মনোহারিণী পর্ব-০৩+০৪

0
1258

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (৩)+(৪)

সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ভোরের যে অপরূপ সৌন্দর্য্য আছে তা উপভোগ করার ভাগ্য হয়তো সকলের হয় না। খুব ভোরে যারা ঘুম থেকে উঠে তারাই কেবল সেই স্নিগ্ধ সকালের মিষ্টি, মোলায়েম সময়টা উপভোগ করতে পারে। ফজরের আযানের পর যখন পাখির কলকাকলি পরিবেশটা ভরিয়ে তুললো তখনই ঘুম ভাঙলো মাইসারার। রাতে অনেক দেরী হয়েছিল ঘুমাতে! ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস হওয়াতে, রাতে ঘুমোতে দেরী হলেও নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম তার ভাঙবেই! আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বিছানা ছেড়ে ঝটপট ওঠে ওয়াশরুমে ঢুকলো সে। অজু করে ফজরের নামাজটা আদায় করে নিল! উড়না ভালোমতো পেঁচিয়ে ত্বোয়াকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটতে শুরু করলো! একটা সময় বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে চলে আসলো দু’জন!

এই গ্রামের শেষপ্রান্তে মনু নদী অবস্থিত! ছোটোবেলা মায়ের সঙ্গে এই নদীর পাড়ে কত ছোটাছুটি করেছে, অথচ আজ সেসব স্মৃতি! মা কাছে নেই, পাশেও নেই, হয়তো মনেও নেই! স্বা’র্থের কাছে সম্পর্ক আজ বড্ড তুচ্ছ হয়ে গেছে! পা ছড়িয়ে নদীর পাড়ে বসলো মাইসারা। টুকরো টুকরো মাটির দলা নদীর মাঝখানটায় ফেলতে শুরু করলো। মন ভালো করার সামান্যতম চেষ্টা চালানো বৈ বেশি কিছু নয়! ত্বোয়া নীরবে বোনকে লক্ষ্য করলো! কাঁধে হাত রাখতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। দু’হাঁটুর ভাঁজে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলো। ত্বোয়া বাঁধা দিল না। কিছুক্ষণ কাঁদলে মনটা হালকা হবে! তাই এখন তাকে কাঁদতে দেয়াই যুক্তিযুক্ত! কান্নার ভার কমাতে একটা সময় মুখ খুললো মাইসারা! বলল,

-“আমি তাদের কাছে বোঝা ছিলাম তাই না? দু’জন দুই প্রান্তে দিব্যি সুখে আছে। মাঝখানে আমার জীবনটা ঝুলন্ত সেঁতুর মতো হয়ে গেছে। সামনের পথটা এতটাই দূরে যে, একাকী গন্তব্যে পৌঁছানোর মতো সাহস নেই। আবার পিছনের পথটাও ভাঙাচো’রা! কোনদিকে যাব আমি?”

-“নিজেকে তুই দুর্বল ভাবলে সামনের পথে একাকী হাঁটতে পারবি না! তারা না থাকুক, আমরা তো পাশে আছি! বাবা, ছোটো ভাইয়া এই দুটো মানুষ যতক্ষণ তোর পাশে আছে ততক্ষণ তুই নিজেকে একা ভাববি না! তুই আমার থেকেও সাহসী, আমি এটা জানি। আগামীর পথ হয়তো কঠিন, তবে সাফল্য খুব বেশি দূরে নয়! এজন্য পিছনের সব কথা মন থেকে মুছে ফেলতে হবে! শুধু সামনের দিনগুলোতে কী করবি, কীভাবে চলবি সেটা ভাববি! অযথাই মনটাকে ভার করছিস তুই!”

আচমকাই ফোনের রিংটোনটা বেজে উঠলো! স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে দেখলো পরিচিত নাম্বার! কতদিন কল আসে না, কথা হয় না ওপাশের মানুষটার সাথে! অভিমানে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে সে। এতদিন পর কী মনে করে ফোন করলেন তিনি সেটাই ভেবে পেল না মাইসারা! দ্বিধাদ্ব’ন্দ্বে ভোগে একটা সময় ফোনটা রিসিভ করলো! ওপাশে আতঙ্কিত কণ্ঠস্বরে এক কিশোরের গলা ভেসে এলো!

-“আপু, একবার আসবে! শুনলাম তুমি নাকি বাড়ি এসেছো! মা খুব অসুস্থ! একবার দেখা করে যাও!”

বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলে সেই সৎ মায়ের সন্তান সৎ ভাই হয়! কিন্তু মা দ্বিতীয় বিয়ে করলে সেই ঘরের সন্তান কি আপন ভাই হয় না? নাকি সে-ও সৎ হয়! অন্য এক পুরুষের ঔরসজাত সে! এখানেই কি পার্থক্য? হিসেবটা বড্ড কঠিন মাইসারার কাছে। এত কঠিন হিসাবেও সে পা রাখতো না, যদি না এই ছেলেটা তাকে মায়ায় জড়িয়ে নিত! হোস্টেলে প্রতি মাসে তিন থেকে চার বার এই ছেলেটা তাকে এক নজর দেখার বাহানায় ছুটে যাবে। আপু বলে জড়িয়ে ধরবে। চাইলেও দূরে ঠে’লে দিতে পারে না সে! কিন্তু তার বাড়ি আসার খবর মাশফি জানলো কী করে! অনিক বলেছে? নাকি আরমান সাহেব নিজে! ভাবনা মিলাতে পারছে না সে। ওপাশ থেকে আবারও ভেসে এলো,

-“প্লিজ আপু! একবার আসো! মা সত্যিই খুব অসুস্থ!”

-“সময় পেলে যাব! রাখি?”

-“মায়ের সাথে কথা বলবে না?”

-“না! ছেড়ে যাওয়ার সময় প্রতিশ্রুতি দেননি তো তিনি। মেয়েটা বাড়তি চা’প ছিল কিনা! সামনের পথের বাঁ’ধা যে, তাকে তো খুব যত্নেই দূরে সরিয়ে দিয়েছেন! দূরত্ব যেখানে চিরস্থায়ী সেখানে দেখা করে কী লাভ ভাই! তবুও চেষ্টা করবো! যদি মন থেকে সায় পাই, যাব। নয়তো না। তাকে দেখার আফসোস যখন ছিল, তখন দেখতে পাইনি। কাছে ছুটে যেতে পারিনি। মা বলে জড়িয়ে ধরার অধিকার পাইনি। এখন কীসের টানে যাব বলবি?”

ফোন কে’টে আবারও ফুঁপিয়ে উঠলো মাইসারা। বাবা-মায়ের সেপারেশনেও এতটা কাঁদেনি সে। দূরত্ব আর আদর যত্নের অভাব এখন তাকে বুঝাচ্ছে, ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান হয়ে সমাজের উঁচু স্থানে আরোহণ করা কতটা কঠিন! শৈশব, কৈশোর থেকে একাকীত্ব, ল’ড়া’ই যার নিত্যদিনের সঙ্গী সে কীভাবে জীবনের পরিপূর্ণ স্বাদ উপলব্ধি করবে? যেখানে শৈশবেই দুই প্রান্তের দুটো হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে চলা মানুষগুলো দুদিকে চিরদিনের জন্য ছিঁটকে পড়েছে! মা তো সামান্য হলেও মাশফির মাধ্যমে খোঁজ রাখেন। জন্ম দিয়েছেন বলেই হয়তো নাড়িছেঁ’ড়া ধনকে অস্বীকার করতে পারেন না। কিন্তু বাবা! তিনি কি পারতেন না, মেয়েটার একটা খোঁজ রাখতে? কতশত প্রশ্ন, অভিমান, অভি’যোগ এসে ভিড় জমায় দু’চোখের পাতায়। একটা সময় ভারি আকার ধারণ করে অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে মাটির বুকে। কেউ দেখে না তা। টেরও পায় না। একাকী কতটা যন্ত্র’ণা লালন করে দিন অতিবাহিত করছে সে।

*****

নাশতা শেষে দুই ভাই যে যার কর্মক্ষেত্রে চলে গেল! মাইসারা তার চাচ্চুর রুমে বসে জায়গাজমির হিসাবনিকাশ দেখছিল! সেই দশ বছরের ছোট্ট মেয়েকে ফেলে বিলেত পাড়ি জমিয়েছিলেন তার বাবা। শুধু বিলেতে গিয়েই ক্ষান্ত দেননি! সেখানে নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে দ্বিতীয় সংসার শুরু করেন খুব অল্প সময়ের মধ্যেই। বাড়িতে জানানোর পর এই বিষয়টা ভয়া’নক প্রভাব ফেলে আঞ্জুমান আরা’র মনে। তিনি সেটা মানতে পারেননি সহজে। কোনো নারীই পারে না স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে মন থেকে গ্রহণ করতে, পারে না সতীনের সংসার করতে! অভিমানে বাবার বাড়ি চলে যান তিনি। সেবার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু বেশিদিন সামলে রাখতে পারেননি। একরকম রাগে, জে’গে, অভিমানে সংসারে ভা’ঙ’ন টে’নে আনেন। ডিভোর্সের কাজকর্ম কমপ্লিট হওয়ার বেশ কিছু মাস পর মাইসারার নানাভাই তার মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের আয়োজন করেন। বাচ্চা মেয়েটাকে ফেলে আবারও নতুন সংসার সাজান তিনি। বাধ্য হোন মেয়েকে দূরে সরিয়ে দিতে। এতে করে বাচ্চা মেয়েটার পড়াশোনায় প্রচণ্ড ক্ষ’তি হওয়া শুরু হয়। এসব পরিস্থিতির নানা ঝা’মে’লা দেখে আরমান সাহেব একদিন মাইসারাকে দেখতে সেখানে যান। বাবা-মা ছাড়া নানা-নানুর সংস্পর্শে কয়েকটা মাস বেশ অসুখের সাথেই কাটিয়েছে সে। তাঁকে দেখে যখন রক্ত আপনা হতেই কোলে এসে আশ্রয় নিল, তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন এই মেয়েটাকে আগলে রাখবেন। এরপর থেকে মাইসারা তার বড়ো মায়ের ভালোবাসা পেয়েই বড়ো হয়েছে। যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন আদরের ভাগে একফোঁটাও কম পড়েনি। তাঁর মৃ’ত্যুর পরেই যতসব কষ্ট উঁকি মা’রছে জীবনে!

কাগজপত্রের হিসাব আর জমিজমার ভাগ বেশ যত্ন সহকারে বুঝিয়ে দিচ্ছেন তিনি। কারণ তিনি জানেন, তার ভাই আর কোনোদিন বাড়িতে পা রাখবে না। এজন্য তার ভাগের সম্পত্তিটুকু মাইসারার নামেই লিখে দিতে চান। পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে এখন, মেয়েটার নিজস্ব শক্ত, পাকাপোক্ত একটা আশ্রয় দরকার! নইলে সামনের পথে অনেক বাঁ’ধা আসবে তার। সব কাগজের দাগ, সীমা আর হিসাব দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মাইসারা। বলল,

-“ভাবীকে রাগাতেই ওসব বলেছি চাচ্চু! আমার কোনো সম্পত্তি চাই না। শুধু তোমরা পাশে থেকো।”

-“আমি বুঝিরে মা! কিন্তু তারপরেও তোর ভাগটা তোর নামে পুরোপুরি রেজিস্ট্রি করে নিতে পারলে ভালো। ভবিষ্যতে কোনো ঝা’মে’লা আসবে না আর অংশীদারও আসবে না।”

-“থাকুক সব তোমার নামেই। এমনিতেও আমার পড়াশোনার পিছনে অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। মনে আছে, শেষবার টাকা জমা দিতে গিয়ে জমি বিক্রি করতে হয়েছিল? দরকার নেই এত ভাগের! আমার জন্য অল্প রেখে দিও, যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই! বেশি কিছু লাগবে না চাচ্চু! তুমি বরং ত্বোয়ার একটা ব্যবস্থা করো। ওর জন্য ভালো পাত্র…!”

কথার মাঝখানে থেমে গেল মাইসারা। কী মুরব্বিদের মতো পাকা পাকা কথা বলছে সে। লজ্জায় দ্রুত মুখ নামিয়ে নিল। আরমান সাহেব তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

-“সে তো দেখবোই। তার আগে তোর জন্যও তো ভালো পাত্রের খোঁজ দরকার!”

-“আমি এখনো ওসব নিয়ে ভাবছি না চাচ্চু! আমার অনেক দূর এগোনো বাকি! আমি পৃথিবীকে দেখিয়ে দিব বাবা-মায়ের সাপোর্ট ছাড়াও সফলতাকে আঁকড়ে ধরা যায়!”

কথা শেষ করে নাহিয়ানকে সাথে নিয়ে স্কুলের দিকে রওনা দিল মাইসারা। ত্বোয়া ভার্সিটিতে চলে গেছে। ফিরবে দুপুরের পর। এতটা সময় ঘরে একাকী বসে থাকা ভীষণ চা’পের তার জন্য। তাছাড়া অনেকদিন পর গ্রামের আলো-বাতাসকে উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছে সে। স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে মেখে পুরো গ্রাম ঘুরে দেখা বাকি! এটাই সুযোগ, নাহিয়ানকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে তার পুরনো সইয়ের বাড়িতে যাবে সে। বাড়িটা এই গ্রামেই। স্কুলে যাওয়ার পথেই পড়ে।

নাহিয়ান মাত্র ক্লাস ওয়ানে পড়ে। রোজই কেউ এসে তাকে স্কুলে দিয়ে যায়, আবার বাড়ি নিয়ে যায়। আজ সেই দায়িত্বটা মাইসারাই নিল। ক্লাসে তার পরিচিত বন্ধুর পাশে তাকে বসিয়ে সইয়ের বাড়ির পথে হাঁটা ধরলো সে। পাশের খামার থেকে তখন একগাদা হাঁস নিয়ে রাস্তার মাঝখান দিয়ে বড়ো পুকুরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে গ্রামের এক যুবক সানোয়ার! হাঁস দেখে মাইসারা সেগুলোর পিছু পিছু ছুটলো। ইচ্ছামতো এদিক-সেদিক দৌঁড়িয়ে হাঁসের দলকে এলোমেলো করে দিল। সানোয়ার হাতে থাকা বাঁশের কঞ্চি নিয়ে তে’ড়ে আসলো মাইসারার দিকে! তা দেখে চঞ্চল তরুণীর মতো লাফঝাঁপ মে’রে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে সইয়ের বাড়িতে ঢুকে পড়লো সে। পিছন থেকে সানোয়ার বলল,

-“আজকে যদি আমার একটা হাঁস হারায় না সারা, তোর খবর আছে!”

-“ক’চু করবা তুমি আমার! ধ’রো তো আগে!”

তাকে বু’ড়ি আঙুল দেখিয়ে জিব বের করে ভেঙ’চি কে’টে দৌড়ে পালালো মাইসারা। সানোয়ার তড়িঘড়ি করে হাঁসের হিসাব করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ঠিকঠাক না হলে আবারও প্রথম থেকে হিসেব করছে সে। বার বার মনে হচ্ছে, কোথাও ভুল পথে তার দু’চারটে হাঁস হারিয়ে গেল কিনা! মাইসারার দিকে তার আর খেয়াল রইলো। দ’স্যি মেয়েটা দিব্যি নাচতে নাচতে ততক্ষণে তার সইয়ের বাড়িতে পৌঁছে গেছে!

*****

ব্যাংক থেকে ফিরে অনিক আর ফ্রেশ হয়নি, দু’জনকে তাড়া দিয়ে ঝটপট বের হওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। যাতায়াতের জন্য সবসময়ই বাইক ব্যবহার করে অনিক, কিন্তু দু’জনকে একসাথে বাইকে তোলা রিস্ক। তাছাড়া মাইসারা ভুল করেও আর অনিকের বাইকে উঠে বসবে না। একবারই উচিত শিক্ষা হয়ে গেছে তার। সেই ঘটনা কোনোদিনও ভুলতে পারবে না সে! বাড়ি থেকে বেরিয়ে কয়েক’পা হাঁটলেই মূল রাস্তা। যার জন্য খুব একটা কষ্ট হয় না এই এলাকার মানুষের। এসবে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা অভ্যস্ত! অভ্যস্ত অনিক, মাইসারা, ত্বোয়াও! হাঁটতে হাঁটতেই মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিল অনিক। আজই, হঠাৎ করেই একটা প্রাইভেট গাড়ির অভাব টের পেল তার মন।

হিসাবটা দাঁড় করিয়ে সিদ্ধান্ত পাকা করলো, কয়েকদিনের ভেতরেই একটা গাড়ি কিনবে। ব্যাংকে যা টাকা আছে তাতে হয়ে যাবে নিশ্চিত! নাহলে বাবা তো আছেনই! তবুও এই বয়সে বাবার কাছে চাইতে ভীষণ লজ্জা লাগে অনিকের। বুঝ হওয়ার পর থেকে নিজের পকেট খরচা সে নিজেই চালায়! পড়াশোনার ফাঁকে প্রচুর টিউশনি করিয়েছে। অল্পস্বল্প টাকা ব্যাংকে জমিয়েছে। মাইসারা আজও জানে না, তার ডাক্তারি পড়াশোনার পিছনে এই পর্যন্ত যত টাকা ব্যয় হয়েছে, সবই অনিক একা ঢালছে। এটা অবশ্য অনিকের ব্যাংকে জব হওয়ার পর থেকেই। এর আগ পর্যন্ত আরমান সাহেবই মাইসারার সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। এরপর সেটা অনিকই দেখাশোনা করতো! যেন বাবার কাঁধটা কিছুটা হালকা হয়! কিন্তু মেয়েটা জানে জমি বিক্রির টাকাতেই তার পড়াশোনা এগোচ্ছে, অথচ জমিটা বিক্রি হওয়ার আগেই মাঝপথে আটকে দিয়েছিল অনিক। যদিও মাইসারার বাবা প্রতি মাসে মেয়ের জন্য টাকা পাঠান। অভিমানে সেই টাকাতে হাতও দেয়নি মেয়ে, দিবেও না কোনোদিন। মাসে মাসে টাকা পাঠালেই কি মেয়ের প্রতি বাবার সব দায়িত্ব পালন হয়ে যায়? আর কোনো দায়িত্ব নেই? রক্তের টান নেই? পিতৃত্বের অধিকার নেই? সবই কি তবে তুচ্ছ? এজন্যই তার ক্রেডিট কার্ডটা সে আজও অনিকের কাছেই গচ্ছিত রেখেছে! ভুলবশত সেই কার্ডের কথা মাথায়ও আনে না মাইসারা। কতশত ভাবনায় ডুবেছিল অনিক! মূল রাস্তায় এসে উভার পেয়ে যাওয়াতে বড্ড সুবিধা হলো। তিনজনে সেই উভারে উঠে মূল শহরে এসে উপস্থিত হলো। যেখানে আসতে তাদের আধঘণ্টা সময় ব্যয় হয়েছে মাত্র!

শপিংমলের কাছেই নামিরা ওদের সবার জন্য অপেক্ষা করছিল! তিনজনকে দেখে হাত বাড়িয়ে দুইবোনকে আগে জড়িয়ে ধরলো সে। অনিক তখনো নিজস্ব ভাবনাতে বিভোর ছিল! তার টুকরো টুকরো ভাবনায় অতীতের ছোটো ছোটো ঘটনা ঘুরপাক খাচ্ছে! বহুদিন পর অনুভব করলো, আজ সে মা’রাত্মক সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। আদৌ বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে তো? হাজারও চিন্তাভাবনার দৌড় থামলো নামিরার হাতের চি’মটি খেয়ে! রাগ হলো। অস্ফুটস্বরে ধমক দিল। বলল,

-“ফা’জি’ল!”

নামিরার দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙানোর চেষ্টা করলো অনিক! মেয়েটার হাসি দেখে সব রাগ উবে গেল তার। এই মেয়েটার উপর একফোঁটাও রাগ আসে না তার। তবুও মাঝেমধ্যে রাগ প্রকাশ করা উচিত মনে করে সে। ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বলল,

-“কখন এলে?”

-“বেশিক্ষণ হয়নি! আগে কি কোথাও বসবো? নাকি মলে ঢুকবে?”

হাত উলটে ঘড়ি দেখলো অনিক। বলল,

-“শপিং শেষ করো আগে! তোমাদের তো পছন্দ করতে গিয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফুরিয়ে যাবে! তবুও কেনাকাটা শেষ হবে না। আড্ডা পরেও চলবে। কিন্তু আমার দরকারি কাজ আছে! আমি বোধহয় বেশিক্ষণ সময় দিতে পারবো না।”

বকবক করতে করতেই শপিংমলের ভেতরে প্রবেশ করলো চারজনে। ত্বোয়া গলা নামিয়ে কিছু একটা আলাপ করছে নামিরার সাথে। মাইসারা পাশে থাকলেও তার সেদিকে দৃষ্টি নেই। সে একমনে কিছু ভাবছে। একটা সময় জামাকাপড় আর প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো নামিরা! মাইসারাও শাড়ি, জামা বেছে বেছে নামিরার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে। কখনো তার গায়ে লাগিয়ে দেখছে ঠিকঠাক মানাচ্ছে কি-না! ওদের এসব পছন্দ করার ফাঁকে সামান্য দূরে সরে গেল অনিক। চুপিচুপি একটা নাম্বারে ফোন করলো। ফোনে হাত চেপে রেখে ফিসফিস করে বলল,

-“তুমি কয়েকটা মিনিট অপেক্ষা করো, আমি আসছি!”

ওপাশ থেকে কল কে’টে গেল। অনিক দ্রুত তিনজনের কাছে গিয়ে দেখলো একগাদা শপিং হয়ে গেছে। ক্রেডিট কার্ড দিয়ে বিল মিটিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে নামিরাকে বলল,

-“তুমি ত্বোয়াকে নিয়ে বাড়ি যেতে পারবে না? আমার একটু কাজ ছিল!”

-“কিন্তু তোমার সাথে আমার জরুরী কিছু কথা ছিল!”

-“পরে শুনবো। প্লিজ, লেট মি গোও! সারা তুই আমার সাথে আয়! কুইক…!”

নামিরা হতাশ হয়ে তাকালো! ত্বোয়া তার হাতে চাপ দিয়ে ফিসফিস করে বলল,

-“যা বলার তুমি বাবাকে বলো। আমার মনে হয় না ভাইয়াকে বলে কোনো লাভ হবে! শুনলে রাগও ঝা’ড়’তে পারে। চলো আমরা যাই!”

নামিরা ঘাড় নাড়লো। আসলেই জরুরী কথা বলার ছিল! কিন্তু তা আর হলো কই! অনিকের এত তাড়াহুড়োর কারণ খুঁজে পেল না সে। কয়েক সেকেন্ডে এত দ্রুত মাইসারার হাত টে’নে এই সীমানা ক্রস করেছে অনিক, যা দেখে অবাক হওয়া ছাড়া আর উপায় রইলো না তার। প্রত্যেকটা টার্নিং পয়েন্ট বেশ সাবধানেই পেরিয়ে আসছে সে। মাইসারার হাতটা তখনো তার হাতে আগলে আছে। মনে হচ্ছে, বেশ তাড়ায় আছে সে। কিন্তু এত তাড়া কীসের!

কয়েক মিনিটে মূল রাস্তা পেরিয়ে একটা উঁচু ভবনের নিচে আসলো। আবারও ফোন করলো কাউকে! উপরের নেমপ্লেটে লেখা নাম দেখে চমকে গেল মাইসারা। আতঙ্কিত চেহারায় বলল,

-“আমরা এখানে কেন?”

-“ভেতরে আয়, বলছি।”

খুব দ্রুততার সাথে তার হাত ধরেই সিঁড়ি টপকাচ্ছে অনিক। একটা সময় পাঁচতলায় এসে দাঁড়ালো। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো বারান্দায় জানালা দিয়ে একজন কিশোর বাইরের দৃশ্য দেখছে। তার চোখমুখে বেদনার চাপ যথেষ্ট! এক মুহূর্তের জন্য ভরকে গেল অনিক। ভয় ঢুকে গেল! দ্রুত তার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রাখতেই পিছু ঘুরে সেই কিশোরটা ঠোঁট চেপে কান্না আটকে জড়িয়ে ধরলো অনিককে। স্বান্তনা দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল সে। বলল,

-“এখন কী অবস্থা?”

ছোটো বাচ্চাদের মতো হাত উলটে চোখের পানি মুছলো মাশফি। মাইসারা স্তব্ধ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো! ওদের দু’জনার কথাবার্তা কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তার। পা দুটো তরতর করে কাঁপছে। রীতিমতো টলতে শুরু করেছে সে। তবুও জোরপূর্বক গুটি গুটি পায়ে তাদের দু’জনকে লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল সে। মাশফি বোনের দিকে তাকালো! মাইসারা কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বলল,

-“কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন তুই? হসপিটালে কেন এসেছিস? মা কি খুব বেশিই অসুস্থ? কোথায় মা, বল না ভাই!”

-“ডাক্তার হা’ল ছেড়ে দিয়েছে আপু! মা ভীষণ ছটফট করছে! বার বার তোমাকে দেখতে চাইছে। এজন্য সকালে তোমাকে বলেছিলাম, একবার আসার জন্য। আমি জানি তুমি আসবে না, তাই ভাইয়াকেই ম্যানেজ করতে হলো!”

মাইসারা জবাব দিল না। অভিমানে হাজারও বেদনা এসে ভর করলো তার চেহারায়। দু’হাতে মুখ ঢেকে নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। খুব বেশি দেরী হয়েছে কি ফিরতে? কতটা দেরী? জন্মদাত্রী মা আর কতক্ষণ পৃথিবীর বুকে শ্বাস টানবেন জানা নেই মাইসারার। শুধু সে জানে, মাকে দেখা প্রয়োজন! শেষবারের জন্য হলেও মা বলে ডাকা প্রয়োজন!

*****

চলবে…

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (৪)

অপরাধবোধ যখন একজন ব্যক্তির সর্বস্বে অনুভূতির সঞ্চার করে, তখন ব্যক্তি বেঁচে থেকেও মৃ’ত প্রায় হয়ে যায়! প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ তার অপরাধবোধ তাকে বুঝিয়ে দেয়, জীবনে সকল সিদ্ধান্ত সবসময় সঠিক হয় না! অনেক সময় জে’দ আর অহমি’কার ব’শে ব্যক্তি ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। সেই ভুল সিদ্ধান্তই তারা গোটা জীবনের অভিশা’প হয়ে দাঁড়ায়। এই ব্যাপারটাই এখন পুরোপুরি মিশে গেছে আঞ্জুমান আরা’র শিরা-উপশিরায়! তিনি চাইলেও আর পিছনের দৃশ্যকে ফিরে পাবেন না, চাইলেও ভুল শোধরানোর সুযোগ ফিরে আসবে না আর। যে ভুল একবার অতীতে হয়ে যায় এবং তা যখন বর্তমানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, অনুশো’চনা আর দূরত্বের দেয়াল তৈরী করে, তখন বিবেক তাকে বুঝায়, একমাত্র ক্ষমাই মুক্তির মাধ্যম! যদি মন থেকে মেয়ে আজ মা’কে ক্ষমা না করে তবে কি মায়ের অপরাধবোধ লাঘব হবে? এই অপরাধবোধ নিয়েই কি তিনি পরপারে পাড়ি জমাবেন?

দ্বিতীয় বিয়ের পর মাইসারার সাথে তার দূরত্ব তৈরী হলেও স্বামী সংসারে তিনি সুখের দেখা পান। সেই সুখের সংসারে হয়তো বাড়’তি জঞ্জা’ল মনে হয়েছিল তার প্রথম পক্ষের সন্তানকে। হয়তো প্রতিশোধের নে’শা’য় তিনি না চাইতেও অন্যা’য় করে ফেলেছেন নিজের নাড়িছেঁ’ড়া ধনের প্রতি। তবুও তো তিনি একজন মা! তাকে তো শত চাইলেও অস্বীকার করা যায় না।

ধীরপায়েই মায়ের কেবিনের ভেতর প্রবেশ করলো মাইসারা! ভদ্রমহিলা তখন নিশ্চুপ! দু’চোখ তার বন্ধ নয়, তবে দৃষ্টিও দরজার দিকে নয়! তিনি একদৃষ্টে জানালার ফাঁক দিয়ে খোলা আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘের ছুটে চলা দেখছেন। হসপিটালের এডমিট হয়েছেন এক সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহে সময়ে শরীর উন্নতির দিকে না এগিয়ে অবনতির দিকে প্রবলভাবে ধা’বিত হয়েছে। মস্তিষ্কে প্রচুর চাপ পড়েছে তার কারণ গত সপ্তাহেই মা’রাত্মক স্ট্রোক হয়েছিল তার। সেই স্ট্রোকে হাত-পা প্যারালাই’জড হয়ে গেছে! কণ্ঠস্বর থেমে গেছে শুধু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ না জবাবটাই দিতে পারেন! নাকের মধ্যে একটা নল ব্যবহার করা হয়েছে এবং নলের সাহায্যেই তরল খাবার খেতে পারেন তিনি। কর্তব্যরত নার্স নয়তো মাশফি এই দু’জনেই খাওয়ানোর দিকটা ভালোমতো নোটিশ করেন!

আধশোয়া হয়ে বেডে ছিলেন তিনি। গুটি গুটি পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। একটা স্নিগ্ধ, ঝলমলে আলোর মতো স্বচ্ছ, মায়াবী মুখটা চোখে পড়লো তার! ফ্যালফ্যাল করে গভীর দৃষ্টিতে সেই মুখবয়বখানি দেখলেন। মাশফির কাছে শুধু ছবিই দেখেছেন। সেই পনেরো বছর আগের নিষ্পাপ চেহারাখানি চোখে ভাসলো তার। চেহারায় কিঞ্চিৎ পার্থক্য টের পেলেন। আগে বাচ্চা ছিল এখন যুবতী! তার চোখদুটো টকটকে লাল! বুঝতে পারলেন, অভিমানী মেয়েটা কেঁদে বুক ভাসিয়েছে তবু মায়ের কাছে ছুটে আসতে পারেনি! হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকবেন সেই শক্তিটুকুও আজ তার নেই। মাত্র এক সপ্তাহে জীবন তাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে এটা ভেবেই দমব’ন্ধ অনুভূতির মুখোমুখি দাঁড়ালেন। মাইসারা চুপচাপ বেডের পাশে বসলো! কোনো কথা বললো না! কয়েক মিনিট বসে থেকে ডানহাতটা শক্ত করে ধরলো! টের পেল, মায়ের হাতের শক্তিটা অনুপস্থিত! তখন মাশফি ভেতরে প্রবেশ করলো! ভাইয়ের দিকে তাকাতেই মাইসারা ছোট্ট শব্দে উচ্চারণ করলো,

-“প্যারালাই’জড!”

মাশফি উপরনিচ মাথা নাড়লো! ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলে নিল মাইসারা! মায়ের হাতটা টে’নে গালে স্পর্শ করালো! বলল,

-“তুমি কাছে ডাকলে আমি নিশ্চয়ই ছুটে আসতাম মা! কেন ডাকোনি?”

আঞ্জুমান আরা জবাব দিতে পারলেন না। প্রতুত্তরে শুধু চোখের পানি ফেললেন। মাইসারা হাতের স্পর্শে মায়ের চোখের পানি মুছে দিল। দু’হাতে জড়িয়ে বুকে মাথা রাখলো। বলল,

-“একদম চিন্তা করো না। তুমি সুস্থ হয়ে যাবে। আমরা আরও উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করবো। প্রয়োজনে থে’রাপির ব্যবস্থাও করবো!”

বোনের কথা শুনে মাশফি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেবিনের বাইরে চলে গেল! এই এক সপ্তাহে সে অনেক ছোটাছুটি করেছে। তার বাবা, মামা কোনো হসপিটাল বাদ রাখেননি। এমনকি সিলেটের দামী হসপিটালেও উন্নত মানের ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করেছেন তবুও লাভ হয়নি! থেরাপিতে হাত-পা সচল হওয়ার কথা অথচ সেসব কিছুই হয়নি! উলটে শরীর দিনদিন দুর্বল হচ্ছে, খাওয়া-দাওয়া কমে যাচ্ছে! শুধু জুস, দুধ খেয়েই দিন কাটাচ্ছেন তিনি। প্রথম যখন স্ট্রোক হয় তখনই হসপিটালে নিয়ে আসা হয়, এখানকার ডাক্তাররা সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে সিলেটে রেফার করে দেন। যাওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্সেও দ্বিতীয়বার স্ট্রোক হয়! একসঙ্গে দু’বার শরীর এই ঝাঁ’কু’নি সামলাতে পারেনি। রিকোভার না করে শেষমেশ প্যারালা’ইজড হয়ে যায়! ডাক্তার তখনই বলে দিয়েছেন, এভাবে যতদিন তিনি বেঁচে থাকেন, সেভাবেই সব চলুক।

*****

রাত তখন দুটো! মাইসারা মায়ের পাশেই বসে আছে! তিনি এখন ঘুমাচ্ছেন। কিছুক্ষণ আগেই অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে ঘুম পাড়াতে পেরেছে সে। মেয়েকে কাছে পেয়ে ঘুম দূরে ঠে’ল’তে চেয়েছেন কিন্তু অসুস্থ দেখে জো’র করে মাইসারাই তাকে ঘুমাতে বললো। মাশফির বাবা এসে একবার দেখে গেছেন মাঝখানে তবে মাইসারার সাথে কথা হয়নি! যে লোকটা তার থেকে তার শেষ আশ্রয় কে’ড়ে নিয়েছে সেই লোকের সাথে কোনো কথা থাকতে পারে না! আলগোছে একপাশে সরে পড়েছিল সে। ভদ্রলোক ডাক্তারের সাথে টুকটাক কথা বলে চলে গেছেন। হাসপাতালে এখন শুধু তারা দুই ভাই-বোন! অনিককে রাতেই বাড়ি চলে যেতে বলেছে সে। যদিও অনিক থাকতে চেয়েছিল! অসুস্থ রোগীকে ফেলে যেতে মন সায় দিচ্ছিলো না তার। তবুও অযথা ভিড় এড়াতে চলে যায় সে। যাওয়ার আগে কয়েক মিনিট আঞ্জুমান আরা’র পাশে বসে যায়!

তিনি হয়তো কিছু বলতে চাইছিলেন, কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোয়নি! যতদিন তিনি ওই বাড়িতে ছিলেন, ততদিন অনিকের কাছে তার ছোটো মা হিসেবেই ছিলেন। দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকে অনিকও আর ছোটো মা বলে ডাকে না। আন্টি বলেই সম্বোধন করে! সেদিনই তিনি বুঝলেন, শুধু মেয়ে হা’রাননি! আরেকটা ছেলেও হা’রিয়ে ফেলেছেন। এই আফসোস, অনুশোচনা আর দুঃশ্চিতার ভা’রে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এছাড়াও তার হাই প্রেশার, ডায়বেটিস এর সমস্যা ছিল বেশি। যার ফলে তিনি বছরের বেশিরভাগ সময়েই অসুস্থ থাকতেন! পারিবারিক সব সুখ পেলেও শারিরীক এবং মানসিক অসুস্থতা তাকে কা’বু করে ফেলে। দিনশেষে তবুও তিনি কোথাও অসুখী ছিলেন! তার সামান্য সিদ্ধান্তে মেয়েটা বাবার পাশাপাশি মায়ের স্নেহ-মায়া থেকে বঞ্চিত হলো! এই বোধটাই তাকে দ্বিগুণ অসুস্থ করে তুললো।

ফজরের ঠিক আগ মুহূর্তে ঘুম ভে’ঙে যায় আঞ্জুমান আরা’র। চোখ মেলে দেখলেন কেবিনের অন্য বেডে মাশফি আধশোয়া হয়ে বই পড়ছে। পাশ ফিরে তাকাতেই চোখের কোন বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। জায়নামাজে বসে একমনে প্রার্থনা করছে মাইসারা। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানিটা বুঝিয়ে দিচ্ছে কতখানি আকুল হয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে মায়ের জীবন ভিক্ষা চাইছে সে। কিছুক্ষণ আগেই সবগুলো রিপোর্ট দেখিয়েছে মাশফি! তাতেই মাইসারা বুঝে গেছে, ডাক্তারদের হাল ছেড়ে দেওয়ার কারণ! তবুও একজন আছেন, যার উপর জীবন মৃ’ত্যুর ভা’র ঠে’লে দেয়া যায়। একমাত্র তিনিই পারেন, জীবন দিতে এবং জীবন নিতে!

মায়ের দিকে চোখ পড়তেই কাছে আসলো মাশফি! মাইসারাও মোনাজাত শেষ করে পাশে এসে বসলো! কিছু খেতে চান কিনা জানতে চাইলো সে। তিনি মাথা নাড়লেন। খাবারের জন্য দুধ তৈরী করে আনতেই দু’দিকে মাথা নাড়লেন তিনি! দুধ খাবেন না বুঝালেন! ইশারায় পানির বোতলটা দেখালেন! মাইসারা সেটাই তুলে আনলো। নলের মুখে অল্প অল্প পানি ঢেলে খাওয়ানোর চেষ্টা করলো! পানি পান করা শেষে কিছুক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি।

আচমকাই অস্বস্তি শুরু হলো তার! চোখদুটো বড়ো বড়ো করে ঠোঁট নাড়াতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না! মায়ের এই অবস্থা দেখে মাশফি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল ডাক্তারের কাছে! সার্জারীর পেশেন্টের জন্য রাতে এই হসপিটালে কয়েকজন ডাক্তার নিয়মিত থাকেন। তাই রোগীদের অসুবিধা দেখলে ছুটে আসতে দেরী হয় না তাদের! মাইসারা দু’হাতে মা’কে ধরে রাখলো। জানতে চাইলো,

-“কোথায় কষ্ট হচ্ছে তোমার বলো!”

এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে চরম অসহায় অনুভব করলো সে! মেয়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই চোখ উ’ল্টিয়ে শরীরের সমস্ত ভর ছেড়ে দিলেন তিনি! ততক্ষণে ডাক্তার নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছে মাশফি! স্টেথোস্কোপ দিয়ে চেক করে দেখলেন হৃদপিণ্ড তার স্পন্দন থামিয়ে দিয়েছে! নাকের কাছে হাত রেখে শ্বাস-প্রশ্বাসের আনাগোনা অনুভব করার চেষ্টা করলেন! সেখানেও ব্যর্থতা টের পেয়ে দু’দিকে মাথা নেড়ে উলটে যাওয়া চোখদুটো হাত দিয়ে বন্ধ করলেন! বললেন,

-“সি ইজ নো মোর!”

স্তব্ধ, নীরব কেবিনটায় শোকের মাতম ছড়িয়ে পড়লো! চিৎকার করে কাঁদতে চাইছে মাইসারা কিন্তু গলা দিয়ে সেই জোরটাও আসছে না। নীরবে ঠোঁট চেপে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের মৃ’তদেহটা বেডে শুইয়ে দিল! বেডশিট টেনে মুখ ঢেকে দিল! পরমুহূর্তে ভাই-বোন একে-অন্যকে জড়িয়ে কান্নায় বুক ভাসালো!

*****

আঞ্জুমান আরা’র মৃতদেহ যখন অ্যাম্বুলে’ন্সে তোলা হলো তখন হসপিটালে সিঁড়ির একপাশের দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে নীরবে অশ্রু বি’সর্জন দিচ্ছে মাইসারা! মায়ের জন্য এতগুলো বছর কেঁদেছে, সব লুকানো একাকী, নিঃসঙ্গ মুহূর্তের কান্না ছিল! কেউ সে কান্না কোনোদিন দেখেনি, বুঝেনি। মা হা’রা’নো মেয়ের হৃদয়ের আর্ত’নাদ কতখানি তীব্র কেউ খোঁজ নেয়নি। অবুঝ বয়স থেকে কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার দিয়ে কান্নার আওয়াজটা আর আসে না। নীরব কান্নাতেই বেদনার গাঢ় মুহূর্ত উপলব্ধি হয়! মুখ ফুটে বলা যায় না, আবার সহ্য করাও যায় না। এই নীরব কান্নার নীরব আকুতি অনিকের দৃষ্টিকেও স্তব্ধ করে দিয়েছে! সিঁড়ির অন্যপাশে বসে মাইসারার কাঁধে হাত রাখলো অনিক। বলল,

-“ওনাদের সঙ্গে যাবি?”

মাইসারা দু’দিকে মাথা নাড়লো। বলল,

-“আমাকে বাড়ি নিয়ে যাও! ওখানে গেলে দমব’ন্ধ হয়ে যাবে আমার।”

লা’শ অ্যাম্বুলে’ন্সে তোলার পর মাশফির বাবা মাইসারার সামনে এসে দাঁড়ালেন। হাত জো’র করে বললেন,

-“তোমার মা’কে ক্ষমা করে দিও। হয়তো তিনি তোমার কাছে অপরা’ধী! তুমি চাইলে আমি তোমার দায়িত্ব নিতে পারি। তোমরা দুই ভাই-বোন একসঙ্গে থাকবে! যাবে, মা?”

মাইসারা আবারও দু’দিকে মাথা নাড়লো! সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোকের হাত দু’খানি ধরে বলল,

-“আমার কারও উপর কোনো অভি’যোগ নেই! অভি’যোগটা সময়ের উপর! আমার অতীতের সময়টা আমার সঙ্গে ছিল না, আমার সাথে বেঈমানী করেছে, মায়ের সাথে বেঈমানী করেছে। অভিমান যা ছিল, তা মুছে গেছে। মাঝেমধ্যে মা’য়ের কব’র জেয়ারত করতে চাচ্চুকে নিয়ে যাব! তখন তাড়িয়ে দিবেন না আমাদের! ভাইয়ের সাথে তো দেখা এমনিতেও হবে। তার আর আমার সম্পর্ক যেমন ছিল তেমনি থাকবে! ভালো থাকবেন!”

ভদ্রলোক মাইসারার মাথায় বুলিয়ে দিলেন। বললেন,

-“তোমার যখন মন চায় যেও! শুধু কোনো অভি’যোগ রেখো না মা।”

বিদায় নিয়ে অ্যাম্বুলে’ন্সে উঠলেন তিনি! মাশফি তখনো ভেতরে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে! তার সে কান্নায় মাইসারারও অন্তর পু’ড়ছে কিন্তু কোথাও সে আট’কে আছে। চাইলেও সম্পর্ককে সহজ ভেবে কাছে যেতে পারছে না। হয়তো অভিমানটা যেমন ছিল, তেমনি রয়ে গেছে! অ্যাম্বুলে’ন্সের সামনে গিয়ে মাশফির সামনে দাঁড়ালো অনিক। বলল,

-“জানা’যার সময়টা জানিয়ে দিও! আমি বাবাকে সাথে নিয়ে আসবো!”

মাশফি মাথা নাড়লো! মায়ের মৃতদেহকে বিদায় দিয়ে অনিকের সঙ্গে বাড়ির পথে রওনা দিল মাইসারা! মৃ’ত্যু’র খবর শুনে এক মিনিটও অপেক্ষা করেনি সে। ফুল স্পীডে বাইক চালিয়ে ছুটে এসেছে! চাবি ঢুকিয়ে মাইসারার দিকে তাকালো অনিক। স্পষ্ট বুঝা গেল, এই বাইকে উঠতে ভয় পাচ্ছে সে। পুরনো দিনের কথাটা দু’চোখে ভেসে উঠলো তার। তার ভেতরটা আন্দাজ করতে পেরে হেলমেট বাড়িয়ে দিল। বলল,

-“তখন নতুন নতুন বাইক চালানো শিখেছিলাম। তাই দুর্ঘটনাটা ঘটেছে। এখন আর ভয় নেই! তোকে একা তো ছাড়তে পারবো না। শেষ একবার ভরসা কর!”

মাইসারা জবাব দিল না। হেলমেটটা মাথায় সেট করে ধীরেসুস্থে বাইকে উঠলো। পিছনের ক্যারিয়ার শক্ত করে ধরে বসলো! বলল,

-“ভাঙাচো’রা গাড়ি দিয়ে একবার মাথা ফা’টিয়েছো! এজন্যই ভয় হয়! তোমার এই নড়বড়ে বাইক চড়ে আবার না কোনো দুর্ঘটনা ঘটে!”

-“বললাম তো শেষ বারের মতো ভরসা কর! আর এমন কিছু হবে না।”

মুখে কোনো জবাব দিল না মাইসারা তবে মনে মনে ঠিকই ভরসার শেষ আশ্রয় হিসেবে এই মানুষটাকেই বেছে নিয়েছে মন! যার সাহায্যে সে এতদূর এগিয়ে এসেছে, তাকে ভরসা না করলে আর কাকে ভরসা করবে সে!

*****
চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে