মনেরও গোপনে পর্ব-১২+১৩

0
490

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_১২
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)

রুদ্র গাড়ি থেকে নেমে মিহিকে নামানোর জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মিহি রুদ্রর হাত না ধরে একা একা নামলো।
” ধন্যবাদ ডাক্তার সাহেব।”
” স্বাগত মিহির দানা। ”
” আবারও! ”
” ভুল হয়ে গেছে মিহির দানা। ”
রুদ্রর দাঁত বের করা হাসি দেখে মিহির গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে একেবারে। শরীফ গেট পেরিয়ে বাসার দরজার তালা খুলে এরমধ্যেই ভিতরে প্রবেশ করেছে। রুদ্র মুখ টিপে মিটিমিটি হাসতে হাসতে দরজার দিকে এগোচ্ছে আর মিহি তার পিছু পিছু হাঁটছে।

নিজের ঘরে মনমরা হয়ে বসে আছেন মিহির মা। বাসার সবাই রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করেছে শুধু মাত্র রিনা বেগমই অভুক্ত রয়েছেন।
” মা ভিতরে আসবো?”
রাহি দরজার বাইরে হাতে খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে ছিলেন রিনা। রাহির কথায় ভাবনার ছেদ ঘটলো।
” হ্যাঁ এসো।”
রাহি খাটের পাশের টেবিলের উপর ভাতের প্লেট রেখে বিছানায় শ্বাশুড়ির পাশে বসলো।
” মা আপনি না খেয়ে থাকলে আপনার শরীর খারাপ হয়ে যাবে। তাছাড়া মিহি যদি জানতে পারে আপনি এরকম করছেন তাহলে কি ও ওই বাড়িতে ভালো থাকতে পারবে?”
” আমার খেতে ইচ্ছে করছে না রাহি। তুমি মিহিকে কিছু জানিও না। ”
” আচ্ছা মা আপনি, আমি সবাই তো বাবার বাড়ি ছেড়ে এসেছি তাই না? এটাই তো প্রাকৃতিক নিয়ম, মেয়েরা বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে নিজের সংসার গুছিয়ে নিবে। তাছাড়া মিহির শ্বশুর বাড়ি তো কাছেই।”
” তা ঠিক বলেছো। তুমি খাবার রেখে যাও,আমি অল্প খেয়ে নিবো। তোমার শ্বশুর কি খেয়েছেন?”
” হ্যাঁ তিনি খাবার খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিয়েছেন। টিভিতে খবর দেখছেন দেখে এলাম।”
” তাহলে তুমিও গিয়ে শুয়ে পড়ো।”
” ঠিক আছে মা, খেয়ে নিবেন কিন্তু। ”
রিনা বেগম মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন তিনি। রাহি শ্বাশুড়ির ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েই মিহিকে কল দিলো। দু’টো রিং হতেই ওপাশ থেকে কল রিসিভ করলো।
” ভাবি আমি এখন এমনিতেই কল দিতাম,সবাই কেমন আছেন? ”
” হ্যাঁ ভালো আছেন। তুমি খেয়েছো রাতে? ”
” না রান্না শেষ হলো মাত্র। তুমি খেয়েছো?”
” হ্যাঁ কিন্তু রান্না কি তুমি করলে?”
রাহির কন্ঠে বিস্ময় সেটা বুঝেই হাসলো মিহি।
” আরে না, চাচা আছেন উনি করেছেন।”
” তাই বলো। তা তোমার বর কোথায়? ”
” ডাইনিং রুমে গেলো মনে হয়। লোকটা ভীষণ বজ্জাত। ”
” তাই না-কি! তা এখনো তো বিছানায় গেলেই না তার আগেই কী আদর শুরু করেছে? ”
রাহি দুষ্টমি করে বললো। মিহি লজ্জা পেলো কিছুটা।
” ধ্যাৎ! কীসব বলো না তুমি। এমনিতে খুব ক্ষ্যাপায় আমাকে। কতবার বলেছি আমার নাম মিহি কিন্তু বজ্জাত লোকটা বারবার মিহির দানা বলেই ডাকছে!”
” রসিক মানুষ মজা করে একটু তাতে রাগের কী আছে ননদী? ”
” মজা না ছাই!”
” হাহা! আচ্ছা রাখছি এখন রাতের জন্য শুভকামনা রইলো।”
” ভাবি!”
রাহি ফোন কেটে পিছন ফিরে তাকাতেই চমকালো। আদ্রিয়ান দাঁড়িয়ে আছে পিছনে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলো না-কি!
” তুমি এখানে? ”
” তুমি কোথাও খুঁজতে গিয়ে এখানে গলার আওয়াজ পেলাম।”
” আচ্ছা চলো ঘরে যাই।”
আদ্রিয়ান রাহির পেছন পেছন ঘরে এসেছে। কিন্তু বিছানার দিকে তাকাতেই রাহির চোখ ছানাবড়া! পুরো বিছানায় বইয়ের ছড়াছড়ি। আদ্রিয়ান বইপ্রেমি মানুষ কিন্তু সমস্যা হলো বই পড়ে সব বিছানায় এলোমেলো করে রাখে। রাহি আদ্রিয়ানের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো একবার। আদ্রিয়ান সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দরজা আঁটকে দিলো। রাহি বিছানা গুছিয়ে বইগুলো সব শেলফে রেখে দিলো।
” এবার শুয়ে উদ্ধার করো আমাকে, বাতি নিভিয়ে এসো।”
রাহি শুয়ে পড়েছে এরমধ্যেই। আদ্রিয়ান রুমের বাতি নিভিয়ে বাধ্য ছেলের মতো রাহির পাশে শুয়েছে।
” রাহি!”
” হ্যাঁ বলো।”
” আমার শাস্তি কি শেষ হবে একজীবনে? ”
” জানি না আমি। তুমি যতবার আমার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করো ততবারই তোশার বলা কথাগুলো মনে পড়ে যায়। ”
” বিশ্বাস করো তোশার সাথে কোনো খারাপ সম্পর্কে লিপ্ত হইনি আমি। আর না তো খারাপভাবে স্পর্শ করেছি।”
” স্পর্শ তো করেছো!”
রাহির এই কথার উত্তরে বলার মতো কোনো যুক্তি নেই আদ্রিয়ানের কাছে। রাহি ফিরে এসেছে মাসখানেক হলেও এখনো আদ্রিয়ানকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। তোশা আদতে না থাকলেও তোশার বলা প্রতিটি কথা আদ্রিয়ান ও রাহির মধ্যে অদৃশ্য দেয়াল হয়ে জুড়ে আছে।

রাতের খাবার রান্না করা শেষে রহমান চাচা ও রুদ্র মিলে টেবিলে পরিবেশন করেছে। তারপর মিহিকে ডেকে নিয়ে এসেছে রুদ্র। বিয়ের ভারী গয়নাগাটি ও পোশাক পাল্টে মিহি হালকা গোলাপি রঙের একটা থ্রিপিস পরেছে। রুদ্রও পাঞ্জাবি পাল্টে টি-শার্ট আর লুঙ্গি পরেছে। ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে মিহি। রুদ্র বসে গেছে আগেই, রহমান চাচা প্লেটে খাবার দিচ্ছে।
” কি হলো দাঁড়িয়ে রইলে কেনো? খেতে বসো।”
” হ্যাঁ বসছি,চাচা খাবেন না?”
রহমান চাচা মুচকি হেসে বললেন,
” আমি বাসায় গিয়ে তোমার চাচির সাথে খাবো মা। তোমরা শুরু করো। এই বয়সেও স্ত্রী’র প্রতি অগাধ ভালোবাসা দেখে সত্যি অবাক হয়েছে মিহি। এই যুগে একজন মানুষে আজীবন আসক্ত থাকা আগুনে পা দিয়ে হাঁটার সমান। মিহি রুদ্রর পাশের চেয়ারে বসে খেতে শুরু করলো। কিন্তু লজ্জার কারণে বেশি খেতে পারলোনা। কয়েক লোকমা ভাত মুখে দিয়েই প্লেটে হাত ধুয়ে বসে রইলো। রুদ্র তখনও খাচ্ছে, কিন্তু মিহির বিষয়টা দেখেছে ঠিকই।
” চাচা ফ্রিজে আইসক্রিম আছে না?”
রহমান চাচা তখন রান্নাঘরে গ্যাসের চুলো পরিষ্কার করছিলো। রুদ্রর কথায় ফ্রিজ খুলে দেখে বললো,
” হ্যাঁ আছে তো,নিয়ে আসবো না-কি? ”
” হ্যাঁ এসো।”
লোকটা কী ভাতের সাথে আইসক্রিম খাবে না-কি! মনে মনে ভাবলো মিহি। রহমান চাচা আইসক্রিম নিয়ে এসে টেবিলে রাখলো।
” মিহির দানা খাবে না-কি আইসক্রিম? ”
মিহি চুপ করে আছে। এভাবে খাবো কি-না জিজ্ঞেস করলে কী বলা যায় খাবো? জোর করে খেতে বলতে পারেনা লোকটা?
” এই মিহির দানা! ”
” না না আমি খাবো না আপনি বরং ভাতের সঙ্গে খান।”
” কী বললে? ভাতের সাথে আইসক্রিম! এটা তোমার জন্য আনতে বলেছি বোকা মেয়ে। ”
” আমি মোটেও বোকা নই।”
” ঠিক আছে বুদ্ধিমতী তরুণী। ভাত তো খেলে না আইসক্রিম অন্তত খেয়ে নাও। মেয়েরা তো ফুচকা, আইসক্রিম, ভেলপুরি, চকলেট এসব পছন্দ করে। ”
” হ্যাঁ আমিও করি। আপনি তো মনে হয় মেয়েদের উপর পিএইচডি করেছেন। ”
” তা করিনি কিন্তু জানি আরকি। তুমি কি জানো তুমি আমার চেয়ে কত বছরের ছোটো? ”
মিহি চোখ বড়ো বড়ো করে শুধালো,
” কত? ”
” বেশি না ছয় বছরের বড়ো। ”
” ছয় বছরের বড়ো!”
” হ্যাঁ তাতে ওমন করে বলার কী হয়েছে মিহির দানা? ”
” কিছু না। ”
রুদ্র খাওয়া শেষে আইসক্রিমের বাটিটা নিজের দিকে নিলো। মিহি আড়চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে।
” তুমি তো মনে হয় খাবে না তাহলে আমিই খাই।”
রুদ্র চামচ দিয়ে নাড়াচাড়া করছে হাতে মিহির খুব ইচ্ছে করছে খেতে কিন্তু লজ্জায় বলতে পারছেনা সেটা। এমনিতেই আইসক্রিম খুব প্রিয় মিহির। এতোটাই প্রিয় যে শীতের মৌসুমেও আইসক্রিম খেতে দুবার ভাবে না। মিহির ভাবসাব দেখে রুদ্র বুঝতে পেরেছে এই মেয়ে লজ্জায় মুখ ফুটে খাওয়ার কথা বলতে পারবেনা। তাই নিজে থেকেই আবারও সাধলো।
” আচ্ছা বেশি খেতে হবে না অল্প একটু খাও।”
রুদ্র আইসক্রিমের বাটি মিহির দিকে এগিয়ে দিলো কিছুটা। মিহি ইতস্ততভাবে চামচটা হাতে নিলো এবার।
” আহা খাও তো। খাবার খেতে এত লজ্জা করলে চলে? দেখে তো মনে হয় না এমনিতে এত লজ্জাবতী তুমি। ”
রুদ্রর শেষ কথাটায় মিহি ক্ষ্যেপে গেলো কিছুটা। এক চামচ আইসক্রিম মুখে দিয়ে রুদ্রকে কিছু বলতেই যাবে এমন সময় রহমান চাচা বলে উঠলো,
” আমি যাচ্ছি তাহলে রুদ্র বাবা,মিহি মা গেলাম।”

” জি চাচা, সাবধানে যাবেন।”
” চাচা খাবার প্যাকেট করে নিয়েছেন তো? ”
” হ্যাঁ রুদ্র বাবা নিয়েছি।”
” ঠিক আছে। ”
চলবে,

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_১৩
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)

“জি চাচা, সাবধানে যাবেন।”
” চাচা খাবার প্যাকেট করে নিয়েছেন তো? ”
” হ্যাঁ রুদ্র বাবা নিয়েছি।”
” ঠিক আছে। ”
রহমান চাচা চলে যেতেই রুদ্র আইসক্রিমের বাটিটা হুট করে নিজের দিকে টেনে নিয়ে এক চামচ আইসক্রিম মুখে দিয়ে বললো,
” তখন ক্ষ্যেপে গিয়ে কী জানি বলতে চেয়েছিলে মিহির দানা? ”
” আপনি আসলে খুব বজ্জাত লোক। আমি রুমে গেলাম। ”
মিহি রাগে কটমট করতে করতে সিড়ি দিয়ে দোতলায় চলে গেলো। রুদ্র এখনও ডাইনিং টেবিলে বসে আইসক্রিম মুখে হাসছে। নবনীও ঠিক এরকমই রাগী ছিল। কথায় কথায় রেগে চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেলতো। স্মৃতি মনে পড়তেই মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেলো রুদ্রর।

ঘরে এসে বিছানায় ধপ করে বসে পড়েছে মিহি। একদিনের সংসারেই রুদ্র এত খুনসুটি করছে ভাবতেই মিহির মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এতটা গায়ে পড়া পুরুষ মানুষ মোটেই ভালো লাগে না তার। তুই পুরুষ মানুষ কোথায় চোখমুখ গম্ভীর করে রাখবি তা না সব সময় টম এ্যান্ড জেরীর মতো করবি কেনো?
” কী হয়েছে দানাপানি এমন রেগে বসে আছে কেনো?”
মিহি ভাবনার অতলে ডুবে ছিল বিধায় রুদ্রর আগমন টের পায়নি। তাই কিছুটা নড়েচড়ে বসলো সে। রুদ্র দরজা আঁটকে আলমারি থেকে একটা সাদা পাঞ্জাবি বের করে রাখলো টেবিলের উপর।
” হোয়াট দ্য! মিহির দানা অবধি একরকম ছিল কিন্তু দানাপানি? ”
কপট রাগ দেখিয়ে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো মিহি। রুদ্র ভাবলেশহীনভাবে মিহির পাশে বসলো।
” একেই বলে মেয়ে মানুষ! যখন মিহির দানা ডাকি তখন তো বলো, আমি কোনো দানাপানি নই। তাই ভাবলাম মিহির দানার চেয়ে দানাপানি ডাকলে বেশি খুশি হবে। ”
” শুনুন ডাক্তার রুদ্র চৌধুরী, আমার নাম মিহি শুধু মিহি। আন্ডারস্ট্যান্ড? ”
” ওকে মিহির দানা। ”
মিহির চোখমুখ এখন দেখার মতো হয়েছে। ফর্সা গালদুটোর চামড়ায় রাগের কারণে লাল আভা ফুটে উঠেছে। রুদ্র সেসব দেখেও না দেখার ভান করে মিহিকে পাশ কাটিয়ে অন্য পাশে শুয়ে ফোন হাতে নিয়ে সেদিকে মনোযোগ দিলো। মিহির মাথা দিয়ে মনে হচ্ছে আগুন বের হচ্ছে। এই লোক কোন পাগলাগারদ থেকে এলো? কোনো ডাক্তার এরকম আধ-পাগলা হয় বলে জানা ছিল না তার।
ঘুম ভাঙলো এলার্ম ঘড়ির আওয়াজে। চোখ মেলে তাকাতেই কেমন ভারী ভারী অনুভব হলো মিহির। বিষয়টা আঁচ করতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো। পরক্ষণেই একপ্রকার বিছানা থেকে লাফিয়ে ফ্লোরে পড়লো। আর তারপরেই মুখ থেকে অস্ফুটে স্বরে আওয়াজ বেরিয়ে এলো মিহির। হুট করে বিছানা থেকে ফ্লোরে পড়ার কারণে কোমরে একটু ব্যথা পেয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় রুদ্রও ঘুম থেকে উঠে চোখ বড়সড় করে ফ্লোরে তাকিয়ে আছে।
” অসভ্য লোক ওরকম ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আবার। ”
” আমি কী করলাম! তুমি ওরকম ফ্লোরে বসে চিৎকার করলে কেনো?”
” আপনিই তো আমার পিঠে নিজের হাত রেখেছিলেন। পাশে শুয়েছি বলে সুযোগ নিবেন এভাবে? উঁহু কোমরে লেগেছে ভালোই। ”
রুদ্র বিছানার সবখানে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। তারপর বিছানা থেকে নেমে মিহির হাত ধরে দাঁড় করাতে চাইলো কিন্তু মিহি হাত না ধরে নিজেই দাঁড়াতে চাইলো কিন্তু পারলো না দাঁড়াতে।
” ব্যাথা ভালোই লেগেছে কোমরে। তবে মিহির দানা বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখো,আমার হাত তোমার শরীরের উপর ছিল না। ওটা অবলা কোলবালিশ আমার, ভুলে তোমার পিঠের ওপর চলে গেছিলো।”
রুদ্রর কথায় ঠিক বিশ্বাস হলোনা মিহির। তাই সন্দিহান দৃষ্টিতে একবার বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলো। আসলেই খাটের মাঝ বরাবর কোলবালিশ রাখা আছে এখনো! নিজের ভুল বুঝতে পেরে কিছুটা লজ্জা পেলো মিহি। কিন্তু নিজ থেকে রুদ্রর সাহায্য চাওয়া কী ঠিক হবে?
” আসলে আমি বুঝতে পারিনি,সরি।”
” এবার কি উঠবে না-কি এভাবেই বসে থাকবে বলো?”
মিহি লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। রুদ্র নিজে থেকেই মিহির হাত ধরে বিছানায় উঠিয়ে বসালো। তারপর ড্রয়ার থেকে ফাস্ট এইড বক্স বের করে একটা মলম এগিয়ে দিলো মিহির দিকে।
” ঔষধ লাগবে না এমনি ঠিক হয়ে যাবে। ”
” ডাক্তার কি আমি না তুমি? ”
” আপনি হার্ট স্পেশালিষ্ট হৃদপিণ্ড নিয়ে থাকুন। ”
” পাকনামি কম করো বুঝলে এটা লাগাও। আশেপাশ থেকে লোকজন আসতে পারে আবার না-ও পারে কিন্তু তোমার বাসা থেকে নিশ্চয়ই কেউ আসবেন। ”
মিহি রুদ্রর হাত থেকে মলমটা নিলো কিন্তু রুদ্রর কথার আগামাথা কিচ্ছু বুঝলো না।
” হ্যাঁ তা তো আসতেই পারে তাতে কী? ”
” তুমি কি আসলেই মাস্টার্সে পড়ো?”
” হ্যাঁ কোনো সন্দেহ আছে? ”
” অবশ্যই আছে। বিয়ের পরের দিন নতুন বউ কোমরের ব্যথায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটলে সবাই কী ভাববে জানো না? মনে মনে তো সবাই আমাকেই দোষারোপ করবে।”
মিহির কিয়ৎক্ষণ লাগলো রুদ্রর কথার মানে বুঝতে। কিন্তু না বুঝলেই হয়তো ভালো হতো। এই লোকটা আসলে কী! লজ্জায়, রাগে মিহির চোখমুখ আবারও লাল হয়ে গেছে। রুদ্র আর কিছু বললো না। শুধু মুচকি হেসে বাথরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।
সকাল হতেই আদ্রিয়ান ও রাহিকে হসপিটালের করিডরে ছুটে আসতে হয়েছে। রিনা বেগমও আসতেন কিন্তু মিহির বাবার শরীরটা হঠাৎ করে খারাপ হয়ে যাওয়ায় আসতে পারেননি। সেদিন তোশা বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পরে আদ্রিয়ানের বাসার কেউ ভাবতেও পারেনি মেয়েটা এরকম একটা কাজ করতে পারে। আদ্রিয়ানের চাচা শাহআলম নিজাম এরমধ্যেই আদ্রিয়ানকে একদফা কথা শুনিয়েছেন। উনার ভাষ্যমতে আদ্রিয়ানের জন্যই তোশা শেষমেশ আত্মহ*ত্যার মতো একটা সিন্ধান্ত নিয়েছে। রাহি রাস্তায় থাকাকালীন সময়েই আদ্রিয়ানকে বারবার বারণ করে দিয়েছে যাতে কারো সাথে কোনো প্রকার কথা কাটাকাটি না করে। সে কারণে চাচার সব কথা মুখ বুঝে সহ্য করছে সে। আগে তোশা সুস্থ হোক তারপর কথা বলা যাবে।
” ডাক্তার সাহেব কেমন আছে আমার মেয়ে? ”
ডাক্তারকে ও.টি থেকে বের হতে দেখা মাত্রই তোশার মা ফাতিমা তেড়ে এসে প্রশ্ন করলেন। ডাক্তার তানজিম খান গম্ভীর স্বরে বললেন,
” আপাতত ঠিক আছে। আরেকটু দেরি হয়ে গেলে শরীর থেকে বিষ বের করা যেতোনা। ”
” যাক আলহামদুলিল্লাহ। আমরা কী দেখতে পারবো এখন?”
” না মি.শাহআলম, এখনই আমরা কাউকে এ্যালাউ করবো না,কেবিনে নেওয়া হবে এখন। দুপুরে দেখা করতে পারবেন শিউড়লি। ”
” ঠিক আছে ডক্টর, থ্যাংক ইউ। ”
” নো নিড ইটস মাই ডিউটি। ”
ডাক্তার সাহেব নিজের রুমের দিকে চলে গেছেন। আদ্রিয়ান চুপ করে আছে সাথে রাহিও। ফাতিমা আদ্রিয়ানের দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,
” তোরা বাসায় চলে যা। আমি জানি দোষ আমার মেয়ের তাই অহেতুক তোকে দোষারোপ করছি না আদ্রিয়ান। ”
” চাচি তুমি একটু চাচাকে বোঝাও। আমরা থাকি,তোশার সাথে দেখা করেই না হয় ফিরবো।”
” না তার কোনো দরকার নেই। তোকে দেখলে ওর পাগলামি বাড়বে। আমরা ওকে এটুকুও বলবো না যে তুমি এখানে এসেছিলে।”
” আপনি যেটা ভালো মনে করেন চাচি তাই করুন। আমি আর আদ্রিয়ান তাহলে আসছি,তোশার দিকে খেয়াল রাখবেন। ”
” ঠিক আছে। ”
দূরে দাঁড়িয়ে বিরক্ত হচ্ছেন শাহআলম নিজাম। স্ত্রী’র এরকম উদারতা মোটেও ভালো লাগে না উনার। কপাল ভালো যে মেয়েটা মায়ের মতো হয়নি বলে মনে মনে শুকরিয়া আদায় করেন তিনি।
সকালের নাস্তা শেষে রুদ্রর সাহায্যে নিজের রুমে এসে বসেছে মিহি। রহমান চাচা খুব সকালে এসে নাস্তা তৈরি করে রেখেছিলেন। মলম দেওয়ার জন্য কোমরের ব্যথাটা একটু কমেছে। কিন্তু এতবেলা হয়ে গেলো তবুও বাবার বাড়ি থেকে কেউ একবার কল পর্যন্ত দিলো না ভেবে কিছুটা মন খারাপ লাগছে মিহির। তাছাড়া রুদ্রর এত জ্বালাতনও বিরক্ত লাগছে। লোকটার হসপিটাল কতদিন বন্ধ কে জানে? রিংটোনের আওয়াজে বিছানায় তাকাতেই ফোনের স্ক্রিনে মায়ের নম্বর ভেসে উঠতে দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠেছে মিহির। কালক্ষেপণ না করে দ্রুত কল রিসিভ করে কানে ধরলো।
” হ্যালো মা কেমন আছো তোমরা? ”
” হ্যাঁ ভালো আছি। তোরা কেমন আছিস?”
” ভালো কিন্তু তোমার গলাটা এমন লাগছে কেনো? কিছু হয়েছে মা?”
” তোশা সুইসা*ইড করতে গেছিলো, আল্লাহ সহায় ছিলেন বলে বেঁচে গেছে। ”
” কী! বদমাশ মেয়ে একটা। দূরে গিয়েও আমার ভাই আর ভাবিকে অশান্তিতে রাখার বুদ্ধি। ”
” থাক এসব বিকেলে তোর ভাবি যাবে তোকে দেখতে। তোর বাবার শরীর একটু খারাপ নইলে আমরাও যেতাম। ”
” বাবার কী হয়েছে? বাড়াবাড়ি কিছু হয়নি তো!”
” আরে না, তুই চিন্তা করিস না। একটু প্রেশার বেড়ে গেছিলো। নিজের খেয়াল রাখিস রাখছি।”
” বাবার খেয়াল রেখো আর নিজেরও টাটা।”

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে