#মন তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম পর্ব-০৩+০৪
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
__________________________
কংলাক পাহাড়ের দিকে ছুটে চলেছে আভা এবং আহনাফরা। আভা চরম উত্তেজিত। এই প্রথম সাজেক ভ্রমন করতে এসেছে আভা। তাই সাজেকের সৌন্দর্য্য আভাকে ভীষন মুগ্ধ করে রাখছে।
–’ আমরা কি পৌঁছে গেছি? ‘
আভা প্রশ্ন করল। দিহান ডিএসলার ক্যামেরা এনেছে। তা দিয়ে অনরবত ক্লিক ক্লিক করে ছবি তুলছে। কামরুল হাত দিয়ে মাথার ঝাঁকড়া চুল সোজা করতে করতে বলল,
–’ আভা, তুমি এই প্রশ্ন এই নিয়ে মোট কতবার করলে? ‘
আভা লজ্জা পেল। বলল,
–’ আসলে তর সইছে না। কখন পৌঁছাব আমরা? ‘
কামরুল উত্তর দিল,
–’ আর মাত্র দশ মিনিট। চোখ বন্ধ করে একবার মুখ ভরে নিঃশ্বাস নাও দেখবে দশ মিনিট পেরিয়ে গেছে। ‘
–’ একবার নিঃশ্বাস নিলে দশ মিনিট পেরিয়ে যাবে? ‘
আভা অবাক হল। বাঁধন চিপস খাচ্ছে। খেতে খেতে উত্তর দিল,
–’ হ্যাঁ, পেরিয়ে যাবে। সাজেকের আবহাওয়াটাই এমন। একবার নিঃশ্বাস নিয়ে দেখো না। আর নিঃশ্বাস ছাড়তে মন চাইবে না। সাজেকের ঠান্ডা বাতাস নাকে প্রবেশ করে দারুন আনন্দ দিবে। ভালো লাগবে। ট্রাই করে দেখো। ‘
আভা নড়েচড়ে বসল। সবার দিকে একবার চেয়ে গাড়ির জানালার বাইরে তাকাল। অতঃপর জোড়ালো ভাবে চোখ বন্ধ করল। লম্বা করে এক নিঃশ্বাস মুখের ভেতর পুড়ে নিল। চমকে উঠল আভা। এত ঠান্ডা বাতাস! মনে হচ্ছে, আভা তুলো মুখে পুড়ছে। আভার খিঁচে রাখা চোখ স্বাভাবিক হল। আভার চুল উড়ছে। রেশমী কেশ মুখে-চোখে লেপ্টে আছে। আভা চুল সরিয়ে আবার উপভোগ করছে তুলো ন্যায় বাতাস। হঠাৎ দিহান চিৎকার দিল,
–’ নড়বে না, আভা। স্ট্যাচু। ‘
আভা থমকে গেল। গা ছেড়ে বসে থাকল। উপভোগ করতে লাগল। দিহান চট করে আভার একটা ছবি তুলে নিল। আভা চোখ খুলল। দিহান তার ক্যামেরা আভার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
-‘ দেখো। ছবিটা সুন্দর এসেছে। ‘
আভা ডাগর ডাগর চোখে ক্যামেরার দিকে তাকাল। খোলা চুল আভার ঝাপটে পড়ছে মুখে, বন্ধ চোখ, সতেজ মন, কানের ঝুমকো। সব মিলিয়ে ভীষন সুন্দর দেখাচ্ছে আভাকে। আভা বলল,
–’ তুমি তো দারুন ছবি তুলতে পারো। ‘
দিহান গর্ব করে বলল,
–’ দেখতে হবে ছবির হাতটা কার? প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার আমি। ‘
আভা চোখ বড় করল। বলল,
–’ তুমি ফটোগ্রাফার? তবে তো এই ট্রিপে আমার সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে দিতে পারবে। আমার ছবি তুলতে ভীষন ভালো লাগে। সাজেকের মত ভীষন সুন্দর জায়গায় যদি ছবি তোলার মত মানুষ পেয়ে যাই, তবে তো সোনায় সোহাগা। ‘
দিহান কলার ঝাঁকাল। বলল,
–’ আচ্ছা। ডিল ফাইনাল। ছবি তুলে দিব ভালো কথা। কিন্তু পারিশ্রমিক কি পাব? ‘
আভা চিন্তায় পড়ে গেল। বলল,
–’ আমি তো অত টাকা আনিনি। হিসেবের টাকা এনেছি। কত দিতে হবে তোমায়? ‘
–’ কম না। এই ধরো কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় উঠে আমাকে জাম্বুরা খাওয়ালেই চলবে। ‘
আভা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। বলল,
–’ এত কম পারিশ্রমিক? ঠিক আছে। খাওয়াব। ‘
আহনাফ বই পড়ছে। আভা ও তার বন্ধুদের কথা শুনে আড়চোখে দু একবার এদিকে তাকিয়েছে বটে। আভা মেয়েটাকে আহনাফের কাছে চূড়ান্ত আশ্চর্য্যজনক লাগছে। একদিনের পরিচয়ে একটা মেয়ে এত সহজে কারো সাথে মিশে যেতে পারে? অদ্ভুত বটে। আহনাফ বাইরে তাকালো। তারা প্রায় পৌঁছে গেছে। আর এক মিনিট লাগবে। তারপর গাড়ি পার্ক করলেই তারা গাড়ি থেকে নেমে যাবে। আহনাফ গলা ছাড়ল। বলল,
– ‘ পৌঁছে গেছি আমরা। বকবক থামিয়ে যার যা লাগবে তৈরী করো। আমরা গাড়ি থেকে নেমে যাব। ‘
আভা কথা চট করে থেমে যায়। তৎপর হয়ে উঠে নিজেকে গুছিয়ে নিতে। দিহান একটা ব্যাগ নিজের পিঠে তুলে সোজা হয়ে বসে। কামরুলের হাতে ফোন। বাকিদের কোনো ব্যাগ নেই। ওরা ইচ্ছে করেই অতিরিক্ত কিছু নিজেদের সাথে আনেনি। কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় ট্রেকিং করতে উঠতে হবে তাদের। অতিরিক্ত কিছু বহন করলে পাহাড়ে চড়তে কষ্ট হবে।
সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। আভার গাড়ি থেকে নেমে জ্যাকেট খামচে ধরে। ঠাণ্ডা বাতাসে গা শিরশির করছে আভার। আভা মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকায়। সাজেকের আকাশটাও কি সুন্দর। আভার ওই আকাশ খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। গপগপ করে।
সবাই সামনে হাঁটছে। কংলাক পাহাড়ের বেশ আগে গাড়ি পার্ক করা হয়েছে। কিছু পথ হেঁটে পাড়ি দিতে হবে। সাজেকের পথ ধরে হাঁটতে বেশ শান্তি। দু পাশে পাহাড়। মাথার উপর মস্ত বড় এক আকাশ ছায়া। আর সাজেকের সড়ক। এ যেন স্বর্গীয় এক শান্তি। আভা হাঁটছে। আকাশের দিকে হঠাৎ হঠাৎ চেয়ে গুনগুনিয়ে গান গাইছে।
‘ সে যে বসে আছে একা একা
রঙিন স্বপ্ন তার বুনতে ‘
কংলাক পাহাড়ের সামনে এসে গেছে সবাই। এবার লাঠি কেনার পালা। আভা প্রশ্ন করল,
–’ লাঠি কিনব কেন? ‘
লাঠি বিক্রেতা ফোকলা দাঁতে হেসে উত্তর দেয়,
–’ লাঠি না থাকলে পাহাড় চড়বেন কেমতে? গড়াইয়া পইড়া যাইবেন না? ‘
আভা মুচকি হাসল। বলল,
–’ আপনি দারুন করে কথা বলেন তো। ‘
বিক্রেতা হাসে। বলে,
–’ তুমিও মেলা মিষ্টি ছেরি। ‘
আভা লজ্জা পেয়ে যায়। ছোট্ট করে বলে,
–’ ধন্যবাদ, চাচা। ‘
অতঃপর সবাই লাঠি কিনে পাহাড়ের উঠার প্রস্তুতি নেয়।
পাহাড়ে চড়ার অভ্যাস না থাকায় অল্পতেই আভা হাঁপিয়ে উঠে। এক জায়গায় থম করে বসে পড়ে। আভাকে আটকে থাকতে দেখে সবাই থামে। দিহান এগিয়ে আসে।
–’ আভা? ক্লান্ত লাগছে? ‘
আভা জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ে। আঙুল দিয়ে এক মিনিট দেখায়। দিহান বলে,
–’ ওকে। সময় নাও। আমাদের আরো কিছু সময় ট্রেকিং করতে হবে। ‘
বাঁধন দূর থেকে আভার দিকে চেয়ে আছে। আভাকে কষ্ট পেতে দেখে বাঁধন বুকে হাত চেপে বিড়বিড় করে,
–’ ইশ, যদি আমি ওকে কোলে তুলে পাহাড় চড়তে পারতাম।’
বাঁধনের কথা শুনে আহনাফ ভ্রু কুঁচকে চায়। বাঁধন সকল সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে। সবসময় মেয়েবাজি তার একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আভার মত উচ্ছল মেয়েকেও ছাড়ল না। আহনাফ খচখচ পায়ে আভার দিকে এগিয়ে আসে। আভার হাত ধরে এক টান দিয়ে তাকে সোজা করে উঠায়। আভা থতমত হয়ে পড়ে। ফ্যালফ্যাল চোখে আহনাফের দিকে চেয়ে বলে,
–’ বিশ্রাম করছিলাম আমি। ‘
আহনাফ বলে,
–’ মাত্র আধা ঘন্টার পথে তুমি তিনবার রেস্ট নিয়েছ। আর কত? এমন হলে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে। আমাদের আবার ফিরতে হবে। আর রেস্ট না। এখন চলো। কুইক। ‘
আভা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। আহনাফের ধমক দিয়ে কথা বলা আভার পছন্দ হয়নি। সুন্দর করে বললেও তো পারত। এত কঠোর কেন সে? সুন্দর করে বললে আভা কি শুনত না? অবশ্যই শুনত।
–’ দাঁড়িয়ে আছো কেন? চলো। ‘
আভা লাঠি শব্দ করে নিচে রাখে। অতঃপর চড়তে থাকে উপরে। আহনাফ বুঝতে পারে আভার রাগ হয়েছে। হোক। এমন করে অল্পতেই হাপিয়ে উঠলে, শক্ত ট্রাভেলিং করতে পারবে না। কষ্ট হবে। হাল ছেড়ে দিবে। এর চেয়ে বরং একটু একটু করে কষ্ট পাক, শিখুক।
অতঃপর সকল কষ্টের অবসান হল। সবাই কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় পা রাখল। সবার চোখে মুছে উচ্ছাস। আভা উত্তেজিত। মুখে হাত চেপে চেঁচিয়ে উঠে,
–’ আল্লাহ! এত সুন্দর কেন? ‘
আহনাফ আভাকে দেখে। মেয়েটা সুন্দর জায়গা দেখে একদম বাচ্চা হয়ে গেছে। আভা দৌঁড়ে আরো একটু সামনে এগিয়ে যায়। চোখের সামনে যেন মেঘের সমুদ্র বইছে। হাত বাড়ালেই যেন মেঘ ছোঁয়া যায়। মেঘেরা যেন সবার পোশাকে পরিণত হয়েছে। গা ছুঁয়ে যাচ্ছে মেঘের শীতল পরশ। দিহান ছবি তুলতে চাইছে। কিন্তু ঘন মেঘের কারণে ছবি তুলতে পারছে না। ঝাপসা আসছে। তবে কিছু ট্রিক খাটিয়ে অবশেষে দু একটা ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছে।
আভা চিৎকার করল
–’ আমার মনে হচ্ছে, আমি এভারেস্ট জয় করে ফেলেছি। ইশ, ইশ। এত সুন্দর কেন? আমার সবকিছু খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। ‘
বাঁধন উত্তর দিল,
–’ এভারেস্ট নয়। আমরা কংলাক পাহাড় জয় করেছি। ‘
আভা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। চিত্রা আহনাফের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। আভাকে দেখে অজানা এক কারণে তার ভীষন বিরক্ত লাগছে। সে মুখ ঝুঁকে আহনাফকে বলল,
– ‘ মেয়েটা এমন ন্যাকামো করছে কেন? তাকে আমার অসম্ভব বিরক্ত লাগছে। ‘
আহনাফ শুনল। তবে প্রত্যুত্তর করল না। বরং ভ্রু কুচকে নির্নিমেষ চেয়ে থাকল আভা নামক এই অদ্ভুত মেয়ের মুখের দিকে।
#চলবে
#মন_তোমাকে_ছুঁয়ে_দিলাম – ৪
লেখনীতে – আভা ইসলাম রাত্রি
______________________________
সবাই খুশিতে বাকবাকুম হয়ে আছে। বাঁধন দু হাত দিয়ে দিকে মেলে চোখ বুজে চেয়ে আছে সামনে। কামরুল নিজের ঝাঁকড়া এলোমেলো চুল সোজা করতে করতে চারপাশ চেয়ে চেয়ে দেখছে। দিহান ব্যস্ত ছবি তুলতে। আভা নিজের গায়ের জ্যাকেট দুহাতে আকড়ে ধরে চোখ বুজে আছে। আহনাফের বন্ধ চোখ জোড়া শীতলতায় ঘেরা। চিত্রা আঙ্গুলের ফাঁকে আহনাফের হাত ধরতে চায়। তবে আহনাফ হাত সরিয়ে নেয়। ভ্রু কুঁচকে গভীর কণ্ঠে বলে,
–’ বিরক্ত করবি না চিত্রা। মোমেন্টটা এনজয় করতে দে। ‘
সবাই ব্যস্ত এই সুন্দর পরিবেশ মন খুকে উপভোগ করতে। একে একে সবাই চোখ খুলে। বাঁধন বলে,
–’ এই তোরা জাম্বুরা খাবি? ‘
কামরুল বলে,
–’ মরিচ এনেছ কেউ? ‘
আভা বলে,
–’ আমি এনেছি। ‘
আভা নিজের ওড়নার অগ্রভাগের গিট্টু খুলে। সেখানে মরিচের ছোট্ট এক কৌটা রাখা। দিহান বলে,
–’ ওড়নায় মরিচ বেধে নিয়ে এসেছে? কি বুদ্ধি! ‘
আভা মুচকি হাসে। অতঃপর সবাই গাছ থেকে জাম্বুরা পেড়ে নেয়। আভা নিজের জন্যে একটা জাম্বুরা পাড়ে আবার দিহানের জন্যে নেয়। গাড়িতে দিহান ছবি তোলার পারিশ্রমিক হিসেবে জাম্বুরা চেয়েছিল। আভা তা ভুলেনি।
অতঃপর সবাই একে একে নিজেদের জাম্বুরায় মরিচ মাখায়।
বাঁধন বলে,
–’ কাউন্ট করি। সবাই একসাথে খাব। ‘
আভা উত্তেজিত। চেঁচায়,
–’ ৩,২,১, ০…. ‘
সবাই একসাথে জাম্বুরার টুকরায় দাত বসায়। ভীষন মজা জাম্বুরাগুলো। মুখে দেওয়ার সাথে সাথে জিহ্বা থেকে লালা ঝড়ে। বাঁধন চোখ বুজে খাচ্ছে। দিহান খেতে খেতে বলে,
–’ ভাই, খেতে সেই কিন্তু। ‘
আহনাফ শুনে। বাঁধন বলে,
–’ আমারও ভালো লাগছে। ‘
আভা উত্তর দেয়,
–’ মনে হচ্ছে মুখে দেওয়ার সাথে সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে। উফ।’
চিত্রা আভার কথা শুনে মুখ বাঁকায়। বলে,
–’ আভা, তুমি কখনো জাম্বুরা খাও নি? এমন পেটুক আচরণ করছ কেন? ‘
আভার খাওয়া থেমে যায়। কেউ যে এভাবে সরাসরি খাবার নিয়ে খোটা দিতে পারে, আভা বুঝতে পারেনি। আভা সামান্য হাসার ভান করে। বলে,
–’ জাম্বুরা আগেও অনেকবার খেয়েছি। তবে সাজেকে ভ্রমন করতে এসে জাম্বুরা খাবার মজাটা কি আর পাঁচ টা ছটা জাম্বুরার মত? ‘
চিত্রা কিঞ্চিৎ হাসার ভান করে। অতঃপর আবার খাওয়ায় মন দেয়। তবে আভার মন খারাপ থেকে যায়। পূর্বে চেহারায় উত্তেজনার ছাপ ছিল। এখন তা কেমন যেন মিইয়ে আসছে। আহনাফ তা লক্ষ্য করে। চিত্রার এমন কি কথা বলা উচিত হয়নি। বাঁধন চিত্রাকে বলে,
–’ তুই এমন অদ্ভুত আচরণ করছিস কেন? আসার পর থেকে দেখছি। কেমন যেন মুখ ভার করে বসে আছিস। প্রবলেম কি? ‘
চিত্রা রাগে থরথর করে কেঁপে উঠে। বলে,
–’ আমার প্রবলেম বলতে? আমি তোদের সাথে এসে প্রবলেম তৈরি করছি? এটা বলতে চাইছিস তুই? ‘
কামরুল বাঁধ সাধে।বলে,
–’ চিত্রা, তুই অযথাই ক্ষেপছিস। বাঁধন সেসব কিছুই বলেনি। ও তো…’
চিত্রা মাথা গরম হয়। বলে,
–’ তার মানে তুই কি বলতে চাইছিস? আমি সিনক্রিয়েট করছি? তোদের আমাকে নিয়ে এতই সমস্যা তাহলে আমাকে এই ট্রিপে আনলি কেন? রেখে আসতি। ‘
পরিবেশ নিমিষেই অশান্ত হয়ে উঠল। অনুভূতিরা পিষে যেতে লাগল। ভালো লাগা কেমন যেন ছুটে পালাতে চাইল। বরাবরই পরিস্থিতি শান্ত করতে আহনাফের জুড়ি মেলা ভার। সে চিত্রার কাধে হাত রাখল। বলল,
–’ রিলাক্স চিত্রা। তুই এমন ভাবছিস কেন? তোকে নিয়ে আমাদের কেন সমস্যা হবে। ইউ আর অ্যা জ্যাম ফর আস। হু? ‘
চিত্রার কান্না করার উপক্রম। বলে,
–’ আমি আর থাকব না। ওরা সবাই আমাকে বারবার অপমান করছে। ‘
আহনাফ চিত্রাকে বুকে টেনে নেয়। সুন্দর করে মাথায় হাত বুলিয়ে আলতো সুরে বলে,
–’ কান্না থামা। এত সুন্দর জায়গায় এসে কাদলে মানায়? বাচ্চা হয়ে যাচ্ছিস দিনদিন। ‘
আভা চোখ দিয়ে সব দেখে। লক্ষ্য করে। আভার বুকে মোচড় দিয়ে উঠে। সে এসেছে বলেই কি আহনাফদের বন্ধুত্ত্ব নষ্ট হচ্ছে? চিত্রাকে কি আভা কাদিয়েছে? হ্যাঁ। আভা এমন করে কথা না বললে নিশ্চয়ই চিত্রা কান্না করত না। হাসত। আভার সবাইকে হাসতে দেখতে ভালো লাগে। আভার জন্যে কেউ কান্না করলে আভার মন খারাপ হয়। কান্না পায়। এখন চিত্রা কাদঁছে। আভারও কান্না পাচ্ছে। এত খারাপ কেন আভা? আভা চিত্রাকে উদ্দেশ্যে করে বলে,
–’ আমি দুঃখিত, চিত্রা। আমি তোমাকে কাদাতে চাইনি। ‘
চিত্রা সাপের ন্যায় ফণা তুলে আভার দিকে চায়। আভা ভয় পায়। চিত্রা কি তবে খুব রেগে আছে? আভা দমে যায়। পরিস্থিতি অস্বাভাবিক ঠেকছে। আভার এখন দম বন্ধ লাগছে। দ্রুত সে চলে যেতে চায় এখান থেকে।
আভা বলে,
–’ আমরা যাব কখন? ‘
বাঁধন বলে,
–’ কেন যেতে চাইছ? মন খারাপ লাগছে? ‘
আভা মাথা নাড়ায়।
–’ না। ‘
কামরুল বলে,
–’ আমরা সূর্যাস্ত দেখে যাব। ‘
–’ সূর্যাস্ত? ‘
আভার চেঁচিয়ে উঠে। দিহান ছবি তুলতে তুলতে বলে,
–’ হ্যাঁ। সূর্যাস্ত। শুনেছি, কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় সূর্যাস্ত খুব সুন্দর দেখায়। তাই এসেছি যখন। এত সুন্দর বিষয় মিস করা যাবে না। ‘
এত সুন্দর সূর্যাস্ত দেখবে ভেবে আভার মন খারাপ হু হু করে হৃদয় ছেড়ে পালায়। খুশিতে নেচে উঠে। আভা বলে,
–’ আর কত সময় পর সূর্যাস্ত হবে? ‘
বাঁধন ঘড়ি দেখে। তারপর বলে,
–’ এখন বাজে ৫ টা ১০। আর এক ঘণ্টা পর সূর্যাস্ত হবে। ‘
আভার তর সইছে না। সময়কে যদি পেছানো যেত? তবে আভা এখনি সূর্যাস্ত দেখে নিত।
সুন্দর বিষয় আমাদের সবসময় অপেক্ষা করায়। দীর্ঘ অপেক্ষার রজনী কাটানোর পর যখন দু চোখ ভরে সেই সুন্দর বিষয় অবলোকন করি, আমাদের আত্মা তৃপ্ত হয়। মনে হয়, এটাই জীবন। যে জীবন তৃপ্তির, আনন্দের, শান্তির।
অতঃপর সূর্য পশ্চিম দিকে অস্তমান। আভা, আহনাফ, দিহান, কামরুন, বাঁধন, চিত্রা সবাই পশ্চিম দিকে এসে দাঁড়িয়েছে। কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় সূর্য যে হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়। সূর্য যেন দেহের উপর ঢলে পড়ে। সূর্যের রক্তিম আভায় দেহ টলমল ছলছল করে। মুখের উপর সূর্যের আলো লেপ্টে যায়। আভার মুখ হা। মৃদু স্বরে বলে,
–’ ওয়াও! ‘
দিহান চট করে সূর্যাস্তের কতক ছবি তুলে। বাঁধন বলে,
–’ কেমন লাগছে? ‘
আহনাফের চোখ স্থির। হালকা কণ্ঠে বলে,
–’ ইটস পিউর। ‘
কামরুল বলে,
–’ সুন্দরতম। ‘
আভার মৃদু কণ্ঠ,
–’ দারুন। ‘
চিত্রা বলে,
–’ ইটস লাভ। ‘
দিহান বলে,
–’ ইটস অ্যা পারফেক্ট ফটোশপ ব্যাকগ্রাউ্ড। ‘
সবার চোখ গেথে আছে অস্তমান সূর্যের পানে। মনে হচ্ছে সূর্য তাদের গিলে নিচ্ছে। সূর্যের উত্তাপ গা ছুয়ে অদ্ভুত শিহরন দিচ্ছে। পুরো সাজেক যেন চোখের সামনে ভাসছে।
–’ সূর্যকে নিয়ে সবার একটা ছবি তুললে কেমন হয়? ‘
দিহানের কথায় সবাই মুহূর্তেই রাজি হয়ে যায়। সবাই পাশাপাশি দাড়ায়। আহনাফের পাশে আভা। আভার মাথা আহনাফের বুক ছুঁইছুঁই। আভার দেহ আহনাফের দেহ ছুঁয়ে। আভা লজ্জায় জমে যায়। মাথা নত করে। আহনাফের দৃষ্টি আভার দিকে। দিহান ক্যামেরা সেট করে।
–’ ৩,২,১,০, রেডি ‘
সবাই পা উচু করে লাফিয়ে উঠে। ক্লিক, ক্লিক, ক্লিক। পরপর তিনটি ছবি উঠে। সবার ঠোঁটে হাসি। নতুন কিছু উদ্ভাবন করার জয়। সাজেক সুন্দর। বাংলাদেশ সুন্দর। এখানের মানুষ সুন্দর। এখানের অনুভূতিসমূহ পবিত্র।
#চলবে