে গেছে। ”

নীলা জয়কে চোখ দিয়ে ইশারা করে পানি আনার জন্য। জয় তার সঙ্গীদের দাড়া পানি এনে বৃষ্টির কাছে দেয়। বৃষ্টি পানি পেয়ে ঢোক ঢোক করে গিলে।

” এবার কথা বলো বৃষ্টি। কেনো তুমি আকাশের সাথে ও আমার সাথে চিট করলে। কি করিনাই তোমার জন্য আমরা। আকাশ তোমাকে নতুন জীবন দিলো। আমি তোমাকে হারিয়ে যাওয়া সবকিছু ফিরিয়ে দিলাম। এরপরেও আমাদের প্রতি তোমার এতো কিসের ক্ষোভ। ”

” নীলার কথা শুনে বৃষ্টি চোখ লাল করে ফেলে। এরপরে বলে সবকিছু ফিরিয়ে দিছো মানে? তুমি আমার আম্মাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারলেও আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিতে কই পারছো? ”

” মৃত মানুষকে কি ফিরিয়ে দেওয়া যায় বৃষ্টি। মিস্টার রায়হান ৩০ বছর আগেই মারা গেছে। মৃত মানুষকে কিভাবে ফিরিয়ে দিবো।জীবিত থাকলে তবেই না ফিরিয়ে দিবো! ”

” আমার বাবাকে মরলো ক্যান? আমার বাবাকে মারা হইছে। আর আমার বাবাকে মারছে আমজাদ শিকদার। বাবার মৃত্যুর বদলা নিতেই আমি এ কাজ করেছি। আরমান শিকদার আমাকে সঙ্গ দিছে। কারণ আরমান শিকদার ছোটবেলা থেকে বঞ্চিত। এক বাপের দুইছেলে হওয়া সত্বেও আরমান শিকদার কে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হইছে।”

” তুমি নিজের কথা ভাবো বৃষ্টি। ত্রিশ বছর আগে আমজাদ শিকদার যা করছে তুমিয়ো তাই করলে। তাহলে তোমাদের ভিতর তফাৎ কই। আমরা তোমাকে নতুন জীবন দিয়েছিলাম। তার বদলে তুমি আমাদের পুড়িয়ে মারার প্লান করছো। শুধু আমাদের না।,আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ১৮ টা পরিবারের ক্ষতি করছো। ১৮ পরিবারের চোখের পানি ঝড়াইছো। তুমি আমজাদ শিকদারের চেয়ে কম কিসে। আমজাদ শিকদার নিজের ভূলের প্রায়চিত্ব করছে। এখানেই কি বিষয়টা শেষ করা যেতো না। আমার ভূল হয়েছে তোমার মতো মেয়েকে আকাশের বোন হিসাবে মর্যাদা দিয়ে। তুমি যেই আরমান শিকদারের কথা বলছো? তুমি কি জানো এই আরমান শিকদার নিজ বাবা মায়ের হত্যাকারী। কতোটা পাষাণ হলে মানুষ নিজের পিতা মাতাকে হত্যা করতে পারে? ”

বৃষ্টি আরমান শিকদারের খুনীরুপের কথা শুনে ভয়ে আতকে উঠে। কিছুতেই নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না, আরমান শিকদার এইরকম জঘন্য কাজ করতে পারে। এই প্রসঙ্গে নীলাকে প্রশ্ন করে আরমান শিকদার যে তার মা বাবার খুনী তুমি জানলে কি করে?

” নীলা ফিক করে হেসে দেয় বৃষ্টির কথা শুনে। এরপরে বৃষ্টিকে বলে তুমি পারফেক্ট প্লান নিয়ে এরপরে জঘন্য খেলায় নামিয়ো। আমি আরমান শিকদার অব্দি কিভাবে গেলাম। তোমার মাথায় প্রশ্ন আসছে না। আরমান শিকদার এতো সহজ লোক নয়। এই কেইসের সূত্র খুঁজতেই আমার দুই মাস লেগে গেছে। পরে আমজাদ শিকদারের সঙ্গে দেখা করি জানো আমজাদ শিকদার বলে। ”

” কি! ”
” তাহলে শুনো। ”

” নীলা শিকদার কোম্পানিতে আগুন প্লানমাফিক লেগে থাকলে, এই কাজ আমার সৎ ভাই আরমান ছাড়া কেউ করে নাই? কারণ আকাশের কোনো শত্রু নাই। আকাশ সবার সাথেই সোহাদ্যর্যপূর্ণ আচরণ করে ”

” সৎ ভাই? এতদিন তো জানতাম আপনি একাই আপনার কোনো ভাই বোন নেই। তাহলে আজকে সৎ ভাই আসলো কোথায় থেকে! ”

” আছে নীলা! আমার বাবা দুটি বিয়ে করেন। আমার মা ছিলো ছোট বউ। আমার বাবার বড় বউ ব্লাড ক্যান্সারে মারা যায়। তখন আরমান ছিলো সবেমাত্র ১.৫ বছরের। তাই আরমানের দেখাশোনা করার জন্য আমার বাবা আমার আম্মাকে বিয়ে করে। আম্মা বিয়ের পর আরমানকে নিজের ছেলে হিসাবে লালন পালন করে। কিন্তু আমি যখন জন্মগ্রহণ করি। ভাইয়ার কানে গ্রামের লোক নানান কথা দিতো। এসব কথায় ভাইয়া ভরকে গেছিলো। তখন থেকে ভাইয়া আম্মাকে ও আমাকে সহ্য করতে পারতো না। আমার যখন ০৮ বছর বয়স ভাইয়া তখন আমাকে ডুবিয়ে মারার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু বাবার জন্য পারেনাই। সেদিন ভাইয়াকে খুব মারে মা। সেই মারের কারণে অনেকবার আমাকে দুঘর্টনার মুখোমুখি দাড় করিয়েছিলো। কিন্তু কোনো না ভাবে আমি সবসময় বেঁচে যেতাম। আমাকে কোনোভাবে মেরে ফেলতে না পারে ভাইয়া আমার ২৪ তম জন্মদিনে বাবা মা কে শুট করে মেরে ফেলে। এরপরে ভাইয়ার আশ্রয় হয় জেলখানায় ৩০ বছরের সাজা। সাজা শেষ হয়েছে তাই এখন ও মুক্ত। আমার মন বলছে পুরনো কাসুন্দিতে আবার ওই তেল ঢালছে। ওকে ধরো নীলা নাহলে আমার আকাশ অনেক বিপদে পড়বে। ”

” বাবা আমাকে অনেক বড় হেল্প করলে। কেউ যাতে জানতে না পারে আমি বেঁচে আছি। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে আমি তোমার দুঃসম্পর্কের ভাইঝি। ”

” ঠিক আছে নীলা। যেকোনো হেল্প লাগলে অনায়াসে এখানে আসিয়ো। তবে সাবধান খুব। ”
” হুম! ”

শুনলে তুমি কার কথায় মাত দিচ্ছিলে। আমজাদ শিকদার লোভের রাজ্য বাঁচাতে খারাপ পথে গেলো। আর তুমি প্রতিশোধের নেশায় নতুন জীবনদাতার কোম্পানি পুড়িয়ে দিলে। এর বিনিময়ে কি পেলে তুমি?

” কাউকে দেখে বুঝা যায়না তার অভ্যন্তরীয় রুপ এতোটা বাজে। আমরা মানুষের বাহ্যিক রুপ দিয়ে মানুষ বিচার করি যার জন্য মনে সবসময় প্রতিশোধ নামক ক্ষোভ সুপ্ত থাকে। আমাকে ক্ষমা করিয়ো নীলা। আমার মেয়েটাকে দেখে রাখিয়ো। ”

____

” মা বৃষ্টিকে কখন থেকে ফোন দিচ্ছি। কিন্তু ফোনটা তো লাগছেই না। বারবার সুইচ অফ বলছে। সেই সকালে শপিং করতে বেরিয়েছে, বিকাল হয়ে গেলো এখনো বাড়িতে আসছে না। আর এদিকে সাফাকে আমার সহ্য করতে হচ্ছে না । তুমি জানোনা মা আমার বাড়তি চাপ নিতে এখন ভালো লাগেনা। ”

” বাবা আকাশ রাগ করছো ক্যান? চলে এসে যাবে, মেয়ে মানুষের শপিং বলে কথা একটু তো দেরি হবেই । ”

” তাই বলে এতো দেরি। তুমিকে সাফাকে আমার রুম থেকে নিয়ে আসো। আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কি একটা অসুখ হলো আমার নীলাও নেই। কে এখন টিপে দিবে আমার মাথা। ”

” আয় আমি টিপে দিচ্ছি। ”

রেহেনা শিকদার অনবরত চোখের পানি ফেলছে। ছেলেটা নীলা মারা যাওয়ার পর থেকে মাথার সমস্যা ধরা দিলো। তাই কেউ আকাশকে কোনো বিষয়ে জোড় করেনা। কারণ কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেই আকাশ স্ট্রোক করে গোমায় চলে যেতে পারে ধারণা করেছে ডক্টর।তাই আকাশকেও কেউ বুঝানোর চেষ্টা করেনা নীলা আসলে নেই, সি ইস ডেড।

চলবে,,,
®️ রিয়া_জান্নাত

আসসালামু আলাইকুম। ফিরে এলাম আপনাদের সবার প্রিয় দহন দ্বিতীয় খন্ড নিয়ে। ভূল ত্রুটি মার্জনীয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে