#মন মহুয়া
রাইটার – Farhana Rahaman আয়াত
পার্ট – ০৬
মহুয়া চুপচাপ শাড়ি পাল্টে ঘুমানোর চেস্টা করছে কিন্তু পারছে না। আজ ঘুম আসবেনা।যতক্ষন মনের কস্টগুলো কান্না হয়ে না ঝরবে মনটা হাল্কা করতে পারবে।
মিনারের মা মহুয়াকে সবকিছু বুঝিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে চলে আসে।আর মহুয়া চুপচাপ সবটা শুনে কোনো কিছুই মুখ ফুটে বলেনি।কিন্তু এখন খুব কস্ট হচ্ছে।মহুয়া ভাবছে এসব কেন হচ্ছে ওর সাথে।কোনো কিছুই স্বাভাবিক ভাবে হয়না কেন ওর জীবনে।ওর বাবা জানলে কি হবে।বাবা একটা কথা বারবার বলতো মহুয়া মা পানির মতো হবি সবসময়।পানি মানুষের পিপাসা মেটায়,জ্বলন্ত আগুন নেভায় আর যে পাত্রে দেয় সেই পাত্রের আকার ধারণ করে।মহুয়াও কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রাতটা এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দিলো
ভোরে উঠে নামাজ পরে বাইরে এসে চারপাশে দেখতে লাগে। কাল ঠিকমতো দেখাই হয়নি।
মিনার সোফায় ঘুমাচ্ছে।সবার রুমের দরজা ভিতর থেকে আটকানো।মহুয়া আস্তে আস্তে ছাদের দিকে পা বাড়ায়।ছাদটা বেশ বড় আর সুন্দর ও।অনেক ফুলের টব আছে।একটা বড় দোলনাও আছে।চারপাশে বড় বড় দালান। গাছ গাছালি নেই বললেই চলে। কারো বাসার বারান্দায় কিছু টব ঝুলে আছে শুধু।মহুয়া কিছুক্ষন বসে নিচে চলে আসে।সবাই এখনো ঘুম শুধু ফুফুর রুমটায় আলো জ্বলছে। মহুয়া যাবে কি যাবে না ভাবতে ভাবতে গেলো ফুফুর রুমে। ফুফু তাসবি পড়ছিলো।মহুয়াকে দেখে বলে, এত সকাল সকাল এখানে কি করছো?
ফুফুর ভারী গলা শুনেই মহুয়া ভয় পায় একটু। মহুয়া আস্তে করে বলে ঘুম ভেঙে গেলো আর সকাল সকাল উঠার অভ্যাস তো তাই।ফুফু বলে তা নামাজ কালাম পড় তো?
মহুয়া বলে,জী।ফুফু বলে তাহলে তো ঠিক আছে।
কোরআন শরিফ ও পড়বে রোজ।
মহুয়া বলে আমার কোরান শরিফ টা আনা হয়নি।ফুফু ওকে ইশারা করে আলমারির উপর এ রাখা কোরআন শরিফ দেখায়।বলে ওখানে দুইটা আছে একটা নিয়ে যেতে।মহুয়া মাথা নেড়ে হুম বলে। ফুফু নিজে নিজে বলে এবাড়িতে রাত জেগে অনেক পড়াশোনা হয় শুধু এই কোরআন পড়ার সময় কারোর নেই।বলেও হয়না এদের।মিমি আর মিরার জন্য নিয়েছিলাম।মাঝে মাঝে পড়ে।তার থেকে তুমি নিয়ে যাও।নিয়ে আবার ফেলে রাখবেনা।রোজ পড়বে।মহুয়া আবার মাথা নেড়ে হুম বলে। মহুয়া বলে ফুফু চা বানিয়ে আনি?
ফুফু বলে খেলে ভালো হয়।মহুয়া বেরিয়ে এসে রান্নাঘরে কি জিনিস কোথায় রাখা আছে একবার দেখে নিলো।তারপর চা বানিয়ে ফুফুকে চা দিয়ে আবার রান্নাঘরে এসে পরোটা, আর পেয়াজকলি দিয়ে ডিম ভাজি করলো।কে কি পছন্দ করে আর কি খায় কিছুই জানেনা তাই আর কিছু করলোনা।
রান্নাঘরের টুংটাং আওয়াজে মিনারের ঘুম ভেঙে গেলো। ঘড়ি দেখে সকাল ৬;৪০।মিনার ভাবছে সবাই উঠে ৯টার দিকে। আজ এত সকাল সকাল উঠছে কেন মা।নাকি ফুফু বুঝতে পারছে না। মিনার এর ঘুম ভেঙে গেলো তাই আর আসছেও না।উঠে রান্নাঘরে একবার উকি দেয় দেখে মহুয়াই কাজ করছে।কিছু বলতে যাবে তখনই ওর বাবা রুম থেকে বের হচ্ছিল।মিনার আর কথা না বলে রুমে চলে গেলো ফ্রেস হতে আর জামা কাপড় ও রুমে তাই।
মিনার দেখে রুমটা কাল যেমন ছিলো এখনো পুরপুরি তেমন না।সবকিছু গুছানো আর পরিপাটি। ফুলের কোনো পাপড়ি পর্যন্ত ঘরে নেই।মনে হয় মহুয়া সারারাত ঘরই গুছিয়েছে।
মিনার ওর সব জামা কাপড় একটা লাগেজে গুছিয়ে নিলো।মহুয়া রান্নাঘর থেকে রুমে ঢুকতে গেলে মিনারের সামনে গিয়ে পড়ে।মহুয়া কিছু বলার আগেই মিনার বেরিয়ে জগিং এ চলে যায়।মহুয়া ফ্রেস হয়ে নিলো।
মিনারের মা ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে নিজেকে বকতে বকতে রুম থেকে বের হয়।কাজের বুয়া কিছুদিন আগেই কাজ ছেড়ে চলে গেছে।তাই মিনারের মা আপাতত সব কাজ করে।কিন্তু আজ উঠতে দেরী হয়ে গেছে।ক্লান্ত ছিলো তাই বুঝতেও পারেনি।রান্নাঘরে আসতেই তিনি পিয়াজকলি ভাজির খুব সুন্দর একটা ঘ্রাণ পায়।এক এক করে সবকিছুই দেখতে থাকে।হটবক্সে পরোটা, বাটিতে ভাজি,চা বানানোর সবকিছু সাজানো। মিনারের মা তো বেশ অবাক।মিনারের ফুফুকে গিয়ে বলে বুবু তুমি সকাল সকাল এত কাজ কেনো করলে?মিনারের ফুফু বলে আমিতো রুম থেকে বের হয়নি।কি করেছি আমি।
মিনারের মা বুঝতে পারছে না এসব কে করলো।কারণ মিরা আর মিমি তো এখনো ঘুম।তার মানে মহুয়া করেছে।মিনারের মা খুশি হয়।
মিনারের বাবা আর মিনার ফিরে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়ে অফিসের জন্য।
মিনার আর কলেজে যাবে না ঠিক করেছে।
মিনারের মা মিনারের জন্য চিলেকোঠার ঘরটা পরিস্কার করে দিলো।কিন্তু মহুয়ার এসব ঠিক লাগছে না।এই রুমটা মিনারের।সবকিছুই মিনারের।মহুয়া এইঘরে থাকার জন্য মন সায় দিচ্ছে না।মহুয়া বলে,মা একটা কথা বলবো? মা বলে জিজ্ঞেস করার কি আছে।কি কথা?
মহুয়া বলে মা আমি এই ঘরে না থেকে চিলেকোঠার ঘরে থাকি?
মা বলে এটা আবার কি কথা?তুই কেনো ওখানে থাকবি।না না মিনার থাকবে।
মহুয়া বলে আমি থাকতে পারবো মা।আর এটা ওনার ঘর।ওনি এখানে থাকতে অভ্যস্ত। শুধু শুধু বদলানোর দরকার কি।আমিতো নতুন আমি যেখানেই থাকবো মানিয়ে নিব।আর আমার একা থাকার অভ্যাস আছে।
মহুয়ার কথায় মা রাজি হয়ে গেলো। মেয়েটা অন্তত নিজের মত থাকার অধিকার টুকু পাওয়া দরকার।অন্য কেউ হলে কাল রাতেই ঘর ছাড়তো। এসব ভেবে মা আর কিছু বললো না।
মিরা কলেজে, মিমি বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গেছে,মিনার আর ওর বাবা অফিসে,মিলন ও বাজারে গেছে।বাসায় মহুয়ার একা একা দিন কাটছেনা।তানিয়ার কথা খুব মনে পড়ছে। বাবার সাথে তাও কথা হয়েছে কিন্তু তানিয়ার সাথে কথা হয়নি।মহুয়া চিলেকোঠার ঘরটায় নিজের জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে রাখে। নিচে গিয়ে অনেকক্ষন মায়ের সাথে রান্নাঘরে সাহায্যে করে।মা রান্না করতে দিচ্ছে না ওকে।তাই কি করা।এর মধ্য ছোট চাচি এসে মহুয়াকে দেখে গেছে।ওনি জানেন বিয়ের ব্যপারে। কিন্তু হঠাৎ করে মেজ চাচী ও আসে ওই সময়ে। মহুয়া সম্পর্কে জানতে চায় অনেক কিছু।মা সব বলে গ্রাম থেকে এসেছে এখানেই থাকবে পড়াশুনা করার জন্য।মেজ মা এসেছিলো নিজের ছেলের গুণকীর্তন করতে।ছেলে নাকি আগামি মাসেই দেশে ফিরবে।ফিরলেই বউ আনবে।পাত্রী দেখেছে বেশ কয়েকটা। ছেলের জন্য নাকি পাত্রীর লাইন ধরে আছে। বেশ কিছুক্ষণ পর গেলেন ওনি।মহুয়ার মনে হচ্ছে যেন কথার ঝর থামলো।
মিলন এর মধ্য বাসায় আসে। এসেই মহুয়াকে খুঁজতে লাগলো। মা বলে ও চিলেকোঠার ঘরে। মিলন যেতে যেতে তানিয়াকে কল করে। তানিয়া সকালেই মিলনকে ফোন করেছিলো মহুয়ার সাথে কথা বলার জন্য।মিলন মহুয়াকে ফোন টা কথা বলার জন্য দিয়ে নিচে চলে আসে।মহুয়া অনেক্ষন কথা বলে তানিয়ার সাথে।তানিয়া বলে সামনের সপ্তাহেই ওদের রেজাল্ট দিবে।মহুয়ার পরিক্ষা বেশ ভালো হয়েছিলো। তারপর ও বেশ ভয় লাগছে এখন।কারণ আগে ভেবেছিলো যেমন হোক আর হয়তো পড়বেনা।রেজাল্ট যেমনই হোক। কিন্তু এটা শ্বশুর বাড়ি। যদি রেজাল্ট খারাপ হয় বা নাম্বার কম আসে।কি ভাববে সবাই।লজ্জায় মাথা কাটা যাবে।
মিনার রাতে বাসায় ফিরে ছাদে উঠে যায়।চিলেকোঠার ঘরে ঢুকতেই দেখে মহুয়া বিছানার উপর বসে ডায়েরিতে কি যেন লিখছিলো।মিনারকে দেখে চমকে ডায়েরি টা বন্ধ করে দিল কলমটা নিচে পড়ে গেলো।
মিনার রেগে বলে তুমি এখানে কি করছো?
মহুয়া বেশ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এই প্রথম মিনার ওর সাথে কথা বলছে।মিনার আবার বলে কি হলো? এখানে কি করছো?
মহুয়া মাথা টা নিচু করে বলে,এখানে আমি থাকবো।আপনি আপনার ঘরে যান।মিনার আর কিছু না বলে ওর মায়ের কাছে গেলো।ওর মা ওকে সবটা বলে।
আর মিনার কে বলে যেন কিছু না বলতে মহুয়াকে।মিনার নিজের রুমে এসে ফ্রেস হয়ে নেয়।শুয়ে শুয়ে মহুয়ার কথা ভাবছে।মেয়েটা বয়সে এত ছোট কিন্তু এতটা বুঝদার আর শান্ত কি করে সেটাই বুঝতে পারছে না। মহুয়ার সাথে এমন করে হয়তো ঠিক করছেনা।কিন্তু এর ফলে দুজনেরই ভালো হবে।জোর করে সব হয়না।সময় হলে সবটা ঠিক হয়ে যাবে।
সবাই খেয়ে ঘুমাতে চলে গেছে। মিনার ও ঘুমানোর চেস্টা করছে কিন্তু কেনো যেন ঘুম আসছেনা।মনে হচ্ছে একবার ছাদে গিয়ে দেখে আসতে মহুয়ার একা একা অসুবিধা হচ্ছে কিনা।ভয় পাচ্ছে কিনা।একা একা কি থাকতে পারবে।মিনার অনেক্ষন এসব ভেবে ঘড়ি দেখে রাত ১;৪০ প্রায়।মিনার এবার ছাদের দিকে গেলো।পুরো ঘরটা অন্ধকার। তার মানে ঘুমিয়ে পড়েছে।মেয়েটার কি ভয় নেই লাইট টা পর্যন্ত অফ করে রেখেছে।মিনার কিছুক্ষন থাকে। হাতের সিগারেট টা শেষ করে নিচে নামতে যাবে তখনি মহুয়ার ঘরের লাইটটা জ্বলে উঠে। মিনার থেমে যায়। মিনার এক্টু এগিয়ে দেখার চেস্টা করে। জানালার পর্দা টা বাতাসে উড়ছে।মহুয়ার ঘর থেকে কোরআন তিলোয়াতের শব্দ আসছে।খুব মিস্টি গলায় মহুয়া কোরআন তিলোয়াত করছে।কিন্তু এত রাতে কেন সেটাই বুঝতে পারছেনা।কিছুক্ষন পর তাহাজ্জুত এর নামাজ পড়ে মহুয়া তারপর লাইটটা আবার অফ করে শুয়ে পড়ে।মিনার কিছুক্ষন দাড়িয়ে নিজের রুমে চলে আসে।মিনার এর মনে মনে ঠিক করে মহুয়ার সাথে নিজের সম্পর্ক টা সহজ করে নিবে।মহুয়া কে আর ইগনোর করবেনা।মহুয়া যদি সবটা মানতে পারে মিনার ও পারবে।
মহুয়ার এখন শান্তি লাগছে।একটু হালকা লাগছে।একা থাকার অভ্যাস মহুয়ার আছে।তাই ভয় পায়না। কিন্তু মন টা খারাপ লাগছে।তাই ঘুম আসছিলো না।
পরের দিন মহুয়া উঠে নামায পড়ে নিচে যায়।চা করে ফুফুকে দিয়ে এসে নাস্তা বানানো শুরু করে।ততোক্ষনে মা ও চলে আসে।মহুয়াকে বলে তুর কি সকাল সকাল উঠে এসব না করলে হয়না।তুই এবাড়ির বউ না মেয়ে।মিরা আর মিমির মত থাকবি।এসব করতে হবে না।মহুয়া এক্টু হেসে বলে, মা মেয়ে বলেই তো করছি।মেয়ে না করলে কে করবে?আমার এসব ভালোই লাগে।
মা হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
মিনার কে জগিং থেকে ফিরতে দেখে ওর মা বলে যা মিনার কে ফ্রুট জুস টা দিয়ে আয়।মহুয়া ভয়ে ওর সামনে যেতে চাইনা কিন্তু মা বলায় চুপচাপ গিয়ে দেখে মিনার কি করছে।ওয়াশরুমে থাকায় মহুয়া জুস টা টেবিলের উপর রেখে পালায়।
দেখতে দেখতে কয়েকটা দিন পার হয়ে গেছে।মহুয়ার বাবা ফোন করেছে মহুয়া আর মিনার কে যেতে।মিনার এই কয়দিনে মহুয়ার সাথে টুকটাক কথা বলে। রাগারাগি করে নি।যাওয়ার কথায় ও রাজি হয়ে গেছে।মিনারের এমন পরিবর্তন দেখে ওর মা বাবা ও খুশি।কিন্তু মিনার ওর দায়িত্ব পালন করছে আর সম্পর্কটাকে মানিয়ে নেওয়ার চেস্টা করছে।
চলবে,