মন উন্মনে আঁচড় পর্ব-০৪

0
670

#মন_উন্মনে_আঁচড়
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ০৪

[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উম্মুক্ত]
.
ছোট ছোট চোখ করে পাশে বসা ছেলেটার দিকে তাকালো মীতি। ‘ফাহাদ!’ পর পর দু’বার উচ্চারণ করলো নামটা। কেন জানি নামটা বেশ পরিচিত বলে মনে হলো। আদতে পরিচিত কি না বুঝতে পারলো না, আর না মনে করতে পারলো। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললো, “থ্যাঙ্কিউ! আপনি না থাকলে…”

“আরে, এভাবে বলছেন কেন? এটা তো আমার কর্তব্য।”

“তবুও, এভাবে হঠাৎ….”

“ইট’স ওকে! আপনাকে বেশ উইক দেখাচ্ছে, আর খাবেন?”

বলেই হাতের পানির বোতলের দিকে ইশারা করলো ছেলেটা, এগিয়ে দিলো সামান্য। মাথা ঝাঁকিয়ে না বোঝালো, মীতি। বললো, “না… নাহ্, ঠিক আছি। আর লাগবে না।”

“আচ্ছা বেশ। তো এভাবে লাগেজ হাতে পার্কে কি করছেন? বাসা থেকে পালিয়ে এসেছেন বুঝি?”

“আশ্চর্য! বাসা থেকে পালাবো কেন? আমি তো….”

কথাটা সমাপ্ত না করেই থেমে গেল মীতি। তৎক্ষনাৎ কোন জবাব দিতে পারলো না যেন। সত্যিই তো, সে পার্কে কি করছে? তার তো বাসায় যাবার কথা। মনে করার চেষ্টা চালিয়ে গেল, কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে কিছুই মনে করতে পারলো না। নিশ্চুপ রইলো, কথা কাটিয়ে প্রসঙ্গ বদলানোর চেষ্টা করলো। ফাহাদ বললো, “আচ্ছা বেশ, আপনার বাসার ঠিকানাটা বলেন, আমি পৌঁছে দিচ্ছি।”

“নাহ্! না… এর কোন প্রয়োজন নেই।”

“দেখুন, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে না আপনি ঠিক আছেন। চলুন, আমি পৌঁছে দিচ্ছি।”

বলেই উঠে দাঁড়ালো ফাহাদ, হাতে নিলো মীতির লাগেজটা। আবারও বারণ করলো মীতি, কিন্তু তার কথাগুলো কানে নিলো না ছেলেটা। উপায় পেল না আর, বাধ্য হয়েই যেতে হলো ফাহাদের সাথে।

.
“বাসায় যাবে বলেছিলে না, চলে এলে যে?”

“বাসায় যাবো মানে? কোন বাসায় যাবার কথা বলছো মা?”

মেয়ের কথার জবাব দিলেন না ফাহমিদা খানম, আগাগোড়া পরখ করলেন শুধু। ঘন্টা খানিক আগেই বেড়িয়ে গেল মেয়েটা, বাসায় যাবে বলে। কিন্তু এখন ফিরে এসে বলছে—কোন বাসায় যাবার কথা ছিলো? কপাল কুঁচকে ফেললেন ফাহমিদা খানম। বললেন, “বুঝতে পারছে না, কোন বাসায় যাবার কথা বলছি? তোমার ভাষ্যমতে তোমার নিজের বাসা। ফিরে এলে কেন? সত্যি করে বলো তো, রাতুলের সাথে কিছু হয়েছে কি?”

মায়ের কথাগুলো একে একে সাজিয়ে ফেললো মীতি। হ্যাঁ! এবার মনে পড়ছে। সে তো রাতুলের সাথে ঝগড়া করেই বাসা ছেড়েছে। রাতুল কানাডা চলে গিয়েছে, আর সে এখানে এসেছে। আসার পর বাবা মাকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে নি। ভেবেছিলো একটু সময় নিয়ে সবটা বলবে, কিন্তু কোন কারণে বলার সুযোগ হয়ে উঠেছি, ডিভোর্সের কথাও বলতে পারে নি বাবা মা’কে। সিদ্ধান্ত নিলো এবার সবটা বলবে।
কিছু বলতে নিলেই তৎক্ষনাৎ তাকে থামিয়ে দিলেন ফাহমিদা খানম। মায়ের মন, মেয়েকে দেখে ঠিক লাগছে না তার। বলে উঠলেন, “তুমি কি আদোও বাসায় ফিরেছিলে মীতি? না কি কোথায় গিয়েছিলে? সত্যি করে বলো তো।”

“মা! আমি আসলে… পার্কে ছিলাম। কিন্তু কিভাবে ওখানে… আমি তো ওই বাসায় ফিরতে চাই নি।”

“পার্কে? পার্কে কেন? বাসায় যাবে বলে বেড়িয়েছিলে, তাহলে ওখানে কেন….”

থামলেন ফাহমিদা খানম, কিছু একটা ভেবে কপাল কুঁচকে ফেললেন। কয়েক সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে ফের বললেন, “এক মিনিট! বাসায় ফিরতে চাও নি, মানে?”

এবার আর ভনিতা করলো না মীতি। মাথা নিচু করে ফেললো, ছলছল করে উঠলো চোখ দুটো। মায়ের দিকে তাকিয়ে ধীর কণ্ঠে বললো, “আমি ডিভোর্স চাই মা, রাতুলের সাথে আর সংসার করতে চাই না।”

নিশ্চুপ রইলেন ফাহমিদা খানম, সহসায় বলতে পারলেন না মুখ ফুটে কিছু। রাতুলের থেকে ডিভোর্স চায় মেয়েটা? কিন্তু কেন? কথাটা যেন তিনি বুঝে উঠতেই পারছেন না তিনি।

“এসব কি বলছো মীতি, রাতুলের থেকে ডিভোর্স চাও মানে?”

মাহতাব শেখের কণ্ঠ শুনে পিছন ফিরে তাকালো মা মেয়ে দু’জনেই। সবেই ফিরেছেন মাহতাব শেখ। বাসার মেইন দরজাটা খোলা দেখে খানিকটা অবাকও হয়েছিলেন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ফাহমিদা খানমকে হাঁক ছেড়ে ডাকার উদ্যোগ হতেই কর্ণপাত হয় মীতির বলা কথাটা। মীতির মুখে ডিভোর্স চেয়ে রাতুলের সাথে সংসার করতে পারবে না—কথাটা শুনতেই চমকে যান।

ভেতরে ঢুকতেই মাহতাব শেখকে জড়িয়ে ধরে মীতি, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। বাবার আদরের মেয়ে তিনি, সম্পর্কটাও বেশ স্বাভাবিক। মা’কে কোন কথা বলতে না পারলেও বাবাকে তা নির্ধিদায় বলে ফেলে মীতি।৷ মেয়েটাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেন তিনি, ঠিক কি হয়েছে রাতুলের সাথে জানতে চান। ফুঁপিয়ে কাঁদে মীতি, ধরা গলায় বলে উঠে, “আমি ডিভোর্স চাই বাবা, ভিভোর্স চাই। রাতুল আমার সাথে থাকতে চায় না, সংসার করতে চায় না ও আমার সাথে।”

“মীতি, শান্ত হও মা। তারপর বাবাকে সবটা খুলে বলো, কি হয়েছে, কেমন?”

“ও আমাকে ঠকিয়েছে বাবা, আমাকে ঠকিয়েছে। আই হেইট হিম!”

“বললাম না শান্ত হতে, তারপর সবটা বলো”

বলেই মীতিকে সহ সোফায় বসে পড়লেন মাহতাব শেখ। ফাহমিদা খানমকে ইশারায় পানি আনতে বললেন। তিনি পানি এনে মীতিকে খাইয়ে দিলেন। খানিকটা শান্ত হয়ে আসলো মীতি, কান্নার বেগও কমে গেল। এবার শান্ত কণ্ঠে মাহতাব শেখ জিজ্ঞেস করলেন—কি হয়েছে? বাবা মায়ের দিকে একবার চাইলো মীতি, ধীর কণ্ঠে বলে উঠলো, “রাতুলের অ্যাফেয়ার চলছে বাবা। ওর কলিগ, ইশার সাথে।”

চমকে উঠে মেয়ের মুখপানে তাকালেন মাহতাব শেখ। রাতুলের অ্যাফেয়ার চলছে—কথাটায় তিনি বেশ ভরকে গেছেন। ফাহমিদা খানমও ঠিক একই ভাবে চমকে গেছেন। গত দেড় বছরে একটা আদর্শবান ছেলে হিসেবেই রাতুলকে জেনেছেন তিনি। হঠাৎ মেয়ের মুখে রাতুলের অ্যাফেয়ারের কথা শুনে কপাল কুঁচকে ফেললেন। বিস্ময় নিয়ে মাহতাব শেখ মীতিকে জিজ্ঞেস করলেন, “এসব কি বলছো মা? রাতুলের অ্যাফেয়ার…. কিন্তু রাতুল তো….”

“সত্যি বলছি বাবা, গত একমাস থেকেই আমার সন্দেহ হতো, খানিকটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। আর সেদিন….”

“সেদিন কি? বলো।”

“ওরা একসাথে বেশ সময় কাটায় বাবা।”

“সেটা তো স্বাভাবিক, মা। ওরা একই অফিসে কাজ করে, বিভিন্ন কাজে বাইরে যেতে হয়। সময় কাটাতে হবেই তো।”

“তুমি বুঝে পারছো না, বাবা। ওরা বেশ ঘনিষ্ঠভাবে…. আমি মুখেও আনতে পারছি না।”

খানিকটা জোরেই কথাগুলো বলে উঠলো মীতি, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো আবারও। এদিকে হতভম্ব হয়ে বসে আছেন মাহতাব শেখ। মেয়ের কথাগুলো মিলেয়ে দেখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এবার আর চুপ থাকতে পারলেন না ফাহমিদা খানম। রাগ রাগ কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আমার তো আগে থেকেই ওই ছেলেটাকে পছন্দ নয়। কত করে বলেছিলাম তখন, শুনেছিলে আমার কথা? এবার দেখো, গেলো তো মেয়ের সংসার ভেঙে।”

“আহ্! ফাহমিদা, চুপ করো তো। শুনতে ওর কথা দাও আমাকে।”

চুপ হলেন না ফাহমিদা খানম, বলতে চাইলেন রাতুলের বিরুদ্ধে নানান কথা। ফের ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন মাহতাব শেখ। মেয়েকে শুধানেন, সে কিভাবে জানতে পারলো এতকিছু? সামান্য দম ছাড়লো মীতি, ভাবতে লাগলো গত মাস দুইয়েকের তাদের সংসার জীবনের সেই ঘটনাগুলো।

.
অফিস শেষে বেশ রাত করেই হঠাৎ বাসায় ফিরতে শুরু করলো রাতুল। অভিযোগ তুলতো না মীতি, বরং অপেক্ষা করতো রাতুলের জন্য। বাসায় ফিরলে হাসিমুখেই ফ্রেশ হতে বলতো, একসাথে খেতে বসতো। এভাবেই গত এক বছরে একে অপরর সাথে মানিয়ে নিয়েছে দুজনে।
বিয়ের পর তাদের সংসার জীবন বেশ সহজ ছিলো বলা চলো। তার কারণটা হয়তো বিয়ের আগেই একে অপরকে খানিকটা বুঝতে পেরেছিলো বলে। মীতিও বেশ স্বাভাবিক ভাবে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলো সংসারে, রাতুলের জীবনে। তাদের বিয়ের মাস খানিক পরেই রাতুলের বাবা মা চলে যান গ্রামে। দু’জনের বেশ ছোট ও সাধারণ সংসার ছিলো বলা চলে। একে অপরকে ভালোবাসি বলা হয় নি কখনো, কিন্তু দ্বায়িত্ব ও সম্মান ছিলো আকাশকুসুম।

এভাবে সপ্তাহ খানিক চলার পর, অফিস শেষে রাতুলের বাসায় ফেরা যখন নিত্যদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়ালো, তখনই হঠাৎ একদিন অভিযোগ করে বসলো মীতি। সেদিন অফিসের প্রচুর কাজের চাপ বলে চালিয়ে দিলো রাতুল। মীতিকে বললো, “অফিসের প্রচুর কাজের চাপ, মীতি। নতুন প্রজেক্ট পেয়েছি, সেটাতেই সময় দিতে হচ্ছে সবার।”

“তুমি কি একাই কাজ করো অফিসে? যে তোমাকেই প্রজেক্টটা সামলাতে হচ্ছে।”

“বলতে পারো। আমার আন্ডারেই কাজ করছে কয়েকজন।”

বলেই একটু থামে রাতুল। একটু সময় নিয়ে, “জানো মীতি, এই বিল্ডিংয়ের প্রজেক্টটা ঠিকঠাক ভাবে প্রেজেন্টেশন করতে পারলে আমার প্রমোশন হবার সম্ভাবনা আছে। অতপর আমি তুমি, একান্তে কিন্তু মুহুর্ত, আর….”

বলেই মীতিকে নিয়ে দুষ্টুমিতে মেতে উঠে রাতুল, তাকে বাঁধা দিয়ে মীতি, “উফ্! ছাড়ো তো, ঘুমাতে দাও।”

থামে না, রাতুল। বরং দুষ্টুমির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, দুরত্ব ঘুচিয়ে কাছে টেনে নেয় মেয়েটাকে। রাতুলের অবাধ্য হাত দু’টো মীতির শরীরে খেলা করতে থাকে। ছেড়ে দিতে শুরু করে মীতির শরীর, তবুও বৃথা চেষ্টা করে যায় রাতুলকে থামানোর। থামে না রাতুল, বরং হেসে উঠে। হাতের পরিবর্তন করে অধর ছুঁইয়ে সর্বাঙ্গ স্পর্শ করতে থাকে। বলে উঠে, “তুমি আপাতত ঘুমকে ছাড়ো, বরের সারাদিনের ক্লান্তি দূর করো।”

.
.
চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে