ভেজা চুলে পর্ব-৬+৭

0
855

#ভেজা_চুলে
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব-৬

“বেশ্যার ঘরে আরেক বেশ্যা জন্ম নিছে। আমি বার বার কই ওই কালনাগিনীরে আমার বাড়ি আইতে দিস না।তাও আমার কথা কেউ শুনে না।মায়ে জামাই বাড়ি কুকাম করবার যাইয়া মরলো আর মেয়ায় এহন যে পোলা দেহে তার পিছ ধরে।
কই লো বেহুসা মাইয়্যা, আমার নাতীর পিছ ছাড়বি না?
কি গিতা মধু জালাই রইছে আমার সাকিবের কাছে?

শরম লজ্জার মাথা খাইছ?বারো ভাতারী একটা। মায়ের মতো হইছে। পোলা মানুষ দেখলেই মায়ে ভাদ্দর মাইসা কুত্তার লাগান করতো মাইয়্যাও হইছে মায়ের মতোন।কব্বরে যাইয়্যাও ওই বেশ্যার শান্তি আছে?”

মাধুর্য এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল তারপর একদম ক্ষেপে উঠে।
তারেকা বানুর এমন কথার কোনো জবাব কোনো দিন সে দেয়নি। তাকে করা অপমান ফাকা ঢোকের সাথে গিলে ফেলেছে বার বার প্রতিবার। তবে আজ আর না।
বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে একজন বয়স্ক মানুষ হয়ে কী করে পারে এসব বলতে?

“আপনি কী চুপ করবেন? আপনার এত সাহস হয় কী করে আমার মৃত মা নিয়ে এসব বলার?”

মাধুর্যের জবাবে আরো ফুসলে উঠে তারেকা বানু। চিৎকার করে বলতে থাকে

“রঙ্গ করো? আমার লগে রঙ্গ করো?মায়ের লাগান বারো ভাতারী হইছো না?
তোমার ভাতে কুড়কুড়ায় না যৌবনে কুড়কুড়ায়?”

“আপনি একটা অসভ্য মহিলা।আপনার মুখের কোনো বালাই নেই। ছিঃহ্। আপনার সাথে কথা বলতে আমার ঘেন্না হচ্ছে।আপনি কী আদৌও মানুষ?”

মাধুর্যের জবাবে তারেকা বানু ওর চুলির মুঠি ধরে টান দিয়ে বলে,

“হোরে খা**** ঘরে খা*** আমি খারাপ। আর তুই খুব ভালা না?তোর…….”

তারেকাবানু কথা শেষ করতে পারে না। তার আগেই সে ধপাস করে মাটিতে পড়ে যায়।
মাটিতে পড়েই সে চিল্লাতে থাকে। আর বলছে

“কে কই গেলিরে, এই বাজারি মেয়ে ছেলে আমারে মাইরা ফালাইলোরে। আমারে বাচা রে।”

মাধুর্য হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছে। সে শুধু চুল ছাড়িয়ে নিতে আঘাত করেছিল আর এদিকে উনি এভাবে পড়ে যাবেন বুঝতেই পারেনি। বাড়ির সব মানুষ এবং আশেপাশের সব মানুষ একত্র হয়েছে।
মাধুর্য তারেকা বানুকে তুলতে এলে সে আরো চিৎকার করতে থাকে।

কোথা থেকে সাকিব এসে তারেকা বানুকে তুলে। তারেকা বানু ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে আর বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথা বলছিলেন।
অর্ণি দূর থেকে দেখেছিল মাধুর্য হাত ঝাড়া দিতেই তারেকা বানু মাটিতে পড়ে যায়।
আর যাই হোক দাদু তো বয়স্ক মানুষ। মাধুর্যের উচিৎ হয়নি এভাবে আঘাত করা। অর্ণি অনেকটা রেগে মাধুর্য কে জিজ্ঞেস করল,

“দাদীজান পড়লো কীভাবে?”
“আমি জানি না।”

মাধুর্যের জবাবে খুব একটা খুশী হলো না অর্ণি। চিৎকার করে বলল,

“তুই ক্যান দাদীজান কে ধাক্কা দিলি?সে বয়স্ক মানুষ না?আমার পরিবারের প্রতি তোর এই কৃতজ্ঞতা?”

কাঠ কাঠ গলায় মাধুর্য জবাব দিলো,

“আমি ধাক্কা দেইনি। শুধু চুল।ছাড়িয়ে নিয়েছি।”

“তবে আমি মিথ্যে বলছি?”

“আমি ধাক্কা দেইনি আপু। উনি চুল ধরেছিলেন তাই আমি ছাড়িয়েছি মাত্র। আর যদি দিয়েও থাকি তবে বেশ করেছি।
সে কোন সাহসে আমার গায়ে হাত তুলে?”

“তুই আস্ত একটা বেয়াদব।”

অর্ণির জবাবে মাধুর্য কিছুই বলেনা। শুধু দাড়িয়ে ছিল।তারপর সাকিবের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

“আমি সত্যি বেয়াদব।কারণ আমি প্রতিবাদ করেছি।আমার মৃত মা তো আপনার বোন। কেনো তাকে এসব বলা হয়?আপনি কিছু বলেন না কেনো?”

এতক্ষণ যে তারেকা বানু শ্বাস নিতে পারছিল না সে হঠাৎ গর্জে উঠে বলল,

“তোর মা ছিলোই এক বাজারি মাইয়্যা। রাত বিরাতে তার ঘরে পুরুষ ঢুকতো। তার হইয়া কি সাফাই গাইবো?”

“আমার মা বাজারি ছিলো মানলাম তাহলে আপনি কী তার দালাল ছিলেন?না হলে আপনি জানলেন কীভাবে?”

মাধুর্যের কথা শেষ হতে না হতেই তার গালে সজোরে থাপ্পড় মারলো সাকিব।তারপর তাকে হাত ধরে নিয়ে দিঘির পাশটায় টেনে নিয়ে গিয়ে বলল,

“এতটা বেয়াদব হয়েছিস জানতাম না।শুনেছিলাম তোর বাবা বেয়াদব। আজ তার প্রমাণ পেলাম।হাজার হোক তুই আর বীজ তো।”

দিঘির এপাড়-ওপাড় বাড়ি। এ পাশে সাকিবদের বাড়ি অপর পাশে মাধুর্যদের। এদিকে টেনে নিয়ে আসা মানে সাকিব তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।
মাধুর্যের সেদিকে কষ্ট নেই।
কষ্ট শুধু এটাই তার মৃত মাকে এত বাজে কথা বলে অথচ কেউ প্রতিবাদ করেনা।
মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় এই দিঘীতে ডুব দিতে। গলায় কলসি বেধে।

সন্ধ্যে নেমেছে চারিদিকে ছড়িয়েছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। মাধুর্য তখন দিঘীর শেষ সিড়িতে বসে আছে।
দূর থেকে কেউ জানবেও না এখানে কেউ আছে।
মাগরিবের আজান দেওয়া হয়েছে। তার ছোট মামা হয়তো খুঁজতে খুঁজতে এলো বলে। ঠিক তখন কাঁধে কারো স্পর্শ অনুভব করে। মাধুর্য চোখ বন্ধ করেই তার পেটের দিকটায় মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো।
আর একটি হাত খুব শান্ত ভাবে তার মাথায় বুলিয়ে দিচ্ছে কেউ।

“আমার মাকে এত কিছু বলে তোমরা কিছু কেনো বলো না?আমার মাঝেমধ্যে মরে যেতে ইচ্ছে করে। আমি মরে গেলে আমাকেও এসব বললে মেনে নিবে?”

হঠাৎ হাত থেমে যায়, মাধুর্যের কান্নার দমক তখন বেড়েই চলেছে।

গম্ভীর স্বরে তখন কেউ বলল,

“একজন সংগ্রামী নারীর গল্প শুনবেন?সে এত অল্পতে ভেঙে পড়তো না।ননীবালা দেবী।যার শরীরে প্রবেশ করানো হয়েছিল লংকা বাটা। তবুও গোপনাঙ্গ দিয়ে। ভাবুন তো, আমরা একটা কাঁচা মরিচ কামড় লাগলে কেমন করি আর এখানে তো দুই বাটি।
সে কে ছিল জানেন?বাংলার প্রথম মহিলা রাজবন্দী ননী বালা দেবী।
আপনি সামান্য কারো কথায় মরতে চাচ্ছেন?”

টানা দুই ঘন্টা বৃষ্টিতে ভিজে মাধুর্য নেতিয়ে পড়েছে। আধো আধো চোখে তাকিয়ে দেখলো আরহান বসে আছে।
আহরার না আরহান? নাম ঠিক মনে করতে পারছে না। তবে এটা খেয়াল হচ্ছে এই মানুষটা বুকে এক সমুদ্র কষ্ট।
সেই কষ্টের সমুদ্রে মাথা রেখে চোখ বুজলো মাধুর্য। তারপর বিড়বিড় করে বলল,

“আমার বাঁচতে ইচ্ছে করে না।
সারা শরীরে হাজারো যন্ত্রণা।”

“কেউ কারো দুঃখের ভাগ নেয় না মিস। নিজের কষ্টের উপশম নিজেকেই খুঁজতে হয়।আপনার সারা অঙ্গে যখন বিষ তখন ওঝা আপনাকেই হতে হবে।”

মাধুর্য ঘুমন্ত গলায় বলল,

“আমার এই অঙ্গের ও বিষ যে ঝাড়িতে পারে। সোনার এই যৌবন খানি দান করিবো তারে।”

চলবে

#ভেজা_চুলে
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব-৭

মাধুর্যের যখন ঘুম ভাঙে তখন সে নিজের বিছামায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। পরণে রাতের পোশাক। নিশ্চয় মাম্মিমার কাজ এটা। গতকালকের ঘটনা মনে হতেই ভিতরে দুমড়েমুচড়ে যেতে লাগলো মাধুর্যের।
না সে এত সহজে হেরে যাওয়ার মেয়ে নয়। নিজেকে মানিয়ে নিতে সে জানে।

বিছানার পাশে টেবিলে রাখা ল্যাপটপে দ্রুত সার্চ করল বাংলার প্রথম মহিলা রাজবন্দী সম্পর্কে। কারণ তার যে বারবার মনে হচ্ছে আরহান নামক মানুষটা তার স্বপ্নে এসেছিল বাস্তবে নয়।

যদি সত্যি ননী বালা দেবী নামক কেউ থেকে থাকে তবে কাল সাঁঝবেলার সেই মুহূর্তটা সত্যি।

হ্যাঁ, এই তো সব তথ্য এসেছে। গতকাল তবে আরহানের বুকে সত্যি মাথা রেখে ঘুমিয়েছিল সে?
ভাবতেই ফাকা ঢোক গিললো মাধুর্য।

পুরোদিন মাধুর্য নানান কাজ করে কাটিয়েছে। বাড়ির উত্তর দিকে যায়নি।কারণ উত্তর দিকে দিঘি পার হলেই সাকিবদের বাড়ি।
বাড়ি থেকে আজ অনেক কাজ করেছে সে। নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে। লাইব্রেরি গুছিয়েছে। সালোয়ার-কামিজ বানিয়েছে। ঘরের পাশে থাকা জারুল গাছের নিচে বসে কচি পেয়ারার পাতা চিবিয়েছে।

এবাড়ির সবাই তখন সাকিবদের বাড়িতে ব্যস্ত তাই নিজের রান্না নিজেই করেছে।
লইট্ট্যা শুটকি ভর্তা সাথে গরম ধোঁয়া উঠা ভাত।
শুটকি ভর্তা করতে প্রথমে শুটকি মাছ ছোটো ছোটো করে কেটেপানিতে ভিজিয়ে রোদে রেখেছে। তারপর পেয়াজ,রসুন কেটেছে। মাছ হালকা সিদ্ধ করে ছেঁচে বেশি করে ঝাল দিয়ে, সরিষার তেলের সাথে ভর্তা করেছে।
রান্না শেষে অনেক সময় নিয়ে গোসল সেরে যখন ঘরে এলো তখন দেখতে পায় ইনহান এবং পত্রী বসে আছে।

“মিস ধানী লংকা, চলে এলাম বিনা দাওয়াতে আপনার বাড়ি।”

ইনহানের কথায় ভেজা চুল মুছতে মুছতে তাদের সামনে এসে দাড়ায় মাধুর্য।
পত্রী না থাকলে এখন ইনহান পৃথিবীর সব’চে দানবীয় চুমুটা খেয়ে নিতো মাধুর্যের ঠোঁটে।

“আমি তো শুধু শুটকি ভর্তা করেছি।”

মাধুর্যের কথায় ইনহান জবাব দেয়,

“চলবে না দৌড়াবে।”

পত্রী ততক্ষণে চার প্লেটে ভাত বেড়ে নিয়েছে।
চার প্লেট দেখে কপাল কুঁচকে মাধুর্য জিজ্ঞেস করে,

“এখানে তিনজন বাকী একজন কে?”
“বাহ্ রে! ছোটো চাচা খাবেন না?সে তো সাকিব ভাইদের বাড়িতে খাবে না। চাচা এলো বলে।”
মাধুর্য দেখতে পেলো তার ছোটো মামা ঘরে ঢুকছে। তার হাতে গাছের পাকা আম।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে এলো মাধুর্য এবাড়ির দিকে আসেনি। সাকিব সকালে একবার ও বাড়ি গিয়েছিল তখন মাধুর্য ঘুমে ছিল।খুব ইচ্ছে করছিল তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কিছু সময় ঘুমাতে কিন্তু হাতে এত কাজ যে সে সময় হয়ে উঠেনি।
ভেবেছিল এতক্ষণে হয়তো সে এসেছে কিন্তু দুপুরে খাওয়ার সময় ওকে না দেখে অর্ণিকে জিজ্ঞেস করলে অর্ণি বলল,

“তামসী কই?”
“কালকের পর আসেনি।”
“একা ওবাড়িতে সারাদিন।”
“থাকুক না দাদাভাই। এত আদিক্ষেতা কীসের?”
“শুনেছিলাম বিয়ের পর মেয়েরা পাল্টে যায়। এতটা বদলে যায়?”
“তুই তাহলে চড় কেনো মেরেছিস?আমি না হয় বিয়ের পর বদলেছি, তুই তো তোর জেরিন আসার নাম শুনেই বদলে গেছিস।মাধু আস্ত একটা আপদ এই পরিবারের কাছে, তোর কাছে, তোর জেরিনের কাছে। থাকুক না দূরে। এ নিয়ে তোর আদিক্ষেতার দরকার নেই।”

খাবার প্লেট রেখেই সাকিব চলল তার মামারবাড়ি। মিনিট দুয়েক এর রাস্তা। দ্রুত হেটে মাধুর্যর ঘরে ঢুকলেও তাকে পেলো না। পুরো বাড়িতে সে নেই।
জারুল গাছের নিচে পড়ে আছে একটা চুড়ি। অথচ মেয়েটা নেই।

সাকিব ভেবেছিল মাধুর্য ফিরবে তার ঘরেই ফিরবে কারণ তার যাওয়ার জায়গা নেই। অথচ সাকিব এটা ভুলে বসেছে

“যার এই পৃথিবীতে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, আস্ত পৃথিবীটাই তার আশ্রয় হয়ে যায়।”

পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ মায়ের বয়স জানেন কত ছিল? মাত্র পাঁচ বছর।
পাঁচ বছর বয়সে সে এক পুত্র সন্তান জন্ম দেয় লিনা মেডিনা।সবটাই হরমোনাল কারণে। তবুও ভাবুন হরমোনাল কারণে সে হয়তো মা হওয়ার উপযুক্ত বৈশিষ্ট্য লাভ করে কিন্তু জৈবিক চাহিদা সম্পন্ন না হলে সে গর্ভবতী হতো না।”

ইনহানের কথায় মুখ তুলে তাকালো মাধুর্য।ইনহানের মুখে এক বেদনার স্পষ্ট

মাধুর্যকে চুপচাপ থাকতে দেখে ইনহান আবার বলল,

“টানা চল্লিশ ঘন্টা পাশবিক অত্যাচারিত হওয়ার কষ্ট বুঝতে পারেন মিস ধানী লংকা?আমার বুবুকে ১৭ জন মিলে টানা ৪০ ঘন্টা পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছিল।সেই ৪০টা ঘন্টা পাগলের মতোন খুজেছিলাম বোনকে। আর যখন আরহান ভাই বুবুকে পেলো! জানেন কী অবস্থায় ছিল?”

চলবে

ভুল ত্রুটির ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।এডিট করার সময় পাইনি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে