মনোহারিণী পর্ব-০৭+০৮

0
1158

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (৭)+(৮)

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ!)

পরিবার! সুখ-দুঃখ, হাসি-আনন্দ ভাগ করে নেয়ার এক প্রধান ধারক ও বাহক! যেখানে প্রতিটা সদস্য বাঁচে একে-অন্যের জন্যে। বিপদে পাশে দাঁড়ানো ছাড়াও জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে একটা মানুষকে পরিপূর্ণভাবে আগলে রাখে এই পরিবার। প্রত্যেকটা পরিবারেরই নির্দিষ্ট নিয়মনীতি থাকে! পরিবারের অভিভাবকরা সবসময়ই চায়, ছোটোরা সানন্দে বেড়ে উঠুক সেখানে। হাসুক, খেলুক, কাঁদুক একে-অন্যের জন্য। তারজন্য তাদের পর্যাপ্ত স্বাধীনতা দেয়া হয়! স্বাধীনতার মানে এই নয় যে, উচ্ছৃ’ঙ্খল জীবনযাপন করা! স্বাধীনতা মানে, নিজেকে বুঝা, অন্যকে বুঝা, শুধু নিজের মতো করে বাঁচাকেই স্বাধীনতা বলে না! এখানেও ঠিক তাই। আরমান সাহেব তার সন্তানদের স্বাধীনতা দিয়েছেন। তাদের জীবন চিনিয়েছেন, বুঝিয়েছেন কীভাবে জীবনটাকে উপভোগ করতে হয়! কীভাবে অন্যদের মূল্যায়ন করতে হয়!

প্রতি সপ্তাহের শেষদিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার এই পরিবারের পারিবারিক আড্ডার দিন। পরদিন ছুটির দিন হিসাবে আগের দিন দুইভাই বেশ সময় নিয়ে বাবার সঙ্গ উপভোগ করে। পরিবারের অন্যান্য দিকও আলোচনা হয় তখন! সমস্যা থাকলে তা সমাধানের পথ খুঁজে নেন! আজকের এই পারিবারিক আড্ডায় উপস্থিত মাইসারাও। বহুদিন পর বাড়ি এসে আড্ডার সময়টা পেয়েছে সে। আগামী রবিবারই বিয়ের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন হবে! এই ফাঁকে যত আলোচনা আছে, বুঝাপড়া আছে সবই প্রয়োজন! কে কীভাবে কোনদিক সামলাবে সেসবও জানা জরুরী, বুঝা জরুরী।

ড্রয়িংরুমের একটা টি-টেবিলে ক্যারামবোর্ড রাখা! গুটি আর স্ট্রাইকের ধুমধাম শব্দ হচ্ছে সেখানে। অনিক আর ত্বোয়া জমিয়ে ক্যারাম খেলছে। আলিফ খাতা, কলম হাতে নিয়ে প্রয়োজনীয় কিছু খসড়া তৈরী করছে। কতটা লাগবে, কী পরিমাণ জিনিসপত্র লাগবে সবটাই টুক টুক করে লিখছে সে। সেটা আবার আরমান সাহেবকে পড়ে শুনাচ্ছে। যদিও তিনি চোখে দেখেন তবে মাঝেমধ্যে ছেলেদের মুখে এমন টুকরো টুকরো হিসেব শুনে আনন্দ পান! তাদের ভাবনাচিন্তার গভীরতা তাঁকে তৃপ্তি দেয়। মাইসারা চায়ের ট্রে হাতে ড্রয়িংরুমে পা রাখলো! দুই ভাই-বোনের পাশ কে’টে অন্য টি-টেবিলটায় চায়ের ট্রে’টা রেখে দিল!

অনিকের সামনে লাল গুটি’টা! সে মনোযোগ দিয়ে তাকে ভেতরে ফেলার জন্য নিশানা ঠিক করছে! মাইসারা যখন চায়ের কাপটা আলিফকে দিয়ে বলল,

-“ভাইয়া আগে চা খাও, পরে হিসাব দেখো!”

সঙ্গে সঙ্গে অনিকের দৃষ্টিটা সেদিকে গেল! আজ সারাদিনে এই কেবল মাইসারাকে দেখলো! মাথা নুইয়ে চা ঢালছিল সে! অমনি সমস্ত চুল এসে তার মুখটা ঢেকে দিল! মনে হলো, শখের কোনো শো-পিসের সামনে কেউ এসে আগলে দাঁড়িয়েছে, যার জন্য শত চেষ্টায়ও হরিণী চোখ, মায়াবী হাসি তার দেখা হচ্ছে না! তবুও দৃষ্টি সরালো না সে। ডানহাতে কানের পাশে চুল গুঁজে আবারও চা ঢালতে মনোযোগী হলো মাইসারা। অনিকের ঠোঁটের কোণের হাসিটা চওড়া হলো এবার। অজান্তেই হাসলো সে। হাতের স্ট্রাইকটার দিকে দৃষ্টি না থাকায় হাত ফসকে অন্যদিকে সরে গেল সেটা! ত্বোয়া ভাইয়ের এই কাণ্ড দেখে মিটিমিটি হেসে বলল,

-“নজর কই তোমার! গুটিটা ভুল জায়গায় ফেললে! দাঁড়াও, এই গেমটা আমিই জিতবো!”

ঘাড় ফিরিয়ে ত্বোয়ার মাথায় ঠো’কা মা’র’লো অনিক! রাগ দেখিয়ে বলল,

-“সরা এসব সামনে থেকে! কাজের সময় কীসের খেলা! পড়াশোনা নাই? দিনরাত শুধু গল্পগুজব! যা পড়তে বস।”

এমন উপুর্যুপরি ব’কা’র ধরন দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো ত্বোয়া! নিজের দান ফেলতে ফেলতে ফিসফিস করে বলল,

-“তুমি দৃষ্টি অন্যদিকে দিবা, আর আমি বললে দোষ! সারার চোখে পড়লে খবর আছে। ভালো করেই জানো, তার মনের রাজ্যে কার বসতী!”

হাসিখুশি পরিবেশে এমন একটা কথা হ’জ’ম হলো না অনিকের! মনে হলো এক প্লেট সাজানো গোছানো সুস্বাদু বিরিয়ানির মধ্যে কেউ এক মুঠো তিক্ত স্বাদের লবণ ঢেলে দিয়েছে! যার কারণে পুরো বিরিয়ানি তার স্বাদ হারিয়ে ফেলেছে। তেমনি সুখের মুহূর্তটাও মুহূর্তের মধ্যে বেদনার গাঢ় নীলে রূপান্তরিত হয়েছে। বুকছিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার! দৃষ্টি সরিয়ে এবার খেলায় পুরো মনোযোগ ঢেলে দিল! বলল,

-“সে থাকুক তার মতো, আমি নাহয় আমার জন্য আলাদাভাবে অনুভূতি তৈরী করে নিব!”

-“পারবে?”

-“তাকে ভালো রাখার দায়িত্ব যখন নিচ্ছি, তখন অনুভূতি তৈরীর দায়িত্বটাও নিব! দেখা যাক, কতদূরে গিয়ে তার উপলব্ধি আসে, জীবনে সঠিক মানুষটা কে!”

এবার আর লাল গুটিটা হাতের নাগালে আসলো না। সাদা গুটি ব্যাগে ফেলে আবারও দৃষ্টি দিল পাশে! মাইসারা নিজেও তখন খসড়াটা দেখছে! গোপনে এই লুকোচুরি নজর কতটা তীব্র অনুভূতি জাগায় এটা বোধহয় এই মুহূর্তে অনিক ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারছে না! না চাইতেও আজ দৃষ্টি বার বার বেয়া’দবি করছে। এই বেয়া’দবি সহ্য করা যাচ্ছে না আবার উপেক্ষা করাও যাচ্ছে না। কী কঠিন পরিস্থিতি এটা?

তোকে একার দেখার লুকিয়ে কী মজা!
সে তো আমি ছাড়া কেউ জানে না।
তোকে চাওয়ারা পাওয়ারা নয় রে সোজা!
সে তো আমি ছাড়া কেউ জানে না।

*****

আঞ্জুমান আরা মারা গেছেন দু’দিন হলো। আগামীকাল তিনদিন হবে। শরিয়ত অনুযায়ী তিনদিন পর উপযুক্ত মেয়ের বিয়ের আয়োজনে কোনো বাধার বিধান নেই! এর কারণে এই পুরো ব্যাপারটা গভীরভাবে ভেবেছেন আরমান সাহেব! তিনি চান না, কেউ এই নিয়ে উল্টোপাল্টা কথা তুলুক। যেহেতু বিয়ের আরও দু’দিন বাকি। তাই এখানে শরিয়তে বিধানও অমান্য হলো না, মাইসারার মনটাও বিক্ষি’প্ত হলো না। কে জানতো হুটহাট অসময়ে আঞ্জুমান আরা এই পৃথিবী ত্যা’গ করে মেয়েকে চিরতরে একা করে দিবেন! অথচ মাইসারা আগেও একা ছিল, এখনও একা। তিনি চান না, মেয়েটার আগামীর পথ কঠিন হোক! সে নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে সানন্দে হাঁটুক, যেন কোনো বাঁধা বিপত্তি তাকে ঠে’কা’তে না পারে!

বিয়েটা মসজিদে পড়ানো হবে! যদিও সেন্টার বুকিংটা নামিরাদের বাড়ি থেকে করা হয়েছিল, তাই এদিকে তাদের আর চা’প নেই। তবে ওইদিন কমিউনিটি সেন্টারে নামিরা আর তানভীরের বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন হবে। মসজিদে পড়ানোর কারণ, অতিরিক্ত ঝা’মে’লা এড়ানো! সুন্নাত মোতাবেক অল্প মোহরানার এই আয়োজনে শুধু গ্রামের মানুষই উপস্থিত থাকবেন৷ এছাড়াও থাকবেন মাইসারার নানাবাড়ির আত্মীয়স্বজন! তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা বাড়িতেই হয়ে যাবে। এরজন্য কমিউনিটি সেন্টার বুকিংয়ের প্রয়োজন নেই!

এসব টুকটাক আলাপের ফাঁকে অনিক আর ত্বোয়ার চায়ের কাপটা রেখে দ্রুত সরে পড়েছে মাইসারা। অনিকও তার অবা’ধ্য, বেয়া’দব, বেহা’য়া মনকে নানারকমভাবে স্বান্তনা দিয়ে থামিয়ে রেখেছে! যেন ভুলবশত চোখ না পড়ে, চোখাচোখি না হয়! নইলে অকারণ অস্বস্তি শুরু হবে মেয়েটার। তবে দু’জনের লুকোচুরি আর একে-অন্যকে এড়িয়ে যাওয়ার সময়টুকু ভীষণভাবে উপভোগ করছিল ত্বোয়া! উচ্চস্বরে হাসতেও পারছিল না, আবার হাসি চেপে রাখতেও পারছিল না। মাইসারা সরে যাওয়ার পর পেটে হাত চে’পে অনেকক্ষণ প্রাণখোলা হাসি হাসলো সে। তা দেখে অনিক রীতিমতো রেগে গেল! ক্যারামের সব গুটি এলোমেলো করে দিয়ে বলল,

-“যা, সামনে থেকে সর। তোকে অকারণ হাসার চাকরি দেইনি আমি। ফা’জি’ল মেয়ে!”

-“আজিব! আমি হাসতেও পারবো না? হাসার জন্য তোমার অনুমতি নিতে হবে নাকি?”

অনিক জবাব দিল না। চায়ের কাপ নিয়ে ফটাফট নিজের রুমে গিয়ে ঢুকলো! ত্বোয়া সবগুলো গুটি বাক্সে ঢুকিয়ে বোর্ডটা যথাস্থানে রেখে চায়ের কাপ সঙ্গে নিয়ে মাইসারার কাছে গেল। তখন রুমের ভেতরে চা খেতে খেতে রিপার সাথে ফোনে কথা বলছিল সে। কথা বলা শেষে ফোন রেখে ত্বোয়াকে দেখে বলল,

-“কিছুক্ষণ আগে নাকি একটা ডেলিভারি হয়েছিল! পেশেন্টকে হসপিটালে নিয়ে আসতে দেরী হয়েছিল বলে বাচ্চাটাকে বাঁচানো গেল না!”

ত্বোয়া তার মুখভারের কারণটা বুঝতে পারলো। দশমাস, দশদিন গ’র্ভে বাচ্চাকে লালন-পালন করে মৃ’ত সন্তানের জন্ম দেয়া, এই আ’র্তচিৎকারে একটা মায়ের ভেতর যে কতখানি পু’ড়ে সেটা মাইসারা উপলব্ধি করেছে প্রতি পদে পদে। রোজ কত শিশুর জন্ম হয় হসপিটালে, কেউ বাঁচে, কেউ ম’রে। কখনো সন্তান মৃ’ত আবার কখনো মা! একটু সচেতনতার অভাবেই অকালে অধিক প্রাণের বি’না’শ ঘটছে। দেশ উন্নত হচ্ছে, চিকিৎসা উন্নত হচ্ছে অথচ মানুষ সচেতন হচ্ছে না! সামান্য অসচেতনতা কে’ড়ে নিচ্ছে হাজারও মানুষের প্রাণ!

এসেছিল চা খাওয়ার ফাঁকে সন্ধ্যার আড্ডাটা জমিয়ে তুলবে, অথচ মাইসারার শুকনো, মলিন, মনম’রা চেহারার এই অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘট’নার খবর শুনে মুখের হাসিটা উবে গেল তৎক্ষনাৎ! আড্ডাও হলো না, হাসিঠাট্টাও হলো না, উলটে মন খারাপের এই ক্ষণটাকে নীরবতা দিয়েই ঢেকে দিল দু’জনে!

*****

পরদিন সকালেই বাড়িতে মেহমানদের আগমন ঘটলো। একগাদা মিষ্টান্নদ্রব্যসহ ফলমূল নিয়ে হাজির হলো নামিরা আর তানভীর! আরমান সাহেব প্রশস্তচিত্তে তাদের আগমনের সময়টাকে গ্রহণ করলেন। খাবার-দাবারের আয়োজন শুরু হলো রান্নাঘরে! একসঙ্গে তিনজনে মিলে রান্নার কাজটা সামলাচ্ছে! ফারজানার চেহারায় রাগ নেই, বরং হাসিমুখেই এই সময়টাকে উপভোগ করছে সে। মাইসারা এটা-সেটা এগিয়ে দিচ্ছিলো। তখন ফারজানা বলল,

-“উপর থেকে দারুচিনি, এলাচির বৈয়ামটা দিবি সারা, আমি সরে গেলে তো মশলা পু’ড়ে যাবে! ত্বোয়া, তুই যা। হাতমুখ ধুয়ে নামিরার সাথে গল্প কর। এদিকটা আমরা সামলে নিব!”

কাজ আর বেশি ছিল না তাই ত্বোয়া ফ্রেশ হওয়ার জন্য সুযোগ পাওয়াতে মাথা নেড়ে চলে গেল নিজের রুমে। মাইসারা বৈয়ামটা আনতে গিয়েই মসিবতে পড়লো! পাশাপাশি অনেকগুলো বৈয়াম রাখা। সাথে তেলের মোটা টিনটাও! খানিকটা উঁচু হওয়াতে উঁকি মেরে বৈয়ামটা আনতে গেল মাইসারা অমনি হাত লেগে তেলের পুরো টিন উলটে মাইসারার মাথায় পড়লো! ঢাকনাটা সরে যাওয়াতেই বিপ’ত্তিটা ঘটলো। গড়গড়িয়ে সবটুকু তেল তার সারা গায়ে লেপটে গেল! ব্যথায় আর্ত’নাদ করে উঠলো সে! ফারজানা সেটা দেখে ক্ষ্যা’পে গেল! হাতের কাজ ফেলে দ্রুত ছুটে গেল ঠিকই! সেইসাথে সামান্য ধাক্কায় মাইসারাকে সরিয়ে তেলের টিনটা তুলে রাখলো। বলল,

-“পারবি না যখন বলতি! কতটা তেল নষ্ট করলি বলতো! জানিস তেলের কত দাম? প্রতিমাসে কয় লিটার তেল লাগে তার খোঁজ রাখিস? ইশ, ইশ অনেকটা তেল জলে গেল! এখন এই নতুন করে তেলটা কে আনবে! সর এখান থেকে! তোকে আর অকাজ করতে হবে না! কাজ যখন পারবি না, তখন না বলতে পারিসনি? শুধু শুধু হয়রানি। তেলের টিনটা উপরে রেখেছিস কেন? ওটা কি ওখানে থাকে? আশ্চর্য সারা, মাত্র একটা রাত তোকে ঘর সামলানোর দায়িত্ব দিয়েছিলাম, তাই বলে এই কোণার জিনিস ওই কোণায় রাখবি? এভাবে ঘর সামলানো যায়?”

মুখের উপর এতগুলো কথা শুনবে ভাবতেও পারেনি মাইসারা! টপটপ করে তার গা বেয়ে যেমন তেল গড়িয়ে পড়ছে, তেমনি চোখ থেকে ঝরছে পানি। সে নিজেও বুঝতে পারছে না, এই তেলের টিনটা উপরে গেল কী করে! গতকাল রাতেও সে নিচে রেখেছিল। মাথাটা ব্যথায় টনটন করছে! ডানহাতে ব্যথার জায়গাটা ভালোমতো ঘষে বলল,

-“আমি খেয়াল করিনি ভাবী। বিশ্বাস করো, তেল আলাদা বোতলে সরিয়ে টিনটা রাতেই আমি নিচে রেখেছি, এটা উপরে গেল কীভাবে সেটাই তো বুঝতে না!”

-“হয়েছে আর কৈফিয়ত দিতে হবে না!”

ফারজানার গলার এমন ভয়া’নক আওয়াজে তড়িঘড়ি করে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো ত্বোয়া! ইচ্ছেমতো মাইসারাকে ব’কে যাচ্ছে। সে-ও বকা হজম করছে চুপচাপ কোনো কথা বলছে না! হাত ধরে টে’নে তাকে বাইরে বের করে বলল,

-“ব্যথা পেয়েছিস কোথাও? এই অবস্থা হলো কী করে! সারা শরীর তো তেলে ডুবে আছে মনে হচ্ছে! জলদি গোসল করে জামা পালটা! সারা যা এখান থেকে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিস কেন তুই? বলতে পারিস না, প্রতি মাসে টাকা কোথায় যায়! এভাবে চলতে থাকলে তো চুপ করে থাকা যাবে না দেখছি! সব জানাবো বড়ো ভাইয়াকে! প্রতিবাদ করতে পারছি না দেখে যা ইচ্ছে তাই বলে পার পেয়ে যাবে! এমনটা তো কখনোই হবে না! আর চুপ থাকবো না। হয় সংসার, বাড়ি দুটো আলাদো হোক, নয় তোর ভাগ নিয়ে তুই যেদিকে পারিস চলে যা! এই জা’হা’ন্না’মে থাকলে ম’রে যাবি!”

ত্বোয়ার কথাটা কাজে দিল! ফারজানা চুপ থেকে কথা শুনলো কিন্তু কোনো জবাব দিল না। তার ভাবনায় তখন একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, তেলের টিনটা উপরে গেল কী করে? ওখানে তো অন্যকিছু ছিল! কে সরালো? ভাবতে পারলো না সে কিছু! তবুও ত্বোয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

-“এটাই পারবি! কথায় কথায় জায়গা সম্পত্তি আলাদা করা ছাড়া আর কোনো বাহা’দুরি আছে তোদের? বাড়িতে মেহমান, নয়তো এই অপ’মান আমি চুপ থেকে হ’জ’ম করতাম না।”

-“বেশ! মেহমান চলে যাক! আমি ভাইয়ার কানে সব কথা ঢালবো। সংসারের কর্ত্রী হয়েছো, তাইবলে আমাদের মাথা কিনে নাওনি নিশ্চয়ই! যখন-তখন যেভাবে পারছো, ব্যবহার করছো! নেহাৎ ভদ্রতা রক্ষার্থে, সংসার বাঁচাতে চুপ থাকি। নয়তো তোমার মতো মেয়ের যে কোনো যোগ্যতা নেই, আমার ভাইয়ের বউ হওয়ার তা হা’রে হা’রে বুঝিয়ে দিতাম। বেশি বা’ড়া’বা’ড়ি করলে নিজের কপালই পু’ড়া’বে! নাহিয়ানটার জন্য তোমার মুখোশটা টে’নে খুলতে পারছি না, নয়তো সারার মতো নাহিয়ানের জীবনটাও তো বি’ষিয়ে যাবে! চল এখান থেকে।”

দাঁতে দাঁত চে’পে অনেকগুলো কথা হ’জ’ম করলো ফারজানা! অগ্নিদৃ’ষ্টি নিক্ষেপ করে দু’জনের দিকে তাকালো। ত্বোয়া বিজয়ীর হাসি ফুটিয়ে তুললো ঠোঁটের কোণে। মাইসারার হাত ধরে তাকে রান্নাঘর ছেড়ে রুম অবধি নিয়ে আসলো। আলনা থেকে জামাকাপড় হাতে ধরিয়ে দিয়ে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে বলল,

-“শান্তিমতো গোসলটা শেষ কর! এই মহিলা আগামী এক সপ্তাহ চুপ থাকবে।”

মাইসারা তখনো মাথায় হাত বুলাচ্ছে! ত্বোয়া সেটা লক্ষ্য করে বলল,

-“অনেকটা কে’টে গেছে! শ্যাম্পু করতে পারবি, নাকি আমি আসবো? চুলগুলো তো আঠালো হয়ে গেছে!”

-“তুই যা, আমি সামলে নিব!”

ত্বোয়া চলে গেলেও তার ভাবনার দৌড় থামছে না। বুঝতেই পারছে না, তেলের টিনটা নিচ থেকে উপরে উঠলো কী করে! তার স্পষ্ট মনে আছে, গতকাল রাতে রান্না শেষে আলাদা বোতলে তেল সরিয়ে টিনটা নিচের দিকের কর্ণারে রেখেছিল! সেখান থেকে কে সরালো? তেল তো বের করার প্রয়োজন হয়নি! তবে? তিনজন মেয়ে ছাড়া আর তো কেউ রান্নাঘরে ঢুকে না! কে করলো এই কাজ?

চলবে…

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (৮)

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ!)

অনেক সময় মানুষ যা ভাবে, যা চায়, হয় তার ঠিক উলটো! আশানুরূপ ফল যদি না মিলে ব্যক্তি যেমন মনের অশান্তিতে পড়ে তেমনি তার মন-মেজাজের পাল্লাটাও তখন মারাত্ম’ক আকার ধারণ করে! বিশেষ করে হিং’সাত্মক মনোভাবাপন্ন ব্যক্তি যখন কার্য সম্পাদনে গাফি’লতি টের পায় তখনই তার হিং’স্র রূপ সে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে! যদিও ব্যক্তি চায় না তার ভেতরের রাগ, ক্ষো’ভ প্রকাশ করে উদ্দেশ্য সফল হওয়ার আগেই ধরা পড়ে যেতে, তবুও ভেতরে যে একটা উৎকণ্ঠা, দুঃশ্চিন্তা শুরু হয়, তা বোধহয় শত চাইলেও মুছে ফেলা যায় না। কারণ তার সেই দুঃশ্চিন্তা আর উৎকণ্ঠার রেখা কাজকর্ম এমনকি চেহারার ভাবভঙ্গিতে ফুটে উঠে প্রতি পদে পদে। নানারকম পেরেশানিতে পড়তে হয় তাকে।

এই মুহূর্তে ফারজানার অবস্থাও হয়েছে সেরকম! শেলফের উপরে যে দরকারী জিনিসটা সে রেখেছিল, সেটা হাওয়া! সেখানে তেলের টিন থাকার কথাই না। সে খুব গোপনে, তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সাথে প্ল্যানটা তৈরী করেছিল, অথচ সব মাটি! মাঝখান থেকে কতগুলো তেল নষ্ট হলো। অবশ্য এ নিয়ে তার আফসোস নেই, দুঃশ্চিন্তাও নেই। তার চিন্তার দৌড় এখন কেবল সেই টের পাচ্ছে। রান্নাঘরের কাজ শেষ করে আড্ডা দেয়া তো দূর, সে হাহু’তাশ করে রুমের ভেতরেই হাঁটাহাঁটি করছে। ড্রয়িংরুম থেকে রুমে আসার পরেই ব্যাপারটা চোখে পড়েছে আলিফের! স্ত্রীর এই দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ, মলিন চেহারা তার খুব একটা ভালো লাগছে না। তাই কিছুক্ষণ চেয়ে বুঝতে না পেরে বলল,

-“বাড়িতে মেহমান রেখে তুমি অকারণ হাঁটাহাঁটি করছো কেন এখানে? যাও ওদের কী লাগে দেখো! কী সারাদিন ভাবো এত?”

ঠোঁট বাঁ’কা’লো ফারজানা! দৌড়ের উপর রুমের প্রত্যেকটা কোণা খুঁজছে সে। এবার মেজাজটা বেশিই চ’ড়ে গেল আলিফের! রাগ দেখিয়ে বলল,

-“কী খুঁজছো তখন থেকে!”

-“মাথা গরম করিও না তো! আমাকে আমার কাজ করতে দাও। বাড়িতে আর লোক নেই? মেহমানদের তারা কি আপ্যায়ন করাতে পারে না? সবসময় আমাকেই কেন লাগবে?”

অগ্নিমূ’র্তির ন্যায় চোখ দু’টোকে রাঙিয়ে ফেললো ফারজানা। ঠোঁটে ঠোঁট চা’পলো। ক’ড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সামনের মানুষটাকে বুঝিয়ে দিল, তার মেজাজ কতটা গরম হয়ে আছে। যে মেয়ে সংসারের যাবতীয় দিক নিয়ে দিনরাত ভাবে তার মুখে এমন কথা বড্ড বেমানান শুনালো। মুচকি হেসে স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে বলল,

-“শান্ত হও! চেঁচিয়ে কথা বলো না। তোমার যদি শরীর খারাপ লাগে বিশ্রাম নাও। নিজে থেকেই সংসারের সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছো! চাইলেও তোমার অনুমতি ছাড়া ওরা কিছু করতে পারে না। তোমাকে কতটা সম্মান করে বুঝতে পারছো?”

-“দরকার নেই এত সম্মানের। যাওতো সরো! ত্বোয়াকে গিয়ে বলো, চা-নাশতার ব্যবস্থা করতে! আমি একটু পর আসছি।”

আলিফ ঘাড় নেড়ে চলে গেল! ঝটপট মোবাইল বের করে নিজের মা’কে ফোন করলো ফারজানা। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নারীকণ্ঠে ভেসে এলো,

-“কীরে, কাজ হলো?”

-“না, মা! খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় যে গেল!”

-“খুঁজে পাচ্ছিস না, মানে কী! ভালো করে দেখ, কোথায় রেখেছিস!”

-“আমি তো ওখানেই রেখেছিলাম মা। ভেবেছিলাম সারার হাত লেগে জিনিসটা ওর উপরেই পড়বে। কিন্তু ওখানে তো তেলের টিন ছিল! বোতলটা ছিল না।”

-“তার মানে কেউ সরিয়ে দিয়েছে!”

-“কী যা তা বলছো! আমরা মেয়েরা ছাড়া রান্নাঘরে কেউ প্রবেশ করে না!”

-“তবে তেলের টিন কি পাখা গজিয়ে আপনা-আপনি উপরে উঠলো?”

-“বুঝতে পারছি না।”

-“ভালো করে খোঁজ। আর দু’দিনের ভেতর কাজে লাগা। মনে রাখিস, এটা কারও চোখে পড়লে তোর সংসারটা ভা’ঙ’তে বেশিদিন লাগবে না।”

-“ভয় দূর করতে তোমাকে ফোন করলাম, তুমি আরও ভয় পাইয়ে দিচ্ছো। রাখো ফোন, খুঁজে দেখি; পাই কি-না!”

ফোন কে’টে মায়ের কথাগুলো একমনে ভেবে চলেছে ফারজানা। গতকাল বাইরে বের হওয়ার অজুহাতে মায়ের সাথে দেখা করে জিনিসটা এনেছিল। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে শেলফের উপরে তুলে রেখেছিল সেটা। উদ্দেশ্য ছিল, মাইসারার ক্ষ’তি করা। অথচ তার রাখা জিনিসটা মাত্র কয়েক ঘণ্টায় হাওয়া! এই ব্যাপারটাই পুরোপুরি বোধগম্য হচ্ছে না তার। মনে হচ্ছে কোথাও একটা ভুল হয়ে গেছে। অতি সুক্ষ্মভাবে কাজ করতে গিয়ে মারাত্ম’ক ভুল করে ফেলেছে সে। এই ভুল শোধরানোর কোনো উপায় তার জানা নেই। যদি বাড়ির কারও চোখে পড়ে, তবে মাইসারার বিদায় হওয়ার বদলে তারই বিদায় ঘণ্টা বেজে যাবে। ভয়ে, আতঙ্কে রীতিমতো অন্তরাত্মা কাঁপছে তার। তবুও মনে পড়ছে না কিছু!

*****

শুক্রবার থাকায় পুরুষরা সবাই একসঙ্গেই জুম’আর সালাত আদায়ে মসজিদে চলে গেলেন। এরমধ্যে অনিকের সাথে মাইসারার কথা হয়নি, দেখাও হয়নি! সেই যে লুকোচুরি খেলা চলছে দু’জনার মাঝে, এই লুকোচুরি খেলাটাকেই বাঁচিয়ে রাখতে চাইছে যেন দু’জনে। মাইসারা তো কাজের ছুঁতোয়ও সামনে আসে না। অনিকও কথা বলার প্রয়োজন মনে করছে না। তবে একটা বিষয় খুশির যে, মাইসারা অমত করেনি! অনিক প্রথমে ভেবেছিল, সানভির কারণে কোনোভাবে না বলতে পারে। কিন্তু যখন কনের দিক থেকে কোনো প্রকার অসম্মতিসূচক বাক্য আসলো না তখন কিছুটা স্বস্তি অনুভব করলো সে। বুঝতে পারলো, অতীতের ভুল থেকে সে পা’লা’তে চাইছে। কতটা পারবে কে জানে! তবে অনিক তার সাধ্যমতো চেষ্টা করবে, মেয়েটাকে ভালো রাখার।

বয়ঃস’ন্ধিকাল সময়টা বড্ড অবুঝ! এই সময় কারও ম্যাচিউরিটি বাড়ে, আবার কেউ কেউ আবেগী হয়ে ভুল পথে এগোয়! সময় পেরোনের সাথে সাথে মানুষ বুঝে সে ভুল পথে হাঁটছিল, জীবন তাকে সঠিক মানুষ চিনায়নি। চিনায়নি সঠিক ভালোবাসা! তাই একটা সময় মনের ডাকেই মন দেয়া-নেয়ার পথে নেমেছিল সে। যখন মানুষটা চলে গেছে, তখনই বিবেক তাকে বুঝিয়েছে, স্বার্থ যতক্ষণ বেঁচে থাকে ততক্ষণ ভালোবাসাও থাকে। স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে অনুভূতিরাও ফিঁকে হয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া এই সমস্ত অনুভূতি মানুষকে প্রতি পদে পদে যন্ত্রণা দেয়! মাইসারাকেও দিয়েছিল। যে যন্ত্রণা আড়ালে থেকেই অনুভব করতো অনিক! অথচ প্রশ্ন করতো না, জানতে চাইতো না! শুধু উপলব্ধি করতো, ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণা, একাকীত্বের যন্ত্রণা মানুষকে কতখানি নীরব, পাথর, নিষ্প্রাণ বানিয়ে দেয়! এতসব উপলদ্ধি মনের কোথাও জাগ্রত হওয়ার পর, মাইসারাকে হরদম বুঝাতো অনিক! প্রয়োজনে নিজের জন্য বাঁচো, নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য বাঁচো, তবু কখনো অতীতের জন্য আফসোস করো না। একটা মানুষের মনকে শক্ত করতে তাকে বকাঝকা করে নয়, যত্ন করে বুঝাতে হয়! আজও অনিকের চোখে ভাসে, সেদিনের সেই কান্নামাখা মুখশ্রী! কী হৃদ’য়বিদা’রক মুহূর্ত ছিল সেটা! চাইলেও ভুলা যায় না! ভুলতে পারে না সে। পারবেও না কোনোদিন!

এইসব টুকরো টুকরো মুহুর্তের স্মৃতিকথা ভাবতেই লজ্জা এসে ভর করে তার সর্বাঙ্গে। যার কারণে অনিকের সামনা-সামনি আসতে পারে না মাইসারা! চোখে চোখ রাখা যাবে না যে! নয়তো মানুষটা মুহূর্তেই টের পেয়ে যাবে, ভাঙ’নের তীব্র আঘা’ত আজও তার হৃদয়ে কাঁ’টা’র মতোই আট’কে আছে! নিজের একাকীত্ব সময়ের খণ্ডাংশ ভাবতে ভাবতেই ব্যথার জায়গায় ঔষধ লাগাচ্ছিল মাইসারা! না চাইতেও মনে পড়ে গেল, সেদিনের সেই দুর্ঘটনা! যেদিন প্রথম অনিকের বাইকে চড়ে কলেজের ক্যাম্পাসে এসেছিল! ফেরার পথেই অ্যাক্সি’ডেন্ট হয়! সড়কে মাথা ঠু’কে অনেকটা ব্যথা পায় মাইসারা। সেই ব্যথা নিয়েও উড়াধু’ড়া লা’তি মে’রে’ছিল বাইকে! বলেছিল,

-“ভে’ঙে ফেলো এটা! ঠিকঠাক চলে না। কতটা ব্যথা পাইয়ে দিল। আর জীবনেও যদি তোমার এই ভাঙাচো’রা বাইকে উঠি!”

ব্যথাতে তার দৃষ্টি নেই, কষ্ট নেই, অথচ রাগ ছিল শুধুমাত্র বাইকের উপর। অনিক সেই দৃশ্য দেখে মারাত্ম’ক ভ্যা’বাচে’কা খেয়ে গিয়েছিল! কী পরিমাণ বাচ্চামো করেছিল মেয়েটা! অথচ আজ সব স্মৃতি। শুধুই স্মৃতি! তবুও এসব স্মৃতিই সুন্দর, জীবন্ত! এরপর মাইসারাকে নিয়ে সোজা হসপিটালে গিয়ে প্রয়োজনীয় ট্রিটমেন্টও করিয়েছিল! সেই ঘটনার পর থেকেই বাইকে উঠতে ভয় পায় মাইসারা। ভাবনারত চেহারা নিয়েই আনমনে হাসলো সে! সামনে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। নামিরা তার হাসিমাখা মুখ দেখে বলল,

-“একা একা হাসছো যে! মনের পর্দা সরিয়ে কেউ উঁকি মে’রেছে বুঝি?”

-“কী যা তা বলছো!”

লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিল মাইসারা! ভাবনাতে সে এতটাই মগ্ন ছিল, ঘরের ভেতর যে কেউ আসতে পারে এটাই ভুলে গিয়েছিল! কোনোমতে ঔষধ লাগিয়ে ফার্স্টএইড বক্সটা তুলে রাখলো। নামিরা বিছানায় বসে চারপাশে চোখ বুলালো। পরিপাটি, সাজানো-গোছানো ঘর দেখে বলল,

-“তুমি কি বরাবরই এমন?”

-“কেমন?”

বুঝতে না পারায় প্রশ্ন করলো মাইসারা! নামিরা চোখের ইশারায় পুরো রুমের দিকে ইঙ্গিত করে বলল,

-“একদম শান্ত অথচ খুব পরিপাটি! মনে হচ্ছে, সবকিছু অনেক যত্ন করে সাজিয়েছো। একটা সংসার যেভাবে মেয়েরা যত্ন করে সাজায়, সেরকম।”

-“আমি এমনই! পরিপাটি থাকতে পছন্দ করি। একটা সত্যি কথা বলবে?”

নামিরা ঘাড় নাড়লো! মাইসারা তার পাশে এসে বসলো। কোনো দ্বিধা সংকোচ ছাড়াই প্রশ্ন করলো,

-“যা তোমার হওয়ার কথা, তা আমাকে কেন দিচ্ছো? আমি কি তাকে পাওয়ার যোগ্যতা রাখি?”

নামিরাও কম যায় না। কথার ভাববাচ্যে মাইসারা যে অনিকের কথা বুঝিয়েছে তা বুঝতে দেরী হলো না তার। সে-ও একইভাবে জবাব দিল,

-“তোমার স্বপ্ন বাঁচানো, তোমাকে সুন্দর একটা পরিবার দেয়া! একজন মানুষ, যে তোমার একমাত্র ভরসা! যাকে ছাড়া তুমি প্রতিটা পদক্ষেপে একা। যে একান্তই তোমার, তাকে কে’ড়ে নিয়ে অভিশা’প গ্রহণ করবো নাকি?”

-“সে আমার?”

হাজারও কৌতূহল, অজানা ভয়, দুঃশ্চিন্তা, বেদনা এসে ভর করলো মাইসারার চোখেমুখে! প্রশ্নটা করেই চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে সে। নামিরা তার এই গভীর ভাবনারত চেহারা দেখে গালে হাত রাখলো। মাথা নেড়ে বলল,

-“হ্যাঁ! সে তোমার! সবসময়ের জন্য। শুধু তুমি উপলব্ধি করতে পারছো না।”

-“মানে?”

মাইসারার ভেতরটা কেঁপে উঠলো! অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো সে। নামিরা বলল,

-“বোকা মেয়ে! সব কথা মুখে বলতে হয়? তুমি নিজেই অনুভব করো। তাকে হারিয়ে যেতে দিও না! আঁকড়ে ধরো, দেখবে সে তোমাকে সুন্দর একটা জীবন উপহার দিয়েছে!”

তাকে ঘিরে অনিকের এতদূর এগিয়ে আসাটা যেন একটা কথাকেই ইঙ্গিত করে। কতটা যত্নের সাথে অনিক তাকে এই অবধি এনে দাঁড় করিয়েছে, তা উপলব্ধি করেই তো হৃদস্পন্দন থেমে যাচ্ছে তার। এখানে শুধু দায়িত্ব কর্তব্য নেই, বিশাল অথচ স্বচ্ছ, সুন্দর এক অনুভূতি ঘিরে আছে! আসলেই কি তাই? যদি হয়, তবে অপ্রকাশ্য কেন? কেন সেসব অনুভূতি গোপন রেখেই নামিরাকে জীবনে জড়াতে চেয়েছিল সে? কেন? এতগুলো প্রশ্নের কি আদৌ আছে?

*****

দুপুরের খাবার শেষ করে সবাই বেশ জমিয়ে আড্ডা দিয়েছে! দু’জন মেয়ে একসাথে হলেই কথার খই ফুটে তাদের মুখে। অথচ বাড়িতে এই মুহূর্তে চারজন মেয়ে। যেখানে এতগুলো মেয়ে আছে, সেখানে আড্ডা হবে না, তা-ও হয়? একেক জনের একেকটা হাসির গল্প, দুঃখ, কষ্ট সবই টুকটাক শেয়ার করা চললো। ফারজানাও সেই সময়টা তাদের সাথেই কা’টালো। যদিও ভেতরে তার মারাত্ম’ক অস্থিরতা ছিল, তবুও সেটাকে গোপন রেখেই আড্ডার পরবর্তী সময়টাকে উপভোগ করলো সকলের সাথে। অনেকদিন পর বাড়িতে এমন আড্ডা আর হৈচৈ’য়ে পুরো সময়টা যেন আনন্দের জোয়ারে ভে’সে গেল! বিকেলবেলা দু’জনে বিদায় নিয়ে চলে গেল! সেই থেকে মাইসারা ফাঁক খুঁজছে, অনিকের সাথে প্রয়োজনীয় কিছু কথা বলার জন্য। যদিও সামনে যেতে, মুখোমুখি দাঁড়াতে সংকোচ হচ্ছে তার, তবুও ভেতরটা ছটফট করছে। খুব জানতে ইচ্ছে করছে, কেন সে জেনেশুনে আ’গু’নে ঝাঁ’প দিতে যাচ্ছে?

একটা মানুষ আর কত পারে, নিজেকে আ’ড়া’ল করে রাখতে! যার বাইরের আচরণে কোনোদিনও প্রকাশ পায়নি তার ভেতরের অনুভূতি, হুটহাট তার সম্পর্কে এমন কিছু জানলে অস্থিরতা তো বাড়বেই, সেইসাথে বাড়বে দুঃশ্চিন্তা! অনিক যে সব জানে! সানভির সাথে রিলেশনে জড়ানোর পর থেকে প্রতিটা কথাই অনিক আর ত্বোয়ার সাথে শেয়ার করতো সে। ধারণা ছিল না, সানভিও তার বাবার জায়গায়ই নিজেকে দাঁড় করাবে! যদিও সেটা কেবল ভালোবাসাই ছিল, সেখানে ঘর বাঁধতেই হবে এমন কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না। তবুওতো, মন যাকে একবার ভালোবেসে ফেলে তাকেই তো সারাজীবনের সঙ্গী হিসেবে পেতে চায়। সে-ও তাই চেয়েছিল। অথচ তার সব চাওয়া দূরত্বের কাছে হে’রে গেল। মিথ্যে হয়ে গেল সব। মিথ্যে হয়ে গেল, প্রিয়জনকে ঘিরে মনের কুঠিরে বাঁচিয়ে রাখা শত স্বপ্নের গল্প!

মাইসারা শত চেষ্টাও অনিকের সামনে দাঁড়াতে পারছে না। একদিকে মুখোমুখি হওয়া, চোখাচোখি হওয়ার ভয়, অন্যদিকে কিছু অকারণ দুঃশ্চিন্তা। সব মিলিয়ে মারাত্ম’ক চা’পে সময় কাটাচ্ছে সে। একবার মনে হচ্ছে, আলোচনাটা করা উচিত! আবার মনে হচ্ছে, হোক না যা হতে যাচ্ছে! ক্ষ’তি কী? ভরসা করার মতো কে আছে আর? যত সহজ করেই ভাবতে চায়, ততই সব কঠিন হয়ে যায়। তবুও কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় না! রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে অনেক চেষ্টার পর সামান্য সাহস সঞ্চয় করে পা টিপে টিপে ড্রয়িংরুমের দিকে এগোলো সে। আরমান সাহেব তখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। ফারজানা, নাহিয়ান, আলিফ কেউ-ই নেই সেখানে। তবে ত্বোয়া আর অনিক রিমোট নিয়ে রীতিমতো যু’দ্ধ শুরু করেছে। একজন দেখবে রিয়েলিটি শো, অন্যজন দেখবে খেলা! দু’জনের এই ঝগ’ড়া আর রিমোট টানাটানির দৃশ্য দেখে সামনে দাঁড়িয়ে রইলো সে। এক সময় সে-ও ত্বোয়ার সাথে রিমোট নিয়ে যু’দ্ধ করেছে। হোস্টেলে যাওয়ার পর এই দৃশ্য এবং সময় দুটোই খুব মিস করে সে। দু’জনের এই ঝগ’ড়া দেখে সহ্য হলো না তার।

চিল যেমন সুযোগ পেলে মোরগছানা নিয়ে ফুড়ুৎ করে উড়ে পালায় তেমনি করে আচমকা টা’নে রিমোটটা নিজের কাছে নিয়ে আসলো মাইসারা! সঙ্গে সঙ্গে টেলিভিশন অফ করে সবগুলো সুইচ বন্ধ করে রিমোট জায়গামতো করে কোমরে হাত রেখে দু’জনের দিকেই রাগী চোখে তাকালো! ত্বোয়াকে ইশারায় বুঝালো,

-“তুই এখান থেকে যা, আমার দরকারি কিছু কথা বলার আছে!”

ঠোঁট চেপে হাসলো ত্বোয়া! মুখে হাত রেখে হাই তুলতে তুলতে সোফা ছাড়লো। মাইসারার গলা জড়িয়ে টুপ করে গালে চুমু খেয়ে বলল,

-“আমার খুব ঘুম পাচ্ছে ভাইয়া। শুভরাত্রি! তুমিও বেশি রাত জেগো না। সকালেই তো মেহমানরা আসতে শুরু করবেন। কত কাজ বলো তো!”

খোঁ’চাটা নীরবে হজম করলো মাইসারা! তবে মুখে কিছু বললো না। ত্বোয়া যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনিকও উঠে দাঁড়ালো! পা বাড়ানোর আগেই পিছন থেকে একটা মিষ্টি আওয়াজ শুনে থেমে গেল তার পা। ভীরু চোখে তাকিয়ে মাইসারা বলল,

-“তোমার সাথে কিছু কথা ছিল! শুনবে?”

অনিক মাথা নাড়লো! পিছু ফিরে আবারও সোফায় বসলো! মাইসারাও দূরত্ব বজায় রেখে আলাদা সোফায় বসে নিজেকে পুরোদমে গুছিয়ে নিল। আপ্রাণ চেষ্টা করলো, নার্ভাস না হওয়ার। তবুও কণ্ঠস্বরে জড়তা নেমে এলো তার। অনিকের চোখ তা এড়ালো না, বরং খুব দ্রুতই সে ধরতে পারলো মেয়েটার নার্ভাসনেস! বলল,

-“সানভির ব্যাপারে কিছু বলতে চাস?”

-“না!”

-“তবে? ঘাবড়াচ্ছিস কেন?”

উপরে সিলিংফ্যান চলছে। তবুও মাইসারা ঘেমে গেছে পুরোটা। চুলের গুড়িতে জমে থাকা ঘাম কপাল বেয়ে ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে পড়ছে। উড়না দিয়ে আলগোছে ঘাম মুছে নিল সে। বলল,

-“আমরা তো কাজিন তাই না?”

-“তোর কি মনে হয়?”

-“উঁহু, আসলে কাজিনদের বিয়ে মানে সাইন্স বলে, সরাসরি কাজিনদেরকে বিয়ে করা উচিত নয়! এতে ফিউচারে…!”

-“ফিউচারে কী হয়?”

কথার মাঝখানেই প্রশ্ন করলো অনিক! মাইসারার তখন হাউমাউ করে কাঁদার অবস্থা। একেই তো কথাটা বের হচ্ছে না, তার মধ্যে সরাসরি প্রশ্নের জা’লে ফেঁ’সে যাওয়াতে নিজের উপর রীতিমতো ক্ষু’ব্ধ সে! দাঁত কিড়মিড় করে উঠে দাঁড়িয়ে সোফায় থাকা কুশনটা অনিকের দিকে ছুঁ’ড়ে মা’র’লো। রাগ মেটাতে ভুলবশতই সামনে থাকা চুলগুলো টে’নে ধরলো! বলল,

-“ফিউচারে আমার মাথা হবে! মাথামো’টা, স্টু’পিড, ভাজা মাছটাও উলটে খেতে জানে না! যাও, নিজের রুমে যাও। ঘুমানোর আগে গুগলটা ঘে’টে ঘুমাও!”

-“আরে ছাড়, চুলে ব্যথা পাচ্ছি তো!”

-“ওহ, সরি! খেয়াল ছিল না।”

অনিকের মনে হলো, বহুদিন পর এমন একটা দিন উপভোগ করছে সে! মাইসারার আসল কথা সে ধরতে পেরেছে। গুগল ঘা’টার প্রয়োজন হবে না। এই সম্পর্কে ধারণা আছে তার। তবুও মেয়েটার মুখ থেকে শুনতে আগ্রহী শ্রোতার মতো তাকিয়ে রইলো। কেমন লজ্জায় লাল হয়ে গেছে সে। যেন তার ফর্সা গালে কেউ ঠো’কা মে’রে’ছে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে ঝটপট সরে গেল মাইসারা। দৌড়ে পালালো রুমে। পিছন থেকে অনিক বলল,

-“ওসব নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করিস না সারা! যা হয়, ভালোর জন্যই হয়। ফিউচারে যা হবে, নিশ্চয়ই ভালো কিছু হবে! আর খারাপ হলেও আমাকে তো তুই চিনিস! আমি আমার দায়িত্ব, কর্তব্য থেকে এক-পা’ও সরবো না।”

ফিরে তাকানোর সাহস পেল না মাইসারা! ভয়ে হাত-পা কাঁ’প’ছে তার। দ্রুত রুমে ঢুকে দরজা আট’কে দিল। অনিক কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেললো! সে বুঝতে পেরেছে, কী বলতে এসে ফিরে গেছে মাইসারা। কী হবে ওতো ভবিষ্যতের চিন্তা করে, যদি কারও বর্তমানটাই ভালো না কা’টে! তবুও ভয় পাচ্ছে সে! সব ভুলে মেয়েটা ভালো থাকবে তো? এই একটাই দুঃশ্চিন্তা উঁকি মা’র’লো মনে। তাকে ভালো রাখার উপায় খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ভবিষ্যতে যা হয় হোক, তবু কেউ অতীত ভুলে বর্তমানকে নিয়ে ভালো থাকুক! আপাতত এইটুকু চেষ্টা সে মনে-প্রাণে করবে। বাকিটা ছেড়ে দিবে সময়ের উপর!

*****

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে