মন মহুয়া পর্ব-৪

0
556

#মন মহুয়া

রাইটার -Farhana Rahaman আয়াত

পার্ট -০৪

ভোরের আলো ফুটে উঠেছে, সবাই এখনো ঘুমিয়ে আছে। মহুয়া একটা ওড়না মাথায় জড়িয়ে তানিয়ার হাত ধরে ঘর থেকে চুপচাপ বেরিয়ে পড়ে মায়ের কবর টা একবার দেখতে।

তানিয়া মহুয়ার হাতটা চেপে ধরে আছে।মহুয়ার চোখ দিয়ে টুপ টুপ করে জল পরছে। ইমাম সাহেব কে মসজিদ থেকে বের তানিয়া মহুয়াকে টেনে নিয়ে আসে।
পুরো রাস্তা কেঁদে কেঁদে এসেছে।ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে না। পুকুর ঘাটে এসেই দপ করে বসে পড়ে।
তানিয়া যে শান্তনা দিবে তাও বুঝতে পারছে না। কারন বুঝতেই পারছে মহুয়ার ভিতর কি অবস্থা হচ্ছে।
মহুয়া তানিয়াকে বলে ওর জামাকাপড় নিয়ে আসার জন্য। পুকুরে গোসল করে নিবে।মাথাটা ভারি লাগছে ওর।ফ্রেস হওয়া দরকার একটু।তানিয়া ঘরে গেলো।
মহুয়া পাদুটো পানিতে ডুবিয়ে ঘাটের উপর বসে।
মিনার এর সারারাত ঘুম হয়নি। মনের মধ্যে অস্তিরতা কাজ করছে।ছাদে এসে পায়ছারি করতে করতে সিগারেট টানছে।গতকালের মতো আজও মিনার এর চোখ পরে পুকুর ঘাটে।কেন যেন হাতের সিগারেট টা ফেলে ওইদিকেই মন দিল মিনার।একটা পরি যেন বসে আছে পুকুর ঘাটে। মুখটা মলিন, গায়ে হলুদ এর ছাপ,গায়ে কাচা ফুলের গয়না,দুহাত ভর্তি লাল চুড়ি।
মহুয়া চুড়িগুলো আর গয়নাগুলো এক এক করে খুলে ঘাটের উপর রাখছে।চুলগুলো কোমর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। মিনার এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।কেন সেটা নিজেও জানিনা।শুধু দেখতেই ইচ্ছে করছে।মায়া লেগে গেছে যেন।এটাকেই হয়তো মোহ বলে।এ মোহ কাটতেই চাইছে না।কিন্ত হঠাৎ ফোন টা বেজে ওঠে।
রেহান ফোন করেছে তাও এত সকালে।কোনো বিপদ হলো না তো।ভাবতে ভাবতেই ফোনটা কেটে গেল।একটা মেসেজ আসে একমিনিট এর মধ্যে।
“একবার কথা বলতে চাই।শুধু একবার ”
মিনার বুঝলো বিপদ হয়নি হয়ত ভূল ভাঙলো তাই কল দিচ্ছে।মিনার ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে আবার সামনে তাকালো।মহুয়া ততোক্ষনে পুকুরে ডুব দিয়ে চলে এসেছে।
মিনার নিজের রুমে এসে একটু ঘুমানোর চেস্টা করে।

জুমার নামাজ এর সময় হয়ে এলো। মিনারের মা ওকে একটা গোল্ডেন কালারের পাঞ্জাবী আর টুপি দিয়ে গেছে।মিনার আর ভাবছে না।কারন এখন ভেবেও লাভ নেই।সবাই খুশি।আস্তে আস্তে মহুয়াকেই মেনে নিতে হবে।জীবনে যার আসার সেই আসছে।ভালবাসাটা দেরিতে হলেও সম্মান টা করবে এই সম্পর্কের।
মিনার বেশ বাস্তবিক চিন্তাধারার মানুষ তাই সবটা এভাবেই ভাবছে আর নিজেকে রাজি করছে নিজে।

মিনারের মা বিয়ের বেনারসি আর গয়নার সেট মহুয়ার বাবাকে দিল। কিন্তু মহুয়ার বাবা গয়নার সেট টা ফেরত দিয়ে দিল।আর বললো মহুয়া যখন বউ হয়ে ওইবাড়ি যাবে তখন পরিয়ে দিতে।এখন মহুয়া ওর মায়ের গয়নাই পরবে।মিনারের মা বুঝলেন তাই কথা না বাড়িয়ে গয়নাগুলো আবার ফেরত নিয়ে চলে আসে।
মহুয়ার মা তো রাগে শেষ।এমন কেন করলো রাগে গিজগিজ করতে করতে জিজ্ঞেস করলো।মহুয়ার বাবা বলে যা করেছে বেশ করেছে।বিয়েতে মিনারের মা যা যা দিয়েছে যথেস্ট।এর বেশি নেওয়া সম্ভব না।আর তুমি কি ভাবছো আমি বুঝিনা তুমি কি চাও।আমি থাকতে এসব হবে না।
মহুয়ার মা বলে তাহলে আমিও গয়না দিব না মহুয়াকে।খালি গায়ে বিয়ে দিয়ে শ্বশুর বাড়িতে পাঠাও বলে উঠে মহুয়ার মা।মহুয়ার বাবা বলে তুমি দেওয়ার কে?ওগুলো মহুয়ার মায়ের বিয়ের গয়না ওর প্রাপ্য।
মহুয়া ওগুলোই পরবে।
মহুয়া মহুয়া মহুয়া।তোমার আরেকটা মেয়ে আছে রিনি সেটা মনে আছে?ওর বিয়ে তে কি দিবে বলে মহুয়ার মা।ওর জন্য ওর আপন মা আর তার গয়না তো আছে মহুয়ার বাবা বলে।রাতুল এসে ওর বাবাকে বলে বাবা কেন সময় নস্ট করছো। ওরা আসছে।চলো যাই।মহুয়ার বাবা আর কথা না বাড়িয়ে আলমারি খুলে গয়নাগুলো নিয়ে চলে আসে।
মহুয়ার বাবা মহুয়ার ঘরে আসে।তানিয়া আর মিমি মহুয়াকে বেনারসি আর হাল্কা সাজিয়ে দিয়েছে।মহুয়ার বাবা মেয়েকে এভাবে দেখে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ছোট মা মরা মেয়েটাকে এভাবে এত তারাতাড়ি বিয়ে দিতে হবে ভাবতেই পারেনি।কিন্তু মনটা খুশি কারন সুপাত্রে দান করছে আর মহুয়ার নিজের মায়ের ইচ্ছে পূরন হচ্ছে আজ।মহুয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।আর গয়নাগুলো মহুয়াকে পরিয়ে দিতে বলে।মহুয়া চুপচাপ বসে আছে।

নামায পরে মিনার,ওর বাবা আর বাকিরা সবাই মহুয়াদের বাসায় আসে।কাজিসাহেব আর মহুয়ার ছোট চাচা এসেছে মহুয়ার সম্মতি নিতে।কাঁপা কাঁপা গলায় কবুল বলে দিল মহুয়া। এই মুহূর্তে যে কোন মেয়ের কান্না করা স্বাভাবিক কিন্তু মহুয়া কাদছেনা।মহুয়ার এই এক অভ্যাস যখন তখন কান্না করতে পারেনা।কিন্ত খুব কাছের মানুষ যখন পাসে থাকে তখন নাহয় একা কেদে মন হাল্কা করতে পারে।আজ পর্যন্ত মহুয়ার বাবা আর তানিয়াই মহুয়ার কান্না দেখেছে।

অন্যদিকে মিনার ও তিনবার কবুল বলে সম্মতি দিয়ে দিয়েছে।মিনারের বাবা আর মহুয়ার বাবা কোলাকুলি করে।
মহুয়া কে এনে মিনারের পাশে বসানো হয়েছে। কিন্তু দুজনের একজন ও তাকাচ্ছে না একে অপরের দিকে।
কিন্তু দুজনেরই কেমন একটা অনুভুতি হচ্ছে।হার্ট বিট বেড়ে গেছে। বিয়েটা হয়েই গেল।
মহুয়ার বাবা এসে মহুয়ার হাতটা মিনারের হাতে তুলে দেয়। ওনার চোখে জল দেখে মিনারের খারাপ লাগছে।মিনার চুপ হয়ে ওনার কথাগুলো শুনছে অন্যদিকে মহুয়ার কাপা হাতটা মিনার কে অন্যমনস্ক করছে।মিনার হাতটার দিকে তাকিয়ে দেখে একবার।মনে হচ্ছে বাচ্চা মেয়ের হাত একটা। মেহেদী তে লাল হয়ে আছে আর দুহাত ভর্তি লাল চুড়ি সাথে দুটো সোনার বালা।হাত দুটো কাপছে অনবরত।
মহুয়ার ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।মিনারের পাশে বসার পর থেকেই এমন হচ্ছে।
খাওয়া দাওয়া সেরে মহুয়াকে মিনারদের বাসায় নিয়ে যায়।মিনারের মা মহুয়াকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দেয়।বলে আজ আমাদের ওয়াদা পুর্ণ হলো। আমার মেয়ে আমাদের কাছেই এলো। মিনারের মায়ের কথা গুলো যেন বুকে লাগছে মহুয়ার।যেন নিজের মা ফিরে পেল।এভাবে মায়ের আদর পাওনা ছিল ওর ভাবতে পারেনি।
মিলন নিজের রুমে বসে বসে বিয়ের ছবিগুলো দেখছে।তারমধ্য কিছু ছবি তানিয়ার ও আছে।মিলন খুটিয়ে খুটিয়ে ছবিগুলো দেখছে আর মুচকি হাসছে।মেয়েটা অনেক চঞ্চল। পুরো বিয়েতে সবাইকে মাতিয়ে রেখেছিলো।
মিলন কি যেন ভেবে তানিয়াদের ঘরের পাসে রাস্তায়গিয়ে দাড়ায়।কিন্তু ঘেরাও দেওয়া তাই কিছু দেখতে পারছেনা।হঠাৎ করে পিছন থেকে কেউ বলে উঠে আমায় খুজেন?
মিলন চমকে উঠে।
কি হলো? বলুন,
মিলন বলে,না মানে হ্যা।
তাহলে এখানে চোরের মতো দারিয়ে আছেন কেন ভিতরে না গিয়ে?ভ্রু কুচকে তানিয়া বলে।
না মানে কে কি ভাবে তাই আর কি।মিলন কি বলবে ও নিজেও বুঝে উঠতে পারছেনা।এই মেয়েটা এত৷ বলে যে কনফিউজড হয়ে যাবে যে কেউ।
তা আমায় কি দরকার?বলুন,তানিয়া বলে।মিলন বলে কাল তো ভাবি চলে যাবে আপনাকে একবার যেতে বলেছে তাই ডাকার জন্য এসেছি।
তানিয়া এবার হেসেই দিলো মিলনের অবস্থা দেখে।
সোজা করে বলে দিলেই হয় এত ডং করার কি আছে?
মিলন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। বলে কিসের সোজা কথা?
সেটা তো আপনি ভালো জানেন।আর তা ছাড়া মহুয়া যে আমাকে দুপুরেই যেতে বলে দিয়েছিলো তাহলে আপনাকে বলতে যাবে কেনো।আমি আপনাদের বাসায় যাচ্ছিলাম।
মিলন আর কথা বাড়ালো না।যা মেয়ে থামানো অসম্ভব। তাহলে চলুন বলেই মিলন হাটা শুরু করে দেয়।তানিয়া ওর পিছু নিলো।এইতো কাছেই তাই দুই মিনিটে পৌঁছে যায়।
মহুয়া চুপচাপ বসে আছে মিমির সাথে।সবাই পরিচিত আর সবকিছুই চেনাজানা তারপর ও কেমন যেন একটা লাগছে মহুয়ার।মিনার এর ঘরের এসব ঝামেলা ভালো লাগছেনা আর তাই একটু বাইরে বেরিয়েছে।এখনো ফিরেনি।
তানিয়াকে দেখে মহুয়ার মুখে হাসি ফোটে।তানিয়া মহুয়াকে জড়িয়ে ধরে বসে পড়ে। মহুয়া ওর বাবার কথা জিগ্যেস করে।দেখেছে কিনা। কারন মহুয়া আসা থেকেই এক জায়গায় বসে আছে। ওর বাবা আসার কথা তাও আসেনি।তানিয়া বলে মহুয়ার বাবা কে দেখেনি হয়ত বাইরে গেছে।
তানিয়া মহুয়া কে বলে, আচ্ছা তোর দেবর টা কি করে রে?জানিস আমি লাইন মারার আগেই নিজে লাইনে দাঁড়িয়ে গেছে বলে হাসতে থাকে তানিয়া।মহুয়া হেসে বলে কি করেছে?
তানিয়া সবটা বলে।মহুয়া বলে ভালোই তো। তুই তো এটাই চেয়েছিস।আর আমার দেবর টা খারাপ না!
তানিয়া বলে,ওমনি না?একদিনেই ছিনে গেলি?
মহুয়া বলে একদিনে কেন হবে মিলন ভাইকে তো তুই ও ছিনিস কেমন।হ্যাঁ কথা হতো না অত বেশি কিন্তু মাঝে মাঝে আসলে তখন তো দেখতাম।
তানিয়া বলে,তাহলে কি বলিস?
মহুয়া বলে সেটা তুই ভালো জানিস।
তানিয়া বলে তবে আমার দুলাভাই বেশি সুন্দর আর তার ভাই বান্দর!
মহুয়া ফিক করে হেসে দিলো। মিলন বাইরে একশবার হাটার নাটক করে দরজার সামনে দিয়ে শুধু তানিয়াকে দেখার উদ্দেশ্য।তানিয়া বাড়ি যাওয়ার জন্য বের হতেই মিলন আবার পিছু নেয়।তানিয়ার বিষয় টা বেশ ভালো লাগছে।মিলন এর সাথে প্রেম করবে তার জন্য না বরং এর জন্য মহুয়ার কাছে যেতে পারবে তাই নিয়ে ভাবছে তানিয়া।মহুয়া কে ছাড়া থাকা অসম্ভব মনে হচ্ছে তানিয়ার।মিলনকে দেখে তানিয়া থেমে যায়।
আবার পিছু নিয়েছেন কেনো?
মিলন বলে,পিছু নিব কেনো?একা মেয়ে এত রাতে একা যাওয়া ঠিক না তাই ভাবলাম,
তাই নাকি?আমাকে কি ভিতু মনে হচ্ছে?আর নাকি আমি একশো মাইল দূরে থাকি?এইটুকু তো পথ।তানিয়া বলে।
মিলন বলে, তাও একটা দায়িত্ব আছে না আমাদের বাসা থেকে আসছেন।তানিয়া হুট করে বলে উঠে সারাজীবন এর দায়িত্ব নিতে পারবেন?
মিলন কিছুটা অবাক হয়। এই মেয়ে হুট করে কি বললো।তানিয়া মিলনের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে চলে যায়। মিলন এখনো মূর্তির মতো দাড়িয়েই আছে।
এই মেয়েটা কে বুঝা সম্ভব না। কিন্তু মেয়েটা কে কেন যেন ভালো লাগছে।
তানিয়া ঘরে ঢুকেই হাপাচ্ছে।কি যে হচ্ছে নিজেই বুঝতে পারছে না।

মিনার ঘরে ফিরে নিজের রুমে যায়।ঘরটা অন্ধকার হয়ে আছে।একটা বড় মোমবাতি জ্বলছে টিমটিম করে।
তার মানে লোড শেডিং হয়েছে।মিনারের শরির টা ভারী লাগছে।মনে হচ্ছে এখানে অন্য কেউ আছে।মিনার মোবাইলে আলো টা জ্বালায়।মহুয়া বেডের এক কোণায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। দুদিন ঘুমাতে পারেনি তাই চোখ বুঝে গেছে।মিনার কি করবে বুঝতে পারছে না। ওর ও ঘুমের দরকার। বাইরে গিয়ে শুয়ে পড়লে তাও সমস্যা।ভাবতে ভাবতে শুয়েই পরলো মহুয়ার পাশে।কিন্তু ঘুমাতে পারছে না। মহুয়াএপাশ ওপাশ করছে গরমে আর হাতের চুড়িগুলোর ঝুনঝুন শব্দ হচ্ছে।মিনার আর না পেরে উঠে আস্তে আস্তে মহুয়ার হাতের চুড়িগুলো খুলে পাশে রেখে দেয়।
তারপর পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে।

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে