গল্পঃ বোরখাওয়ালী
পর্বঃ ০১
লেখাঃ লিজা
ঈদের ছুটিতে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।বাসের টিকিট ৯দিন আগেই কেটে রেখেছি।আগের বছর ঠিক সময়ে টিকিট না পাওয়ায় ঈদের পরেরদিন বাড়িতে যেতে হয়েছিল।এবার বাবা মা খুব খুশি হবে বলতে বলতেই ঢাকা টু খুলনার বাসটি চলে আসলো।বাস স্ট্রান্ডের সবাইকে ঈদের অগ্রিম শুভেচ্ছা জানিয়ে বাসে উঠে পড়লাম।
,
বাসে উঠে আমি আমার সিটটাই বসে আছি।হঠাৎ একটি মেয়ে এসে আমাকে বলল,
-আস্সালামু আলাইকুম
-ওয়া আলাইকুমুস সালাম; কিছু বলবেন?
-জ্বী, আপনার পাশের সিটটা আমার।আপনি যদি একটু উঠে দাড়াতেন তাহলে ভালো হতো!
-অবশ্যই।
আমি উঠে একটু সরে দাড়ালে মেয়েটি গিয়ে তার সিটে বসে পরল।তারপর আমি আমার সিটটাই বসে একটা দীর্ঘঃশ্বাস নিলাম।বাস চলতে শুরু করল তার উক্ত গন্তব্যে নিজ গতিতে।তৎক্ষনাথ আমার খেয়াল গেল আমার পাশের সিটে বসে থাকা সেই মেয়েটির উপর।মেয়েটির পা থেকে মাথা অবদি তাকিয়ে দেখি পুরো শরীরটা ঢোলাঢালা বোরকার আবরণে ঢাকা।হাতে, পায়ে মোজা।দেখে বোঝা যাচ্ছে না মেয়েটি আসলে যুবতী নাকি বৃদ্ধা। তারপর ভাবলাম, তখন তো মেয়েটির কন্ঠ শুনেছিলাম অল্প বয়সী যুবতীই হবে!!
বাস চলছে..
জালানার কোন ঘেষে দমকা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। মেয়েটি তার নিকাবের উপরের পার্টটি উঠিয়ে ফেললো।এখন তার চোখদুটি খুব ভালো ভাবেই দেখা যাচ্ছে।স্যামলা বর্ণের বড় বড় হরিণি চোখদুটি ঘন গাঢ় কাজলে খুব মায়াবতী দেখতে লাখছে। মেয়েটির চোখদুটি থেকে আমি যেন চোখ সরাতেই পারছি না। জানালার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে মেয়েটির চোখ ছুয়ে আছে।সূর্যের এই আলোক রশ্মিতে যেন মেয়েটির চোখদুটি আরও উজ্জ্বল দেখতে লাগছে।আমি মেয়েটির চোখের পানে এক অপলক দৃস্টিতে চেয়ে আছি।মেয়েটি হয়তো বুঝতে পেরেছে আমার দিকে তাকাতেই আমি আমার চোখটা নিচে নামিয়ে নিলাম।
আমি সোজা বসে সিটের সাথে মাথাটা ঠেকিয়ে আড় চোখে মেয়েটিকে দেখে চলেছি।আচ্ছা মেয়েটিকে আমার এতো চেনা চেনা কেন লাগছে! এ যেন এক চিরচেনা অতীত আমার সামনে এসে দাড়িয়েছে।না তা কিভাবে সম্ভব??
আচ্ছা, আজকের দিনেও এই ডিজিটাল যুগে ঢাকা শহরে এমন বোরকাওয়ালি মেয়ে দেখতে পাওয়া যাই? (মনে মনে ভাবছি)
,
কিছুক্ষণ পরে,,
,
হুট করেই আমি মেয়েটিকে বলে উঠলাম।
-আপনার নাম?
-…….. (কোনও কথা নেই)
-আচ্ছা, আমি তো আপনার প্রতিবেশী যাত্রী।আপনি আমার সাথে কথা বলতে পারেন।
-…. (নিরাবতা)
-কি হলো আপনি কথা বলছেন না যে?!
-…..(নিরাবতা)
-বলছি কি এই রাস্তাটা আমরা গল্প করে শেষ করতে পারি না?
-…..(আবার নিরাবতা)
এবার একপ্রকার রেগে গিয়ে বললাম।
-আচ্ছা আপনি কি আমাকে পাত্তা দিচ্ছেন না?
-দেখুন আমি অপ্রয়োজনে গায়েরে মাহারাম পুরুষের সাথে কথা বলি না।এতে আপনার এবং আমার দুইজনের জন্যই ক্ষতি।
মনে মনে বললাম যাক, এতোক্ষণে মেয়েটি তার মুখ ফুটে কথা বলল!
-জ্বি, আপনার কথা আমি বুঝলাম না!
-না বোঝার তো কিছু নেই!
আপনি মুসলমান তো?
-হ্যাঁ, কিন্তু আপনি বললেন না গায়রে মাহারাম পুরুষের সাথে অপ্রয়োজনে কথা বলেন না?
-আপনি গায়রে মাহরাম বোঝেন না?
-না যদি একটু বুঝিয়ে বলতেন!
-তাহলে শুনুন,,,,
মাহরাম কি?
মাহরাম কারা?
গায়রে মাহরাম কি ও কারা?
————-_————–
মাহরাম কি?
– যে সকল পুরুষের সামনে নারীর দেখা
দেওয়া,কথা বলা জায়েজ এবং যাদের সাথে বিবাহ
বন্ধন সম্পূর্ণ হারাম তাদের কে শরীয়তের
পরিভাষায় মাহরাম বলে|
.
মাহরাম কারা?
-সূরা আন নূরের ৩১ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা
নারীর মাহরাম নির্ধারিত করে দিয়েছেন|
পূর্ণ আয়াত টি হল –
“আর মুমিন নারীদেরকে বলে দিন, তারা যেন
তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের
লজ্জাস্থানের হিফাযত করে।
আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা
প্রকাশ না করে।
তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত
করে রাখে।
আর তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর,
নিজদের ছেলে,
স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাই-এর ছেলে,
বোনের ছেলে, আপন নারীগণ, তাদের ডান
হাত যার মালিক হয়েছে,
অধীনস্থ
যৌনকামনামুক্ত পুরুষ অথবা নারীদের গোপন অঙ্গ
সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ছাড়া কারো কাছে
নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে।
আর তারা যেন নিজেদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ
করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে।
হে মুমিনগণ, তোমরা সকলেই আল্লাহর নিকট
তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (সূরা
আন-নূর:৩১)
…
গায়রে মাহরাম কি?
– যে সকল পুরুষের সামনে যাওয়া নারীর জন্য
শরীয়তে জায়েজ নয় এবং যাদের সাথে বিবাহ
বন্ধন বৈধ তাদের কে গায়রে মাহরাম বলে|
বস্তুতঃ গায়রে মাহরামের সামনে একান্ত অপারগ
হয়ে যদি যাওয়াই লাগে তবে নারী পূর্ণ পর্দা
করে সামনে যাবে|
.
গায়রে মাহরাম কারা?
-মাহরাম বাদে সমস্ত বিশ্বে-মহাবিশ্ব
যত পুরুষ আছে সব গায়রে মাহরাম!
নিজ পরিবারে
চাচাত/খালাত/মামাত/ফুপাত সব ভাই,
নিজ দুলাভাই,
দেবর,
ভাসুর,
(আপন,দাদা ও নানা শ্বশুর বাদে) সমস্ত চাচা-মামা-খালু-
ফুপা শ্বশুর…
নিজ খালু/ফুপা এরা সবাই গায়রে মাহরাম!
তাদের সামনে নিজেকে প্রদর্শন করা আল্লাহর
হুকুমের অবাধ্যতা করা!
মাহরাম ছাড়া সকল পুরুষের সামনে পর্দা করতে
হবে।
এক নজরে মাহরাম পুরুষ –
১. স্বামী
(দেখা দেওয়া,সৌন্দর্য প্রদর্শনের প্রেক্ষিতে
মাহরাম)
২. পিতা, দাদা, নানা ও তাদের উর্ধ্বতন পুরুষগণ।
৩. শ্বশুর, আপন দাদা ও নানা শ্বশুর এবং তাদের
উর্ধ্বতন পুরুষগণ।
৪. আপন ছেলে, ছেলের ছেলে, মেয়ের
ছেলে ও তাদের ঔরসজাত পুত্র সন্তান এবং আপন
মেয়ের স্বামী।
৫. স্বামীর অন্য স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র।
৬. আপন ভাই,সৎ ভাই
৭. ভাতিজা অর্থাৎ, আপন ভাইয়ের ছেলে এবং সৎ
ভাইয়ের ছেলে।
৮. ভাগ্নে অর্থাৎ, আপন বোনের ছেলে এবং
সৎ বোনের ছেলে।
৯. এমন বালক যার মাঝে মহিলাদের প্রতি কোন
আকর্ষণ নেই। (সূরা নূর-৩১)
১০. দুধ সম্পর্কীয় পিতা, দাদা, নানা, চাচা, মামা এবং
তাদের উর্ধ্বতন পুরুষগণ।
১১. দুধ ভাই, দুধ ভাইয়ের ছেলে, দুধ বোনের
ছেলে এবং তাদের ঔরসজাত যে কোন পুত্র
সন্তান।
১২. দুধ সম্পর্কীয় ছেলে, তার ছেলে, দুধ
সম্পর্কীয় মেয়ের ছেলে এবং তাদের
ঔরসজাত যে কোন পুত্র সন্তান। এবং দুধ
সম্পর্কীয় মেয়ের স্বামী। (বুখারী শরীফ
হাদীস নং ৫০৯৯, মুসলিম শরীফ হাদীস নং ১১৪৪)
১৩. আপন চাচা, সৎ চাচা।
১৪. আপন মামা,সৎ মামা। (সূরা নিসা-২৩)
……………উপরোক্ত পুরুষ যাদের সাথে দেখা
করতে বা দেখা দিতে পারবে তারা ছাড়া অন্য সমস্ত
পুরুষ কে দেখা দেওয়া সম্পূর্ণ নাজায়েয এবং হারাম।
আর উপরোক্ত পুরুষের সাথে বিয়ে সম্পূর্ণ
হারাম|
-বুঝলাম।তাহলে তো আমি আপনার কাছে গায়রে মাহারাম পুরুষ।
-জ্বী
-আচ্ছা আমি যদি আপনাকে বিয়ে করি,,তখনও কি আমি আপনার কাছে গায়রে মাহারাম থাকবো?
-কি বলছেন কি আপনি?
-না শুধু জিজ্ঞাসা করছি!?
-দেখুন আপনি এ ধরনের মজা না করলেই আমি খুশী হব।
-ঠিক আছে!
,
২ ঘন্টা পর,,,,
,
নিরাবতা ভেঙে মেয়েটিকে আমি বললাম,
-আচ্ছা আপনি যাচ্ছেন কোথায়?
-খুলনায়
-সে তো আমিও যাচ্ছি।কিন্তু আপনি খুলনাতে কোথায় যাচ্ছেন? নামবেন কোথায়?
-আপনি যেখানে নামবেন আমিও সেখানেই নামবো।আর যদি বলেন কোথায় যাচ্ছি তাহলে বলব- দৌলতপুর, ফুপ্পির বাড়িতে যাব।
-ও আচ্ছা। আমার বাসাও দৌলতপুর তাহলে তো আপনি আমাদের এলাকাতেই যাচ্ছেন।আপনার বাসা বুঝি ঢাকাতে?
-জ্বী।
-কতদিন বেড়াবেন ফুপ্পির বাড়ি?
-যানি না
-কেন? ঈদের সময়ে আসলেন প্লান করে আসেন নি?
-না পালিয়ে এসেছি।
-মানে???
-মানে পরসু বুধবার আমার বিয়ে।
-সেটা কেমন কথা আপনার মতো একটা পর্দাশীল মেয়ে বিয়ে না করেই পালিয়ে এলেন?
-দেখুন আমি কোনও পরকিয়া বা ভালোবাসার ফাঁদে পরে পালিয়ে আসি নি!আমি পালিয়ে এসেছি নিজের নিরাপত্তার জন্য।
-আমি কিছু বুঝলাম না আপনার কথা!
মেয়েটি তার হাতের ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করল।আর বলল,
-আমি তো আপনার এলাকাতেই যাচ্ছি!! আমাকে শুধু আপনি এই ঠিকানাটাই একটু পৌঁছে দিতে পারবেন?! আসলে আমি খুলনা শহরে এর আগে কখনও আসি নি তো!!যদি একটু উপকার করতেন তাহলে ভালো হতো!
আমি মেয়েটির হাতের কাগজটা নিয়ে দেখে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে রইলাম।তারপর বললাম,
-কার বাড়ির ঠিকানা এটা??
-আমার ফুপ্পির বাড়ির ঠিকানা।।।
চলবে…..ইনশাআল্লাহ্…