#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৮
(মুক্তমানদের জন্য উন্মুক্ত)
এতক্ষণে রহমান চাচার দিকে খেয়াল করেছে রুদ্র।
” উনাদের সামনে আগ বাড়িয়ে বিয়ের কথা বললেন কেনো আপনি? আপনার যদি আরেকটা বিয়ে করার ইচ্ছে থাকে তো বলুন চাচীকে গিয়ে বলে আসছি।”
“এসব কী বলছো তুমি? তোমার চাচি ভুলেও এসব শুনলে আমার গর্দান নিবে।”
কিছুটা হতাশ কন্ঠে বললেন রহিম চাচা। সারাদিন রুদ্র চেম্বারে যখন থাকে রহিম চাচাও বাড়িতে থাকে। রুদ্রর বাসা থেকে কয়েক মিনিটের পথ উনার বাসা। নিঃসন্তান দম্পতি উনারা,কিন্তু ভালোবাসার কমতি নেই। রুদ্র তো দুপুরে বাসায় ফেরে না তাই একেবারে সন্ধ্যায় আসেন রহমান চাচা। তারপর রান্নাবান্না শুরু করেন,মাঝে মধ্যে রাতে রুদ্রর সাথেই থাকে। রুদ্র অবশ্য কয়েকবার বলেছিল স্ত্রী’সহ তার বাসায় থাকতে কিন্তু রহমান চাচা গরীব হলেও আত্মসম্মান প্রচুর।
” আহারে! তারমানে চাচী কিছু না বললে আপনি ঠিক আরেকটা বিয়ে করতে রাজি ছিলেন?”
” তা ঠিক আরকি, না মানে না।”
রহমান চাচার মুখখানা দেখে রুদ্র আর নিজের হাসি চেপে রাখতে পারলোনা। রুদ্রকে এরকম হাসতে দেখে রহমান চাচা আরকিছু বললো না। রাতের খাবার রান্না করার জন্য রান্নাঘরে গিয়ে তরকারি কাটতে শুরু করেছেন তিনি। আজকের খাদ্য তালিকায় আছে পুটিমাছ আর বাঁধাকপি।
রাতের আকাশে একফালি চাঁদ কেমন আলো ছড়িয়ে আছে। চারপাশে তার কতশত তারাদের ভীড়! উত্তরের ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে আজকাল। এই যে এখনও ঠান্ডা বাতাস বইছে। মিহি বরাবরের মতোই চাঁদ দেখার জন্য ছাঁদে এসে উপস্থিত হয়েছে। চাঁদের সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত হয়ে গেছে মেয়েটা। মাঝে মধ্যে কয়েক টুকরো কালো মেঘেরা ঢেকে দিচ্ছে চাঁদকে। মেঘের আড়ালে চাঁদ! হঠাৎ করে রাহির কথা খুব মনে পড়ছে মিহির। মানুষ দূরে চলে যায় কিন্তু তার স্মৃতিগুলো রেখে যায় খুব কাছে।
” এত রাতে ছাঁদে কী করছিস তুই? ”
হঠাৎ ভাইয়ের আগমনে কিছুটা হকচকিয়ে গেলো মিহি। এমন সময় কখনো সে ব্যাতিত অন্য কেউ ছাঁদে আসেনা।
” আমি প্রতিদিন এমন সময় এখানে আসি। তুমি এলে কেনো?”
” ভালো লাগছিল না ঘরে, এজন্য ভাবলাম একটু খোলা আকাশের নিচ থেকে ঘুরে আসি।”
” ভালো করেছো। তোশা আপুর সাথে না-কি মা তোমার বিয়ে দিতে চান?”
” আর বলিস না! জীবনে আমার মাঝে মধ্যে এমন ভুল করে বসি পরে আর সেই ভুল শোধরাবার কোনো পথ খোলা থাকে না। ”
” কথায় আছে না কর্মফল? এসবকিছু তোমার কর্মফল। ভাবির মতো স্ত্রী পেয়েও হেলায় হারালে। ”
আদ্রিয়ান বোনের কথায় কিছু বলার মতো কথা পেলো না। আজ খুব কষ্ট হচ্ছে তার। বুকটা কেমন খাঁ খাঁ করছে। মনে হচ্ছে একবুক তৃষ্ণা জমেছে হৃদয়ে। এ তৃষ্ণা রাহির ভালোবাসা পাবার তৃষ্ণা! ভাইয়ের নিরবতা দেখে নিজে থেকেই আবারও কথার খেই ধরলো মিহি।
” আমি তো বেশি দিন থাকবো না বাসায় তুমি বরং ভাবিকে ফেরানোর চেষ্টা করো তার আগেই। বাবা-মা উঠেপড়ে লেগেছেন আমাকে পরের ঘরে পাঠানোর জন্য। ”
বোনের কন্ঠে স্পষ্ট অভিমানী সুর খেয়াল করলো আদ্রিয়ান।
” বোকা মেয়ে বিয়ে তো করতেই হবে তাই না? আজকেও গিয়েছিলাম রাহির অফিসের গেটের সামনে। ও দেখেও আমার জন্য একটু দাঁড়ালো না মিহি।”
কথাগুলো বলার সময় আদ্রিয়ানের গলা কেমন ভারী হয়ে এসেছে। মিহি এবার বেশ আগ্রহের সহিত ভাইয়ের দিকে আরো মনোযোগ দিলো। পূর্ণ দৃষ্টিতে একবার আদ্রিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলো নোনাজলে চিকচিক করছে গাল। ভাগ্যিস জোছনার আলো খুব প্রখর নয়তো ভাবির জন্য ভাইয়ের অশ্রু বিসর্জন দেওয়ার বিষয়টা দেখতো না সে। মিহি ভাইয়ের দু’হাত ধরলো।
” ভাইয়া তুমি যতই অপরাধ করো না কেনো আমি তোমার কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। চোখের পানি মুছে ফেলো। ”
আদ্রিয়ান নিঃশব্দে নিজের চোখের পানি মুছে ফের বোনের হাতে হাত রাখলো। বোন হলো মায়ের মতো, তারকাছে সবকিছু নিরদ্বিধায় বলা যায়।
” আমি চেষ্টা করবো মিহি। যতটা অন্যায় করেছি রাহির সাথে তার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করবো। কিন্তু তোশার থেকে রেহাই চাই আমি। ঝোঁকের বশে তোশাকে লাই দিয়ে মাথায় তুলে যে কতটা ভুল করেছি সেটা এখন হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছি। ”
” কিন্তু ভাইয়া তোশা আপু একা তো নয় সাথেও মা-ও আছে। মা’কে কীভাবে বোঝাবো বলো তো? ”
” সবকিছু আমার জন্য। আমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই বোন। আজ বেঁচে থেকেও আমি প্রতি দিন, প্রতি মুহুর্তে ম*রে যাচ্ছি। ”
” এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। কীভাবে ভাবির মন জয় করবে সেটা ভাবো বুঝলে? একবার ভাবি চলে এলে তোশা এমনি আউট হয়ে যাবে। ”
” ঠিক আছে মিহি। ধন্যবাদ বোন,একটু হালকা লাগছে এখন। ”
” ধন্যবাদ লাগবে না, পকেট থেকে পাঁচশো টাকার একটা নোট বের করো। কাল আইসক্রিম আর চকলেট খাবো তারপর তোমার জন্য দোয়া করে দিবো ওকে।”
মিহির কথা শেষ হতেই দু’ভাই বোন একসাথে হেসে উঠে। আদ্রিয়ান মিহিকে টাকা দিয়ে দেয়। আসলে ছোটো থেকেই মিহি আদ্রিয়ানের কাছে এরকম চকলেট আর আইসক্রিম কেনার টাকা চেয়ে নিতো। কিন্তু বড়ো হওয়ার পর আজ আবারও টাকা চাওয়াতে দুজনেই শৈশবের সুখকর স্মৃতি রোমন্থন করলো।
দেখতে দেখতে কয়েকদিন পেরিয়ে গেছে। এরমধ্যে রিনা বেগম তার নিজের পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে মিহির। ছেলে ব্যবসায়ী, বাবামায়ের একমাত্র সন্তান। টাকাপয়সার কোনো অভাব নেই তাদের। একবার নিজের পছন্দের ছেলের কাছে গিয়ে খালি হাতে ফিরেছেন বলে সালমান খুরশিদ নিজের স্ত্রীকেই মেয়ের জন্য ছেলে দেখতে বলেছিলেন। তাই তিনিও সেই মতো কাজ করেছেন। মিহিকে একবার ছবি দেখাতে গিয়েছিলেন রিনা বেগম কিন্তু মিহি ছবি না দেখেই হ্যাঁ বলে দিয়েছে। আদ্রিয়ান বেশ বুঝতে পারছে মিহির মন অন্য কোথাও আছে। তাই মনে মনে ভেবেছে মিহির সাথে সরাসরি কথা বলবে। কিন্তু সেটা একান্ত নিরিবিলিতে।
ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে ঘাসের উপর বসে আছে মিহি,অহনা। এরমধ্যে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে মিহি। অহনার সাথে সবকিছুই শেয়ার করে মিহি। বিয়ের কথা শুনে অহনা চুপ করে আছে। ঠিক কী বলবে বুঝতে পারছে না। যদি কোনো ছেলের সাথে সম্পর্ক থাকতো কিংবা সেই ছেলেটাকে যদি চোখেও দেখতো তবুও না হয় তার কথা বলা যেতো বাসায়। কিন্তু এরকম পাগলামির কথা কে শুনবে? আর যার কোনো খোঁজ নেই তার জন্য অপেক্ষা করা তো আসলেই বোকামি ছাড়া কিছু না। কিন্তু মনটা এমন কেনো? কারো সামান্য স্পর্শ কিংবা সাহায্যেও তার প্রতি ভালোলাগা সৃষ্টি হতে হবে!
” মিহি তুই যা ঠিক করেছিস তাই কর। তবে হ্যাঁ মনের মধ্যে অন্য কাউকে আগলে রেখে আরেকটা লোকের সাথে কীভাবে সংসার করবি!”
” তবুও সংসার করতে হবে অহনা। সংসার করবো,তার শয্যাসঙ্গী হবো,তার বাচ্চার মা-ও হবো অথচ আমার মনটা থাকবে অন্য কোথাও। ”
” এরকম করে বলিস না। বড্ড খারাপ লাগছে।”
” আরে বাদ দে,তা তোর খবর বল। আসমান ভাই দেশে ফিরবে কবে?”
” সামনের বছর ফেরার কথা বলেছে। তারপর বিয়ের কথা বলবে বাসায়। ”
” দোয়া করি আল্লাহ তোর মনের মানুষের সাথে মিল করে দিক।”
” আমিও দোয়া করি সব পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো ধৈর্য যেনো তোর হয়।”
দুই বান্ধবীর কথা শেষ হওয়ার আগেই হুট করেই বৃষ্টি শুরু হলো। নভেম্বর রেইন! অসময়ে সবকিছুই খারাপ লাগে অহনার। তাই দৌড়ে ভার্সিটির ভিতরে ঢুকলো অহনা। কিন্তু মিহি কেবল উঠে দাঁড়ালো কিন্তু কোথাও গেলো না। অহনা ইশারায় বারকয়েক ডাকলো তাকে। কিন্তু মিহি সেদিকে খেয়াল করলো না। বৃষ্টির মধ্যে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। গুনগুনিয়ে গান ধরলো মিহি,
আজকেও বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরবে বলে সিন্ধান্ত নিয়েছে মিহি। ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে অটোতে চড়ে বসলো। সেদিনের মতোই অর্ধেক গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলো মিহি। সেদিনের ঘটনাটা কী আরেকবার পুনরাবৃত্তি হতে পারে না? কিন্তু না তেমন কিছু ঘটলো না সারা রাস্তায়। ভিজতে ভিজতে বাসায় গিয়ে পৌঁছুলো মিহি। দরজা খুলে মিহিকে ভেজা দেখে বেশ চটে গেলেন রিনা বেগম।
” তোকে কতবার বলেছি অসময়ে যখন তখন বৃষ্টি হচ্ছে ছাতা নিয়ে বের হ। কিন্তু না আমার কথাই কানে যায় না তোর। ”
মিহি মায়ের কথায় কোনো জবাব দিলো না শুধু পাশ কাটিয়ে বাসার ভিতরে প্রবেশ করলো। তারপর সোজা নিজের রুমে গিয়ে দরজা আঁটকে দিলো। রিনা বেগম আরো কিছু সময় একা একাই বকাবকি করলেন। যার সারমর্ম ছিল সামনে বিয়ে এখন অসুস্থ হয়ে চেহারা নষ্ট করলে কী ভালো দেখায়?
জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে শহরের ব্যস্ত সড়কের দিকে তাকিয়ে আছে রুদ্র। বৃষ্টি হলে না ছুঁয়ে পারে না সে। মনে হয় কোনো সম্মোহনী শক্তি তাকে বৃষ্টির দিকে অনবরত টানে। আজকে বৃষ্টির কারণে রোগী কম এসেছে অন্য দিনের তুলনায়। তাছাড়া দুপুর হয়ে গেছে এখন খাওয়ার সময় বটে। শরীফ এরমধ্যেই দুজনের খাবার নিয়ে চেম্বারে এসেছে।
” ভাইয়া আসেন খেয়ে নিন।”
” তুমি খাও আমি একটু পর খাবো। ”
” ভাইয়া আপনি কী কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করছেন? ”
শরীফ রুদ্রর সাথে থাকতে থাকতে ভালোই বুঝতে পারে তাকে। রুদ্রকে ভাইয়ের মতো ভালোবাসে তাই কখনোই কোনো কিছু লুকায় না রুদ্র। জানালা পাশ থেকে সরে এসে নিজের চেয়ারে বসে টিস্যু দিয়ে হাত মুছে শরীফের দিকে মনোযোগ দিলো রুদ্র। শরীফও রুদ্রর দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
” আসলে শরীফ গত মাসে যে একজন ভদ্রলোক এসেছিলেন না? সালমান খুরশিদ নামে,সাথে উনার ছেলে ছিলো?”
শরীফ কিয়ৎক্ষণ ভেবে মনে পড়ার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললো,
” হ্যাঁ মনে পড়েছে। ভদ্রলোক খুব ভালো, দেখেই বোঝা যায়। ”
” হ্যাঁ উনি দিন পনেরো আগে হঠাৎ একদিন রাতে আমার বাসায় একটা অদ্ভুত প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন।”
” আমার কাছ থেকেই তো বাসার ঠিকানা নিয়েছিলেন উনার ছেলে। তারপর বলো ভাইয়া।”
” সাথে উনার স্ত্রীও ছিলেন বুঝলে। উনি উনার একমাত্র মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিতে চাচ্ছিলেন। আমি সেখানেই কৌশলে না বলে দিয়েছিলাম।”
” তাহলে কী হয়েছে আবার? ”
” উনি আমার অসম্মতির কথা শুনে সেখানে বসেই একটু অসুস্থ ফিল করেছিলেন। বুঝতে পারছিস কতটা আশাবাদী ছিলেন?”
” আসলেই খারাপ লাগছে। কিন্তু এরকম হুটহাট কী বিয়ে ঠিক হয়!”
” সেটাই তো। তাছাড়া তুমি তো জানোই বিয়ে নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। ”
” জানি বলেই বলছি মানুষ একা বাঁচতে পারে না। শেষ বয়সে পাশে থাকার জন্য হলেও একজন সঙ্গীর প্রয়োজন ভাইয়া। ”
” কিন্তু আমি তো অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারবোনা শরীফ।”
” সংসার করতে গেলে ভালোবাসা আপনাআপনি চলে আসবে। ভালোবেসে বিয়ে করা জরুরি নয়,বিয়ের পরও ভালোবাসা যায়। ”
” ও আচ্ছা! তা তোমার কী বিয়ের শখ হলো না-কি? ”
” কী যে বলো ভাইয়া! বড়ো ভাই এখনও বিয়ে করেনি,আমি কীভাবে করবো।”
” আচ্ছা ভদ্রলোকের নাম আর ফোন নম্বর আছে না?”
” হ্যাঁ সব রোগীদের থাকে, উনারও আছে। খুঁজে বের করবো?”
” হ্যাঁ দেখো তো একবার। ভাবছি সন্ধ্যায় উনার বাসায় যাবো। ভদ্রলোক যদি এখনো রাজি থাকেন তাহলে উনার মেয়েকে মেয়েকে জানাবো, আমি তাকে বিয়ে করলেও তাকে ভালোবাসতে পারবোনা। এসব শুনেও যদি সে রাজি হয় তাহলে বিয়ে করবো তাকে। ”
এরমধ্যে শরীফ রোগীদের তথ্যের খাতা থেকে খুঁজে সালমান খুরশিদের ফোন নম্বর বের করেছেন। ভালো কথা হচ্ছে সাথে উনার বাড়ির ঠিকানাও আছে!
চলবে,
#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৯
(মুক্তমানদের জন্য উন্মুক্ত)
এরমধ্যে শরীফ রোগীদের তথ্যের খাতা থেকে খুঁজে সালমান খুরশিদের ফোন নম্বর বের করেছেন। ভালো কথা হচ্ছে সাথে উনার বাড়ির ঠিকানাও আছে!
” ফোন নম্বর আছে সাথে ঠিকানাও। কিন্তু বিয়ে করবে কিন্তু ভালোবাসতে পারবেনা এটা কী ধরনের কথা ভাইয়া?”
শরীফ খাতাটা রুদ্রর সামনে দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো। রুদ্র ততক্ষণে একবার সালমান খুরশিদের ঠিকানাটায় চোখ বুলিয়ে নিয়েছে।
” তুমি ভালো করেই জানো শরীফ আমি নবনী ছাড়া আর কাউকে এ জীবনে ভালোবাসতে পারবোনা। ”
” তাহলে অন্য একটা মেয়েকে অহেতুক নিজের সঙ্গে জড়ানোর দরকার কী! সে তো বাবার কাছে না খেয়ে নেই যার জন্য আপনার সাথে বিয়ে করবে! বিয়ের পর একটা মেয়ে তার স্বামীর কাছে ভালোবাসা ছাড়া আর কী-বা চাইতে পারে? ”
” আমি আমার কোনো দায়িত্ব অপূর্ণ রাখবো না শরীফ। স্বামীর সব দায়িত্ব পালন করবো কেবল মনটা দিতে পারবো না। ”
” তোমার যা ভালো মনে হয় করো। মনে হয় না কোনো মেয়ে এরকম প্রস্তাবে রাজি হবে! ”
” না হলে ভালোই। আসলে ভদ্রলোকের চেহারাটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কোথাও যেনো নানুর চেহারার সাথে একটু মিল আছে। ”
নানার কথা মনে পড়তেই বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো রুদ্রর। শরীফ আর কিছু বললো না আর।
ইদানীং প্রতিদিন আদ্রিয়ান রাহির জন্য অফিসের বাইরে অপেক্ষা করে। প্রথম প্রথম রাহির সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেও আজকাল আর সেই চেষ্টা করে না আদ্রিয়ান। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রাহির গমনের পথে চেয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে। রাহিও প্রতিদিন গাড়ির সাইডে থাকা আয়নার দিকে তাকিয়ে একপলক দেখে নেয় আদ্রিয়ানকে। কিন্তু যখনই এটা অনুভব করে আদ্রিয়ানের কাছে সে কেবল প্রয়োজন ছিল প্রিয়জন নয় তখনই এক নিমিষে মনকে শক্ত করে ফেলে। অবশ্য এ জগতে সবাই প্রয়োজনেই প্রিয়জন বানায়।
ভরসন্ধ্যা, বসার ঘরে সোফায় বসে টিভি দেখছেন সালমান খুরশিদ। রিনা বেগম পাশে বসে আছেন ঠিকই কিন্তু তার মনোযোগ অন্য দিকে। আদ্রিয়ানের চেহারার দিকে তাকানো যায় না ইদানীং। একেবারে শুকিয়ে গেছে ছেলেটা। তোশার সাথে বিয়ের কথা বলতে গেলেই এড়িয়ে যায় সে। তাছাড়া সামনে মিহির বিয়ে এসব নিয়ে ভাবুক হয়েছেন রিনা বেগম। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে নড়েচড়ে উঠলেন তিনি। সালমান খুরশিদও স্ত্রী’র দিকে তাকালেন একবার। রিনা বেগম গিয়ে দরজা খুলতেই চমকালেন। ডাক্তার রুদ্র চৌধুরী!
” আপনি? ”
কন্ঠে আকাশসম বিস্ময় নিয়ে শুধালেন রিনা বেগম। এরমধ্যে সালমান খুরশিদও দরজার কাছে উঠে এসেছেন। রুদ্র স্বভাবসুলভ মিষ্টি হেসে বললো,
” জি আন্টি,কেমন আছেন আপনারা?”
” আরে বাবা তুমি! এসো এসো ভিতরে এসে বসো।”
স্বামীর কথায় রিনা বেগমও যেনো হুঁশ ফিরে পেলেন। এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে কথা বলা ঠিক হয়নি বুঝতে পেরে বললেন,
” দেখেছেন দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখলাম! আমি খুব লজ্জিত, ভিতরে চলুন।”
” সমস্যা নেই। আর আপনিও আমাকে তুমি বলেই সম্মোধন করুন,খুশি হবো।”
রুদ্র বাসার ভিতরে প্রবেশ করেছে। সালমান খুরশিদ নিজে সোফায় বসে রুদ্রকেও বসতে বললেন। রিনা বেগম রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের সাথে কিছু বিস্কুট নিয়ে এলেন। আগে থেকেই চা তৈরি করা ছিল বলে আপাতত এগুলো দিলো। তারপর নিজেও বসলেন সেখানে। রুদ্র ভীষণ চা পছন্দ করে তাই নিরদ্বিধায় চায়ের কাপে চুমুক দিতে শুরু করলো।
” তা বাবা হঠাৎ আমার বাসায় আগমন? আর ঠিকানা কোথায় পেলে তুমি? ”
” ঠিকানা পাওয়া বিষয় নয় আঙ্কেল, আসলে সেদিন আপনি যে প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন আমি সেই বিষয় কথা বলতে এসেছি। ”
” মিহির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ”
মাঝখান থেকে রিনা বেগম বলে উঠলেন। সালমান খুরশিদ একটু দোটানায় পড়ে গেলেন। এরমধ্যে মিহি দৌড়ে বসার ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু বাবা-মা ব্যাতিত তৃতীয় কারো উপস্থিতিতে লজ্জা পেলো সে। এরকম দৌড়ে না আসলেও বোধহয় হতো। রুদ্র মুচকি হেসে বললো,
” ইটস ওকে মিহির দানা। আপনার লজ্জা পেতে হবে না। ”
রুদ্রর এরকম অদ্ভুত কথায় ভড়কে গেলো মিহি। লোকটা এরকম কেনো? প্রথম দেখায় কেউ এরকম ভুলভাল নামে সম্মোধন করে!
” এক্সকিউজ মি,আমার নাম তানজিনা ইসলাম মিহি নট মিহির দানা। গট ইট ওকে?”
” ওকে ম্যাম।”
” আচ্ছা বাবা শোনো ভাবি কল করেছিলো আমাকে। এত দিন পর কল পেয়ে একটু এক্সাইটেড হয়ে গেছিলাম। বাই দ্য ওয়ে উনি কে বাবা?”
” তুমি রাজি থাকলে উনার সাথে তোমার বিয়ে হবে মিহি।”
সালমান খুরশিদের কথায় রিনা বেগম, মিহি ও রুদ্র তিনজনই চমকে উঠেছে। যেখানে মেয়ের বিয়ে অন্যত্র ঠিক হয়ে গেছে সেখানে এসব বললেন কেনো ভদ্রলোক! রিনা বেগম ইশারায় সালমান খুরশিদকে চুপ করতে বললেন কিন্তু তিনি মোটেও সেসব গ্রাহ্য করলেন না। রুদ্র ও মিহি নির্বাক হয়ে দু’জন দু’জনার দিকে তাকিয়ে আছে।
” রুদ্র তুমি বরং মিহির সাথে একটু আলাদা কথা বলে নাও। তোমাদের যদি দু’জন দুজনকে ভালো লাগে তাহলে আমি তোমাদের বিয়ে দিতে রাজি। বিয়ের কথা আগে তোমার সাথে হয়েছিল তাই তুমি আগে অগ্রাধিকার পাবে অবশ্যই। ”
স্বামীর কথায় ক্ষেপে উঠলেন রিনা বেগম কিন্তু রুদ্র সামনে থাকায় দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে রইলেন। বাবার কথার আগামাথা কিছুই বুঝলোনা মিহি। তবে অন্য কাউকে বিয়ে করাও যা আর লোককে বিয়ে করাও মিহির জন্য সমান। তাই বাবার কথামতো ইশারায় রুদ্রকে নিজের সাথে যেতে বললো মিহি। রুদ্রও মনে মনে যেনো এ সুযোগ খুঁজছিলো। মিহিকে একা পেলে সবকিছু বলা যাবে। তাই মিহির পিছুপিছু রুদ্র ছাঁদে গেলো। রুমের সাথে কোনো বারান্দা না থাকায় ছাদ ছাড়া অন্য কোথায় বসে কথা বলার জায়গা খুঁজে পেলো না মিহি। অচেনা একজন লোকের সাথে রুমে ঢুকে কথা বলা কেমন বেমানান লাগবে বলে মনে হচ্ছিল মিহির। ছাঁদের দক্ষিণ দিকে কার্ণিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে মিহি,সামনে রুদ্র দাঁড়িয়ে। আশেপাশের বিল্ডিং- গুলোতে বাতি জ্বলছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলো দু’জন তারপর সময় অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে রুদ্র নিজেই কথা শুরু করলো।
” আপনার কোনো পছন্দের মানুষ আছে? ”
হঠাৎ রুদ্রর এই কথায় কাটা গায়ে কেমন নুনের ছিটা লাগার মতো অনুভূতি হচ্ছে মিহির। অবশ্য রুদ্র একটা স্বাভাবিক প্রশ্নই করেছে।
” না তেমন কেউ নেই। আপনার আছে না-কি? অবশ্য থাকলে তো নিজে থেকে বিয়ের কথা বলতে আসতেন না।”
” ব্রিলিয়ান্ট গার্ল। ঠিক ধরেছো,কেউ নেই কিন্তু অতীতে ছিল। আমি আজও তাকেই ভালোবাসি মিহির দানা। তাই আপনাকে বিয়ে করতে পারবো কিন্তু মন থেকে ভালোবাসতে পারবোনা কখনো। কিন্তু বিশ্বাস করুন স্বামী হিসেবে সকল দায়িত্ব পালন করবো অবশ্যই। ”
রুদ্রর কথা শুনে বেশ ভালো লাগলো মিহির। মোটেও খারাপ লাগলো না তার। কারণ মিহি নিজেও তার স্বামীকে কখনো মন দিতে পারবেনা।
” আমার কোনো সমস্যা নেই তাতে। কিন্তু কথা হলো যদি ভালোবাসতে না পারেন তাহলে বিয়ে কেনো?”
” আপনার বাবা খুব ভালো মানুষ। উনি একবার আমার বাড়ি গিয়েছিলেন আপনার কথা বলতে। আমি তখন অতীতের জন্য তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে বারবার উনার মুখখানা ভেসে উঠছিল চোখের সামনে। আর মেইন কথা হচ্ছে উনার সাথে আমার নানুর চেহারার বেশ মিল আছে। নানু ছিলেন এ পৃথিবীতে আমার একমাত্র আপনজন। ”
” তারমানে আপনার কেউ নেই? ”
” নাহ! আমি একাই থাকি একটা বাড়িতে, রাতে শুধু একজন চাচা আছেন উনি রান্নাবান্না করেন।”
মিহি চুপ রইলো আবারও কিছু সময়। তারপর কিছুটা হেসে বললো,
” ঠিক আছে তাহলে বাবাকে গিয়ে বলুন আমরা রাজি। বিয়ে যখন করতেই হবে তখন না বলে লাভ নেই। আপনাকে না হলেও অন্য কাউকে করতেই হবে, তারচে আপনার একাকীত্বের বন্ধু হবো না হয়।”
চলবে,