#ভালোবাসায়_তুমি_আমি
#পর্ব_০৩
#নির্মল_আহমেদ
এদিকে,,,
আসাদুল চৌধুরী ও তানিশা বেগম এই দীর্ঘ জার্নিতে পুরো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাই ফ্লাটে এসেই তারা সোফায় বসে পড়ল। এবং সেখানে বসে কিছুক্ষণ রেস্ট নিতে থাকলো। তনয় স্যুটকেসটা নিয়ে গিয়ে তার বাবা-মা যে ঘরে থাকবে, সে ঘরে রেখে দিয়ে আসলো। তারপর তনয় তাদেরকে বলল,
‘আচ্ছা তোমরা তো সারাদিন কিছু খেতে পারো নি। এখন নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে? তা বল কি খাবে? আমি রেস্টুরেন্ট থেকে আনিয়ে দিচ্ছি।’
‘রেস্টুরেন্ট থেকে আনবে মানে? এখানে কি কিছু রাঁধা হয় না নাকি?’তানিশা বেগম বেশ ধারালো কন্ঠেই কথাটি বললেন।
তনয় মুচকি হেসে জবাব দিল না,’আসলে মা, বুয়া এসে রেঁধে দিয়ে যায় কিন্তু আজ নাকি আসতে পারবেনা। তাই আর কি বলছিলাম!’
তানিশা বেগম অন্য মুখ ঘুরে একটু রাগী লুকে বললেন,’তাই বলে যে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনতে হবে নাকি? আমি কি রাঁধতেতে পারব না!’
তানিশা বেগমের কথায় খুশি হলো তনয়; উৎফুল্লিত কন্ঠে বলল,’মা! তুমি রাঁধবে? তাহলে তো বেশ ভালই হয়। কতদিন তোমার হাতে রান্না খাইনা!’
তানিশা বেগম বিরক্ত কণ্ঠে বললেন,’হয়েছে হয়েছে আর নাটক করতে হবে না! যতসব!’ বলেই হনহনিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন তিনি।
মায়ের কথায় মন খারাপ হচ্ছিল তনয়ের তখনই তার বাবা বলল,
‘এই তনয়! আমার পাশে বস। কতদিন একসাথে বসে গল্প করি না। চুকিয়ে বাপ বেটা মিলে গল্প করব।’
তনয় একটা মুচকি হাসি দিয়ে তার বাবার পাশের সোফায় গিয়ে বসল।
কেটে গেল সেদিনটা। পরেরদিন তিশার বাবা মা ফিরে আসি বাসায়। আজই তনয় তার বাবার বন্ধুর মেয়ে দেখতে যাবে। তাই অফিসে ছুটি নিয়েছে। বিকেলের দিকে যাবে তারা। এদিকে তিশাদের বাড়িতেও হুলস্থুল বেজে গেছে। পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে বলে কথা তাই ভালো মন্দ রান্না হচ্ছে সকাল থেকেই। তিশা তার আপু তুলিকে সাজাতে ব্যস্ত। একটি সুন্দর গোলাপী বর্ণের শাড়ি পরিয়েছে তুলি কে। তুলি এমনিতেই অনেক সুন্দরী! যাকে বলে মায়াবতী আর কি। তিশা তুলিকে সাজাতে সাজাতে বললো,
‘আপু আমি তোকে গ্যারান্টি দিচ্ছি, যেই ছেলে তোকে আজকে দেখতে আসুক, সে দেখে পুরোই বেহুশ হয়ে পড়বে?’
তুলি খানিকটা লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বলল,’ধুর কি বলছিস এসব?’
‘হুম। আপু! সত্যি বলছি, একদম পরী লাগছে তোকে।’
‘পরী লাগছে, তাই না?এক মারবো চাটি। সব সময় শুধু বদমাইশ গিরি।’
‘আহ্! আপু সব সময় এমন তেতোর মত হয়ে থাকিস কেন? প্রশংসা করছি তাও তোর সহ্য হচ্ছেনা। যখন বর প্রশংসা করবে তখনও কি তাকে এভাবে চাটি মারতে চাই বি।’
তুলি রাগী লোকে তিশার দিকে তাকালো তারপর বলল,
‘তুই চুপ করবি। নাকি এখান থেকে যাবি, বলতো আগে।’
তিশা দুষ্টু মাখা কন্ঠে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে। যাচ্ছি আমি। তাতে তুই বরং তোর হবু বরের কথা চিন্তা কর।’ বলেই তিশা সেখান থেকে পালালো।
তিশা চলে যেতেই তুলি একটা মুচকি হাসি দিলো। কালকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো ছেলের ছবিটা অন্ততপক্ষে 50 60 বার দেখেছে। এককথায় ছেলেটাকে বেশ পছন্দ হয়েছে তার।
এদিকে,,,
তিশা আপুর ঘর থেকে পালিয়ে ড্রইং রুমে আসলো। সেখানে সোফায় বসে তার বাবা পত্রিকা পড়ছেন আর তার বন্ধুর অপেক্ষা করছেন। তার মা রান্নাঘরে এখনো রান্না করেই যাচ্ছেন। হঠাৎ দরজায় কলিং বেলটা বেজে উঠলো। তিশার বাবা বুঝতে পারলেন তারা এসে গিয়েছেন। তাই পত্রিকাটি মুড়িয়ে ছোট করে টেবিলটায় রাখলেন এবং দরজা খোলার জন্য এগিয়ে গেলেন। দরজা খুলেই তিশার বাবা তাদেরকে সালাম করলেন এবং তারপর ভালো করে দেখলেন তনয় আসেনি। তাই তিনি একটি কৌতুহলী কণ্ঠে বললেন,
‘আরে আসাদুল তনয় কোথায়? তনয়কে তো দেখতে পাচ্ছি না।’
আসাদুল চৌধুরী একটা মুচকি হাসির সাথে বললেন,ও তনয়! আসলে তনয় একটু পিছনে আছে। আসলে আমি আর তানিশা একটা রিকশায় এসেছি। আর তনয় আর একটা রিক্সায়। তাই হয়তো একটু পিছিয়ে আছে।’
‘ওহ। তা তনয় আমাদের বাড়ির ঠিকানা জানে তো?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ। চিন্তা নেই আমি সব বলে দিয়েছি।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। তাহলে আসুক তনয়। ততক্ষণ আমরা না হয় একটু গল্প করি। আসুন ভাবি।’
বলেই তারা ভিতরে প্রবেশ করল। তিশার সোফায় বসে ছিল। তিশাকে দেখে আশাদুল চৌধুরী বললেন,
‘আরে আতিফ এ তোর ছোট মেয়ে না? কি যেন নাম!’বলেই মনে করার চেষ্টা করতে থাকলেন আসাদুল চৌধুরী।
তিশা একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল,’আঙ্কেল! আমার নাম তিশা ইয়াসমিন।’
মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিমায় আসাদুল চৌধুরী বললেন,’রাইট তিশা। তুমিও তো বড় হয়েছো দেখছি, তোমাকেও বিয়ে দিতে হয়।’
তিশা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করল। তখনই মনে পড়ল, তার তো বিয়ে হয়ে গেছে! ভেবেই একটা ঢোক গিলল সে। পুনরায় মনটা খারাপ হয়ে গেল তার।
এমন সময় রান্নাঘর থেকে তিশার মা বেরিয়ে এসে তিশার বাবা আতিফ কে বললেন,’
‘ওগো শুনছো চিনি আনতে যে বলেছিলাম, তা চিনি আনো নি কেন?’
আতিফ রহমান মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললেন,
‘ও আল্লাহ! একদম ভুলে গেছিলাম।’
‘তাহলে এখন কি হবে? চিনি ছাড়া চা কফি হবে কিভাবে?’
আতিফ রহমান ভাবলেন, অনেকদিন পর তার বন্ধু আর বন্ধুর স্ত্রী এসেছে। তাদেরকে এখানে একা ফেলে রেখে সে বাজারে চিনি আনতে যাবে। সেটা ভালো দেখায় না। তাই তিনি তিশাকে বললেন,
‘আচ্ছা তুই শালা তুই বাজারে গিয়ে একটু চিনি আনতে পারবি না?’
‘হুম কেন পারব না। অবশ্যই পারবো। মা আমাকে ব্যাগ আর টাকা দাও। আমি বাজারে যাচ্ছি।’
এদিকে,,,
তনয় রিক্সাওয়ালা কে রিস্কা থামাতে বলে একটু বাজারে নেমেছে। তার খুবই সিগারেটের নেশা পেয়েছে একটা সিগারেট খেতেই হবে। তাই বাজারে নেমেছে সিগারেট কেনার জন্য। সেখানে একটি দোকান থেকে সিগারেট কিনে তাতে আগুন জ্বালিয়ে কয়েকটা টান দিতে দিতে রিক্সার কাছে যাচ্ছিল। এদিকে তিশাদের বাসা থেকে বাজার অতটা দূরে ছিল না। এই 5 মিনিটের পথ। তাই তিশার বাজারে পৌঁছতে খুব একটা সময় লাগেনি। বাজারে পৌঁছে তিশা টাকা গুনছিল আর সামনের দিকে এগোচ্ছিল। সেজন্য সামনের দিকে খুব একটা খেয়াল করেনি এগোতে এগোতে হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা খায় সে। তাল সামলাতে না পেরে তিশা মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল হঠাৎ যার সাথে ধাক্কা খেয়েছিল সে হাতটি ধরে ফেলে। অন্য কেউ তার হাত ধরে ফেলে অনেকটা রেগে যায় এবং বলে,
‘এই হু আর ইউ? আপনি আমার হাত ধরলেন কেন? আপনার তো সাহস কম না।’
ছেলেটা অর্থাৎ তনয় অবাক হয়ে বলল,’আরে আচ্ছা মুশকিল তো আপনি তো পড়ে যাচ্ছিলেন। আমি ধরেছিলাম জন্য বেঁচে গেছেন।!’
‘হুম হুম বুঝি বুঝি এসব আপনার….’বলতে বলতে হঠাৎ ছেলেটার মুখের দিকে তাকাতেই অবাক হয় এবং বলে,
‘আরে আবার আপনি? মিস্টার হবু হাজব্যান্ড!’
তনয় ও ভালো করে তাকিয়ে বুঝতে পারলো এটা সেই মেয়ে যার সাথে কয়দিন আগে তার বিয়ে হয়েছিল। সেও সমপরিমাণ অবাক হয়ে বলে,
‘আরে আপনি সেই না মিস…না না মিসেস! আপনি এখানে কি করছেন?’
‘আমি এখানে যাই করি না কেন,তাতে আপনার কি? আগে বলুন আপনি এখানে কিভাবে?’
তনয় ঠোঁট বাকিয়ে অ্যাটিটিউড ভাব নিয়ে বলল,’হুহ! আপনি যদি না বলেন যে আপনি এখানে কি করছেন তাহলে আমারই বা কোন ঠেকা পড়েছে যে আমি বলব।’বলেই তো নয় আবার সিগারেটে টান দিতে দিতে সেখান থেকে চলে গেল। পিছনে ফিরে একবারও দেখল না। তিশা গাল ফুলিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,’হায় আল্লাহ! ভেবেছিলাম লোকটা ভালো কিন্তু এতো দেখছি মহা খারাপ লোক। আমাকে ইগনোর করে যায়!’বলতে বলতে হঠাৎ তার মনে পড়ল যে সেখানে চিনি নিতে এসেছে। তাই তাড়াতাড়ি চিনি কেনার জন্য বাজারের ভিতরে প্রবেশ করল।
চিনি কিনা শেষে তিশা বাড়িতে চলে গেল। এখনো ছেলে আসেনি। সে ভাবলো হয়তো ছেলে খুবই ঢিলে টাইপের। আপুর কপালে দুঃখ আছে! বলেই সে উপরে আপুর ঘরে গেল।
তনময় এতক্ষণে তিশা দের বাড়িতে চলে এসেছে। এসেই চুপচাপ সোফায় বসে আছে। তার এসব কিছুই ভালো লাগছে না বিয়ে করার কথা তো একদমই না। সে শুধু বাবার আজ্ঞা পালনের জন্য এখানে মেয়ে দেখতে এসেছে। বাকিটা বাবা যা বলবে তাই করবে এবং চিরকালই তা করে এসেছে।
তুলিকে আজ প্রথম ছেলে দেখতে এসেছে।তাই সে একদমই কনফিডেন্স পাচ্ছিনা। কিন্তু তিশা তুলিকে এমন ভাবে বুঝাচ্ছে যেন সে এর আগে দশ-বারোবার পাত্রপক্ষের সামনে বসেছে। বলছে,
‘আপু তুই কোন চিন্তা করিস না। আমি তোর পাশে আছি না? তুই শুধু চুপ করে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবি আর ওরা যা যা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে তার তার সহজ সরলভাবে উত্তর দেবার চেষ্টা করবি। ব্যাস, তাহলেই হয়ে যাবে।’
তুলি চিন্তিত ও শুকনো গলায় বলল,’তাহলেই হয়ে যাবে। না?’
তিশা পুরো কনফিডেন্স নিয়ে বলল,’হবে মানে? হয়ে পুরো বেশি!’
এসব কথাবার্তা চলছিলো দুই বোনের মধ্যে তখনই তাদের মা রুমে প্রবেশ করলেন। তাড়া নিয়ে বললেন,
‘এই তিশা তুলির রেডি হওয়া পুরো শেষ? তোর বাবা বলছেন তাড়াতাড়ি তুলিকে নিচে নিয়ে আসতে!’
‘এইতো হয়ে গেছে, মা। তুমি নিচে যাও। আমি আপুকে নিয়ে নিচে আসছি।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি আয়।’বলে তিনি চলে যাবেন নিচে।
এরপর তিশা তুলির মাথায় একটু ঘোমটা টেনে দিয়ে নিচে নিয়ে যেতে থাকলো। যখন সিঁড়ি দিয়ে নাম ছিল তারা, তখন তিশা সেখান থেকে সোফায় বসা ছেলেটার দিকে তাকালো। কেমন চেনা চেনা ঠেকছে! হঠাৎ ঐ তার চোখ রসগোল্লা হয়ে গেল এবং মনে মনে বলল,
‘আরে এটাতো মিস্টার হবু হাসবেন্ড! এখানে কীভাবে তার মানে… আপুকে যে ছেলে দেখতে এসেছে সে এই ছেলে। হায় আল্লাহ এবার কি হবে উনার সাথে তো আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এখন আবার পাত্র সে যে আমার আপুকে বিয়ে করবে।’এসব ভাবছিল তিশা আর ঢক গিলছি লো।
তনয় মাথা নীচু করে ছিল। তখন আসাদুল চৌধুরী তাকে সিঁড়ির দিকে তাকাতে বললেন। বাবার কথা অনুযায়ী তনয় সিঁড়ির দিকে তাকালে তার চোখ রসগোল্লা হয়ে যায়।
‘আরে একটু আগে যার সাথে ঝগড়া করে আসলাম কয়দিন আগে যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে সে এখানে কিভাবে?’
তখন তিশা ও তনয়ের মনে এসব কথাই ঘুরচ্ছিল। তারা দুজনে অবাক দুজন কে এভাবে দেখতে পেয়ে। এমন সময় আতিক রহমান বললেন,
‘এই যে বাবা তনয়, তুমি হয়তো তুলিকে এর আগে কখনো দেখো নাই। কারণ তোমার বাবা সেই যে গ্রামে গিয়েছিল আর শহরে আসেনি বা এসেছিল কিন্তু তোমাদের নিয়ে আসেনি। তাই হয়তো তোমাদের দেখা হওয়ার সুযোগ হয়নি। এই হচ্ছে আমার বড় মেয়ে তুমি আর ওর পাশে যে দাঁড়িয়ে আছে ও আমার ছোট মেয়ে তিশা।’
তনয়ের মাথা ঘুরছে। আল্লাহ তাকে কোন খেলায় নামালেন। ছোট বোনকে বিয়ে করে আবার বড় বোনকে বিয়ে করতে হবে এসব ভাবতে ভাবতে তার ঘাম ছুটছে। তুলি লজ্জা মাখা দৃষ্টিতে একবার তনয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। তা দেখে তিশার কেন যেন সহ্য হলো না। সে অন্য দিকে তাকালো।
এমন সময় আবার আসাদুল চৌধুরী বলে উঠলেন,
‘আচ্ছা আমি আর তনয়ের মা তুলিকে ছোট থেকেই দেখে এসেছি। তাই আমাদের আর কি দেখার আছে। এখন ছেলে মেয়ে পছন্দ হলেই হয়ে গেল। তাই বলছিলাম আরকি তনয় আর তুলিকে আলাদা ঘরে একা সময় কাটানোর ব্যবস্থা করে দেয়া হোক।’
বন্ধুর কথা সমর্থন দিয়ে আতিফ রহমান বলেন,
‘হুম একদম ঠিক কথা। আচ্ছা বাবা তনয় তুমি তুলিকে নিয়ে তার ঘরে যাও। ওখানে তোমরা একটু পাইভেট টাইম স্পেন্ড করো।’
কথাটা শুনে তুলি তো খুশিতে গদগদ। তনয় কি করবে বুঝতে না পেরে তিশার দিকে তাকাল অসহায় ফেসে আর তিশা রেগে যেন পূরো ব্যোম হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন হয়ে যাচ্ছে তা সে নিজেও জানে না …
চলবে………..?