মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি ২ পর্ব-১২+১৩

0
439

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১২

অব্যক্ত হতাশা প্রকাশ করলো হৃদি। হঠাৎ দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো স্বামীর পানে। হকচকিয়ে গেল তার চাহনির তীক্ষ্ণতা উপলব্ধি করে। একটু আগেই না কেমন মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন! এখন ক্ষ্যা পা ষাঁড়ের মতো লুক নিয়ে আছেন কেন? গলা শুকিয়ে গেল হৃদির। ভয় জমলো মনে। চোখের তারা চঞ্চল। শুকনো ঢোক গিলতে লাগলো। মানুষটা এমন করে তাকিয়ে কেন! আস্তে আস্তে সরতে সরতে স্বামীর পেশিবহুল বাহু হতে সরে হাতের কবজি বরাবর পৌঁছে গেল মেয়েটি। আকস্মিক মাথা তুলে ওর পানে ঝুঁকে গেল ইরহাম। তাতেই ফুরুৎ হৃদির প্রাণপাখিটা। ক্ষীণ দূরত্ব দু’জনার মধ্যে। একে অপরের শ্বাস প্রশ্বাস অনুভব করতে পারছে। স্বামীর মুখপানে নিষ্পলক নেত্রে তাকিয়ে হৃদি। ওর ভীতিকর অভিব্যক্তি অগ্রাহ্য করে চোখে চোখ রাখলো ইরহাম। খানিক বাদে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,

” দেশীয় ক্রাশ সিয়াম, জোভান, তাহসান, সাকিব আল হাসান, ইমরান, আয়মান সাদিক, ইরহাম চৌধুরী? ”

ঘোর কেটে গেল। দ্রুততার সহিত ইতিবাচক মাথা নাড়ল হৃদি। হাঁ। ওরাই। অতঃপর হুঁশ ফিরে আসা মাত্রই ভয়ের চোটে নেতিবাচক মাথা নাড়ল,

” না না। কেউ নেই। বিশ্বাস করুন। শুধুমাত্র স্বামী আছে। ক্রাশ ম্রাশ সব বাদ। ”

শব্দগুচ্ছ এলোমেলো হয়ে পড়ছে। গলা এত শুকিয়ে আসছে কেন? বড্ড তেষ্টা পেয়েছে কি! এখন এই রাতদুপুরে বাহিরে পানি পাবে কোথায়? কিংবা পেলেও পানি খেতে যাবে কি করে? দ্যাখো কেমন চোখের চাহনিতেই মোড়াল সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরেছে। উফ্! দমবন্ধকর অবস্থা। হঠাৎ কর্ণ গহ্বরে পৌঁছালো গুরুগম্ভীর আদেশ,

” হৃদির মনের ঘরে বসত করবে শুধু একজন। এই আমিটা। তার অর্ধাঙ্গ‌। এই আমি বিহীন অন্য কাউকে তোমার মনের ঘরে সামান্য ঢুঁ মা-রার অনুমতি অবধি দেইনি। না কখনো দেবো। বুঝেছো মেয়ে? ”

বিহ্বল রমণী ডুবে ওই নভোনীল শান্ত গভীর চোখে! চোখের অতল গহ্বরে একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে সে। ফিরে আসার বিন্দুমাত্র তাড়া নেই। সে চায়। চিরতরে হারিয়ে যেতে চায় ওই চোখের মায়াজালে। একান্ত বন্দিনী হয়ে থাকতে চায় এই গোমড়ামুখো মানুষটির বক্ষপিঞ্জরে। থাকবে সেথায় চিরকাল সুখময় স্মৃতির মাঝে। ভাবনার বহিঃপ্রকাশ চোখেমুখে হলো। উজ্জ্বল হলো বদন। ঝলমলে হেসে পেলব দু হাতে স্বামীর গলা ধরলো জড়িয়ে। হাতের আলতো ছোঁয়ায় একটুখানি কাছে টেনে নিলো গম্ভীর মুখ। প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে ইরহাম। নয়নে নয়ন স্থির রেখে হৃদি কোমল কণ্ঠে বললো,

” স্বামী মহাশয়! অহেতুক বিচলিত হবেন না। এই আমিটা শুধু আপনারই। এ পৃথিবীতে এসেছি আপনার অর্ধাঙ্গী রূপে। অন্য কারোর নয়। বিশ্বাস করুন। এই মনের ঘরে বসত করে একটিমাত্র নাম। ইরহাম! আপনার নাম। ”

হৃদি ঘুচিয়ে ফেললো মধ্যকার ব্যবধান। উষ্ণ ছোঁয়া এঁকে দিলো একান্ত পুরুষের ডান কপোলে। গাঢ় সে ছোঁয়া! লহমায় অশান্ত মানুষটি শান্ত হলো‌। ভালোলাগার পর্বত গড়ে উঠলো অন্তরে। পুরুষালি দু হাতের অভেদ্য বলয়ে আবদ্ধ হলো মেয়েটি। ললাটে সবটুকু ভালোবাসা ঢেলে এক গভীর চুমু অঙ্কন করলো মানুষটি। ফিসফিসিয়ে আওড়ালো মনের অরণ্যে লুকায়িত শব্দমালা,

” আমার হৃদয়ের রাণী। সমস্ত যন্ত্রণার উপশম। মনের প্রশান্ত আকাশে এক টুকরো সোনা রোদ। থাকবে তো আজীবন হৃদরাণী হয়ে আমার? ”

আবেগের আতিশয্যে অক্ষিকোল ভিজে উঠলো। নিঃশব্দে বলছে চোখ। নড়ছে ঠোঁট। শব্দভাণ্ডার শূন্য প্রায়। কিছু বলতে অপারগ হৃদি দু হাতে স্বামীকে আলিঙ্গন করে সুখের অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো। ইরহাম দেখলো। উপলব্ধি করলো সবই। তৃপ্তিময় হেসে সঙ্গিনীকে আঁকড়ে ধরলো। মুখ লুকালো ডান কাঁধে। নিভৃতে সেথায় অঙ্কন করলো ক্ষুদ্র এক পরশ। হালকা কেঁপে উঠলো কোমল সত্তা। শীতাংশু(চাঁদ) দেখলো এ অন্তরস্পর্শী ভালোবাসাময় প্রহর। লাজে মুখ লুকালো মেঘের ডানায়।
_

ইরহাম চৌধুরী। শৈশব হতেই বুদ্ধিদীপ্ত, পরোপকারী এক সত্তা। অন্যের উপকারে শৈশব হতেই নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে সে। হয়তো তখন ছোট ছিল। পুরোপুরি অন্যের উপকার করতে ব্যর্থ। তবুও যথাসম্ভব চেষ্টা করতো। বন্ধুদের কাছে সে ছিল ‘ প্রকৃত বন্ধু ‘ যে বন্ধু বিপদের সময় হাতটি ছেড়ে পালিয়ে যায় না। বরং শক্ত করে আঁকড়ে ভরসা জোগায় ‘ আমি আছি তো ‘। সময়ের পরিক্রমায় বড় হতে লাগলো ইরহাম নামের ছেলেটি। দেশমাতৃকার সেবা করার অদম্য অভিলাষ লুকিয়ে মনে। বেছে নিলো রাজনৈতিক জীবন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করা তরুণ ইরহাম জড়িয়ে পড়েছিল ছাত্র রাজনীতিতে। ঢাবির অভ্যন্তরীণ নির্বাচনে বেশ কয়েকবার নির্বাচিত হয়েছিল সে। নজর কাড়লো ক্ষ”মতাশালী রাজনৈতিক দলটির। অতঃপর ধীরে ধীরে সগৌরবে জায়গা করে নিলো সে দলে। বর্তমানে তার দল বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত। সরকার গঠন করেছে ‘খন্দকার আজগর মল্লিক’ এর দল। বরাবরই দেশের সেবায় নিয়োজিত ইরহাম। রাজনৈতিক জীবনে ওতপ্রোতভাবে ছিল জড়িয়ে। জীবনে কখনো প্রেম ভালোবাসার মতো অনুভূতির জায়গা দেয়নি। পরিচিত জনের কাছে সে ছিল কঠিন হৃদয়ের অধিকারী। যাকে চেনা, ভালোমতো জানা ছিল দুষ্কর। জটিল। এমন করেই প্রেম ভালোবাসা বিহীন কাটলো জীবনের ঊনত্রিশ বসন্ত। অতঃপর মায়ের তরফ থেকে মানসিক চাপ। আর কতকাল একা থাকবে! এবার বিয়ে করো। অনিচ্ছা প্রকাশ করা সত্ত্বেও লাভ হলো না। পাত্রী দেখা শুরু হলো। বেশ কয়েকজনকে দেখতে গেলেন মালিহা, ইনায়া এমনকি রাজেদা খানম। পছন্দ হলো না। তারা ইরুর সাথে বেমানান। ইরহাম তো কখনোই পাত্রী দেখতে যায়নি। বরাবরই ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে পাশ কাটিয়ে গিয়েছে।

একদিন ভণ্ডুল হলো সমস্ত পরিকল্পনা। কোনোরূপ অযুহাত দেখিয়ে লাভ হলো না। অপ্রসন্ন চিত্তে পাত্রী দেখতে গেল। মনমেজাজ ঠিক ছিল না। কিছুটা দেরি করেই গেল‌ ইরহাম। গিয়ে দেখলো এবারকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। পাত্রী বেশে বসে হৃদি শেখ নামক এক ললনা। যে এক দেখাতেই তার মা ও বোনের মন জয় করে নিয়েছে। আশ্চর্যজনক! একান্তে কথা বলতে পাঠানো হলো দু’জনকে। প্রথম দেখাতেই অভাবনী রূপে হাজির হলো মেয়েটা। একাকী বকবক করে গেল কত কি। প্রথম দেখাতেই মেয়েটার প্রতি কেমন বিরূপ ধারণা জন্ম নিল। তবে অপছন্দ করতে নারাজ হৃদয়। জানা নেই কেন অদ্ভুত কথা বলে উঠলো ইরহাম। পেশ করলো অদ্ভুতুড়ে প্রস্তাব। বিয়েটা যদি হয়েই যায় তবে আপত্তি নেই তার। কিন্তু দুঃখজনক ভাবে হৃদি কখনোই স্ত্রীর অধিকার দেখাতে পারবে না। এক ঘরে থেকেও অজানা আগন্তুকের ন্যায় থাকবে তারা। কখনোই একে অপরের ওপর অধিকার দেখাতে পারবে না। তারা নামমাত্র স্বামী স্ত্রী। বাস্তবে কোনোরূপ সম্পর্কের প্রগাঢ়তা থাকবে না। এমন প্রস্তাবে যারপরানাই অবাক হয়েছিল হৃদি! তবে কটূক্তি করেনি কোনো। নিশ্চুপ ছিল ক্ষণিকের জন্য। অতঃপর তারা সকলের মাঝে যোগদান করলো।

প্রথম প্রথম চমকালেও হৃদি এ সম্বন্ধ ঠিক হলে আপত্তি করেনি। চঞ্চল মেয়েটা জীবনে প্রথমবারের মতো আবেগের বশবর্তী হয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিল। যে সিদ্ধান্ত তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারতো। রায়হান সাহেব। বাবা তার ডানপিটে স্বভাবে অতি চিন্তিত। এছাড়াও বিয়ের বয়স হয়েছে। বেশ কিছু প্রস্তাব রয়েছে হাতে। তাদের মধ্যে মেয়েটার নজর কাড়লো অন্যতম ক্রাশ ইরহাম। রাজনীতিতে জড়িত সুদর্শন পুরুষ! বিয়ে তো জীবনে কাউকে না কাউকে করতেই হবে। এছাড়াও ভাল্লাগে না পড়াশোনা। এরচেয়ে বিয়ে করাই উত্তম। পাত্রটা ইরহাম চৌধুরী হলে মন্দ কি? চমৎকার হবে! কোনোরূপ ভবিষ্যৎ চিন্তাভাবনা ব্যতিত বিয়েতে সম্মতি জানালো হৃদি। ইরহাম কি বলেছে না বলেছে তাতে কিছু এসে যায় না। সে-ও সংসার করার জন্য নাকের জল চোখের জল এক করে ফেলছে না। জীবনে বহুত সময় আছে। একসময় ঠিক হয়ে যাবে সব। কল্প জগৎকে প্রাধান্য দেয়া মেয়েটা শ্বশুরবাড়ি নামক দ্বিতীয় বাড়ির আশায় দিন গুনছিল। যে বাড়িতে মুক্ত পাখির ন্যায় উড়ে বেড়াবে সে। থাকবে না বাবার শাসন, মায়ের নিষেধাজ্ঞা। বিরাজ করবে শুধু সুখ আর সুখ। ভাগ্যক্রমে ইরহাম পত্নী হলো হৃদি। ভাবনায় আসেওনি জীবন এত সহজ নয়। তার একটা ভুল সিদ্ধান্তে গোটা জীবনটা তছনছ হয়ে যেতে পারতো। সৌভাগ্যবতী সে‌! তাই তো ভুল সিদ্ধান্তে পেয়ে গেল সঠিক মানুষটিকে।

বিবাহ সম্পর্কিত অদ্ভুত প্রস্তাব পেশ করে ইরহামের মন বলছিল আপত্তি জানাবে হৃদি। তীব্র প্রতিবাদ করবে‌। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। অজান্তে মনোক্ষুণ্ন হলো মানুষটির। হৃদি কি তবে অন্য সব ইঁচড়েপাকা, গায়ে পড়া মেয়েদের মতো! মেয়েটির ওপর সুপ্ত ক্ষো ভ জন্ম নিলো। বিয়েশাদী নিয়ে মোটেও আগ্রহী নয় ইরহাম। কিন্তু মা ও বোন হৃদিকে দেখে অভিভূত! মালিহার পৈতৃক নিবাস সিলেট। সেখানকার মেয়ে হৃদি কেননা রায়হান সাহেবের গ্রামের বাড়ি সিলেট। এক অদ্ভুত মায়ায় হৃদির সনে জড়িয়ে পড়লেন মালিহা। ইরহাম দেখলো। আনমনে কোনোরূপ বাঁধা দিলো না। যা হওয়ার হোক। বিয়ে নামক ‘সুন্নাত’ পালন করার সময় বুঝি হয়েই গিয়েছে। বিয়ের আয়োজন আরম্ভ হলো। একদিন মোবাইলে খুদে বার্তা পাঠালো হবু স্ত্রীকে। বিয়েটা না করতে সতর্ক করলো। মেয়েটি খুদেবার্তা দেখেও নাদেখা করলো। যথাসময়ে হালাল বন্ধনে আবদ্ধ হলো ইরহাম ও হৃদি নামক অপরিচিত দু’জন। অতঃপর মনে লুকায়িত অসন্তোষের ফলস্বরূপ, প্রথম দেখায় পেশকৃত প্রস্তাব অনুযায়ী ইরহাম সম্পূর্ণ নিস্পৃহ আচরণ শুরু করলো। চরমভাবে অবাক হলো বিপরীতে থাকা মেয়েটির প্রতিক্রিয়া দেখে! হৃদিও কেমন আচরণ করছে। স্বামী নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। নিজের মতো থাকছে। জীবনটা উপভোগ করছে। সহ্য হলো না তা। অপছন্দের মেয়েটির ওপর এক অধিকারবোধ জন্ম নিলো। যে অধিকারবোধ হতে ছিঁড়ে ফেললো বউয়ের ক্রাশদের ফটো। শৈশব হতেই নিজের জিনিস নিয়ে যথেষ্ট পসেসিভ ইরহাম। যা তার, শুধুমাত্র তার। সেখানে তার একমাত্র বউয়ের মনে অন্য পুরুষের আনাগোনা! অসম্ভব। সব ছিঁড়ে ফেললো। তার বউয়ের মনে থাকবে শুধু একটি চিত্র। ইরহাম!

এরপরের পথচলা সকলের জানা। কেমন করে এই অপছন্দনীয় মেয়েটা হয়ে উঠলো ইরহাম নামক এক দুর্বোধ্য পুরুষের হৃদয়ের রাণী। মেয়েটির সরলতা, মিশুকে স্বভাব, শ্বশুরবাড়ির সকলের প্রিয় হয়ে ওঠা… মন ছুঁয়ে গেল! অজান্তেই মানুষটি ভুলে যেতে লাগলো নিজের পেশকৃত অদ্ভুতুড়ে প্রস্তাব। টের পেল বউয়ের ক্রাশ লিস্টে রয়েছে তার নামটিও। পুলকিত হলো মন। সময়ের পরিক্রমায় হালাল সঙ্গিনী হয়ে উঠলো তার হৃদরাণী! তাদের টক-ঝাল-মিষ্টি পথচলা এখানেই নয় শেষ। বাকি আরো অনেকখানি।

গাজীপুর ভ্রমণের আজ দ্বিতীয় দিন। স্বামীর সঙ্গে কাটলো স্মরণীয় এক দিন। ঘুরলো দিনের অর্ধ ভাগ। টুকটাক কেনাকাটা করলো। লং ড্রাইভে সীমাহীন পথে হারালো তারা। হৃদি বিমোহিত হলো স্বামীর নয়া অবতারে! মানুষটির ভালোবাসায়, যত্নবান রূপে আরো একবার নিজেকে হারিয়ে ফেললো মেয়েটি। জীবন এত সুন্দর কেন! কেন ভালোবাসা নামক অনুভূতি হৃদয় জুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে! এ কেমন মন কেমনের মিষ্টি যন্ত্রণা! স্মরণীয় এই ভ্রমণে হালাল কপোত-কপোতীর অগোচরে রয়ে গেল এক অজ্ঞাত ব্যক্তি এবং তার তীক্ষ্ণ চাহনি! যে কিনা অত্যন্ত সতর্কতার সহিত তাদের অনুসরণ করে চলেছে।
.

নিকষকৃষ্ণ রজনী। বিছানায় আধশোয়া হয়ে মানুষটি। অপেক্ষায় তার সঙ্গিনীর। নৈশ পরিচর্যা সেরে বিছানার ধারে শ্লথ গতিতে অগ্রসর হলো হৃদি। চোখেমুখে লাজুকতার বন্যা! স্বামীর চোখে একরাশ নে-শার আভাস! আহ্বান ভালোবাসার বাহারি রঙে বিলীন হবার। পাশে এসে বসলো মেয়েটি। ধুকপুকানি বর্ধিত হচ্ছে ক্রমবর্ধমান হারে। আলগোছে স্ত্রীকে নিজের সনে আগলে নিলো ইরহাম। বিগত দিবার চেয়েও মধুরতম কাটলো এ রজনী। একে অপরের উষ্ণতায় হারিয়ে গেল তারা। নিশাকরের অংশুমালা মুড়িয়ে নিলো মোহনীয় চাদরে!

তিন দিন তিন রাতের সফর সেরে চিরপরিচিত শহরে ফিরে এলো ইরহাম, হৃদি যুগল। সাথে নিয়ে এলো মধুর, স্মরণীয় কিছু স্মৃতি। জীবনের কোন এক সময়ে স্মৃতির পাতা হাতড়ে স্মরণ করবে তা। একে অপরের চোখে চোখ রেখে তৃপ্তিময় হাসবে। ফিরে যাবে সুমধুর স্মৃতিতে! ঢাকা ফিরে এসে আরম্ভ হলো সে-ই ব্যস্ত জীবন। ইরহাম তার রাজনৈতিক জীবনে। হৃদি ব্যস্ত সংসারে। তন্মধ্যে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত বিদায় লগ্ন।

ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোর ঘরে। মমতাময়ী মা’কে আলিঙ্গন করে কেঁদে চলেছে মেয়েটি। মালিহার চোখে জমে অশ্রু। উনিও নিঃশব্দ ক্রন্দনে লিপ্ত। মা ও মেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে আবেগতাড়িত। হৃদি ও ইরহাম পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। হৃদির চোখেও অশ্রুর ভীড়। মনে পড়ে যাচ্ছে সেই দিনটি। এমন করে সে-ও তো আপন নীড় ত্যাগ করে নতুন জীবনে পদার্পণ করেছিল। কেঁদেছিল মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে। সকলে একে একে বিদায় জানিয়েছিল তাকে। আজ তেমনই এক বেদনাময় মুহূর্তে দিশেহারা ইনু। বাবার বাড়ি ছেড়ে স্বামীর ঘরে পদার্পণ করতে চলেছে। কাঁদছে খুব। আপন নীড়, আপনজন ছেড়ে যাওয়া সহজ নয় যে। বড্ড কষ্টকর। চুরমার করে দেয় বুকের ভেতর। আলতো করে নোনাজল মুছে নিলো হৃদি। অধর প্রসারিত করে এগিয়ে গেল ইনুর পানে।

” ইনু! কাঁদে না সোনা। একটু শান্ত হও। ”

মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে হৃদি। ভাবীর আদুরে কণ্ঠে ইনু মা’কে ছেড়ে ভাবীকে আলিঙ্গন করলো। সে যে ভাবী অন্ত প্রাণ। এ বাড়িতে এত এত স্মৃতি। মা, ভাবী, দাদির সঙ্গে খুনসুটি। গম্ভীর বাবা ও ভাইকে ভয়ে সামলে চলা। বাড়ির আনাচে কানাচে তার দুরন্তপনার ছোঁয়া। ভাবীর আগমনে মেয়েটা খোলস ত্যাগ করে বড় চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। আজ থেকে সবটার সমাপ্তি। ঠাঁই হবে নতুন নীড়ে। সেথায় থাকবে শুধু দু’জন। সে এবং তার স্বামী। হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো ইনায়া। হৃদি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে। সে কাঁদলে কি করে হবে! ইনুর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে গেল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এগিয়ে এলো ইরহাম। মা ও বোনকে ঠিক সামলিয়ে নিলো। চোখের ইশারায় শান্ত করলো স্ত্রীকে। হৃদি ইশারাটুকু বুঝে নিলো। মুছে ফেললো অশ্রুবিন্দু।

ইনায়া আবেগী বদনে বাবার সম্মুখে দাঁড়িয়ে। জড়তা সংকোচে পারলো না বাবার বুকে মাথা রেখে একটুখানি কাঁদতে। তার দোয়া নিতে। এজাজ সাহেব নীরবে দেখে গেলেন। কি ভেবে যেন হঠাৎই স্নেহশীল হাতটি স্থাপন করলেন মেয়ের মাথায়। চমকালো সকলে! ঝরঝর করে কেঁদে উঠলো ইনায়া। ত্বরিত নিজেকে সামলিয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলেন উনি। মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালেন। মালিহা ও রাজেদা খানম ইনুকে অনেক উপদেশ দিলেন। কাঁদতে কাঁদতে নিজেদের সামলানোর বৃথা প্রয়াস চালিয়ে গেলেন। দুঃখে কাতর ইনু ভাইয়ের বুকে মাথা এলিয়ে দিলো। কাঠিন্যতা ভীড় করেছে ইরহামের মুখে। ভেতরকার অনুভূতি সম্পূর্ণ লুকায়িত। বোনের মাথায় বারকয়েক স্নেহের হাত বুলিয়ে দিলো। আদরের বোনের হাতটি তুলে দিলো ভাই রাহিদের হাতে। রাহিদ সকলকে আশ্বস্ত করলো। এবার যে বিধায় লগ্ন। স্বামীর হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে মায়ের কাছে গেল ইনু। কাঁদতে লাগলো সশব্দে। পা-গলী মেয়েটিকে নিয়ে এরা যাবে কোথায়? কি করে সামলাবে? এ পুরো আবেগঘন এক পরিবেশ!

চলবে.

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১৩

” ওয়েলকাম টু আওয়া’র হোম মিসেস রাহিদ! ”

নতুন গৃহ। আপন নীড়। অশ্রুসজল নয়নে ঘুরে ঘুরে নতুন বাসাটির ড্রয়িংরুম দেখছিল ইনায়া। তখনই কর্ণপাত হলো পুরুষালি কণ্ঠস্বর। তার স্বামীর কণ্ঠস্বর। চকিতে পিছু ঘুরে তাকালো ইনু। দু হাত দুই দিকে প্রসারিত করে স্বল্প ঝুঁকে রাহিদ। হাস্যবদনে নতুন গৃহে আপন অর্ধাঙ্গীকে উষ্ণ স্বাগত জানাচ্ছে। মেয়েটির চোখে জল ঠোঁটে খুশির ছোঁয়া। হৃদয়ে আনন্দ উচ্ছ্বাস। এমন এক মুহুর্ত সত্যিই তার তাকদীরে ছিল! আজ সে এবং তার স্বামী নতুন ঘরে। স্বামী নামক মানুষটি সুখপূর্ণ প্রাণবন্ত রূপে তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। এমন একটি দৃশ্য কি তার স্বপ্নে এসে বহুবার ধরা দেয়নি? দিয়েছে তো। আজ স্বপ্ন যেন সত্যি হলো। খুশি ধরা দিলো মনের দোরগোড়ায়। দু হাতের তালুতে মুখ লুকিয়ে কেঁদে উঠলো ইনায়া। দাঁড়ালো আরেকদিকে পিঠ করে। রাহিদের উজ্জ্বল মুখখানা অকস্মাৎ কালো মেঘে ছেয়ে গেল। তার ইনু কাঁদছে! চঞ্চল পায়ে স্ত্রীর পানে এগিয়ে গেল রাহিদ। ক্রন্দনরত মেয়েটিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে আবদ্ধ করে নিলো বাহুবন্ধনে। ললাট কার্নিশে অধর দাবিয়ে রেখে ফিসফিসিয়ে বলতে লাগলো,

” কাঁদে না সোনা। হশশ! একটু থাম। শান্ত হ‌‌‌। ইনু। শান্ত হ সোনা। এটা স্বপ্ন নয়। সত্যি। পিওর ট্রুথ। আর না। দুঃখ পালিয়েছে। এখন শুধু সুখের সময়। ”

ক্রন্দনে লিপ্ত মেয়েটি অভিমানের পাহাড় গুঁড়িয়ে জাপটে ধরলো আপনজনকে। মাথা এলিয়ে দিলো বুকের বাঁ পাশে। হৃৎপিণ্ড বরাবর। পেলব দু হাত স্থাপিত চওড়া পৃষ্ঠে। ওর ক্রন্দন ধ্বনি চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিচ্ছে সে জনের হৃৎযন্ত্র। রূদ্ধ হয়ে আসছে শ্বাস-প্রশ্বাস। নিজের সবটুকু স্নেহ একত্রিত করে ইনুকে আগলে নিলো রাহিদ। আজই এর শেষ। আজকের পর এই মায়াবী কন্যার দু চোখে বিনা কারণে অশ্রুজল জমতে দেবে না সে। এ তার নিজেকে নিজের প্রতিশ্রুতি।

সময়ের চাকা অবিরাম চলতে থাকে। থামে না কারোর বিন্দুমাত্র আবদারে। চলমান এ সময়ের চাকা ঘুরতে ঘুরতে অতিবাহিত হলো একমাস। বদলে গেছে কত কি। ইনায়া এখন রাহিদের ঘরণী। গড়ে উঠেছে তাদের ছোট্ট সংসার। তবে একপাক্ষিক অভিমান এখনো চলমান। যদিওবা স্বামী নামক মানুষটির ছোটোখাটো যত্ন, ভিন্ন অবতারে অভিমান এখন নেই বললেই চলে। তবে তা অপ্রকাশ্য রয়ে গেছে। রাহিদের দৃষ্টিতে ইনুর অভিমান একটুও কমেনি। বরং এখনো কঠিন হৃদয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। হৃদয়ের দোরগোড়ায় বরফ জমেছে কি! এত কিসের কাঠিন্যতা! জানা নেই রাহিদের। তবে সে নিজের তরফ থেকে সবটুকু চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইনশাআল্লাহ্ সফলতা একদিন না একদিন ধরা দেবেই। অন্যদিকে ‘ আনন্দাঙ্গন। ‘ ইনায়ার অনুপস্থিতিতে বাড়িটা কেমন নির্বাক হয়ে ছিল। সব থেকেও যেন নেই। ইরহাম যথারীতি নিজ কর্মে ব্যস্ত। এজাজ সাহেব চুপচাপ। অফিসিয়াল কার্যে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। বাড়িতে এখন শুধু তিনটে জীব। হৃদি, মালিহা এবং রাজেদা খানম। এদের সঙ্গেই সময় কাটে হৃদির। বড্ড মিস্ করে তার আদুরে ননদকে। ইনু বিহীন কেমন যেন রষকষহীন সময় কাটে। পুরো বাড়িতে একাকী তরুণী সে। মা ও দাদি রয়েছে। তবে স্বাভাবিক ভাবেই তারা বয়সে বড়। একটা জেনারেশন গ্যাপ রয়েছে। কেমন একটা শূন্যতা রয়েই যায়। ওদিকে স্বামী নামক মানুষটিও ব্যস্ত। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ে। ফেরে রাত্রি বেলা। আগে তো ননদ ছিল। তার সঙ্গে সময় কেটে যেতো। আজকাল এই নিঃসঙ্গতা বড় কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। কেমন অসহনীয় লাগে। তবুও বাড়ির বউ হিসেবে সকল দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে হৃদি। আগে হয়তো বাড়ির বউ হয়েও নিস্প্রভ ছিল। এখন তেমনটি নেই। প্রায়শ নিজেই টুকটাক রান্না করে। শ্বশুর, শাশুড়ি, দাদি শাশুড়ি তাদের খেয়াল রাখে। তাদের শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে দায়িত্বরত। সব মিলিয়ে চলছে দিনকাল।

তমসাচ্ছন্ন কক্ষ। আরামকেদারায় দেহ এলিয়ে দিয়েছেন আজগর সাহেব। নিমীলিত আঁখি পল্লব। বড় শান্ত মুখশ্রী। এ যেন প্রলয় সৃষ্টিকারী কোনো ঝড় ওঠার পূর্বাভাস। তছনছ করে দেবে সব। ছিন্নভিন্ন হবে কারোর সুখের নীড়। ওনার সম্মুখে দাঁড়িয়ে কয়েকজন চ্যা লা। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে তারা। কি করে বলবে সত্যিটা! নেতাজী কি ক্রু-দ্ধ হবেন না! কোনোমতে একজন মৃদু স্বরে ভীতসন্ত্রস্ত বদনে বলে উঠলো,

” নেতাজী! মুহিত কেসে এবার প্যাঁচ লাগতাছে। পুলিশ আরো কিছু ক্লু পাইছে। সন্দেহ করতাছে এইটা সাধারণ মৃ-ত্যু না। ভেতরে গণ্ডগোল আছে। ”

আরামকেদারায় শায়িত মানুষটির আরামে ব্যঘাত ঘটলো। শক্ত হলো পেশি। কাঠিন্যতা ভীড় জমালো মুখের আনাচে কানাচে। সহসা আঁধার চিরে কর্ণপাত হলো ভ য় ঙ্ক র স্বরে এক আদেশ বার্তা,

” অনেক হয়েছে। আর নয়। তুলে ফেল ওটাকে। ”

চমকালো ওনার চ্যা”লারা! কার কথা বলছেন নেতাজী! মুখ ফসকে একজন জিজ্ঞেস করে উঠলো,

” কাকে? হৃদি শেখ? ”

বলেই মুখে হাত চাপা দিলো। ভয়ে আঁতকে উঠলো অন্তঃস্থল। এ কি করলো সে? নেতার মুখের ওপর প্রশ্ন! তবে ভাগ্যক্রমে আতঙ্কিত হবার মতো কিছুই ঘটলো না। আঁখি বুঁজে আজগর সাহেব আপনমনে বলে উঠলেন,

” চৌধুরীর হৃদয় রাণী! আর মাত্র ক’দিন। যত পারো উড়ে নাও। শীঘ্রই মুখ থুবড়ে পড়বে মাটিতে। ”

ওষ্ঠপুটে লেপ্টে ক্রুর হাসির রেখা। ওনার লুকায়িত আদেশ নির্দ্বিধায় অনুধাবন করতে পারলো শিষ্যরা। নি-ষ্ঠুর এই আদেশ নির্দ্বিধায় মান্য করার পণ করলো তারা। অপেক্ষা শুধুমাত্র সঠিক সময়ের। অতঃপর…!

রবি’র ঝলমলে কিরণে আলোকিত বসুন্ধরা। নিদ্রায় তলিয়ে হৃদি। তাকে সাপের ন্যায় পেঁচিয়ে এক সুঠামদেহ। ফজরের সালাত আদায় করে দু’জনেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে। ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে সাত নির্দেশ করছে। সহসা বালিশের পাশে রাখা মোবাইলটি কর্কশ ধ্বনিতে বিরক্ত করতে লাগলো। অ্যালার্ম বেজে চলেছে। বিরক্তিকর ধ্বনিতে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলো। অস্বস্তিতে কুঁচকে গেল চোখমুখ। আস্তে ধীরে আঁখি পল্লব মেলে তাকালো হৃদি। ডান হাত পৌঁছে গেল বালিশের পাশে। হাতের নাগালে মিললো মোবাইল। মুখের সামনে মোবাইল এনে ঘুমকাতুরে চোখে তাকালো মেয়েটা। আঙ্গুল ছুঁয়ে বন্ধ করলো অ্যালার্ম। পূর্বের জায়গায় রেখে দিলো মোবাইলটি। ডান হাতের উল্টো পিঠে ওষ্ঠাধর আড়াল করে হাই তুললো। নড়তে গিয়ে অনুভব করতে পারলো চরম অস্বস্তি। কোমল দেহ যেন চাপা পড়েছে কয়েক মণ ওজনের নিচে। দমবন্ধকর অবস্থা। হাঁসফাঁস করে বামে মুখ নিলো সে। লহমায় অস্বস্তি কেটে গিয়ে মোহগ্ৰস্থ হলো! চোখের তারায় বন্দী হলো স্বামীর ঘুমন্ত অবয়ব। কেমন শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ বদনে ঘুমিয়ে সে। পেশিবহুল দু হাতে পেঁচিয়ে তাকে। ভারী একটি পা উঠিয়ে ওর দু পা আঁটকে। নড়াচড়া দুষ্কর। গত রাতে সীমাহীন মধুর যাতনা দেয়া মানুষটি এখন যেন অবুঝ শিশুতে রূপান্তরিত হয়েছে। কে বলবে বিগত রাতে এ মানুষটি ছিল প্রিয়তমায় উ-ন্মাদ। মা তা ল। এখন কেমন সাপের মতো পেঁচিয়ে ঘুমোচ্ছে। আলগা করে ধরলে বুঝি হারিয়ে যাবে।

অধর প্রসারিত হলো হৃদির। তার গলদেশে মাথা এলিয়ে ঘুমন্ত মানব। হৃদি মুখ নামিয়ে ওষ্ঠ চাপ বসালো স্বামীর চুলের ভাঁজে। লহমায় টনটনে ব্যথা অনুভূত হলো ওষ্ঠাধরে। গত রাতের যন্ত্রণা এখনো ছাপ ফেলে রেখেছে। আজ দিনভর খাওয়া-দাওয়ায় যন্ত্রণা হতে চলেছে! কেউ দেখলে কি ভাববে? হুঁ? আস্ত এক ভ্যাম্পায়ার! ফিক করে হেসে উঠলো হৃদি। ভ্যাম্পায়ার রূপী এমপি সাহেব। কেমন লাগবে দেখতে! হাসি চেপে স্বামীকে নড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো মেয়েটি। এমন বলিষ্ঠদেহী একজনকে সরানো ওর মতো শুঁটকি মাছের কর্ম নয়। তবুও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মিহি স্বরে ডেকেও চলেছে। তাতে কি হয়েছে? সাপ এবার জোঁকের মতন আঁকড়ে ঘুমাতে লাগলো। ফোঁস করে শ্বাস ফেললো হৃদি। স্বেচ্ছায় কেউ সরতে না চাইলে তাকে সরানো মুশকিল। অসম্ভব। কিইবা করার? স্বামীর বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে রইলো হৃদি। সময় সচেতন মানুষটা ঠিক একটু পরেই উঠে পড়বে। দেশসেবা করতে হবে না! চকিতে চমকালো মেয়েটা! গলদেশে ছুঁয়ে যাচ্ছে আর্দ্র পরশ। ঘুম থেকে উঠেই আবারো দুষ্টুমি আরম্ভ করেছে! মিথ্যে বিরক্তি প্রকাশ করলো হৃদি। তাতে কি হয়েছে?

” ছটফট করে না জান। দশটা মিনিট একটু আদর করতে দাও। ”

মা*দকতাপূর্ণ আবদারে ব`শীভূত হলো হৃদি! প্রিয়তমায় বিভোর মানুষটি ঠিক তাকে আগলে নিলো। অল্প সময়ের জন্য একে অপরেতে হারালো তারা। হাতে সময় কম। অন্যথায় এমপি সাহেব এত সহজে ছেড়ে দেয়ার লোক নয়।
.

সকালটি শুরু হয়েছিল স্বামী সান্নিধ্যে। এক মিষ্টি সূচনা। দিনটা কেমন ফুরফুরে মেজাজে কাটলো। বিকালে গেল নাদিরা’র বাড়িতে। বন্ধুরা মিলে গ্রুপ স্টাডি করতে। আফরিন আসলো বেশ দেরি করে। বেচারি মেয়েটিকে দেখলেই কেমন দুঃখ হয় হৃদির। দুই বছর বয়সে মাতৃহারা হয়েছিল আফরিন। বছর গড়াতে না গড়াতেই বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলো। সে ঘরে এখন একটা বোন রয়েছে। সৎ বোন। আচরণ করেও সৎ বোনের মতো। সে যতই আপন ভাবুক না কেন সৎ মা ও বোন তাকে কখনো আপন ভাবতে পারেনি। কয়েক বছর আগে বাবা ইন্তেকাল করেছে। এরপর শুরু হলো আফরিনের আসল লড়াই। টিউশনি করিয়ে নিজের খরচ নিজেই চালাচ্ছে। নেহাৎ বাড়িটা বাবার নামে এবং ওয়ারিশ হিসেবে ওর নাম রয়েছে। নয়তো কবেই গৃহছাড়া হতে হতো! প্রতিনিয়ত ওকে কটূক্তি শুনতে হয় মা ও বোনের। তবুও নিজ সম্মান বজায় রেখে চলার চেষ্টা করে মেয়েটা। আর মাত্র বছর দুই। কোনোমতে অনার্স শেষ করেই ওই ধ্বং-সপুরী ত্যাগ করবে। তেমনটাই পরিকল্পনা। ওরা বন্ধুরা আফরিনের সঙ্গেই আছে। সর্বদা বিপদে আপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। মেয়েটিকে আগলে রাখে। বন্ধুত্বের ধর্ম ই তো এটি। একে অপরের তরে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো হৃদি। আফরিন এসে বসলো ওর পাশে। সকলে মিলে মনোনিবেশ করলো পড়ালেখায়। সাথে খুনসুটি তো রয়েছেই।
.

গ্রুপ স্টাডি শেষে আড্ডাবাজি হলো। বিকেল গড়িয়ে নামলো সন্ধ্যা। আঁধারে তলিয়ে ধরিত্রী। নাদিরা বন্ধুদের বিদায় জানালো। বাড়ির বাইরে এসে বিচ্ছিন্ন হলো ওদের পথ। হৃদি গিয়ে বসলো গাড়িতে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাথে রয়েছে তিনজন দেহরক্ষী। একজন চালকের পাশে বসে। বাকি দু’জন বাইকে করে সঙ্গ দিচ্ছে। এমপি পত্নী সে। এছাড়াও মুহিত কেসে এখন পরোক্ষভাবে জড়িয়ে। স্বাভাবিক ভাবেই নিরাপত্তা জোরদার করা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাড়ি চলছে ঢাকার ব্যস্ত সড়ক ধরে। কিছুটা পথ অতিক্রম করতেই…

চলবে.

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১৩ ( বর্ধিতাংশ )

বিকেল গড়িয়ে নামলো সন্ধ্যা। লালচে কমলা আভা হারিয়ে গেল সুবিশাল আকাশ হতে। আঁধারে তলিয়ে ধরিত্রী। গ্রুপ স্টাডি সেরে নাদিরার বাসা হতে বেরিয়ে এলো হৃদি। গিয়ে বসলো গাড়িতে। ওর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাথে রয়েছে তিনজন দেহরক্ষী। একজন ড্রাইভারের পাশে বসে। বাকি দু’জন পিছু পিছু বাইকে করে সঙ্গ দিচ্ছে। এমপি পত্নী সে। মিসেস হৃদি শেখ। এছাড়াও মুহিত কেসে এখন পরোক্ষভাবে জড়িয়ে। স্বাভাবিক ভাবেই নিরাপত্তা জোরদার করা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বাহিরে বের হলেই সর্বদা দেহরক্ষী দ্বারা সুরক্ষিত বলয়ে আবদ্ধ থাকে। এমপি সাহেবের কড়া নির্দেশ। যা অমান্য করার সাধ্য এ মেয়েটির নেই। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেহরক্ষী নিয়ে ঘুরতে হয়। ক্ষুণ্ণ হয় তার স্বাভাবিক চলাফেরা, স্বাধীনতা। কিন্তু কিছুই করার নেই। স্বামীর আদেশ বলে কথা। এছাড়াও ভালোর জন্যই বলেছেন। তাই মান্য করাই শ্রেয়। ভাবনার মাঝে গাড়ি চলতে আরম্ভ করলো। ফুরফুরে মেজাজে হৃদি তাকিয়ে জানালার বাহিরে। আজকের দিনটা কেমন যেন বেশ আনন্দময় ছিল! সকাল হতে সন্ধ্যা, বহুদিন পর এমন চমৎকার একটি দিন কাটলো। উৎফুল্ল তনু ও মন উভয়। তবুও মনটা কু গাইছে। বহুদিন পর খুশির ছোঁয়া। কোনো অশনিসংকেত বয়ে আনবে না তো? বারবার বাড়ির লোকেদের, আপনজনদের মুখখানি মানসপটে ভেসে উঠছে। মনে হচ্ছে আর বুঝি দেখা হবে না। সব শেষ। ইন্না লিল্লাহ! এসব কি ওলটপালট ভাবছে সে! আল্লাহ্ সহায় আছেন। ইনশাআল্লাহ্ যা হবে ভালোর জন্যই হবে। নিজের মনকে শান্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো হৃদি।

গাড়ি তখন চলছে ঢাকার ব্যস্ত সড়ক ধরে। কিছুটা পথ অতিক্রম করতেই অকস্মাৎ থেমে গেল গাড়ি। এহেন কাণ্ডে যথেষ্ট চমকালো হৃদি! সম্মুখের সিটে বসে থাকা দেহরক্ষী রুস্তম’কে শুধালো,

” কি হয়েছে ভাইয়া? ”

বছর বত্রিশের দেহরক্ষী রুস্তম পেছনে হৃদির দিকে ফিরলো। তবে চোখ তুলে তাকালো না। নত চাহনিতে ওকে আশ্বস্ত করতে বললো,

” আমি দেখছি ম্যাডাম। আপনি চিন্তা করবেন না। ”

রুস্তম ওকে বললো বটে। তবে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট চেহারায়। সে মোবাইল হাতে নিয়ে কাউকে কল করলো। হৃদি চিন্তিত বদনে আশপাশে দেখছে। দেখতে পেল পেছনে বাইকে থাকা একজন রক্ষী মোবাইলে কথা বলছে। বোধহয় সামনের ভাইয়াটা পেছনের জনকে কল করেছে। কথা বলছে। চলন্ত গাড়ি হঠাৎ থেমে গেছে। এর ওপর সামনে জটলা দেখা যাচ্ছে। চঞ্চল মেয়েটা অস্বস্তি বোধ করছে। মন চাইছে এখুনি গিয়ে দেখে আসুক কি হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনা করে এখনো বসে।

” ভাইয়া সব ঠিক আছে তো? ”

সামনের সিটে বসে থাকা রুস্তম ওর দিকে পুনরায় হালকা ফিরলো। নজর তার সম্মান প্রদর্শনের ভঙ্গিতে নিচু করে রাখা। স্ত্রীর দিকে দেহরক্ষীদের সরাসরি তাকিয়ে কথা বলায় ঘোর নিষেধাজ্ঞা সাংসদ ইরহাম চৌধুরীর। এছাড়াও মালকিনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে। তাই দেহরক্ষীরা বরাবরই অবনত মস্তকে সম্মান প্রদর্শন করে প্রয়োজনীয় টুকটাক কথাবার্তা বলে থাকে। রুস্তম চিন্তিত স্বরে বললো,

” ম্যাডাম সামনে বোধহয় কোনো অ্যা”ক্সিডেন্ট কিংবা ঝামেলা হয়েছে। আমাদের এখানে বেশিক্ষণ থাকাটা রিস্কি। আপনি বসুন। আমি দেখে মিটমাট করে আসছি। ভুল করেও গাড়ি থেকে নামবেন না যেন। স্যারের কড়া নিষেধ। ভুলেও নামবেন না। ”

একান্ত মানুষটির নাম কর্ণপাত হতেই একটুখানি শান্ত হলো মন। বুকের ধুকপুকানি এখন নিয়ন্ত্রণে। ইতিবাচক মাথা নাড়ল হৃদি। রুস্তম দুশ্চিন্তা সমেত গাড়ির দ্বার খুলে বেরিয়ে গেল। দ্বার বদ্ধ করে পেছনে থাকা দু’জন রক্ষীকে ইশারায় সতর্ক থাকতে বললো। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো তারা দু’জন। রুস্তম সাবধানী ভঙ্গিতে জটলার দিকে এগিয়ে গেল। রাতদুপুরে হচ্ছেটা কি? এদিকে গাড়িতে বসে হৃদির অবস্থা নাজুক। অজানা ভয়ে হিম হয়ে আসছে হাত-পা। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিবেগ অস্বাভাবিক। গাড়িতে এসির মধ্যে বসেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে মুখশ্রীতে। ভীত চোখ দু’টো বারবার ডানে বামে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বদ্ধ জানালা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে পরিস্থিতি। নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়িয়ে স্মরণ করে চলেছে মহান রব’কে। ডান হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে কোলে থাকা ব্যাগ। ঈষৎ কম্পন সারা কায়ায়। নেত্র জোড়া আকুল হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে একান্ত পুরুষটিকে। সে কোথায়? একটুখানি উষ্ণতা দিয়ে আগলে কি নেবে না! আশ্বস্ত করবে না তাকে!

দু’টো বাইক অনিয়ন্ত্রিত ভাবে চলতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। বিপরীত দিক হতে আসছিল তারা। হঠাৎ সং ঘ র্ষ। বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে দু’জনের মধ্যে চূড়ান্ত মাত্রার বাকবিতণ্ডা সৃষ্টি হয়েছে। একে অপরকে দোষারোপ করছে তারা। নিজের দোষ স্বীকার করতে নারাজ। পথচারীরা তাদের কেন্দ্র করে গোলাকার ভীড় জমিয়েছে। দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। কেউবা মোবাইলে ধারণ করছে এই বিনোদনমূলক বাকবিতণ্ডা। রুস্তম ভীড়ের মধ্যে মিশে গেল। চমকালো প্রকৃত ঘটনা উপলব্ধি করে! বাকবিতন্ডা দূর করতে গিয়ে সে নিজেও ঝামেলায় ফেঁ সে গেল। ওই দু’জন এখন রুস্তমের সঙ্গে যেনতেন আচরণ করছে তাদের বিষয়ে নাক গলানোর জন্য। বিরাট ঝামেলা তো। সহসা রুস্তমের আস্ত এক রাম ধমকে সব ঝামেলা দূর। কুস্তিগীরের ন্যায় শরীর তার। ঈষৎ কৃষ্ণবর্ণ রূপ। দেখলেই কেমন ভয় হয়। স্বাভাবিক ভাবেই ভয়ে সব সুর সুর করে পালালো। ঝামেলা মিটমাট করে অবশেষে গাড়ির কাছে ফিরে এলো রুস্তম। তপ্ত শ্বাস ফেলে গাড়ির দ্বার উন্মুক্ত করতেই স্তব্ধ হলো!

” ম্যাডাম! ”

.

নিশুতি রাত। অনুতপ্ত চাহনিতে তাকিয়ে রাহিদ। বিপরীতে দাঁড়িয়ে কঠিন হৃদয়ের অধিকারিণী। দু’জনে এ মুহূর্তে উপস্থিত তাদের বেডরুমে। ভাঙা স্বরে বলে উঠলো রাহিদ,

” এমন করিস না সোনা। আমার ভেতরটা জ্ব’লেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। ”

অশ্রুসজল নয়নে স্বামীর পানে তাকালো ইনায়া। কেমন বিদ্রুপ করে হাসলো। কাট-কাট স্বরে বলতে লাগলো,

” তোমার জ্ব’লেপুড়ে যাচ্ছে! কেন ভাইয়া? আমি কে হই তোমার? নামমাত্র বউ। এমনটা নয় যে তুমি আমায় খুব ভালোবাসো। ভালোবাসার মানুষটির সামান্যতম অবজ্ঞা, অবহেলায় তোমার ভেতরটা চূর্ণ বিচূর্ণ হচ্ছে। তাই কি? নাহ্। ভাইয়ার কথায় আমাকে বিয়ে করে দয়া করেছো। ওই জুনায়েদ নামক আপদ হতে রক্ষা করেছো। তাহলে এসব কি? কেন এমন দক্ষ অভিনেতার মতো অভিনয় করে যাচ্ছো? এখানে তুমি আমি ব্যতীত কে আছে? কেউ নেই। তাহলে এই দুর্দান্ত অভিনয় কার জন্য? প্লিজ বন্ধ করো এসব। ”

অভিনয়! তার এতদিনের স্নেহ-যত্ন-ভালোবাসা সবটা ওর কাছে অভিনয় মনে হচ্ছে? পিওর অ্যাক্টিং! শব্দটি রাহিদের আত্মসম্মানে যেন চরমভাবে আঘাত করলো। লহমায় ক্ষি প্ত রূপ ধারণ করলো ছেলেটা। এক টানে ইনুকে নৈকট্যে আনলো। বন্দী করলো নিজ বাহুডোরে। চমকিত নেত্রে তাকিয়ে ইনায়া! এ কি থেকে কি হয়ে গেল! মনের মানুষটির সান্নিধ্যে চঞ্চল হলো চিত্ত। বর্ধিত হৃদস্পন্দনের ধ্বনি যেন কর্ণ গহ্বরে কড়া নাড়ছে বারংবার। অপলক চোখে তাকিয়ে ইনায়া। রাহিদ ঝুঁকে আরো নিকটে এলো। চোখে চোখ রেখে রাশভারী কণ্ঠে বলল,

” আমি অভিনয় করছি? বিবাহিত জীবনের দুই দুইটা মাস সিঙ্গেল হয়ে কাটিয়ে দিলাম। প্রথম মাস ঘরদোর ঠিকঠাক করতে করতে। দ্বিতীয় মাস পিচ্চি বউয়ের রাগ অভিমান ভাঙাতে ভাঙাতে। তোর কি মনে হয়? আসলেই সবটা অভিনয়? আমি দয়া দেখাতে বিয়ে করেছি? আমাকে কোন দিক থেকে দয়াশ্বরী লাগে? হুঁ? আমি এতটাও উদারমনা নই যে দয়া দেখাতে গিয়ে একজনকে সোজা বিয়ে করে নেবো। লাগলে আরেকজনের গলায় ঝুলিয়ে দেবো। তবুও দয়া দেখাতে গিয়ে নিজের কাঁধে তুলে নেবো না। বুঝেছিস? ”

মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে ইনায়া। পেলব দু হাতে আঁকড়ে ধরলো স্বামীর কোমরের দিকের টি-শার্ট। মিহি স্বরে শুধালো,

” তাহলে কেন বিয়ে করেছো? ”

বিরক্তিকর ধ্বনি মুখনিঃসৃত হলো। চোখমুখ কুঁচকে রাহিদ বললো,

” তোর মতো গ`বেট দ্বিতীয়টা দেখিনি। মেয়েদের ইন্দ্রিয় শক্তি নাকি প্রখর। কোন ছেলে তার দিকে কোন চাহনিতে তাকায় দূর থেকেই বুঝতে পারে। সেখানে আমি গোটা একমাস তোর সামনে দিয়ে ঘুরঘুর করছি। টম এন্ড জেরী’র ওই সুন্দ্রী মাইয়া বিড়ালগুলোর মতো আবেদনময়ী নজরে তাকাচ্ছি। অথচ যার দিকে তাকাচ্ছি সে-ই বেখবর। কিচ্ছু জানে না। হ-তচ্ছাড়ি! তোর বোধহয় চোখে ব্যা মো হয়েছে। কাল ই ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো। ইয়্যু নিড ট্রিটমেন্ট। ”

রাহিদের শিশুসুলভ মুখভঙ্গি এবং কথাবার্তার ধরনে চমকিত ইনায়া না হেসে পারলো না। ফিক করে হেসে উঠলো। এতেই তেঁতে উঠলো রাহিদ বাবু। তার দুঃখময়-বেদনাদায়ক কাহিনী শুনে হাসা হচ্ছে! তবে রে! লহমায় স্তব্ধ ইনায়া! বিহ্বল ওপাশের মানুষটি নিজেও! এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না! সে তো শুধুমাত্র প্রিয়তমার বিদঘুটে-অসহ্যকর হাসিতে বাঁধা দিতে চেয়েছিল। তাতেই হলো এহেন কাণ্ড। একান্ত জনের প্রথম প্রগাঢ় স্পর্শ। দু’জনার অধরে অধরে সন্ধি। আবেশে মুদিত হলো ইনুর দু চোখ। কপোলের ত্বকে গড়িয়ে পড়লো সুখের অশ্রু। রাহিদ প্রথমে চমকালেও পিছিয়ে আর এলো না। বরং শক্ত করে অর্ধাঙ্গীকে নিজের সনে আগলে নিলো। চক্ষু বুজে উপভোগ করতে লাগলো এ প্রথম ছোঁয়া। বুঝিয়ে দিতে লাগলো হৃদয় কোণে লুকায়িত অনুভুতির বহর। সে অভিনয় করছে না। সবটুকু অনুভূতি বাস্তব। গাঢ়।

সফল আজ ইনু। বিয়ের পর প্রথম প্রথম ভেবেছিল তাকে দয়া করে বিয়েটা করেছে রাহি ভাইয়া। কেননা যে মানুষটি একদা তাকে সহ্য করতে পারতো না সে অকস্মাৎ কি করে বিয়ে করে ফেললো! অবাস্তব নয় কি? তবে সময়ের পরিক্রমায় মানুষটির সঙ্গে থাকতে থাকতে তার রূপান্তরিত অবতার দেখে নিশ্চিত হলো এ অভিনয় কিংবা দয়া নয়। সত্যিই রাহির মনের গহীনে শুধু তার বসবাস। ব্যাস। অপেক্ষায় দিন গুনতে লাগলো কবে ধরা দেবে মানুষটি। প্রকাশ করবে মনের ভাব। তবে সে আশায় গুড়ে বালি। বান্দা মনের কথা না বলে দেবদাস ম্যাক্স প্রো হয়ে ঘুরছিল। একদম অনাথের মতো চেহারা বানিয়ে। না পারছে বলতে না পারছে সইতে। এক বিছানায় ঘুমিয়েও দু’জন কেমন পর। একসাথে থাকছে কিন্তু সাবলেট ভাড়াটিয়ার মতন। বড় মায়া হলো মেয়েটার। নিজের স্বামী তো। তার ওপর মনের মানুষ। দুঃখ হচ্ছিল। তাই তো আজ সময় সুযোগ পেয়ে ইচ্ছামতো উস্কে দিলো। ফলস্বরূপ বেরিয়ে এলো পেটের কথা। বহিঃপ্রকাশ হলো তার হৃদয়ে লুকানো অনুভূতির। তবে একটাই আফসোস! মানুষটির মুখে চার বর্ণের জা-দুকরী শব্দটি শোনা হলো না। তাতে কি? একদিন না হয় তা-ও হবে। আপাতত এই অনুভূতিপ্রবণ মুহূর্তটি উপভোগ করতে থাকুক। ভালো থাকুক ভালোবাসার মানুষগুলো!

.

মাত্র দু ঘন্টা। তন্মধ্যে ঝড় উঠলো আনন্দাঙ্গনে। বাড়ির একমাত্র বউ হৃদি নিখোঁজ! মাঝ সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়ার মতো অবস্থা দুই অসহায় নারীর। মালিহা উদ্বেগের সহিত বারবার বড় সন্তানকে, স্বামীকে কল করে চলেছেন। ইরহাম ফোন তুলছে না। সে কি খবরটা জেনে গেছে নাকি এখনো অজ্ঞাত? আর স্বামী নামক মানুষটি? সে ফোন তুলছে না কেন? ইয়া খোদা! শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে কেঁদে উঠলেন মালিহা। এলোমেলো আঙ্গুল চালিয়ে পুনরায় স্বামীর নম্বরে কল করলেন। বৃদ্ধা রাজেদা খানমের অবস্থা দিশেহারা। সোফায় বসে চিন্তিত বদনে পুত্রবধূর পানে তাকিয়ে। মনে মনে স্মরণ করছেন সৃষ্টিকর্তা’কে। হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠলো। এক চিলতে আশার আলো দেখা দিলো। ডান হাতের উল্টো পিঠে অশ্রুবিন্দু মুছে দ্রুত পায়ে সদর দরজার পানে এগিয়ে গেলেন মালিহা। একবুক আশা নিয়ে প্রসন্ন চিত্তে দরজা উন্মুক্ত করলেন। লহমায় আশাহত হলেন মেয়ে ও মেয়ে জামাইকে দেখে। কান্নাভেজা কণ্ঠে ইনায়া বলে উঠলো,

” ভাবী কোথায় আম্মু? ”

কেঁদে উঠেছে মেয়েটা। ওর অবস্থা দেখে বাকশূন্য মালিহা। উনি নিজেও কেঁদে চলেছেন। কি বলবেন জানা নেই। ফাঁকা লাগছে মস্তিষ্ক। রাহিদ পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারলো।

” ফুপি! ভাইয়া কোথায়? ওর সাথে কন্টাক্ট হয়েছে? ”

ভেজা কণ্ঠে নেতিবাচক জবাব দিলেন মালিহা,

” না বাপ। ও। ও ফোন তুলছে না। তুই একটু গিয়ে দেখ না। আমার মেয়েটা। আমার সোনা মেয়ে। ও কোথায় গেল? একটু দ্যাখ না বাপ। ”

ক্রন্দনে ভেঙে পড়লেন মালিহা। বৃদ্ধা রাজেদা খানম আশাবাদী হয়ে দুর্বল পায়ে এখানে এলেন। তবে হতাশ হলেন কাঙ্ক্ষিত মানবীকে না দেখে। ওনার চোখেও নোনাজলের অস্তিত্ব। রাহিদ বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে ফুপুর দু কাঁধ আঁকড়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলো,

” ফুপি। একটু শান্ত হও তোমরা। আল্লাহ্’কে ডাকো। এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে? আমি এখুনি যাচ্ছি। দেখি ভাইয়া কোথায়। আমি নিশ্চিত ভাইয়া অলরেডি খবর পেয়ে গেছে। সে বসে নেই। অলরেডি চিরুনি তল্লাশি শুরু হয়ে গেছে। প্লিজ হ্যাভ ফেইথ(faith)। একটু শান্ত হও। ঠিক আছে? ”

ফুফুর ললাটে আলতো চুমু এঁকে সরে গেল রাহিদ। চোখ পড়লো স্ত্রীর পানে। সে করুণ চাহনিতে ওর পানেই তাকিয়ে। রাহিদ চোখের ইশারায় ভরসা প্রদান করলো। অতঃপর এক মুহুর্ত বিলম্ব না করে পকেট হতে মোবাইল বের করলো। ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে গেল বাড়ি হতে। ইনায়া মা’কে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। বড় ভয় করছে। অস্থির অন্তঃস্থল।

‘ ভাবী। তুমি কোথায়? ‘

.

রাতের শহর। আলো ঝলমলে পরিবেশ। ঘড়ির কাঁটা তখন দশের কাছাকাছি। এখনো জমজমাট শহরের বড়বড় সড়ক। তেমনই এক ব্যস্ত সড়ক ধরে ছুটে চলেছে মেরুন রঙের টয়োটা প্রিমিও। গাড়ির নিয়ন্ত্রণ ইরহাম চৌধুরীর হাতে। দক্ষতার সহিত গাড়িটি নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে শহরের এ প্রান্তে। ও প্রান্তে। একাকী নিরাপত্তা বিহীন বেরিয়ে পড়েছে সে। বাঁ কানে গুঁজে ওয়্যারলেস ব্লুটুথ ইয়ারবাড। শুভ্র রঙা পাঞ্জাবি স্বেদজলে সিক্ত হয়ে সুঠামদেহে লেপ্টে। এসির শীতলতা তাকে স্বস্তি দিতে ব্যর্থ। বাজপাখির চেয়েও তীক্ষ্ণ চাহনিতে চলন্ত গাড়ি হতে এদিক ওদিক একান্ত নারীকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। অপরদিকে তার দেহরক্ষীরা! তারাও বসের নির্দেশ মোতাবেক কর্মে নিয়োজিত। দলবল সহকারে একতা ও সমন্বয় বজায় রেখে শহরের যত্রতত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে মিসেস শেখ’কে। এমপি পত্নী নিখোঁজ। বাতাসের বেগে খবরটি ছড়িয়ে পড়েছে শহর জুড়ে। নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে!

” ব্রেকিং নিউজ! সংসদ সদস্য ইরহাম চৌধুরীর স্ত্রী মিসেস হৃদি শেখ আজ সন্ধ্যা হতে নিখোঁজ। আমাদের রিপোর্ট মোতাবেক, বন্ধুর বাড়ি থেকে গ্রুপ স্টাডি করে নিজের বাড়ি ফিরছিলেন মিসেস হৃদি শেখ। মাঝপথে হঠাৎই তিনি লাপাত্তা হয়ে যান। শুধু উনি একা নন। ওনার একজন বডিগার্ডও নিখোঁজ। তবে কি এই দু’টো নিরুদ্দেশ ঘটনা একে অপরের সাথে সংযুক্ত? সকলের চোখে ধুলো দিয়ে কোথায় হারিয়ে গেলেন মিসেস হৃদি শেখ এবং বডিগার্ড মুরাদ ? নাকি এর পেছনে রয়েছে কোনো গোপন ষ-ড়যন্ত্র? পরবর্তী আপডেট জানতে আমাদের সঙ্গেই থাকুন। ”

এমনই মুখরোচক সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে চ্যানেলে চ্যানেলে। গুজব উঠেছে হয়তো সে বডিগার্ড ‘মুরাদ’ এর সঙ্গেই পালিয়েছে এমপি পত্নী। হয়তো তারা অবৈধ সম্পর্কে জড়িত ছিল। সুযোগ বুঝে আজ পলায়ন করেছে। কি ঘৃণ্য সংবাদ!
.

নিউজ চ্যানেলের মাধ্যমে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত খবর জানতে পারলো হৃদির পরিবার। ফারহানা মেয়ের নিখোঁজ সংবাদ সইতে পারলেন না। মুহুর্তের মধ্যেই চেতনা হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন। আঁতকে উঠলো পরিবারের সদস্যরা। হৃদির চাচি নাজরিন ছুটে গেছেন ওনার কাছে,

” ভাবী! ভাবী কি হয়েছে তোমার? নীতি! তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে আয়। ”

নাজরিনের কোলে অচেতন ফারহানা পড়ে। নীতি দ্রুত পায়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো। মায়ের হাতে দিলো গ্লাস। নাজরিন তাড়াতাড়ি বড় জায়ের চোখেমুখে পানি ছিটাতে লাগলেন। রায়হান সাহেব ততক্ষণে প্রস্থান করেছেন। ঘরের বিষয় ঘরের মেয়ে-বউরা ঠিক সামলে নেবে। ওনায় এই মুহূর্তে পুলিশ স্টেশন যেতে হবে। ওনার কলিজার টুকরো ছোট মেয়েটা যে নিখোঁজ। তাকে যে করেই হোক খুঁজে বের করতে হবে।
.

চব্বিশ ঘণ্টার আগে পুলিশ কোনো মিসিং কমপ্লেইনে কর্মলিপ্ত হয় না। তবে এবারের বিষয়টি বেশ হাই প্রোফাইল। ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট এজাজ চৌধুরীর পুত্রবধূ, সাংসদ ইরহাম চৌধুরীর স্ত্রী, নামকরা ইঞ্জিনিয়ার রায়হান শেখের কনিষ্ঠ কন্যা মিসেস হৃদি শেখ নিখোঁজ। ক্ষমতার জেরে পুলিশ বারো ঘন্টা অতিবাহিত হতে না হতেই কাজে লেগে পড়লো। ইরহামের বন্ধু এসপি তাঈফ সেও বিষয়টিতে জড়িয়ে পড়লো। ভাবী বলে কথা। শহরের আনাচে কানাচে তখন অভিযান চলছে। কোথাও কেউ নেই। রাতারাতি হৃদি যেন উধাও। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এ কি করে সম্ভব? কোথায় তবে ইরহামের হৃদরাণী?

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে