ভালোবাসি বলেই ভালোবাসি বলিনা পর্ব-১২

0
2305

গল্পর নাম :#ভালোবাসি_বলেই_ভালোবাসি_বলিনা
#পর্ব-১২: #অপ্রকাশিত_ভালোবাসা
লেখিকা : #Lucky

জ্ঞান ফিরতেই এক অদ্ভুত ঘ্রাণ নাকে আসতে লাগল। অনেক কষ্টে চোখ খুলতেই ঘোলাটে ভাবে তাকিয়ে চারিদিক অচেনা মনে হলো।
দৃষ্টি স্বচ্ছ হতেই বুঝলাম আমি হস্পিটালে। হাতের ডান দিকে তাকাতেই দেখলাম স্যালাইন চলছে। আর ক্যানুলা করা সেই হাতটা ইথান তার দুইহাত দিয়ে ধরে রেখে ঘুমোচ্ছে।
তার অগোছালো চুলগুলো আর শুকনো মুখই বলে দিচ্ছে সে অনেক ক্লান্ত।
কিন্তু আমি ত তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ চোখ খুলে এই জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করছি কেন?
নাকি রাতে জ্বর বেড়ে গিয়ে বেহুশ হয়ে গিয়েছিলাম?
এটা ছাড়া আর কি-ই বা হবে!
আমার জন্য তার অবস্থা নাজেহাল।
কিন্তু আমি কয়দিন ধরে হস্পিটালে?
ইথানের দিকে দেখে মনে হচ্ছে কয়েক মাস ধরে। যদিও তা না।
হয়তো গতরাতেই কিছু হয়েছিল।
আমি বাম হাত দিয়ে তার চুলগুলো গুছিয়ে দিতে লাগলাম। আর তখনি একটা নার্স কেবিনে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “ও.. আপনি উঠেছেন?”
আমি চমকে তাকে ইশারায় চুপ করতে বললাম কারণ ইথান ঘুমাচ্ছে।
কিন্তু ইথান নড়েচড়ে চোখ খুলল।
এদিকে নার্স না বুঝে তাকিয়ে আছে।
ইস ওনার ঘুমটা নষ্ট করলো এই নার্সটা!
ইথান দ্রুত মাথা তুলে আমার দিকে তাকালো।
আমার হাতটা এক হাত দিয়ে ধরে রেখে অন্য হাত দিয়ে আমার কপাল স্পর্শ করল। আর ব্যস্ত হয়ে বলল, “এখন ঠিক আছো? আমি বার বার বলেছিলাম ডাক্তার ডাকি। তোমার কথা শোনাই উচিত ছিল না আমার।”
আমি শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে তার ব্যাকুলতা দেখছি।
“জ্বর ত এখনো আছে।” ইথান বলল।
তারপর নার্সের দিকে তাকিয়ে বলল, এখন মেডিসিন আছে কোনো?
নার্স এত সময় টাশকি খেয়ে আমাদের দেখছিল। ইথানের কথায় তার হুস হলো।
“স্যালাইন দিব আরেকটা। আর জ্বরের জন্য এখন ট্যাবলেট খেলেই হবে।” নার্স বলল।
“Yeah sure.” বলে ইথান উঠে যেতে লাগল। সাথে সাথে আমি তার হাতটা আরো শক্ত করে ধরলাম।
ইথান প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “কি?”
“আমার সাথেই থাকেন প্লিজ।” অনুনয় করে বললাম আমি।
“যাচ্ছি না। ওই সাইডে এসে দাড়াচ্ছি।” বলল ইথান।
ইথান এক পাশে সরে বুকে দুই হাত গুজে দাড়ালো।
নার্সটা মুচকি হেসে অন্য একটা স্যালাইন চালু করতে করতে বলল, “আপনার হাসবেন্ড ত অনেক ঘাবড়ে গিয়েছিল। আর সারা রাত জেগেও ছিল আপনার জন্য। জলপট্টিও দিয়েছে। আপনার অনেক জ্বর ছিলো। একশো চারের বেশি।”
আমি হতবাক হয়ে ইথানের দিকে তাকালাম।
সে অপ্রস্তুত হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিলো। কারণ কেউ যে এভাবে তার করা সবকিছু বলে দেবে সে বুঝতেও পারেনি।
আমি মৃদু হেসে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
নার্সটা স্যালাইন চালু করে দিয়ে আমার কানের পিছনে থার্মোমিটার ধরে জ্বর মেপে নিলো।
“এখন একশো। আশা করি জলদিই সুস্থ হয়ে যাবেন।” বলে নার্সটা চলে গেল।
ইথান আবার আমার পাশে এসে বসলো।
“আপনি বাসায় যান। আপনার ত সারারাত ঘুম হয়নি আমার জন্য!” বললাম আমি।
“আমি ঠিক আছি।” ইথান সরু চোখে তাকিয়ে বলল।
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে ইথানের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ঠোঁটটাও শুকিয়ে যাচ্ছে ওর। তাই বার বার জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিচ্ছে।
আমাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইথান ভ্রুকুচকে তাকিয়ে বলল,”কি?”
আমার কেন জানি সন্দেহ হলো তাই আমি হাত বাড়িয়ে ওর গাল স্পর্শ করলাম।
সাথে সাথেই চমকে গেলাম।
ওর শরীরেও জ্বর। বলতে গেলে অনেক জ্বর। গা পুড়ে যাচ্ছে।
“আপনার মাথা খারাপ! এত জ্বর আপনার তাও বসে আছেন?” আমি রেগে বলে উঠলাম।
ইথান অবাক হলো।
এতেই বুঝে গেলাম যে সে বুঝতেও পারেনি তার জ্বর।
“আমার আপনাকে রাতে জড়িয়ে ধরাই উচিত হয়নি। আমার জন্য আপনার জ্বর হয়ে গেল।” আমি অস্থির হয়ে গেলাম।
“ডোন্ট প্যানিক। আমি ঠিক আছি।” ইথান আমাকে স্বাভাবিক করার জন্য বলল।
“না নেই আপনি। এখনি ভর্তি হবেন। এখনি মানে এখনি।” বিচলিত হয়ে বললাম আমি।
.
শেষমেশ ওনাকেও হস্পিটালে ভর্তি করিয়ে দিলাম। প্রথমে ত অন্য কেবিনে দিতে চাচ্ছিলো।
কিন্তু আমিই দিলাম না।
আমার কেবিনেই পাশাপাশি আরেকটা বেডে তাকে নিয়ে এলাম।
এখন শান্তি লাগছে। হস্পিটালের হালকা নীল কাপড়ে তাকে দেখতে দারুন লাগছে।
ইথান নিজের বেডে বসে আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে আছে। এদিকে দিবা মুচকি মুচকি হাসছে।
আমি মহাতৃপ্তিতে আছি।
“জীবনেও হস্পিটালাইজড হতে হয়নি আমার।” বলল ইথান।
“এখন দেখেন কেমন লাগে! সামান্য জ্বরের জন্য আমাকে তুলে হস্পিটালে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন।” একটু ভাব নিয়ে বললাম আমি।
“তোমার সেন্সই ছিল না।” রেগে বলল ইথান।
“আর বলো না! বলতে গেলে তোমার বর পাগোলই হয়ে গিয়েছিলো।” দিবা মুচকি হেসে বলল।
আমি ভ্রু উঁচু করে ইথানের দিকে তাকালাম।
“তোর কোনো কাজ নেই?!” ইথান চোখ পাকিয়ে বলল দিবাকে।
“না নেই।” ইথানকে মুখ ভেংচি দিয়ে বলল দিবা।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “শোনো, রাতে সে তোমার পাশ থেকে নড়লই না। আরে বাবা! আমি ত এসেছি এজন্যই যাতে ও একটু ঘুমাতে পারে। কিন্তু না! সে-ই থাকবে তার বউয়ের কাছে। কি যে বলব!”
ইথান কড়া চোখে তাকিয়ে আছে দিবার দিকে। কিন্তু দিবা গায়ে মাখাচ্ছে না।
“কত ভাব! আমার সাথে কারো রিলেশন নেই। কিন্তু আমি ত জানি, বাগানে কিছু-মিছু চলছিলো। শেষ পর্যন্ত বিয়ে ত করলই। তুমিই বলো ছিলো না রিলেশন?” দিবা ভ্রু উঁচু করে বলল আমাকে।
ইথান বিরক্ত হয়ে গায়ে চাদর টেনে নিয়ে শুয়ে অন্যদিকে ঘুরলো।
“এখন রাগ দেখাচ্ছে দেখো! এত ভালোবাসা কিন্তু মুখে প্রকাশ করেতেই চায় না।” নিরলস ভাবে তাকিয়ে বলল দিবা।
“ভালোবাসার যত গভীর তার প্রকাশ তত কম।” আমি ইথানের দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তে বলে উঠলাম।
দিবা হা হয়ে তাকিয়ে আছে। ইথান শুনেছে কিন্তু ঘুরে তাকায় নি।
তবে না তাকালেও আমার মন বলছে যে সে মৃদু হেসেছে।
বলার পরেই একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম। তাও নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “ঘুম পেয়েছে ঘুমাবো আমি।”
দিবা একটু মুচকি হাসল। তারপর বলল, “আমি যাচ্ছি তাহলে বাসায়। মাসি এসে যাবে এখনি। রাতে ত অনেক বুঝিয়ে বাসায় রেখে এসেছি। এসে এখন দুইজনকেই হস্পিটালে ভর্তি দেখে হা হয়ে যাবে।”
বলতে বলতেই ইথানের মা ঢুকল।
সে সত্যিই আমাকেসহ ইথানকে হস্পিটালে ভর্তি দেখে হা হয়ে গেল।

সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ইথান এখনো ঘুমোচ্ছে। ইথানের মা দুপুর বারোটার দিকে আমাদের খাবার খাওয়া শেষ করিয়ে তবেই ফিরে গেছেন।
তারপর থেকেই সে ঘুমোচ্ছে। আর আমি বসে বসে বোর হচ্ছি।
একটু আমার দিকে ফিরে ঘুমালে কি হত?
অন্তত পক্ষে মুখ টা ত দেখতে পেতাম।
হঠাৎই মনে হলো ওনার পাশে গিয়ে শুয়ে পরলেই ত হয়।
আমার হাতে আপাতত স্যালাইন চলছে না শুধু ক্যানুলাটা করে রাখা। শরীর এখনো দুর্বল বলে রাতে আবার হয়তো স্যালাইন দিবে।
আমি নিজের বেড থেকে নেমে গুটি গুটি পায়ে তার কাছে এগিয়ে গেলাম।
সে শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। যাক তাও সব ক্লান্তি দূর ত হয়েছে।
আমি অনেক সামলে গুটিশুটি হয়ে তার পাশের অল্প জায়গায় শুয়ে পরলাম। আর তাকে দেখতে লাগলাম।
ভেবেই অবাক লাগে যে ইথান এখন আমার।
পুরোপুরিভাবে শুধু আমার। অন্য কারো না।
ভাবতে ভাবতেই আমার অবাধ্য হাত তার গাল ছুয়ে দিলো।
ইথান তাও ঘুমেই ব্যস্ত।
আমি মৃদু হেসে ওর কপালে ঠোঁট ছুয়ে দিলাম।
তখনি ইথান কপাল কুচকে ফেলে আস্তে আস্তে চোখ খুলল। তারপর সরু চোখে আমার চোখের দিকে তাকালো।
আমি অনেক বেশিই অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।
“আ…আমি…।” এটুকু বলেই আমি চোখ সরিয়ে নিলাম।
“হস্পিটালও বাদ রাখতে চাচ্ছ না!” মুচকি হেসে বলল ইথান।
“আ…আমি ত…।” এটুকু বলেই আমি একটু সরে যেতে চাইলাম। কিন্তু বেডটা যে অনেক ছোট সেটাই খেয়াল ছিল না। তাই পরে যাওয়ার মতো অবস্থা হতেই নাক মুখ কুচকে ফেললাম।
কিন্তু ইথান আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নিলো।
আপাতত আমি নাকমুখ কুচকে তার কাধের কাছের জামাটা হাতের মুঠোয় ধরে আছি।
“বেড অত বড় না।” বলল ইথান।
আমি আস্তে আস্তে চোখ খুলে ওর দিকে তাকালাম। তার মুখে দুষ্টু হাসি।
“আমার বেডে কি করছ?” ভ্রু উঁচু করে বলল ইথান।
আমি ঝট করে জামাটা ছেড়ে দিয়ে বললাম, “ভুল করে এসে পরেছি।”
“Lame excuse.” মুচকি হেসে বলল ইথান।
অসহ্য! ধরা পরে যাই শুধু।
আমি নিজেকে সামলে ভ্রুকুটি করে বললাম, “আপনি বেশি বুঝবেন না, আমি ভুল করেই এসেছিলাম।”
তার মুখে এখনো মৃদু হাসি বিদ্যমান। মানে আমাকে ধরা পরতে দেখে তার মহা আনন্দ লাগছে। কিন্তু আমার গা জ্বলে যাচ্ছে।
দিন আমারো আসবে।
আমি কপাল কুচকে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম।
তখনি উনি আমাকে আরো কাছে টেনে নিলেন।
আমি চমকে উঠলাম আর ওর কাধের কাছের শার্টটা আবার শক্ত করে ধরে নিলাম।
আর বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলাম।

“তোমার বিখ্যাত ডায়লগ দিবা না- ‘আমি এখনো রেডি না’?!” বলেই ইথান হেসে দিল।
আবার অপমান করলেন উনি আমাকে!
“ভুল করেই এসেছি আমি। যত্তসব। ছাড়ুন আমাকে।” মুখ ফুলিয়ে বললাম আমি।
ইথান সত্যি সত্যিই আমার কোমড় থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো।
“ছাড়তে বললাম আর ছেড়ে দিলেন?” আমি হা হয়ে বলে ফেললাম।
“ত?” ইথান ভ্রুকুচকে তাকিয়ে বলল।
তারপর উপহাসের সুরে বলল, “তুমি নাকি ভুল করে চলে এসেছো! এখন যেতে দিচ্ছি যাচ্ছও না!”
আমি কটমট নজরে ইথানের দিকে তাকালাম।
“আপনি অনেক ফালতু। দুনিয়ায় ফালতু।” বলেই আমি উঠে বসে নামতে গেলাম।
তখনি ইথান আমার হাত ধরল।
যদিও মনের মধ্যে এক ভালো লাগা কাজ করলো কিন্তু সেটাকে দূরে ঠেলে দিয়ে আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বললাম, “এখন কেন আটকাতে চাচ্ছেন?”
“এটাই বলার জন্য যে আমাকে এক গ্লাস পানি ঢেলে দিয়ে যাও।” হাসি আটকে রেখে বলল ইথান। তারপর আমার হাত ছেড়ে দিল।
দেখেই বুঝলাম উনি মজা নিচ্ছেন আমার সাথে?
আমি মুখ ফুলিয়ে তার বেড থেকে নেমে নিজের বেডে চলে গেলাম।
উনি এখনো হাসছেন সেটা আমি বুঝতে পারছি।
হেসে রাখেন। এরপর আমার হাসার পালা। আপনি শুধু অপেক্ষা করতে থাকেন মিস্টার।
“তোমার মেবি আমার বেডটা বেশি পছন্দ, এক্সচেঞ্জ করবা?” বলল ইথান।
আমি রাগে ফুলতে ফুলতে গায়ে চাদর টেনে নিয়ে নিজেকে ঢেকে নিলাম।
.
আমি রাতের খাবারের সময়ও তার সাথে কোনো কথা বললাম না।
আমি এখনো রেগেই আছি।
কিন্তু তাকে দেখো! বিষয়টা গায়েই মাখাচ্ছে না!
তবে তার ঠোঁটের মৃদু হাসি জানান দিচ্ছে যে সে এগুলোতে বেশ মজা পাচ্ছে।
আমার এখন প্রচুর বিরক্ত লাগছে।
ফোনটা শশুড়বাড়িতেই পরে আছে৷ নাহলে সত্যি আমি ব্লক খুলে মৃদুলের সাথে প্রেমালাপ করতে শুরু করে দিতাম।
আমি লাইট অফ করে নিজের মত ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। এবার আমিও পাত্তা দিব না।
কাচের জালানা দিয়ে বাহিরের হালকা আলো ঢুকে কেবিনটা হালকা আলোকিত করেছে।
ইথান বিছানা থেকে উঠে কেবিনের দরজার কাছে গেল।
আমি তার দিকে অত খেয়াল করছি না এমন ভান করে নিজের চাদরটা গায়ে দেওয়ার জন্য ঠিক করতে লাগলাম।
হঠাৎই ইথান কেবিনের দরজা লক করে দিলো।

(চলবে…)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে