ভালোবেসে ঠাঁই দিও পরাণে পর্ব-০১

0
759

#ভালোবেসে_ঠাঁই_দিও_পরাণে
#সূচনা_পর্ব
#নুজাইফা_নূন

-” আই ওয়ান্ট ডিভোর্স।একটা শ্বেতী রোগীর সাথে আমার পক্ষে সংসার করা সম্ভব নয়। ভার্সিটির সবাই যখন জানতে পারবে রাদিয়াত মির্জার ওয়াইফ একজন শ্বেতী রোগী আমার তো লজ্জায় মাথা কা’টা যাবে।আমি চাইলেও তোমাকে আমার কলিগদের সামনে দাঁড় করাতে পারবো না। একজন টিচার হিসেবে সবাই আমাকে যে সম্মানটুকু দেয় , আমি চাই না তোমার জন্য আমার সেই সম্মানটুকু ধুলোয় মিশে যাক।তাই আমি ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।যদিও ডিভোর্সের জন্য কয়েকমাস অপেক্ষা করতে হবে। যতোদিন না আমাদের ডিভোর্স হচ্ছে ততোদিন তোমার আর আমার রাস্তা আলাদা। তুমি তোমার মতো থাকবে ।আর আমি আমার মতো।তবে তোমার কোনো টেনশন নেই। ডিভোর্সের পর তোমাকে তোমার প্রাপ্য টাকার অধিক টাকা দিয়ে দিবো আমি। এই টাকার জন্যই তো আমাকে ঠকিয়ে তোমার বাবা মা তোমাকে এই মির্জা পরিবারের ব‌উ বানিয়ে পাঠিয়েছে তাই না?একে তো তুমি শ্বেতী রোগী , আবার বয়স পঁচিশের কোঠায়।তোমার বাবা শত চেষ্টা করেও তোমাকে বিয়ে দিতে পারছিলো না।তাই তো তারা আমার সাথে ছলনা করে তোমার মতো বুড়ি , শ্বেতী রোগীকে হ্যান্ডসাম টিচারের গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে তাদের আপদ বিদায় করেছে।হয়তো তুমি ও এটাই চেয়েছিলে।আফটার অল মির্জা বাড়ির বউ বলে কথা।তোমার তো খুশিতে আটখানা হয়ে যাওয়া উচিত।যতো পারো খুশি হয়ে নাও। কিন্তু তোমার সেই খুশি বেশি দিন স্থায়ী হবে না। খুব শ্রীঘ্রই ডিভোর্সে পেপার চলে আসবে।”

-” বাসর রাতে বরের মুখে ডিভোর্সের কথা শুনে একটু ও অবাক হয় নি রুকু।যেনো এটাই হ‌বার ছিলো।সে খুব ভালো করে জানে তার মতো শ্বেতী রোগীকে কোন পুরুষ’ই ভালোবেসে পরাণে ঠাঁই দিবে না।রুকু চোখের পানি মুছে মাথায় থাকা ঘোমটা সরিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন পুরুষ কে দেখে যেনো বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।বিয়ের আগে মানুষ টা কে দেখার সৌভাগ্য হয় নি তার। শুধু জানতো মির্জা পরিবার থেকে তাদের একমাত্র ছেলে রাদিয়াত মির্জার সাথে তার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। ‌।সবাই ভালোবেসে তাকে রাদ বলে ডাকে। যে কিনা পেশায় একজন টিচার। এমন বড় পরিবার থেকে রুকুর জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে শুনে রুকু যেন নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারে না।সে দেখতে কালো বা খাঁটো এমনটা না। বরং তার দুধে আলতা গায়ের রং, ডাগর ডাগর মায়াবী চোখ , হাঁটু পর্যন্ত ঢেউ খেলা চুল,উচ্চতায় পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির হালকা পাতলা গড়নের মিষ্টি একটা মেয়ে। কিন্তু শ্বেতী রোগ টার কারণে যেন তার সব সৌন্দর্য চাঁপা পড়ে গিয়েছে।রুকু মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তার বাবা রাজন শেখ একজন প্রাইমারির টিচার। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।এর মধ্যে আবার তার একমাত্র ছেলে রিমন মানসিক ভারসাম্যহীন।তার বেতনের অর্ধেক টাকা প্রায় রিমনের চিকিৎসার পেছনে চলে যায়। তার সাধ্যে কুলায় নি রুকুর শ্বেতী রোগের জন্য ভালো কোনো চিকিৎসা দেওয়ার। অবশ্য দু একটা হাতুড়ে ডক্টর দেখিয়েছে ।তারা ঔষধ, মলম দিয়েছে। যেগুলো তে রুকুর কোনো পরিবর্তন হয় নি।এক পর্যায়ে রুকু হাল ছেড়ে দিয়ে তার শ্বেতী রোগের জন্য আর কোনো চিকিৎসা নেয় নি।তার এই রোগের জন্য সমাজের লোকেদের নানান কথা শুনতে হয়।সবাই তাকে এড়িয়ে চলে। তবুও রুকু থেমে থাকে নি। আশেপাশের মানুষের মন্দ কথা উপেক্ষা করে গ্ৰাজুয়েশন শেষ করে।যতো দিন যায় রুকুর বাবা মায়ের রুকু কে নিয়ে টেনশন ততো বাড়ে।রুকুর বয়সী মেয়েদের বিয়ে হয়ে বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেছে অথচ রুকুর জন্য ভালো কোনো ছেলের থেকে প্রস্তাব আসে না।যারা আসে তারা রুকু শ্বেতী রোগী দেখে তাদের বাড়ি থেকে পানি টুকু ও মুখে না দিয়ে চলে যায়। কতোবার যে রুকু পাত্রপক্ষের থেকে রিজেক্ট হয়েছে সে হিসেব নেই।রুকুর বাবা মা তার দুই ছেলেমেয়ে কে অনেক বেশি ভালোবেসেন।তারা সিদ্ধান্ত নেন তারা আর কখনো রুকু কে পাত্রপক্ষের সামনে এনে নিজের মেয়েকে অপমানিত করবেন না।প্রয়োজনে রুকু কে তারা সারাজীবন নিজেদের কাছে রেখে দিবেন। তাদের এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঠিক দু’দিন পরে রাদিয়াতের মা তমা মির্জা বোন তুলি মির্জা রুকুদের বাড়ি এসে রুকুর বিয়ের প্রস্তাব দেন।এতো বড় বাড়ি থেকে রুকুর জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে শুনে রুকুর মা লিমা বেগমের খুশিতে চোখ ছলছল করে উঠে।তিনি তাদের আদর আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি রাখেন না।রুকু কেও সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে তাদের সামনে নিয়ে আসা হয়।তমা মির্জা রুকু কে দেখে যেনো স্তব্ধ হয়ে যায়। পরক্ষণেই তিনি ভাবেন তার ছেলে পছন্দ করেছে বলে কথা।যে ছেলে এতো গুলো বছর বিয়ে করতে রাজি হয় নি , সেই ছেলে স্বেচ্ছায় এই মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছে ভেবে তিনি আর দ্বিমত করেন নি।রুকু কে আংটি ,বালা পরিয়ে বিয়ের দিন পাকা করে আসেন।রাতে তমা মির্জা রাদের রুমে গিয়ে দেখেন রাদ ল্যাপটপে কাজ করছে।তিনি এগিয়ে গিয়ে রাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

-” এখনো সময় আছে রাদ। তুমি ভেবে দেখতে পারো‌।বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয়।এটা সারাজীবনের ব্যাপার।”

-” এমনভাবে বলছো কেনো আম্মু? মেয়ে দেখে তোমাদের কি পছন্দ হয় নি?”

-” সংসার তুমি করবে রাদ। তোমার পছন্দ’ই আমার পছন্দ। তবু ও আমার মনে হচ্ছে মেয়েটার সাথে তোমার ফেস টু ফেস কথা বলা উচিত।একে অপরকে জানা উচিত।”

-” না না আম্মু। তার কোনো প্রয়োজন নেই।তার সাথে যতো কথা সব বাসরঘরে হবে।”

-“ঠিক আছে। তোমার যখন কোনো আপত্তি নেই, তাহলে আমার আর বলার কিছু নেই বলে তমা মির্জা নিজের রুমে চলে আসেন।”

-“দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসে।সব কিছু ঠিকঠাক মতো চলছিলো কিন্তু বিপত্তি ঘটে যখন রাদ রুকুর ছবি দেখে।তুলি মজা করে রুকুর সাথে সেলফি তুলে সেটা রাদের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেয়।ছবিটা দেখা মাত্র রাদ এর বুঝতে বাকি রইলো না সে যে মেয়েকে পছন্দ করেছিলো এই মেয়ে সেই মেয়ে নয়। মূহুর্তের মধ্যে বিয়ে বাড়িতে এক প্রকার হুলুস্থুল কাণ্ড বেঁধে যায়।রাদ বিয়ের আসর ছেড়ে চলে আসে।রুকুর টেনশনে রাজন শেখ হার্ট অ্যাটাক করেন।এসব দেখে তমা মির্জা স্থির থাকতে পারেন না। তিনি রাদ কে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে রুকুর সাথে বিয়ে সম্পন্ন করেন।রুকু জানতো আর পাঁচটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক ভাবে স্বামীর সংসার করতে পারবে না সে।তাই তো বাসর ঘরে ডিভোর্স এর কথা শুনে একটু ও ঘাবড়ে যায় নি সে। রুকু কে এতো গুলো কথা বলার পরেও রুকু বিছানা থেকে না নেমে ঠাঁই সেখানেই বসে থাকে ।যা দেখে বিরক্তি নিয়ে রাদ রুকুর সামনে গিয়ে বললো,

-” এই মেয়ে কি জানি নাম তোমার ? রুকাইয়া না কি জানি একটা।যাই হোক তোমার সাহস হয় কি করে আমার বিছানায় বসে থাকার।নামো এক্ষুনি আমার বিছানা থেকে।তোমাকে আমার আশেপাশে ও যেনো না দেখি। তোমার এই রোগ সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার খুব ইচ্ছে তোমার তাই না?”

-” আপনি নাকি পেশায় একজন টিচার? টিচার কি আদৌ পড়াশোনা করে হয়েছেন ? না মানে আপনি একজন শিক্ষিত মানুষ হয়েও অশিক্ষিত লোকের মতো কথা বলছেন। আপনি ও এসব কুসংস্কার বিশ্বাস করেন?আপনি বোধহয় জানেন না শ্বেতী রোগ কোনো ছোঁয়াচে বা প্রাণঘাতী রোগ নয়।”

-” তোমার থেকে কোনো জ্ঞান নিতে চাইছি না আমি। বেশি কথা না বলে চুপচাপ আমার রুম থেকে বেরিয়ে যাও।”

-” আপনার মতো নিচু মানসিকতার লোকের সাথে থাকার কোনো ইচ্ছাও আমার নেই।যে লোক সামান্য একটা মেয়েকে সম্মান দিতে জানে না সে নাকি আবার ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা দেয়। ছাত্র-ছাত্রীরা আপনার থেকে ঠিক কি শিখবে মিস্টার রাদিয়াত মির্জা ?”

-” তুমি কিন্তু বড্ড বেশি কথা বলো মেয়ে।আমার থেকে তুমি দূরত্ব বজায় রাখবে ব্যাস।আমার কোনো জিনিসপত্রে ভুলেও যেনো তোমার টাচ না লাগে।রুকু একথা শোনা মাত্রই রাদের সামনে এসে রাদ কিছু বুঝে উঠার আগেই রাদ কে জড়িয়ে ধরলো।”

চলবে ইনশাআল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে