মনের গহীনে শুধুই তুমি পর্ব-৫+৬+৭

0
1576

#মনের_গহীনে_শুধুই_তুমি
#পর্ব_5+6+7
#Mst_Meghla_Akter_Mim

রোজা চৌধুরী আর মিমি হাসান মেঘ কে নতুন বউ এর মতো সাজিয়ে দিলো। মেঘ বললো, “তোমরা আমায় এইভাবে সাজিয়ে দিলে কেনো?”

রোজা চৌধুরী নজর টিপ দিয়ে দিয়ে মেঘের থুতনী ধরে বললো, “বাহ বেশ সুন্দরী তো আমার বউ মা। আজ তো তোমাদের বাসর রাত তো সাজাতে তো হবেই।”

উনার কথা শোনা মাত্র মেঘ বসা থেকে উঠে বললো,” নাহ! এইসব এর কোনো দরকার নেই।”

মিমি হাসান মেঘের সামনে গিয়ে বললো,” কি দরকার আছে আর কি দরকার নেই সেটা তোকে বুঝতে হবে না।”

অর্চি রোদ কে বলে এসে মেঘের সাজ ঘরে এসে বসে নিজে নিজে বলছে,” ছেলে গুলো বোবা নাকি বুঝিনা।”

মেঘের কাছে গিয়ে বললো, “এই মেঘ তোর স্বামীর কি বোবা বন্ধু আছে নাকি।”

মেঘ মুখ ভার করে বললো,” আমি আমার স্বামীকে ই আজ প্রথম দেখছি তার বন্ধুর কথা কিভাবে বলবো বল আমায়!”

রোজা চৌধুরী বললো, “কি হয়েছে মা?”

–“আর বলেন না আন্টি। গিয়ে বললাম ভাইয়া কে তাড়াতাড়ি রেডি করে দিতে কিন্তু শুধু মাথা নাড়াল কোনো কথা বললো না কেউ।হা করে তাকিয়ে থাকে!”

রোজা চৌধুরী আর মিমি হাসান হেসে উঠলো। মিমি হাসান একটু হাসি থামিয়ে বললো,” বেয়ান চলুন আমরা বাহিরে যায়। মা দের বাসর ঘর পর্যন্ত যেতে নেই।”

–” তাই তো! চলুন যায় আমরা।”

–অর্চি মা তুই মেঘ কে নিয়ে যা ওখানে আয়রা, সাপা আর দিহান আছে, ঘর সাজাচ্ছে।(মিমি হাসান)

অর্চি মাথা নারাল। মিমি হাসান মেঘের কাছে এসে গালে হাত দিয়ে বললো,” আজ থেকে তুই বিবাহিত। আর বিয়ের পর সবাই কে ভালো রাখার দায়িত্ব তোর। ভালো থাকিস মা।”

মেঘ কেঁদে উঠে মিমি হাসান কে জড়িয়ে ধরলো। মিমি হাসান চোখের জল লুকিয়ে রেখে ঘর থেকে গেলেন। অর্চি মেঘের কান্না থামানোর চেষ্টা করছে আর বলছে,

–“আরে মেঘ তোর সাজ নষ্ট হবে তো। আর কান্না করিস না চল।”

মেঘ আর অর্চি ঘর থেকে বেরোতেই প্রতীক হাসান সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো। মেঘের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

–” জীবন অনেক কঠিন মেঘ। আর মনে রেখো এই পৃথিবীতে মুখের চেয়ে মুখোশের সংখ্যা বেশি! তাই সাবধানে থেকো।”

–“কিন্তু বাবা এইখানে সাবধানে থাকার কি আছে? এনারা তো খুব ভালো।”

–“মেঘ রে অনেক কারণ আছে সে কারন গুলো পড়ে জানবে। চোখ কান সোজাগ রেখো সবসময় আর মনে রেখো তোমার পাপ্পা সবসময় তোমার সাথে আছে।”

–” ওকে পাপ্পা।”

প্রতীক হাসান মেঘের মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন।
_________
দিহান ফুল দিয়ে বেড সাজানোর সময় বারবার আয়রার সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজছে। আয়রাও যেনো দিহানের কথায় খুব আনন্দ পাচ্ছে। কথায় কথায় আয়রা দিহানকে জিজ্ঞেস করলো ওর কেমন মেয়ে ভালো লাগে। দিহান চোখ বন্ধ করে বললো,

–” আমার তো তেমন মেয়েই পছন্দ যে খুব বেশি কথা বলে না। সারাদিন বই পড়ায় ব্যস্ত আর তোমার মতো একটা মিষ্টি মেয়ে।”

আয়রা দিহানের কথায় লজ্জা পেয়ে গেলো। ওদের চোখে চোখে এক অদ্ভূত কথা চলছে যেনো। সাপা দিহানের মাথায় গোলাপ দিয়ে মেরে বললো,

–“কি হয়েছে তোর বল তো? মেঘের আসার সময় হলো তো। চল নিয়ে আসি।”

আয়রা স্বাভাবিক হয়ে বললো,” হ্যাঁ আপু চলো ভাবি কে নিয়ে আসি।”

সাপা, আয়রা আর দিহান ঘর থেকে বেরোতে যাবে তখনই অর্চি মেঘ কে নিয়ে এসে বললো, “আর তোমাদের যেতে হবে না। আমি নতুন বউ কে নিয়ে এসেছি।”

আয়রা মেঘের দিকে তাকিয়ে বললো,” ভাবি ভাইয়া তোমাকে দেখে নির্ঘাত ঘায়েল হয়ে যাবে।”

দিহান মেঘ কে বেডে বসিয়ে বললো,” আরে তোকে সাজালে খুব সুন্দর লাগে তো! যাক আজ অন্তত সাজতে না করিস নি।”

মেঘ মুখ ফুলিয়ে বললো,” আজকেও ইচ্ছা ছিল না সাজার কিন্তু কি করব পোরা কপাল আমার। ওই বদ রাক্ষস এর সাথে এই ঘরে থাকতে হবে আমার। ”

–” ভাবি তুমি ভাইয়া কে রাক্ষস বলতে পারো না।”

–“বলব না কেনো? তোমার ভাইয়া আমাকে রাক্ষসী বললো তাতে কিছু না তো! ”

সাপা মেঘের পাশে বসে বললো,” ঠিক বলেছিস তুই। ও রাক্ষস আর তুই ওর রাক্ষসী। ”

মেঘ রেগে গেল কিন্তু সবাই হেসে উঠলো। অর্চি বাহিরে উকি দিয়ে বললো,” এই চল আমরা বাহিরে যায় ভাইয়া আসার সময় হয়ে গেলো মনে হয়। ”

–” তোরাও থাক এইখানে উনাকে ঘরের বাহিরে রেখে দিবো। ”

দিহান হেসে বললো, – “হ্যাঁ বাসর করবি তোরা আর আমরা থাকব তাইনা? শোন তোর দুই বান্ধবী তো আঙ্কেল আন্টির সাথেই যাবে তাই ওদের ও দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

মেঘ মুখ ভার করে বললো,” হ্যাঁ যা তোরা। ”

আয়রা মেঘ কে বললো,” ভাবি মাথায় ঘোমটা দিয়ে চুপ করে বসে থাকবে ওকে? ”

মেঘ অনিচ্ছা স্বত্বেও হাসি দিলো। সবাই দরজা একটু লাগিয়ে বাহিরে চলে গেলো।
_______
রোদ ঘরের দিকে আসতে নিতেই মেঘের বন্ধুদের সাথে দেখা হয়ে গেলো। রুদ্র অর্চিকে দেখে রোদ কে বললো,” তুই একা যা আমার একটু কাজ আছে ।”

–” তোদের আসতে বলিনি। আমার ঘর আমি চিনি খুব ভালো করে যা তোরা। ”

রুদ্র অর্চির পেছন পেছন চলে গেলো আর রাহুল তো ওর গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতে busy. রোদ একা একা যেতে যেতে বলছে, “আমার জান শেষ আর ওদের প্রেম সৃষ্টি হচ্ছে। বন্ধু নামে কলঙ্ক শালা রা। ”

এমন সময় ইহারা রোদের সামনে এসে দাঁড়ালো। রোদ ভ্রু কুঁচকে বললো,” কিছু বলবি?”

–“তোমাকে না আজ খুব সুন্দর লাগছে। আর তুমি ওই মেয়েকে বের করে দাও। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।”

–“শোন তোর মাথা খারাপ হতে পারে কিন্তু আমার মাথা পুরোপুরি ঠিক আছে। আমি তোর বড় ভাই এর বাহিরে অন্য কিছু ভাবতে যাস না কষ্ট নিজেই পাবি। ওই মেয়েকে আমি মেনে নেই আর না নেই সেটা তোর ভাবতে হবে না। ”

রোদ চলে এলো। ইহানা রেগে চলে গেলো।
_________
মেঘ সবার চলে যাওয়া দেখেই মাথার ঘোমটা তুলে ঘরে পায়চারী শুরু করলো। পুরো ঘর ফুল দিয়ে সাজানো আর সব ফুলই গোলাপ আর রজনীগন্ধা। পুরো ঘর ফুলের গন্ধে মো মো করছে। মেঘ পুরো ঘরের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলো ঘর টা এমনিতেও খুব সুন্দর করে গোছানো। সাধারণত ছেলেদের ঘর এতো সুন্দর হয় না কিন্তু এ ঘর দেখে মনে হচ্ছে কোনো মেয়ে গুছিয়ে রেখেছে। পুরো ঘর প্রায় ছবি দিয়ে ভরা। ছবি গুলো অসাধারণ দেখতে, তার মাঝে দু একটা রোদের ছবি। মেঘ রোদের ছবি দেয়াল থেকে নামিয়ে নিয়ে বললো,

–“ব্যাস এইবার ঠিক আছে।”

দরজার বিপরীতে একটা টেবিল আছে সেখানে অনেক বই রাখা। আর টেবিল এর উপরে একটা ক্যামেরা রাখা। মেঘ এইসব দেখে একা একা বললো, “তাহলে এই ছবি গুলো আপ্নার ই তোলা। রিয়েলি অসাধারন ফটোগ্রাফার আপনি।”

বেডের দিকে আসতে নিতেই বেডের উপরের দেয়ালের দিকে মেঘের চোখ পড়লো। দেয়ালে কিছু একটা ছবি আছে খুব বড় কিন্তু তা সাদা কাপড়ে ঢাকা। মেঘ কৌতুহল বসত দেয়ালের কাছে গিয়ে কাপড় টায় হাত দিতে নিলো। তখনই বাহিরে থেকে রোদ বলে উঠলো,

–” এই মেয়ে তুমি কি করছো ওখানে হ্যাঁ? ”

রোদের কথায় মেঘ কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো। পরক্ষণেই হেসে বললো, “দেখছিলাম ঘর টায় কি কি পরিবর্তন করতে হবে।”

রোদ মেঘের সামনে এসে না বুঝার ভান করে বললো, “কি পরিবর্তন করবে তুমি? কি সব বল পাগলের মতো!”

মেঘ রেগে কোমরে হাত দিয়ে বললো,” এখন আবার পাগল বলছেন আমায়। আপ্নার সাহস তো কম না। এইতো আপ্নার এই পুরো ঘরের মানচিত্র পাল্টে দিবো আমি দেখে নিবেন। ”

–” মেঘ বলে দিলাম আমার ঘরের কোনো কিছুতে তুমি হাত দিবে না। আর তুমি এই ঘরে কাল থেকে থাকবে না। বাড়িতে চলে যাবে।”

মেঘ বেডের উপরে বসে রোদের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দিয়ে বললো, -” যাবো তো বাড়িতে কিন্তু সাথে আপনিও যাবেন তারপর আবার আপ্নার সাথে আমি চলে আসব। আর অন্য ঘরে কেনো থাকবো আমি তো আপনার স্ত্রী তাইনা? ”

রোদ বললো,” আমি তোমাকে স্ত্রী বলে মানি না। ”

মেঘ রোদের মুখের সামনে গিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললো, “তো এই বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য কেনো আপনি স্বামীর জোর দেখিয়েছিলেন? নিজের বাবার জন্য আমায় নিয়ে এসেছেন তারপরেও অনেক অপমান ই তো করেছেন আমায়। তো এখন এই স্বামীর জোর দেখানোর শাস্তি তো আপনাকে পেতেই হবে মিস্টার রোদ্দুর চৌধুরী।”

রোদ দাঁত কটমট করে বললো, “আমার জীবন শেষ করে দিলো এই মেয়ে। ”

মেঘ হেসে বললো,” সবে তো কয়েক ঘণ্টা হল আমাদের দেখা হওয়ার এতেই শেষ হলে হবে নাকি। ”

রোদ মেঘের দিকে এগিয়ে এসে বললো, -” কি এতো নতুন বউ সেজেছো কেনো? আমি তোমাকে মানি না বুঝতে পারো না নাকি! ”

মেঘ বেডে বালিশে হাত রেখে বললো, “আমিও আপনাকে মানি না ভুলে যাবেন না বুঝেছেন। আর এইসব সাজার কোনো ইচ্ছা ছিল না মায়েরা জোর করেছে তাই. .. কিন্তু আপনি এইভাবে শেরয়ানি পড়ে কেন?”

–“একই অবস্থা! বাবার কথায় পড়তে হয়েছে। ”

মেঘ হাসতে শুরু করলো। রোদ তাকিয়ে ওর হাসি দেখছে, মেঘের হাসি যেনো রোদ কে মোহিত করছে রোদ না চাইতেও। চোখের তাকিয়ে থাকা খেয়াল করে মেঘ হাসি থামিয়ে বললো,

–” আপনি সোফায় শুয়ে পড়ুন আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। ”

রোদ চোখ বড় করে বললো,” আমার ঘরে আমি সোফায় ঘুমাব আর তুমি বেডে! এইটা সম্ভব না তুমি সোফায় ঘুমাও।”

মেঘ শুয়ে পড়ে বললো, “পছন্দ না হলে ফ্লোরে ঘুমান কিন্তু আমি সোফায় ঘুমাতে পারবো না।”

রোদ মেঘের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,” উঠো তুমি বলছি নাহলে…. ”

মেঘ শুয়ে থেকেই বললো, “নাহলে কি? আমার সাথে এতো বেশি রাগ দেখালে আমি কিন্তু বাবা কে ডেকে দিবো তখন কেমন হবে? ”

রোদ সোফায় গিয়ে বসে বললো,” এই আমার বাবা হয়েছে উনার জন্য এখন জীবনে যা যা করিনি সব করতে হবে।”

মেঘ রোদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে অন্য পাশ হয়ে ঘুমানোর ভান করলো। রোদ চেঞ্জ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল। মেঘ একটু পর রোদের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বেড থেকে উঠে ওর সামনে গেলো। ওর চোখের সামনে হাত নাড়াল কিন্তু ওর কোনো সাড়া নেই। মেঘ কোমরে হাত দিয়ে বললো,

–” বাহ নবাব সাহেব ঘুমিয়ে পড়েছে এত তাড়াতাড়ি।”

মেঘ রোদ কে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করছে। ফ্যানের বাতাসে রোদের চুল একটু করে উড়ছে, ফর্সা গায়ের রং, ভীষণ মায়াবী চেহারা। মেঘ পর্যবেক্ষণ শেষে বললো,

–“না বেশ সুন্দর আপনি কিন্তু ঘুমে থাকলে। ঘুম থেকে জাগ্রত হলেই তো একটা বান্দর আপনি। যাইহোক এখন শান্তিতে একটু আমিও ঘুমাই থাকুন।”
_________

আয়রা অনেক ঘুমানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ঘুম আসছে না। বারবার দিহানের মুখ টা ভেসে উঠে আর কানে বাজছে দিহানের প্রতিটা কথা। আয়রা সবে ইন্টারে পড়ছে। এইসব মনের ভেতরে এক অন্য রকম অনুভূতি কাজ করে। আয়রা কখনো কোনো ছেলের সাথে এতক্ষণ থাকে নি। কিন্তু দিহানের সাথে থেকে ওর অনেক ভালো লাগছে। আয়রা আনমনে হেসে উঠছে দিহানের কথা ভেবে। একা একা বলছে,

–“এমন কেনো হচ্ছে আমার? এ অনুভূতি বড্ড অচেনা আমার। তবে কি আমি প্রেমে পড়ে গেলাম? কিন্তু প্রেম তো খুব সাময়িক ব্যাপার, তবে কি প্রেম থেকেই ভালোবাসা তৈরি হয়! দিহান আপ্নার মনের গহীনে কি অন্য কারো বাস? না আমি আর ভাবব না কারণ মন ভাঙতে চাই না আমি। কাউকে ভালোবেসে হারানোর কষ্ট নিজের চোখে ছোট থেকে দেখে আসছি আমি। আমি চাই না ভাইয়ার মতো আমিও কষ্টের আগুনে ঝলসে যায়। এখন শুধু ভাবি যেনো ভাইয়া কে আবার ভালোবাসার পরশ দিয়ে স্বাভাবিক করতে পারে এইটাই চাওয়া। ”

আয়রা জোর করে ঘুমানোর চেষ্টা করছে কিন্তু তবুও দিহানের চেহারা চোখের সামনে বারবার আসছে। মনের উপরে জোর চলেনা আয়রা তা ভালোভাবেই বুঝতে পারছে।
________

। বৃষ্টির শব্দে চারিদিকে এক মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। মিস মৌ বারান্দায় এক ক্যাপ ধোঁয়া উঠা চা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। অপলক দৃষ্টিতে বাহিরের বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে। টিপ টিপ বৃষ্টির শব্দে মন ভালো হয়ে যায় কিন্তু মিস মৌ এর মন টা ভীষণ খারাপ। ধোঁয়া উঠা চা হিম ঠান্ডা চায়ে পরিণত হলো তবুও এক চুমুকও চা পান করেনি মিস মৌ, সে বৃষ্টির পানে এখনও তাকিয়ে আছে। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে উনি যেনো কাউকে মন ভরে দেখছে কিন্তু সামনে কেউ নেই। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে উনার। মিস্টার নীল অনেক খুশি নিয়ে মিস মৌ এর দিকে এগিয়ে আসলেন কিন্তু উনার কাছে এসে উনার খুশিও কেমন জানি মলিন ভাব ধারণ করলো। মিস্টার নীল মিস মৌ এর কাঁধে হাত রাখলো। মিস মৌ ঘোর থেকে বেরিয়ে চোখের জল মুছে নিলো। মিস্টার নীল শান্ত গলায় বললো,

–” চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। কি ভাবছ এত? রাস্তায় কেউ নেই মৌ!”

–“কেনো নেই কেউ? ওই দেখো আমার মেয়েটা কে দেখতে পারছি আমি। গুটি গুটি পায়ে হাঁটছে আর আমাকে ডাকছে মা মা বলে।”

মিস্টার নীল মিস মৌ কে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললো, “মৌ আমাদের মেয়ে হয়তো আর বেঁচেই নেই। প্রিন্স কে দেখে পায়েল কে ভুলে থাকার চেষ্টা করো প্লিজ।”

মিস মৌ কান্না করছে। বললো,” কিভাবে ভুলে যাবো আমি আমার মেয়েকে? আমি তো মা। তুমি কি ভুলে গেছো সত্যি করে বলো।”

–” না ভুলে যাই নি। আমার একমাত্র মেয়েকে আমিও ভুলতে পারিনি। শুধু কি আমরা বল আমাদের সাথে সাথে রোদও ওকে এখনও ভুলতে পারে নি।”

-” সেদিনের কথা আমার এখনো চোখে ভাসে জানতো। আজ থেকে ষোলো বছর আগে, তখন পায়েল মাত্র তিন বছরের। আমরা বাংলাদেশ এ আমাদের নিজেদের বাড়িতে থাকতাম। কেবল মাত্র দু একটা কথা বলতে পারে মেয়েটা। রোজা আমার বন্ধু সেই সুবাদে রোদ আর পায়েলের বিয়ে ঠিক করে রাখতে জোর করলো আদিল ভাইয়া। আমরাও রাজি হয়ে গেলাম। রোদ তখন নয় বছরের ছোট ছেলে কিন্তু পায়েলের প্রতি ওর ভালোবাসা তখনই তৈরি হয়ে গেছিল আর তা এখনও আছেই। ওদের বিয়ে ঠিক করার দিনেই কে যেনো ওকে কিডন্যাপ করলো আর খুঁজে পেলাম না আমাদের মেয়েটা কে, আর পেলাম না।সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় রোদের জন্য এখনও ও পায়েলকে খুঁজে যায়। ”

মিস মৌ দুকরে কেঁদে উঠলো। মিস্টার নীল আরো শক্ত করে মিস মৌ কে জড়িয়ে ধরলেন। মিস্টার নীল এর চোখ থেকেও পানি পড়ছে। উনি মিস মৌ কে বললেন,

-” রোদের কষ্ট লাঘব করার কেউ একজন এসেছে মৌ! এইবার হয়তো রোদ আবারো অন্য কাউকে ভালোবাসবে!”

মিস মৌ মিস্টার নীলের বুক থেকে মাথা তুলে বললো, “কে এসেছে? তোমার কথা আমি কিছুই বুঝছি না।”

মিস্টার নীল মুচকি হেসে বললো, “রোদ বিয়ে করেছে। অবশ্য ইচ্ছা কৃত ভাবে না একটা পরিস্থিতিতে পরে।”

-” তুমি কিভাবে জানলে?”

-” আদিল এসএমএস পাঠিয়েছে। শুধু এইটুকুই বলেছে আর বলেছে বাকিটুকু দেশে গেলে বলবে আর আমাদের তাড়াতাড়ি দেশে যেতে বললো।”

-” আমি আর দেশে ফিরতে চাই না। একদিন ওই দেশে আমি আমার নিজের মেয়েকে হারিয়ে ফেলেছি আর যেতে চাই না। মেয়ের স্মৃতি ভুলতে আমরা এই দেশে এসেছি আর পুরোনো স্মৃতি জাগিয়ে তুলতে চাই না নীল!”

মিস্টার নীল মিস মৌ এর গালে দু হাত দিয়ে বললো,”সেদিন চলে এসেছিলাম কিন্তু রোদের জীবনের সাথে যে মেয়ে জড়িয়ে গেছে তাকে আশীর্বাদ করাটা আমাদের তো উচিত তাইনা? ওই মেয়েটা কে আমাদের মেয়ে মনে করব তাহলে হয়তো কষ্ট অনেকটাই কমে যাবে।”

মিস মৌ নিচু দিকে মাথা করে বললো,” হুম। কবে যাবে? আর প্রিন্স যেতে চাইবে তো?”

-“দু তিন দিন পর যায়? এইখানে business এর সবকিছু ম্যানেজার কে বুঝিয়ে দিতে হবে। আর প্রিন্স নিশ্চয় রাজি হবে কারণ ও তো বাংলাদেশ দেখতে চায়।”

-” ওকে তুমি যা ভালো মনে করো।”
__________
ভোরের আলো ফুটবে ফুটবে ভাব। মেঘ আর রোদ গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। রোদ ঘুমের মাঝেই ছপপট করছে। রোদের কানে ছোট একটা মেয়ের খিল খিল করে হাসির শব্দ ভেসে আসছে। কিছুক্ষণ বাদে সে হাসি থেমে গিয়ে একটা উনিশ বিশ বছরের মেয়ের কান্নার আওয়াজ আসছে রোদের কানে। স্বপ্নের ভেতরে সে কান্নার আওয়াজ রোদের মাথায় ঘুরছে। একটা মেয়ে রাস্তার মাঝে বসে আছে তার চেহারা বুঝা যায় না, মেয়েটা কান্না করছে আর বলছে,

-“রোদ তুমি আমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিলে? আমাকে ভুলে গেলে রোদ! আমি আর আসব না তোমার কাছে চলে গেলাম চিরতরে রোদ! ভালো থেকো।”

মেয়েটার কথা শেষ হতে হতে মেয়েটাও রোদের স্বপ্ন থেকে মিলিয়ে গেলো। রোদ ঘুম থেকে ‘পায়েল’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠে বসলো। ফ্যান অন করা থাকতেও রোদের গা ঘামে একাকার হয়ে গেছে। মনের ভেতরে ছটপট করছে। রোদ উঠে কাঁপা কাঁপা হাতে পুরো এক গ্লাস পানি খেলো। তারপর মাটিতে বসে পড়ে বললো,

-“পায়েল আমায় ছেড়ে যেও না। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।”

মেঘের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি এই মেয়েকে কোনোদিন আমার মনের গহীনে জায়গা দিবো না কারণ এই মনের গহীনে শুধুই তুমি পায়েল।”

বসা থেকে উঠে পুরো ঘরের ফুল গুলো নষ্ট করতে শুরু করলো রোদ। কিছু ফুল মেঘের মুখে গিয়ে পড়লো তবুও মেঘের কোনো হুসই নেই ঘরে কি হচ্ছে। ক্লান্ত শরীরে ঘুম একটু বেশিই জেকে বসেছে মেঘের চোখে। রোদ ঘরের কিছু জিনিস ভেঙ্গে ফেললো। কিছু ভাঙ্গার শব্দে মেঘ ঘুম থেকেই বললো,

-“বান্দর রাতেও কি বান্দরপানা না করলে হয় না।”

বলে আবার পাশ ফিরিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। রোদ মেঘের কথা শুনে আরো তেলে বেগুনে হয়ে মেঘের দিকে তেড়ে গেলো। মেঘ কে ঘুম থেকে উঠাতে যাবে তখনই রোদের চোখ যেনো মেঘের দিকে আটকে গেলো। বাচ্চা মেয়ের মতো ঘুমিয়ে আছে, নিষ্পাপ মুখ। ঘুমন্ত মেঘ রোদের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করছে। রোদ খেয়াল করলো মেঘের চুলের দিকে, মেঘের চুল কালো নয় হালকা বাদামী রঙের। এই রঙের চুল আরো সুন্দর করে তুলেছে মেঘ কে। কিন্তু এই রঙের চুল রোদের মনে অন্য কারো কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। রোদ মেঘের দিকে তাকিয়ে বললো,

-” পায়েল!”

পরক্ষণেই রোদ স্বাভাবিক হয়ে মনে মনে বললো, “এ তো পায়েল নয়। এই মেয়ের চুল গুলোর রঙের সাথে শুধু মিল তা থাকতেই পারে। আর চুলে হয়তো কালার করা।”

ওদিকে সূর্যের আলো মেঘের চোখে পড়ায় মেঘের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। রোদ কে ওর সামনে দেখে চোখ বড় বড় করে বললো,

-” আপনি এখানে কেনো সরুন।”

মেঘ উঠে বসলো। পুরো ঘরের দিকে তাকিয়ে বললো,”ঘরের কি অবস্থা! এইসব কিভাবে হলো? আর আপনি এখানে কেনো?”

রোদ মেঘের একদম কাছে গিয়ে শয়তানী করে বললো,”এইসব কিভাবে হলো জানো না বউ!”

মেঘ চোখ বড় বড় করে আছে। তুতলিয়ে বললো,” আমি কিভাবে জানবো?”

রোদ শয়তানী হাসি দিয়ে বললো, “সারারাত তো আমরা বাসর করলাম তাহলে এরকম হবে না কি? আর তুমি ই তো আমাকে কাছে আসতে বললে।”

মেঘ রোদ কে ধাক্কা দিয়ে বললো, “মিথ্যা কথা বলছেন কেনো আপনি হ্যাঁ? আপনি আমার সাথে কি করেছেন বলুন।”

রোদ মিট মিট করে হাসছে। মেঘের চোখে পানি ও রোদের টি শার্ট চেপে ধরে বললো, “কি করেছেন আপনি আমার সাথে বলুন বলছি! ছি আপনি আমার সাথে এইসব করতে পারলেন।”

রোদ don’t কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,” বাবু আমি তোমার স্বামী না তোমার উপর সম্পূর্ণ অধিকার আছে আমার।”

মেঘ রোদের কথা শুনে ওকে ছেড়ে নীরব হয়ে গেলো। মাটিতে পড়ে গেলো আর চোখ বেয়ে পানি পড়ে যাচ্ছে। রোদ মেঘের দিকে তাকিয়ে আর মেঘের অবস্থা দেখে মনে মনে ভাবছে,

-” একটু বেশি ই বলে ফেলেছি মনে হয়। ইস মেয়েটা কাঁদছে।”

রোদ জোরে জোরে হেসে যাচ্ছে। মেঘ রোদের দিকে কাঁদো কাঁদো দৃষ্টিতেই তাকালো। রোদ হাসতে হাসতে মেঘের পাশে বসে বললো,

-” আরে আরে তোমার সাথে আমি কিছু করিনি। তুমি কত ভীতু! তোমার সাথে কিছু হলে তুমি কি বুঝতে না? আর তোমার মতো পেত্নীর সাথে কিছু করার ইচ্ছাও আমার নেই।”

মেঘ মুহূর্তেই অন্য রূপ যেনো ধারণ করলো। কান্না থামিয়ে প্রচণ্ড রেগে রোদ কে মারতে নিলো। রোদ মেঘ কে থামানোর চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ পর মেঘ নিজেই থেমে গিয়ে বললো,

-” সবকিছু নিয়ে মজা করবেন না বুঝলেন। এই জন্য আমি ছেলেদের পছন্দ করি না।”

-” কোথায় সবকিছু নিয়ে মজা করলাম? আমি তো একটা কথা নিয়ে মজা করলাম।”

মেঘ রোদের কথায় বিরক্ত হয়ে গোসল করতে চলে গেলো। আর বললো, “শুনুন লাগেজ এ আমার ড্রেস আছে ওগুলো তে যেনো হাত না দেয়া হয়।”

রোদ বেডে বসে হাফ ছেড়ে বললো,” হ্যাঁ তোমার ড্রেস তো আমি পড়ব তাই ওগুলো তে হাত দিতে যাব। পাগলা কুকুরে কামড় দিয়েছে নাকি আমায়।”

রোদ নিজে পুরো ঘর ঠিক করছে আর মনে মনে ভাবছে,”মেয়েটা অদ্ভূত কখনো ভয় পায় আবার কখনো ভয় দেখায়। তবে মেয়েটা খুব একটা খারাপ না।”

মেঘ গোসল করে বেরিয়ে পুরো ঘর ঠিক আগের মত দেখে বললো,” বাহ ভূত এসে সবকিছু ঠিক করে দিয়ে গেলো নাকি?”

রোদ ফোনের দিকে তাকিয়ে বললো,” আমার ঘর আমি ঠিক করেছি ভূতের দরকার পড়ে না বুঝলে।”

মেঘ তাওয়াল হাতে নিয়ে রোদ কে বললো,” হুম অনেক বুঝেছি। এখন গোসল করে নিচে আসুন ওকে? আমি গেলাম।”

রোদ ফোনের দিকে থেকে মাথা তুলে মেঘের দিকে তাকিয়ে আর নজর ফেরাতে পারছে না। ভেজা চুল থেকে পানি পড়ছে এখনও। রোদ নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,

-“গোসল করতে পারবো না সকালে আমি। আর….”
বলতে গিয়ে রোদ থেমে গেলো।

মেঘ ভ্রু কুঁচকে বললো, “আর কি?”

রোদ বললো, “না কিছুনা। এখনই গোসল করে আসছি।”

মেঘ দরজার দিকে যেতে যেতে একা একা হাসল। দরজা খুলতেই আয়রা মুখের সামনে এসে দাঁড়াল মেঘের। মেঘ ভয় পেয়ে বললো,

-“আয়রা তুমি এখানে? আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম।”

আয়রা হেসে বললো, “ভাবি আমি তো তোমাদেরই ডাকতে যাচ্ছিলাম। আম্মু নাস্তা রেডি করেছে তাই ডাকতে এসেছি।ভাইয়া কোথায়? আর তোমাকে তো বেশ লাগছে।”

-“তোমার ভাইয়া গোসল করছে। চলো উনি পরে আসবে আমি আর তুমি নিচে যায়। মা কে হেল্প করতে হবে তো।”

আয়রা একটু চাপা হাসি দিয়ে বললো, “হুম চলো ভাবি।”
.
রোজা চৌধুরী মেঘ কে কিছুই করতে দিলো না। আদিল চৌধুরী মেঘ কে ডাইনিং এ বসলো। এতক্ষণে ডাইনিং টেবিলে বাড়ির সবাই চলে এসেছে। শুধু রোদ আসে নি এখনো, মেঘ বারবার উপরের দিকে তাকাচ্ছে। ইশা চৌধুরী মেঘ কে দেখে বললো,

-“বিয়ের পরের দিন থেকেই থ্রি পিচ পড়তে হলো তোমার? নতুন বউ শাড়ী পড়তে পারো নি?”

মেঘ কি উত্তর দিবে কিছুক্ষণ ভাবলো। ইশা চৌধুরীর কথা শেষ না হতেই রোজা চৌধুরী বললো,

-“এখনকার মেয়েরা শাড়ী পছন্দ খুব কম করে। আর আমার বউ মা কে থ্রি পিচেই বেশি ভালো লাগছে।”

ইশা চৌধুরী মুখ বাঁকা করলো। মেঘ একটু হাসি মুখে বললো,” আসলে আন্টি আমি শাড়ী পড়তে খুব ভালোবাসি কিন্তু শাড়ী পড়তে পারিনা তাই পড়িনি।”

-“হ্যাঁ কত কি আর শুনব।” ইশা চৌধুরী খেয়ে নিয়ে উঠে গেলো।

আদিল চৌধুরী মেঘ কে বললো,” মা ওর কথায় কিছু মনে করো না।”

আয়রা পাশ থেকে ফিসফিস করে বললো, “ভালো কিছু দেখলেও এখন জ্বলবে ওদের।”

মেঘ মুচকি হেসে বললো, “না বাবা আমি কিছু মনে করিনি।”

আদিল চৌধুরী কিছু বলতে নিতেই রোদ কে আসতে দেখে বললো, “কি রে তোর ঘুম ভাঙতে এত সময় লাগে? আয় বউ মার পাশে বস।”

-“না আমি ওর পাশে বসব না।”

আয়রা হেসে বললো, “ভাইয়া মনে হয় ভাবীর সামনে বসবে যাতে ভাবি কে ভালোভাবে দেখতে পারে।”

আদিল চৌধুরী আর রোজা চৌধুরী হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করল। মেঘ কিছুটা লজ্জা পেলো। রোদ কোনো উপায় না পেয়ে মেঘের পাশেই বসলো। রোজা চৌধুরী রোদের প্লেটে স্যান্ডউইচ, পরোটা, খাসির মাংস, সবজি আর ডিম দিয়ে রোদ কে যেই দিতে গেলো মেঘ আটকালো। মেঘের আটকানো দেখে আদিল চৌধুরী, রোজা চৌধুরী সহ সবাই কিছু বুঝতে পারলো না। রোদ কিছুটা রেগে, রাগ চেপে রেখে বললো,

-“আবার কি হলো যে তুমি আম্মু কে আটকালে আমাকে খাবার দিতে? ”

মেঘ রোদের দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি টেনে বললো,”আপনি এখন আমায় জিজ্ঞেস করছেন? কি ভুলো মন আপনার। আপনি ই তো কাল রাতে বললেন তিন দিন আপনি শুধু নিরামিষ খাবেন কারণ আমার মত এত ভাল একটা বউ পেয়েছেন বলে।”

–“কি! কখন বললাম এইসব আমি? মিথ্যা কথা বলবে না মেঘ।”

–“বাবা আমি মিথ্যা বলছি না বিশ্বাস করুন। উনি মনেহয় আপনাদের সামনে লজ্জা পাচ্ছে তাই কথাটা বলেছে তা স্বীকার করছেন না।”

রোদ দাঁত চেপে চেপে বললো,” মিথ্যা বলাটা বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু… আমি নিরামিষ খেতে পারিনা।”

মেঘ আবার হেসে বললো,” সেজন্য ই তো আপনি নিরামিষ খাবেন বলেছিলেন। আল্লাহ এর কাছে শুকরিয়া আমি আপ্নার মতো এতো ভালো একটা স্বামী পেয়েছি। মা আমি উনার গা ছুয়ে বলছি কথাটা তাহলে আপনারা বিশ্বাস করবেন আমি জানি।”

মেঘ রোদের হাত স্পর্শ করতে যাবে তখনই রোদ উঠে বললো,” না না আমাকে ছুয়ে তোমার কিছু বলতে হবে না। আর যাইহোক আমি মরতে চাই না।”

আয়রা এক টুকরো রুটি নিয়ে বললো,” তাহলে ভাবীর কথা মেনে নিয়ে খেয়ে নে।”

মেঘ রোদের হাত ধরে বসিয়ে বললো,” অবশ্যই খাবেন এখন উনি।”

আদিল চৌধুরী আর রোজা চৌধুরী মলিন দৃষ্টিতে রোদের দিকে তাকিয়ে বললো,” তো বউ মা ওকে কি খেতে দিবো এখন?”

–” কেনো মা এইতো রুটি আর সবজি! কি রোদ খাবেন তো?”

–“খাচ্ছি!”

রোদ খুব কষ্টে রুটির টুকরো মুখে দিচ্ছে। আদিল চৌধুরী আর রোজা চৌধুরী রোদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আদিল চৌধুরী ফিস ফিস করে রোজা চৌধুরী কে বললো,

–‘ বাহ আমিষ ভোজী থেকে নিরামিষ খেতে শুরু করেছে। রোদ কবে শুরু নিরামিষ খেয়েছে মনে আছে তোমার?”

রোজা চৌধুরী হাসি চেপে রেখে বললো,” সে মনে নেই। ছোট থেকেই তো রোদ নিরামিষ শুধু খেতোই না। যাক আজ এই দৃশ্য টা দেখে মন ভরে গেলো।”

আয়রা খেতে খেতে বললো,” ভাইয়া নিরামিষ খেতে কেমন লাগছে এই প্রথমবারের জন্য??”

রোদ কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,” দারুণ লাগছে বোন, যেনো অমৃত!”

মেঘ রোদের কানের কাছে গিয়ে বললো,” সকালে আমার সাথে ওসব বাজে মজা করার revenge নিলাম। এখন বুঝুন কেমন লাগে।”

রোজা চৌধুরী মেঘ কে খাবার দিতে নিলো। মেঘ খাবার গুলো সরিয়ে দিয়ে বললো,” মা আমিও এতকিছু খেতে পারবো না। স্যান্ডউইচ টা শুধু খাবো। ”

-” এইসব বললে হবে না মা। খেতেই হবে।”

–“উফ তোমরা এতো ওকে জোর কেনো করছো? ও না খেয়ে থাকলে তো আমি আরো খুশি হব। “(রোদ)

–” রোদ….

মেঘ হেসে বললো,” মা ওর উপরে রাগ করবেন না। আসলে আমি সকালে এতো ভারী কিছু খাই না আর সকালে এতকিছু স্বাস্থ্যের পক্ষেও ভালো না।”

ইহানা সবে ঘুম থেকে উঠে টেবিলের দিকে আসতে আসতে বললো,” বড় মা আমার গ্রিন টি কোথায়?”

–“একটু দেরি কর নিয়ে আসছি।”

ইহানা রোদের পাশে বসে ওর খাবারের দিকে তাকিয়ে বললো,” তুমি এগুলো কি খাচ্ছ! এগুলো খাওয়া যায় নাকি?”

আদিল চৌধুরী বললো,” ও ওর এমন ভালো বউ পেয়েছে সেজন্য নিরামিষ খাবে তিন দিন নিয়ত করেছে।”

আয়রা বললো, “দেখ ইহানা দেখ একেই বলে ভালোবাসা। ভাইয়া ও নিরামিষ খাচ্ছে সেজন্য ভাবি ও শুধু স্যান্ডউইচ খাচ্ছে। ওদের কি ভালোবাসা দেখেছিস।”

মেঘ আর রোদ একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসছে আর মেঘ ভাবছে, “ভালোবাসা নাকি ছাই! আমি তো এমনিতেই সকালে খায় না।”

রোদ কি যেনো ভেবে ইহানা কে বললো,” ইহু তুই না আমাকে ভালোবাসিস!”

ইহানা লজ্জা পাওয়ার ভান করে বললো,” হুম অনেক ভালোবাসি।”

–” তাহলে আমি নিরামিষ খেলে তুই এইসব ভালো খাবার খেতে পারবি বল। আমি বলছি কি তুই আজ থেকে শুধু সকালে একটা রুটি খেয়ে সারাদিন থাকবি।”

ইহানা মুখ বাঁকা করে বললো,” অ্যাঁ..”

–“তুই আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসিস তার প্রমাণ দেয়ার সময় হয়েছে তো এখন তাইনা বল!”

–” হ্যাঁ ইহু প্রমাণ করে দে তোর চেয়ে ভাইয়া কে কেউ বেশি ভালোবাসে না।”

ইহানা উপায় না পেয়ে রাজি হয়ে গেলো। আদিল চৌধুরী মুখ চেপে হাসছে। উপস্থিত সবাই যেনো মজা পাচ্ছে। মেঘ সবকিছু না বুঝলেও এইটা বুঝতে পেরেছে ইহানা রোদ কে ভালোবাসে হয়তো।
________
মিমি হাসান তার একমাত্র জামাই এর জন্য উনিশ টা রেসিপি রান্না করছে। উনি খুশিতে আটখানা উনার একমাত্র জামাই আজকে প্রথম আসবে বলে কথা। এ দিকে অর্চি আর সাপা আগেই এসেছে দিহান একটু পর আসবে বলেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মিমি হাসান বলছে,

–” কখন আসবে আমার মেয়েটা আজ দুদিন ওকে ছাড়া আর ভালো লাগছে না। বারো টা বেজে গেছে।”

“আমি এসে গেছি মাম্মা।” – মেঘ দরজায় দাঁড়িয়ে বললো।

মিমি হাসান তাকিয়ে দেখলো শুধু মেঘ দাঁড়িয়ে আছে। মিমি হাসান মেঘের কাছে গিয়ে বললো, “সবাই কোথায়? তুই একা কেনো?”

“মাম্মা উনারা আসছে ওই দেখো। ”

মিমি হাসান তাকিয়ে দেখলো রোদ, আয়রা, রোজা চৌধুরী আর আদিল চৌধুরী আসছে। প্রতীক হাসান আর মিমি হাসান উনাদের অনেক ভালো করে আপ্রায়ন করলেন। অবুঝ চৌধুরী আর উনার ফ্যামিলি আসে নি বলে প্রতীক হাসান সবার সামনে মন খারাপ দেখলেও মনে মনে উনি কেনো যেনো বেশ খুশি। রোদ সকালে না খেয়ে দুপুরে মিমি হাসানের তৈরি খাবার গুলো বেশ তৃপ্তি সহকারে খেলো।
.
রোজা চৌধুরী, আদিল চৌধুরী মিমি হাসান আর প্রতীক হাসানের সাথে বসে গল্প করছে। আরেক ঘরে সাপা, অর্চি আর আয়রা গল্প করছে। মেঘ আর রোদ অন্য মেঘের ঘরে সবে গেলো। রোদ মেঘের ঘরে গিয়ে পুরো ঘর দরজায় দাঁড়িয়েই দেখে নিলো। মেঘের পুরো ঘর সাদা আর গোলাপি রঙের রঙে রঙিন। ঘরে কৃত্রিম প্রজাপতি আর তারার মেলা যেনো। মেঘ ঘরে এসে রোদ কে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে বললো,

–” কি ব্যাপার ভেতরে আসুন।আর দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?”

-“তুমি পেত্নী হলে কি হবে তোমার বাড়ি আর ঘর টা খুব সুন্দর কিন্তু।”

-“আপনি আবার আমায় এসব বলছেন। দেখুন সবসময় এগুলো ভালো লাগেনা কিন্তু। আমি কি পেত্নী নাকি যে সবসময় বলেন হুম?”

রোদ হেসে বললো, “তুমি খুব বাচ্চা আছো এখনও।”

-” আমি যেমনই হয় তাতে আপনার কি? আচ্ছা শুনুন আপনি রেস্ট নিন এখন ঝগড়া করার ইচ্ছা নেই। আমি একটু বাহিরে ঘুরতে যাই?”

রোদ ভ্রু কুঁচকে বললো,” কোথায় যাবে তুমি? গিয়ে দেখো কোথাও আমি কি কি বলি সবাই কে।”

-” আরে বাবা আপনি তো কিছুই বুঝেন না। আমি থাকলে আপনার এই ঘরে থাকতে তো ভালো লাগবে না আমি জানি। আর সবচেয়ে বড় কথা আপনার রেস্ট নেয়াও হবে না কারণ আমি থাকলেই ঝগড়া হবে।”

রোদ কিছুক্ষণ চুপ করে বললো, “ঠিক আছে যাও।”

মেঘ ঘর থেকে গেলো। ওকে অনেক খুশি খুশি লাগছে। রোদ মনে মনে ভাবছে,” আমার সুবিধার কথা ভাবলো এইটাও সম্ভব? কি জানি কোথায় যাবে, সারাদিন তো শয়তানী মাথায় ঘোরে মেয়েটার। তা যাইহোক আমার রাতে একটুও ঘুম হয়নি আমি একটু রেস্ট নেই।”
.
মেঘ বাড়ির বাহিরে গিয়ে দিহান কে কল করলো।

–কোথায় তুই এখন? আসবি কখন?

–এইতো তোদের বাড়ির কাছেই চলে এসেছি।

–এই শোন তোর আসতে হবে না আমি যাচ্ছি তোর কাছে। পরে বাড়িতে যাওয়া আগে বল যা যা আনতে বলেছিলাম এনেছিস?

–উফ তোকে নিয়ে আর পারি না। আমি আমার বাইক নিয়েই এসেছি আয় তুই। আর তোর costume আমার কাছেই আছে। তুই ওখানে থাক আমি আসছি।

–ওকে তাড়াতাড়ি আয়।
.
মেঘ বাইক চালাতে খুব ভালোবাসে। আর ওর এই ইচ্ছা পূরণ করেছে ওর বন্ধু দিহান। বাড়ির কেউ কিংবা দিহান ছাড়া কেউ জানে না মেঘ বাইকার। আর কেউ দেখলেও চিনতে পারে না কারণ পুরো বাইকারের ড্রেস পরে থাকে। মাঝে মাঝে বাইকারের ড্রেস না পড়লেও মাথায় হেলমেট থাকে তাই কেউ চিনতে পারে না। দিহান এসে মেঘ কে বাইক দিলো। মেঘ কয়েকদিন পর বাইক নিয়ে বেরিয়েছে। রুদ্র রাস্তায় হাটছিল হঠাৎ ওর সামনে সেই লেডি বাইকারকে দেখেই ও রোদ কে কল করলো।
______
রোদ একটু গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। অনেক ক্লান্ত রোদ। বারবার আজ সকালের স্বপ্নের কথা মনে পড়ছে। মনের ভেতরে কিছু প্রশ্ন জাগছে সত্যি কি পায়েল কে আর ফিরে পাবে না রোদ? রোদের ভাবনার মধ্যে রুদ্র কল করলো। রোদ অনিচ্ছুক ভাবেই কল তুলে বললো,

-” দোস্ত ভালো লাগছে না পড়ে কথা বলি?”

–আরে আগে শোন তুই। সেই লেডি বাইকার কে এখনই দেখলাম।

রোদ উঠে দ্রুত বললো, “কোথায় দেখেছিস? তাড়াতাড়ি বল আমায় আর ওকে একটু থামিয়ে রাখার চেষ্টা কর। আমি মেঘের বাড়িতে আছি এখনই আসছি।”

-তাড়াতাড়ি আয় ভাবীর বাড়ির কাছেই ফাঁকা রাস্তার মোড়ে দেখেছি।

রোদ দৌড়ে গিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। এই মেয়েকে ও খুঁজছে আজ থেকে তিন বছর আগে থেকে। রোদ ছবি তুলছিল কিছু পাখির এমন সময় এক লেডি বাইকার ওর ক্যামেরায় ধরা পড়ে। মেয়েটার মুখ না দেখেই মেয়েটা কে সেই থেকে খুঁজে বেড়ায় রোদ। রোদ ড্রাইভ করছে আর বুকের মাঝে ঢুকপুক করছে। অজানা এক মানুষের প্রেমে ও, না জানি কেমন দেখতে? কেমন সে? তাকে দেখার ইচ্ছায় রোদ ছটপট করছে। কিছুক্ষণ বাদেই রোদ কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছে গেলো। রুদ্র আর ও মেয়েটা কে খুঁজতে নিলো।

এদিকে মেঘ বাইক থামিয়ে হেলমেট হাতে নিয়ে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাস বইছে, মেঘের চুল গুলো বাতাসে ওর মুখে এসে পড়ছে। পাখির কিচিরমিচির ?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে