#মন_উন্মনে_আঁচড়
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ০৬
.
“উফ্! ফাহাদ, তুমিও না।”
হেসে উঠে বললো, মীতি। মীতির কথার প্রতিত্তোরে ফাহাদও হাসলো ফোনের অপর পাশে। বললো, “আমি কি?”
“ফাজিল!”
“আমি কিন্তু মোটেও ফাজিল না, মীতি। শুধু তোমার কাছেই আমার ফাজলামো গুলো বেড়িয়ে আসে।”
ফাহাদের কথায় হাসে মীতি। ছেলেটার হয়তো অদ্ভুত ক্ষমতা আছে, কথার জালে আটকে ফেলতে জানে। এই তো কিছুদিন আগে পরিচয় হলো তাদের, তারপর ফোনালাপ। সেই ফোনালাপ থেকেই হয়ে উঠলো এক অজানা সম্পর্ক। রাতুলের বিষয়ে সবটা বলার পরেই যেন মীতির সাথে ফরহাদের সম্পর্কটা গাড়ো হয়, নানান কথার মাঝে মীতিকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টায় থাকে ছেলেটা। সে নিজেও বেশ উপভোগ করে ফাহাদের এই পাগলামি গুলো।
ঠোঁটে এক বিস্তৃত হাসি মেলে ধরে প্রতিত্তোরে মীতি বলে, “আমার কাছেই কেন তোমার ফাজলামো গুলো বেরিয়ে আসে, ফাহাদ?”
“উমম্! তা জানতে হলে তো দেখা করতে হবে। চলো, কালকে দেখা করি।”
“ইস্! মোটেও না। আজকেই দেখা করেছি। কালকে কিছুতেই বেরোতে পারবো না বাসা থেকে।”
“তাহলে আমি আসি?”
“কোথায়?”
“তোমার বাসায়।”
“কেন? ফাহাদ, তুমি কিন্তু….”
“মি. মাহতাব শেখের কাছে, তার মেয়েকে চাইতে।”
মীতিকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠে ফাহাদ। এদিকে ফাহাদের কথা খিলখিল করে হাসতে থাকে মীতি। এভাবেই বেশ কিছুক্ষণ চলতে থাকে তাদের ফোনালাপ। এক সময় মোবাইলটা রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়, মীতি। কিন্তু হঠাৎ বাবার ডাকে আবারও উঠে বসে। ভেতরে আসেন মাহতাব শেখ। মীতি বলে উঠে, “কিছু বলবে, বাবা?”
“তেমন কিছু নয়, মা। ওই তো….”
“কি হয়েছে, বাবা?”
“আসলে…. রাতুলের সাথে কথা হয়েছিলো তোর?”
রাতুলের কথা উঠতেই নিশ্চুপ হয়ে গেল মীতি, মাথা নিচু করে ফেললো। মাথা ঝাঁকিয়ে ‘না’ বললো মাহতাব শেখকে। বললো, “আমি ডিভোর্স চাই বাবা। তুমি ওর হয়ে কিছু বোঝাতে এসো না আমাকে।”
“আচ্ছা বেশ, তোমাদের মাঝে আমি কিছু বলবো না। কিন্তু দু’জন একবার সামনাসামনি কথা বলে….”
“রাতুল তো নিজেই আলাদা হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বাবা। আমি তো শুধু…. যা হোক, তুমি উকিলের সাথে কথা বলে ডিভোর্সের জন্য এপ্লাই করো। রাতুল আসবার আগে….”
“সামনের সপ্তাহে দেশে আসছে, রাতুল।”
চট করে মাথা তুলে বাবার পানে তাকালো মীতি। তীব্র এক উত্তেজনা কাজ করলো, হৃদপিণ্ডে দ্রিমদ্রিম শব্দ তুলে উঠলো। পরক্ষণেই ইশার কথা ভাবনায় আসতেই নিভে গেল মেয়েটা, নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো। মাহতাব শেখ ফের বলে উঠলেন, “তুমি চিন্তা করো না, মা। আমি তোমার পাশে আছি। রাতুলকে ভয় পেতে হবে না তোমার। ও আসুক, আমি কথা বলে সবটা সামলে নিবো।”
বাবার কথায় ভরসা পায় মীতি, সায় জানিয়ে ‘হ্যাঁ!’ বলে। এই মানুষটাই যেন মীতির একমাত্র ভরসা, একমাত্র ঠিকানা। একটা মেয়ের কাছে পৃথিবীতে বাবাই একমাত্র মাত্র মানুষ, যাকে নির্ধিদায় ভরসা করা যায়, চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়, যার ছায়াতলে নির্ধিদায় ঠায় পাওয়া যায়।
বাবার কাছে অনেকটা এগিয়ে এলো মীতি, হাতের বাহু জড়িয়ে মাথা রাখলো কাঁধে। মাহতাব শেখ সামান্য হেসে হাত বুড়িয়ে দিতে লাগলেন মেয়ের মাথায়। বলে উঠলেন, “সরি! আম্মু। বাবা কথা দিয়ে কথা রাখতে পারে নি।”
“কি কথা বাবা?”
“বাবা হয়ে সবসময় চেয়েছি বেস্ট কিছু তোমাকে দিতে, হয়তো দিয়েছি। কিন্তু জীবনসঙ্গী হিসেবে বেস্ট কাউকে দিতে চেয়েও পারি নি, মা। আমাকে ক্ষমা করে দিও।”
সহসায় কিছু বললো না মীতি। সামান্যক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর আহ্লাদী কণ্ঠে বললো, “উফ্! এসব বাদ দাও না, বাবা। একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দাও, ঘুম পাচ্ছে।”
.
মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছে, রাতুল। তার সামনেই বসে আছেন মাহতাব শেখ। দু’জনেরই মুখ থমথমে হয়ে আছে। রাতুলের মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে, এদিকে মাহতাব শেখও মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। তিনি কিছু সত্যি মিথ্যার সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত। রাতুলও ঠিক একই ভাবভঙ্গিতে বসে কিছু ভেবে চলেছে।
ঘন্টাখানিক আগে এখানে এসেছে, রাতুল। তারপরই শ্বশুরের সাথে আলাপচারিতায় বসেছে। মাহতাব শেখ বলেছে তাকে নানান কথা, রাগারাগি করেছে। তারপর রাতুলও নিজের হয়ে সাফাই দিয়েছে। সবটা শুনে দু’জনেই চুপচাপ বসে আছে সোফার দুই প্রান্তে।
গতকাল রাতেই কানাডা থেকে দেশে ফিরেছে রাতুল। বাসায় এসেই বুঝতে পেরেছে সংসারের পিছুটান ছেড়ে চলে গিয়েছে মীতি। ভেঙ্গে পড়েছিলো, আন্দাজ করে নিয়েছিলো মাহতাব শেখের ফোন করার কারণ। কোনরকমে রাতটা কাটিয়ে দেয় রাতুল। বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে অফিসে যায়। অফিসে তার সফলতায় সবাই হৈ-হুল্লোড় করলেও নির্জীব রয় ছেলেটা। বিদেশী ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি তাদের। কানাডার অফিসটাই তাদের মেইন অফিস। রাতুলের বিল্ডিংয়ের প্রজেক্টটা সফল হবার পর সেখানে বেশ নাম ছড়িয়ে পড়ে তার, সম্মান পায়। বাংলাদেশের অফিসে তার স্থান বড় পদে পায়, সুনাম ও সম্মান দুটোই ছড়িয়ে পড়ে। সবকিছু ম্যানেজ করে ছুটে আসে মীতির কাছে। কিন্তু দেখা পায় না মেয়েটার। মাহতাব শেখের সাথেই কথোপকথনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
বেশ খানিকক্ষণ নীরবতা চলে। নীরবতাটা ভেঙে মাহতাব শেখ’ই বলে উঠেন, “মেয়েকে খুব আদরেই বড় করেছি, রাতুল। সবসময় বেস্ট জিনিসটাই দিয়ে এসেছি। জীবনসঙ্গী হিসেবে তোমাকেও বেস্ট ভেবে আমার মেয়েটাকে দিয়েছি। কিন্তু তুমি….”
“বাবা, আমি তো সবটা খুলেই বললাম আপনাকে। কিন্তু বুঝতে পারছি না, মীতি কেন….”
“আমি তোমাকে ভরসা করলেও বিশ্বাস করতে পারছি না, রাতুল।”
“বাবা, আপনি…. আচ্ছা বেশ, মীতি ফিরুক। ওর সাথে সামনাসামনি কথা বলে….”
“রাতুল!”
রাতুলের কথাটা শেষ হবার আগেই কেউ বিষ্ময় নিয়ে তাকে কেউ ডেকে উঠলো। এই কেউটা যে কে, তা খুব ভালো করেই জানে রাতুল। হ্যাঁ! মীতি। এখনো দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। রাতুল ও মাহতাব শেখ ফিরে তাকালেন দরজার পানে। মীতিকে দেখে রাতুলের চোখেমুখে যেন এক খুশির রেখা ফুটে উঠলো। বলে উঠে, “কেমন আছ?”
“তুমিই? তুমি এখানে কি করছো?”
খানিকটা জোরেই বলে উঠলো মেয়েটা। কিঞ্চিৎ অবাক হলো রাতুল, পরমুহূর্তেই সামলেও নিলো নিজেকে। কিছু বলতে নিলেই তাকে থামিয়ে দিলো, মীতি। বললো, “এসেছো বেশ ভালো। বাবা নিশ্চয়ই বলেছে ডিভোর্সের কথাটা। তো? বাবার সাথে আজকেই কোর্টে যাও।”
“এসব কি বলছো তুমি?”
“কেন? বুঝতে পারছো না বুঝি? তুমিই তো বলেছিলে আলাদা হবার কথা।”
“মীতি! তুমি ভুল বুঝছো আমাকে। আমি শুধু বলেছিলাম….”
“ভুল বুঝছি, আমি? আলাদা হবার কথাটা তুমি বলেছিলে, রাতুল।”
একটু থামলো মীতি। দম ফেলে জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিলো। আবারও বলে উঠলো, “এটাই তো চেয়েছিলে তুমি, এখন এমন করছো কেন? আমি তো বলেছি তোমাদের মাঝে আসবো না, তাহলে?”
“তুমি ভুল বুঝছো, মীতি। ইশার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই, ইশা তো শুধু….”
“দেখেছি আমি, ইশার সাথে কি সম্পর্ক তোমার। ভুল বোঝাতে হবে না আমাকে। তোমাদের অন্তরঙ্গ মুহুর্ত নিজ চোখে দেখেছি আমি।”
“মীতিই….”
চেঁচিয়েই যেন উঠলো রাতুল। আর যা-হোক, এসব মিথ্যে অপবাদ যেন নিতে পারছে না। এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এবার যেন আর চুপ করে থাকতে পারলেন না মাহতাব শেখ। ফাহমিদা খানমও চলে এসেছেন বসার ঘরে। রাতুল আসার পর থেকেই তিনি খানিকটা রেগে ছিলেন। যতই হোক, মা তিনি। মেয়ের ভবিষ্যৎ তো এভাবে অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারেন না। রাতুলের ধমকে মীতিও থেমে থাকে না, প্রতিত্তোরে বলতে থাকে নানান কথা। এদিকে মেয়েকে থামানোর চেষ্টা চালিয়ে যান মাহতাব শেখ। মীতি যেন উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকে নানান কথা। কথার তাড়নায় এক সময় বলেই ফেলে, “এতএত টাকার মালিক হয়েছো তুমি, তোমার যা ইচ্ছে তুমি করতে পারো রাতুল। বলেছি তো বাধা দিবো না আমি। আমি ফাহাদ কে ভালোবাসি।”
মুহূর্তেই স্থির হয়ে যায় সবটা, স্তব্ধ হয়ে সবাই দাঁড়িয়ে রয়। খানিকক্ষণ নিশ্চুপ রইলো সবটা, মীতিও শান্ত হলো একটু। নীরবতা ভেঙে রাতুল বলে উঠলো, “কি বললে তুমি? ফাহাদকে ভালোবাসো, মানে? ফাহাদ কে?”
“হ্যাঁ! ঠিক শুনছো তুমি। ওকে হয়তো আমি ভালোবেসে ফেলেছি। তোমাদের মাঝে আসবো না আমি।”
“মীতিই… ভালোবেসে ফেলেছো মানে? আমি তো বলেছি ইশার সাথে আমার সম্পর্ক নেই কোন। তাহলে কাকে টানছো আবার আমাদের মাঝে?”
ফের উত্তেজিত হয়ে উঠলো মীতি, রাতুলও থেমে নেই যেন। যদিও মীতিই উত্তেজিত হয়ে নানান কথা বলে যাচ্ছে, আর রাতুল তাকে বোঝানোর চেষ্টায় আছে। এদিকে সবটা নীরব দর্শকের মতো দেখে চলেছেন মাহতাব শেখ ও ফাহমিদা খানম। আগের চেয়ে অধিক উত্তেজিত, উন্মাদ প্রায় মীতি। মেয়ের এহেন উন্মাদনায় হতভম্ব হয়েই দাঁড়িয়ে রইলো মাহতাব শেখ ও ফাহমিদা খানম। শান্তশিষ্ট মেয়েকে এমতাবস্থায় যেন কল্পনাও করতে পারছেন না তারা। মীতিকে অধিক উত্তেজিত হতে দেখে রাতুল শান্ত হয়ে এলো, থামাতে চাইলো তাকে। মীতিও হঠাৎ শান্ত হয়ে এলো, দাঁড়িয়ে গেল নিশ্চুপ হয়ে। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে দেখতে লাগলো চারদিকে। কিন্তু না, পারলো না। মেয়েটার চোখের দৃশ্যপটে হঠাৎই ঝাপসা হয়ে এলো। চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসতেই কান ও নাক দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো র’ক্ত। এবার আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না মীতি, লুটিয়ে পড়তে লাগলো মাটিতে। তখনই রাতুল ছুটে গিয়ে বলিষ্ঠ দু’হাতে আঁকড়ে ধরলো মীতিকে, জড়িয়ে নিলো বুকের সাথে। ঘাবড়ানো কণ্ঠে বলে উঠলো, “এ্যাই! মীতি, কি হয়েছে তোমার?”
.
.
চলবে…..
[ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন, ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন।]