মন তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম পর্ব-২৭+২৮

0
1394

#মন তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম পর্ব-২৭+২৮
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

২৭.
খাবার টেবিলে চেয়ার টেনে বসে আছে আভাদের পুরো পরিবার। আভার মা স্বামী সন্তানের পাতে মাংসের টুকরো তুলে দেন। আভা মায়ের হাত থামিয়ে বলে,’ মাংস না। ভাজি দাও মা। ‘
আভার মা মেয়ের কথামত এক চামচ ভাজি মেয়ের পাতে দেন। মিনহাজ খাবারের ফাঁকে আড়চোখে বাবাকে লক্ষ্য করে। বাবা বেশ খোশ মেজাজে আছেন। হয়ত এখন বিয়ের কথাটা তুললে মন্দ হয় না। মিনহাজ কিছু বলার পূর্বে আভা বলে উঠে,
‘ বাবা, আমি সিলেট যেতে চাই। ‘
জুনায়েদ খাবার খাওয়া থামান। থমথমে মুখে মেয়েকে খানিক পরখ করে পুনরায় মাথা নত করে খেতে থাকেন। আভা মৃদু নিঃশ্বাস ছাড়ে। বাবা কি যেতে দিবেন না? আভা মায়ের দিকে কাতর চোখে তাকায়। আদুরে মেয়ের কাতর দৃষ্টি ফেলতে পারেন না আভার মা। স্বামীর দিকে চেয়ে বলেন,
‘ যেতে চাইছে যখন, যাক না। ‘
জুনায়েদ বলেন,
‘ কদিন আগে সাজেক গিয়ে এল। এখন আবার কেন যাবে? ‘
‘ কদিন কই, বাবা? তিনমাস আগে গিয়েছি। ‘
‘ তিনমাস বেশি সময়? ‘
‘ তা না। ‘
আভার কণ্ঠ নিচু হয়ে আসে। বাবার কথা অমান্য করার সাধ্য তার নেই। কখনো বাবার মুখের উপর কথা বলতে পারে না আভা। আল্লাহ হয়ত আভাকে সে শক্তি দেন নি। বাবাকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করে সে। আভার মা মেয়ের মন খারাপ দেখে স্বামীকে বলেন,
‘ মেয়েটা যেতে চাইছে। তাছাড়া এখন পরীক্ষা শেষ। বন্ধতে কোথাও ঘুরে আসলে পড়াশোনা ভালো হবে। ‘
জুনায়েদ খানিক সময় মেয়েকে লক্ষ্য করলেন। আভা চোখ ছোট করে বাবার দিকে চেয়ে আছে। একটুখানি আশা পাওয়ার উদ্দেশ্যে। জুনায়েদ মৃদু নিঃশ্বাস ছাড়লেন। বললেন,
‘ তিনদিনের জন্যে যাবে। ‘
আভা চেয়ারে নেচে উঠল। চোখ দুখানা উজ্জ্বল হয়ে গেল। ছোট ছিমছাম গড়নে প্রবল আনন্দের ছাপ। আনন্দের চোটে পাশে বসে থাকা মায়ের দেহ জড়িয়ে ধরলো। আভার মা মেয়ের এমন পাগলামি দেখে হাসতে লাগলেন। বোনের খুশিতে মিনহাজ আর নিজের খুশির কথা তোলার সাহস করতে পারল না। চেপে গেল আরোহীর কথা।
______________
সিলেটের যত্রাগামী বাস স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আভা এবং তার বাবা। মেয়ের ব্যাগে এক বোতল পানি রেখে বললেন,
‘ আর কিছু লাগবে? ‘
আভা মানা করল। জুনায়েদ পকেট থেকে তিন হাজার টাকার নোট বের করে মেয়েকে দিলেন। বললেন,
‘ কার্ড দিয়েছি ব্যাগে। আর খুচরো কোনো প্রয়োজন হলে এই টাকাগুলো খরচ করবে। ‘
‘ আচ্ছা। এবার আসি? ‘
আভার বাবার চোখ ভিজে উঠল। মেয়ের মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করে দোয়া পাঠ করে বললেন, ‘ আসো। সুস্থভাবে ফিরে আসবে। ‘
‘ তুমিও ভালো থাকবে। ‘
আভা বাসে উঠে পড়ে। বাসের জানালার কাছে সিট পেয়েছে আভা। ব্যাগটা সিটের উপরে রেখে জানালার কাছে বসে। জানালার কাঁচ খুলে দিল। আজ প্রচণ্ড গরম পড়েছে। গরমে বোধ হচ্ছে গা পুড়ে যাচ্ছে। আভা খোলা চুল খোঁপা করে নিল। ব্যাগ থেকে পানি বের করে দু ঢোক পানি খেল। অতঃপর অপেক্ষা করতে লাগল আহনাফদের।
দশ মিনিট পরে আহনাফ ও তার বন্ধুরা বাসে উঠে। দূর থেকে আভাকে দেখে বাঁধন চমকে উঠে। এতদিন পর সেই কাঙ্ক্ষিত মেয়ে? হুড়মুড়িয়ে আভার কাছে এসে দাঁড়ায় বাঁধন। আভা মুচকি হাসে। অবাক হওয়ার ভান করে বলে,’ বাঁধন ভাই, তোমরা এই বাসে? সিলেট যাচ্ছ নাকি? ‘
বাঁধন নিজের হাতে চিমটি কাটে। আশ্চর্য লাগছে তার। আভাকে হন্যে হয়ে খুঁজেও সন্ধান পায়নি। আর আজ আভা স্বয়ং তার চোখের সামনে। তাদের সাথে সিলেট যাচ্ছে? হাতের চিমটি খেয়ে ব্যথায় ‘ উহ ‘ করে উঠে বাঁধন। আভার দিকে চেয়ে বলল,
‘ তুমি সত্যি আভা তো? ‘
আভা আশেপাশে তাকায়। তারপর নিজের গা ছুঁয়ে বলে,
‘ তাই তো মনে হচ্ছে। কেন আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে তোমার? আভার ভূত? ‘
আভা কিটকিট করে হেসে উঠল। বাঁধন মুগ্ধ চোখে আভাকে দেখল। এই মেয়েকে পাওয়ার জন্যে এতদিন বাঁধন কি না কি করেছে? বন্ধুদের কাছে দুহাত পেতে ভিক্ষা চেয়েছে আভার নাম্বার। কেউ দেয়নি নাম্বার। বাঁধন জানে ওদের কারো না কারোর সাথে আভার যোগাযোগ আছে। তবুও যে কেন তারা বাঁধনকে আভার নাম্বার দেয়নি কে জানে?
বাঁধন বলল, ‘ আভা, আমি তোমার পাশে বসি? যদি তুমি কিছু মনে না করো। ‘
আভা কিছুটা অপ্রস্তুত হল বটে। ওরনা টেনে গায়ের সাথে মিশিয়ে বলল, ‘ আসলে…..’
‘ বাঁধন, এটা আমার সিট। ‘
আহনাফ কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বাঁধনের পাশে এসে দাঁড়ায়। বাঁধনের কাঁধে হাত রেখে মৃদু হাসে। বাঁধন অসহায় বোধ করে। আভার পাশে বসার জন্যে সে মরে যাচ্ছে। আর এই আহনাফ কি না এখন আমার সিট, আমার সিট বলে চেঁচাচ্ছে। বাঁধন আহনাফের কানে কানে বলল, ‘ ভাই, একটু ম্যানেজ কর না। কতদিন পর মেয়েটাকে দেখলাম। একটু বসতে দে। গল্প করব দুজন। ‘
আহনাফ কিছু বলার আগে কামরুল পেছন থেকে চিৎকার করে ডাকে বাধনকে। বাঁধন পেছনে ফিরে তাকালে কামরুল নিজের পাশে সিটটা দেখিয়ে বলে, ‘ এই দ্রুত এই সিটে এসে বসে যা। বাস ছেড়ে দিচ্ছে। ‘
বাঁধন অসহায় চোখে আহনাফের দিকে চায়। দু চোখের ইশারায় সিটটা দিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করে। আহনাফ বন্ধুর কাতর চোখের দৃষ্টি উপেক্ষা করতে পারে না। আভার দিকে আড়চোখে চেয়ে পেছন ফিরে চলে আসতে চায়। অথচ আভা সবার সম্মুখে ডাক দিয়ে উঠে, ‘ আহনাফ, আমি আপনার পাশে বসতে চাইছি। যদি আপনি কিছু মনে না করেন। ‘
আহনাফ মাথা নত করে ঠোঁট টিপে হেসে উঠে। অতঃপর বাঁধনের দিকে ফিরে তাকিয়ে এমন ভাব করে যেন তার এখন কিছুই করার নেই। বাঁধন দুঃখী দুঃখী দৃষ্টিতে আভাকে দেখে। আভা নিরুত্তর। বাঁধনকে চোখের ইশারায় সরি বলছে। কি আর করার! বাঁধন চুপ করে সরে যায় তাদের মাঝখান থেকে। আহনাফ ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছাড়ে। ব্যাগটা পাশে রেখে আভার পাশের সিটে বসে। রোদ চশমা চোখের থেকে খুকে শার্টের কলারে ঝুলিয়ে রাখে। আভা আড়চোখে আহনাফকে দেখে। তারপর আহনাফের দিকে ঝুঁকে এসে মিনমিন করে বলে, ‘ সানগ্লাস শার্টের কলারে ঝুলিয়ে রাখলে আপনাকে অনেক সুন্দর দেখায়, রাগীনাফ। ‘
আহনাফ কপালে আঙ্গুল ঘষে মৃদু শব্দ করে হেসে ফেলে। আভার দিকে চেয়ে আভার ন্যায় মিনমিন করে বলে, ‘ প্রশংসার জন্যে কি দেওয়া যায়? চুমু দিলে চলবে? ‘
আভা হকচকিয়ে উঠে। দ্রুত নিজের জায়গায় বসে ওড়না ঠিক কর বলে, ‘ ছিঃ, অসভ্য লোক। ‘ আহনাফ মৃদু হাসে।
বাস ছেড়ে দিয়েছে। আভার বাসে উঠলে ঘুম পায়। ঘুমে চোখ যেন অসাড় হয়ে আসে। এখনো ঘুম পাচ্ছে। আর তাকিয়ে থাকতে পারছে না। আভা আলতো করে আহনাফের কাঁধে মাথা রাখে। চোখ বুজে বলে, ‘ এখানে ঘুমাই আমি? ‘
আহনাফ আভার ওড়না সুন্দর করে মেলে দেয় আভার গায়ে। সম্পূর্ন শরীর ওড়না দিয়ে ঢেকে আভার হাত নিজের হাতে পুড়ে নেয়। সহসা বলে, ‘ এখন ঘুমাও। ‘
আভা মুচকি হাসে। চোখ বুজে বিড়বিড় করে আওড়ায়, ‘ আপনি খুব ভালো, রাগীনাফ। পুরুষরা এত ভালো হয়, জানা ছিল না। ‘
দেখা গেল, কিছুক্ষণের মধ্যে আভা ঘুমে কাহিল। আহনাফ মোবাইলে কিছু একটা দেখছে। সহসা বাঁধনের দিকে চোখ যায়। বাঁধন খুব অন্যমনস্ক। আহনাফ বুঝতে পারে, বাঁধনের মন খারাপ। তার কি দোষ? আভার পাশে বসে সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার লোভ যে সে সামলাতে পারেনি। প্রেমিক হতে গিয়ে হয়ত সে বন্ধুত্বের দায়িত্ত্ব পালনে ব্যর্থ হয়ে গেছে। আহনাফ ঘাড় হালকা কাত করে আভার দিকে চায়। ঘুমন্ত কিশোরীর ন্যায় লাগছে আভাকে। ফোলাফোলা গালে ইচ্ছে করছে চট করে একটা চুমু বসিয়ে দিতে। কিন্তু আহনাফ হচ্ছে ভদ্র পুরুষ। সে নিজেকে সংযত করতে জানে। আহনাফ বিড়বিড় করে আওরায়,
‘ গতবার প্রেমে পড়েনি দেখে বেঁচে গেছি। এবার কি করে বাঁচব? এই মেয়েটা দেখছি এবার আমার চরিত্রে দাগ লাগিয়েই ছাড়বে। উফ, ভয়ংকরী। ‘
______________
বাস থেমে যায় মৌলভীবাজারে। আভাসহ সকল বাসযাত্রী নেমে দাঁড়ায় বাস থেকে। আভা মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে। সদ্য ঘুম থেকে উঠার দরুন মাথার চুল এলোমেলো, অগোছালো। কপালের উপর পড়ে আছে কিছু বেবি হেয়ার। মুখে তৈলাক্ত ভাব। নরম তুলতুলে গাল ফুলে আছে এই মুহূর্তে। আভাকে এমন অবিন্যস্ত দেখে আহনাফ বলল, ‘ মুখ ধুবে? ‘
আভার চোখে এখনো ঘুমেরা ছোটাছুটি করছে। আভা ঘুমঘুম কণ্ঠে বলল, ‘ হু। ‘
আহনাফ তার ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে আভার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে মুখ চোখ ধুয়ে নাও। ‘
আভা পানির বোতল হাতে নিয়ে হেলেদুলে রাস্তার পাশে চলে গেল। মুখ হাত ধুয়ে আবার ফিরেও এল। আহনাফ টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ মুখ মুছে নাও। ‘
আভা বাধ্য মেয়ের ন্যায় আহনাফ যা বলছে তাই করছে। আহনাফের হাত থেকে টিস্যু নিয়ে মুখ মুছে ফেলল। আহনাফ বলল, ‘ তুমি সামনের ওই মহিলাদের সাথে হাঁটো। আমি পেছন পেছন আসছি। ‘
‘ আচ্ছা। ‘
আভা কোনোরূপ দিরুক্তি না করে চুপচাপ সামনে চলে গেল। আহনাফ মৃদু নিঃশ্বাস ছেড়ে বন্ধুদের কাছে এল। বাঁধন এতক্ষণ শকুনি দৃষ্টিতে আভা এবং আহনাফের কার্যকলাপ দেখছিল। আভার প্রতি আহনাফের এমন যত্নআত্তি দেখে তার ভেতর খটকা লাগছে। ওদের দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে তারা পূর্বপরিচিত। শুধু পরিচিত নয়, আভা আহনাফের বিশেষ কেউ। আহনাফ বন্ধুদের সামনে এসে দাঁড়াল। রোদ চশমা চোখে দিয়ে বুক টানটান করে বলল,
‘ যাওয়া যাক এবার। ‘
কামরুল মুখে চোখে পানি ছেটাচ্ছে। এতটা দূর সফর করে এসে সে বড্ড ক্লান্ত। চিত্রা লাগেজ হাতে নিয়ে চোখ মুখ খিঁচে দাড়িয়ে আছে। আহনাফকে দেখে বিরক্ত হয়ে বলল,’ হিল পড়ে পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে আমার। কি করব এখন? আমি আর কোনো জুতো আনিনি। ‘
দিহান রাগ করে বললো, ‘ এই পাহাড়ি এলাকায় তুই হিল জুতো কোন যুক্তিতে আনিস? সব জায়গায় ফ্যাশন না দেখালে চলে না? ‘
আহনাফ দিহানকে আটকালো। বলল, ‘ বাদ দে। চিত্রাকে সামনের কোনো দোকান থেকে স্যান্ডেল কিনে দেওয়া যাবে। আপাতত কষ্ট করে হাঁটতে হবে। ‘
চিত্রা দিহানের দিকে রাগ নিয়ে চাইল। বলল,’ সবসময় তোর রাগারাগি। আহনাফের কাছে সকল সমস্যার সমাধান আছে। তোর মত মাথামোটা না সে। ‘
দিহান বিড়বিড় করে কতগুলো বকা দিয়ে পেছন ফিরে গেল। আসলে সাত ঘণ্টার এত লম্বা সফর করে সবারই মেজাজ বেশ চটে আছে। খিটখিটে মেজাজ নিয়ে কারো সাথে কথা বাড়ান মানে ঝগড়া করা। আহনাফ বাধনের দিকে চাইল। বলল, ‘ তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? হোটেলে যাবি না? ‘
আহনাফ বাধনের কাঁধে হাত রাখলে বাধন চট করে আহনাফের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সামনে হাঁটা ধরে। আহনাফ ভ্রু কুঁচকে বাধনের যাওয়ার পথে চেয়ে থাকে।

#চলবে

#মন_তোমাকে_ছুঁয়ে_দিলাম – ২৮
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
________________________
মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জলপ্রপাত হিসেবে সমধিক পরিচিত। L পাথারিয়া পাহাড় (পূর্বনাম: আদম আইল পাহাড়) কঠিন পাথরে গঠিত; এই পাহাড়ের উপর দিয়ে গঙ্গামারা ছড়া বহমান। এই ছড়া মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত হয়ে নিচে পড়ে হয়েছে মাধবছড়া। আভা এবং আহনাফরা সবাই যাচ্ছে মাধবকুন্ডের দিকে। তবে গাড়িতে নয়। রিকশা করে। গাড়ি থেমে যায় কাঠালতলী বাজারে। এরপরের পথটা সিএনজি নাহয় রিকশা করে যেতে হয়। আহনাফ চেয়েছিল সিএনজি ভাড়া করতে। কিন্তু আভা মানা করেছে। সে রিকশা চড়তে চায়। আহনাফ বোঝানোর চেষ্টা করেছে অনেকটা পথ যেতে হবে। সিএনজি ভালো। তবে আভা নাছোড়বান্দার ন্যায় রিক্সার নাম মুখে নিয়ে কুলুপ এটে বসেছিল। আহনাফ তবুও শুনছে না। কামরুল এগিয়ে এল। আহনাফের কাধে হাত রেখে টিপ্পনী কেটে বলল,
‘ দোস্ত,প্রেমিক ও প্রেমিকার মধ্যে হরহামেশা প্রেমিকাই জিতে এসেছে। এবারেও তাই হবে। তুই খামোকা নিজের শক্তি অপচয় করছিস। তোরা রিক্সা করে আয়, আমরা সিএনজি নিচ্ছি। এনজয়।’
কামরুল হেসে চলে গেল। আহনাফ চোখ উল্টে মৃদু নিঃশ্বাস ছাড়ে। আভার দিকে কিছুক্ষন থমথমে দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে রিকশা নেয়। আভার দিকে চেয়ে বলে,
‘ উঠো এবার। ‘
আভা খিলখিল করে হেসে উঠে। হেলেদুলে রিক্সায় চড়ে বসে। আহনাফ আভার পাশে বসে। তবে বেশ খানিক দূরত্ব রেখে। আভা চেপে বসেছে রিক্সার কিনারায়। আহনাফ বলল,
‘ এদিকে এসে বসো। রিক্সার ঝাঁকুনি লাগলে পড়ে যাবে। ‘
‘ না, পড়ব না। অভ্যাস আছে আমার। ‘
আহনাফ আর কথা বাড়াল না। চুপ করে সেলফোন বের করে মগ্ন হয়ে পড়ল। বিপত্তি ঘটল খানিক পর। রিকশা কিছুক্ষন পরপর ঝাঁকুনি খাচ্ছে। আভার বোধ হচ্ছে তার পেটের নাড়িভুড়ি সব বের হয়ে যাচ্ছে। যা খেয়েছিল সব বমি হয়ে যাবে এখন। এত বন্ধুর রাস্তা! আবারও বিশাল এক ঝাঁকুনি খেয়ে আভা আহনাফের উরু চেপে ধরল। আহনাফ মনেমনে বেশ শান্তি পেল। তার কথার খেলাপ করে এবার বুঝবে। সেলফোন পকেটে পুড়ে আহনাফ আভার কাধে হাত গলিয়ে দিল। একহাতে আভাকে শক্ত করে চেপে ধরল। বলল,
‘ একটু পথ সহ্য করে নাও। পৌঁছে গেছি প্রায়। ”
আভা আড়চোখে আহনাফের দিকে চাইল। মানুষটা এত দারুন কেন? তার ভয়ংকর ভালোবাসা দেখলে আভার হাউমাউ করে কান্না পায়। কাদতে কাদতে আহনাফের বুক ভেজাতে ইচ্ছে করে। ইশ! এত ভয়ংকর ভালোবাসা তার কপালে ছিল বুঝি?

মাধবকুন্ড পৌঁছে গেছে সবাই। কামরুল এবং বাকিরা আভাদের অপেক্ষা করেছিল। আভা এবং আহনাফ আসার পর তারা পা বাড়াল সামনে। কিছুটা পথ হাঁটতে হবে এবার। তবে হাঁটার জায়গা বেশ সুন্দর, পাকা করা। তবে উচুঁ ভীষন। গ্রাভিটির কারণে কষ্ট হয় বেশ। আভা সুন্দর করে সবার আগে আগে হেঁটে চলে যাচ্ছে। বোধ হচ্ছে এই জায়গার মত ভয়ানক সুন্দর জায়গা সে আর দুটো দেখেনি। কিছু দূর যাওয়ার পর একটা ছোট দোকান চোখে পড়ে। আহনাফ সেখান থেকে সবার জন্যে ড্রিংকস ও আইস্ক্রিম কিনে। আভা মালাই কিনেছে। খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত সবাই পৌঁছে গেছে জলপ্রপাতের সামনে।
জলপ্রপাতের সৌন্দর্য্য দেখে সবার ঠোঁট ফাঁক হয়ে হা আকার ধারণ করেছে। আভা মুখে দুহাত চেপে ধরে বড়বড় চোখে উপর থেকে বেয়ে নিচে নেমে আশা জলের দিকে চেয়ে আছে। আভা দৌঁড়ে গেল সামনে। থামল অতঃপর আরো একটু দৌঁড়ে আরো সামনে গেল।
পা ভেজাল জলপ্রপাতের পানিতে। ইশ, কি ঠান্ডা। আভা তাৎক্ষণিক পা বটে নিল। পেছন ফেরে সবার দিকে চেয়ে দেখল সবাই ইতিমধ্যে জিন্স বটে পাথরে বসে পানিতে পা ভিজিয়ে রেখেছে। একে অন্যের গায়ে পানি ছেটাচ্ছে। আভা ওদের দেখাদেখি আবার পানিতে পা ভেজানোর চেষ্টা করল। ইশ, অনেক ঠান্ডা পানি। মনে হচ্ছে ফ্রিজের পানি কেউ রেখে দিয়েছে। পা রাখা যাচ্ছে না পানিতে। আভা আবার পা বটে নিল। মুখ ফুলিয়ে সবার দিকে চেয়ে বলল,
‘ তোমরা কিভাবে পা ভিজিয়েছ? আমি পা রাখতে পারছি না। অনেক ঠান্ডা পানি। ‘
দিহান ছবি তুলছে। কথা বলতে বলতে ব্লগ করছে। দিহান নতুন ট্যুর ব্লগ চ্যানেল খুলেছে। সেই চ্যানেলের জন্যেই ব্লগ বানাচ্ছে। আহনাফ এগিয়ে এল। তার জিন্স পায়ের বেশ খানিক উপরে বটে রাখা। যার ফলে পায়ের ঘন লোম দেখা যাচ্ছে। আভা আহনাফের পা দেখে শিউরে উঠল। এত আকর্ষণীয় কারো পা হয় বুঝি? লোমগুলো দেখে আভার গায়ে কাঁপন দিচ্ছে। আহনাফের ভেজা পা দেখে আভার লোভ লাগছে। ইশ, কি লজ্জার ব্যাপার। আভা নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করল। আহনাফ আভার পায়ের কাছে হাঁটু গেরে বসল। আভার লেগিংস একটু উপরে বটে দিল। বলল,
‘ কবে নিজের খেয়াল রাখতে শিখবে? এক্ষুনি ভিজে যাচ্ছিল কাপড়। ‘
আভা মিনমিন করে বলল,
‘ আমি সারাজীবন এমন বেখেয়ালি থাকব, রাগিনাফ। তুমি আছ তো আমার খেয়াল রাখার জন্যে। ‘
আহনাফ শুনতে পেল। ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘ আমি যখন থাকবনা তখন….’
আভা কেঁপে উঠল। কেউ যেন কানে বি’ষ ঢেলে দিয়েছে তার। এমন ফালতু কথা আহনাফ কি করে বলল? বুক কাঁপল না তার? আভা আহনাফের থেকে সরে হনহন করে চলে গেল সামনে। পাথরে বসে অসহ্য ঠান্ডা পানিতে জেদ করে পা চেপে রাখল। পাথরের ঘষা লেগে পা খানিক কেটে গেল। তবুও ঠায় বসে রইল নিজ স্থানে।
আহনাফ দূর থেকে কিছুক্ষণ আভার কাজ দেখল। আভা রেগে আছে, কিসের জন্যে? সে তো সত্য কথা বলেছে। মৃত্যু সত্য জানার পর সেটা থেকে পালানো বোকামি। মৃত্যুকে উপভোগ করতে শেখা উচিৎ। মেয়েটা বড্ড আবেগি। আহনাফকে ঘিরে তার যত অসম্ভব আবেগ। আহনাফ আভার পাশের এক পাথরে বসল। আভার পায়ের রক্ত ভেসে উঠেছে পানিতে। আহনাফ চমকে উঠল রক্ত দেখে। দ্রুত আভার পা পানি থেকে তুলে নিজের উরুর উপর রাখল।
‘ কোথাও কেটেছ? হ্যাঁ? এই মেয়ে কথা বলছ না কেন? ‘
আভা চুপ। অন্যদিকে চেয়ে আছে। ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল। আহনাফ আবার বলল,
‘ থাপ্পড় চেনো? এরপর অযথা সব কথায় নিজের শরীরের উপর রাগ দেখাবা তো তোমার সাথে কথা বন্ধ। বুঝেছ? ‘
আহনাফ খুঁজে পেল আঘাতপ্রাপ্ত স্থান। পানির নিচে ছিল বলে রক্ত পড়া কমে গেছে। আহনাফের ব্যাগে সবসময় ফার্স্ট এইড বক্স থাকে। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিল। আভা এখন ফুপাচ্ছে। আহনাফ বলল,
‘ আর কিছুক্ষণ থাকলে ইনফেকশন হয়ে যেত জায়গাটা। মাথায় ঘিলু বলে কিছু আছে? নাকি সব হাঁটুর নিচে? ‘
‘ তোমার মত মহা বুদ্ধিমান হওয়ার কোনো দরকার নেই আমার। ‘
আভা এতক্ষণে মুখ খুলল। আহনাফ নত মুখে ঠোঁট টিপে হাসল। সোজা হয়ে বসে বলল,
‘ আমি বুদ্ধিমান?
‘ হ্যাঁ। মরার কথা যে বুক ফুলিয়ে বলতে পারে সে তো বুদ্ধিমানই। ‘
‘ আচ্ছা?
‘ খবরদার ওভাবে তাকাবে না। ওভাবে তাকালে আমি রাগ করে থাকতে পারি না তোমার উপর। আমি এখন রাগ ভাঙতে চাইছি না। বুঝেছ? ‘
‘ আচ্ছা? ‘
‘ উফ! অসহ্য! ‘
আভা হাল ছেড়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বসে রইল। আহনাফ শব্দ করে হেসে ফেলল। আভার নরম গাল টেনে ধরে বলল,
‘ হুয়াই সো কিউট? ‘
আভা গাল ঘষে বোকা বোকা চোখে আহনাফের দিকে চেয়ে থাকল।

‘ আহনাফ, আমি চলে যাচ্ছি ঢাকা। ‘
বাঁধনের হঠাৎ আগমন আভা এবং আহনাফকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিল। আহনাফ গলা কেশে আভার থেকে সরে দাঁড়াল। আভা লজ্জায় উঠে চলে গেল সেখান থেকে। বাঁধনের কথা শুনে আহনাফের ভ্রু কুঁচকে গেল। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ কেন? মাত্র আজ এলাম আমরা। ‘
‘ আমার এখানে ভালো লাগছে না। দম বন্ধ লাগছে। বাসায় গিয়ে একা থাকতে চাই কদিন। ওদের বলে দিয়েছি। এবার তোকে বললাম। আসছি আমি। ‘
আহনাফ আরো দু কথা বলতে চাইল। পারল না। তার আগেই বাঁধন ব্যাগ কাধে তুলে হনহন করে চলে গেল।
আহনাফ হতাশ চোখে বাকি বন্ধুদের দিকে তাকাল। ওরা নিজেরাও হতবম্ব। বাঁধনের এরূপ অস্বাভাবিক আচরণের কারণ কামরুল ধরতে পেরেছে। বাকিরা এখনো অবাক, নির্বাক, হতবম্ব!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে