#বেলা_শেষে। [২৬]
মাহিনের দৃষ্টি অনুসরণ করে আরাভ তার দৃষ্টি রাখতেই দেখতে পেলো ভূমিকা দাঁড়িয়ে আছে। দু-চোখ থেকে অশ্রু পরছে তার। ভূমিকার চোখের পানি দেখে আরাভের মনে হয় পুরো দুনিয়াটাই থমকে গিয়েছে। আরাভের ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে ভূমিকার চোখের পানি মুছে দিতে। কোথায় যেন শুনেছে, ভালোবাসার মানুষের চোখের পানি মাটিতে পরতে দিতে নেই। কিন্তুু এই মুহূর্তে সেটা করতে পারবে না। সেই অধীকার তাকে দেওয়া হয়নি। অস্ফুটভাবে বলল আরাভ,
-ভূমিকা আপনি এখানে????
ভূমিকা কিছু বলল না। অশ্রুসিক্ত নয়নে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আরাভের মুখ পানে।তার পর এক পা দু পা করে পিছিয়ে উল্টোদিকে হাটা শুরু করলো ভূমিকা। পিছন থেকে আরাভ ওকে কয়েক বার ডাকলেও পিছনে ফিরে তাকায়নি ভূমিকা। ভূমিকার চলে যাওয়ার মাহিন পৈশাচিক হাসি হাসলো। তার প্ল্যান সাকসেসফুল। আরাভ ক্রোধান্বিত হয়ে মাহিনের দিকে তাকালো। মনে মনে বলল, তোকে আমি পরে দেখছি। তারপর সেও চলল ভূমিকার পিছন পিছন।
সবাই স্বার্থপর। স্বার্থহীন কেও ভালোবাসে না। কেও কাছেও আসে। স্বার্থের টানে সবাই কি ভালো মানুষের মুখোশ পরে থাকে। আর স্বার্থ শেষ হলেই উপচে পরে মানুষের মুখোশ। আনমনে সামনে হাটছে আর একা একা বকবক করছে ভূমিকা। পিছন থেকে আরাভ ওকে ডাকছে কিন্ত তার কোন ডকাই ভূমিকার কান পর্যন্ত পৌছাচ্ছে না। তার ও পিছনে মাহিন শয়তানি মার্কা হাসি অধরে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরাভ বড় বড় পা ফেলে ভূমিকার দিকেই আসছে আর ওকে ডেকে চলেছে। এদিকে দিগন্ত তার স্ত্রী মিমিকে নিয়ে হসপিটাল থেকে ফিরছে।রাস্তার মাঝে ভূমিকাকে এভাবে হাটতে দেখে দুজনেই রিক্সা থেকে নামে ভূমিকার সামনে এসে দাঁড়ায়।
চোখের সামনে প্রাক্তন স্বামি ও তার স্ত্রী কে দেখে থমকে যায় ভূমিকা। অপলক তাকিয়ে থাকে এই নতুন কাপলের দিকে।ততক্ষণে আরাভও এসে ভূমিকার পাশে দাঁড়ায়।
-কি হয়েছে ভূমি? [দিগন্ত]
-আপনি এখানে??
-প্রশ্নটা আমি আগে করেছি। [দিগন্ত]
-আপনার প্রশ্নের এ্যনসার দিতে আমি বাধ্য নই। আমার পথ আটকিয়ে দাঁড়িয়েছেন কেন?? সামনে থেকে সরে দাঁড়ান। ভূমিকার এমন ঝাঁঝালো কথার কর্ণপাত কারলো না দিগন্ত। দিগন্তের কাছে এটা নতুন নয়। ভূমিকা বরাবরই ওর সাথে এমন ভাবে কথা বলেছে।
-কি হয়েছে সেটা তো বলবে?? দিগন্তের কথার প্রতিউত্তরে আরাভ বলে উঠলো,
-আরে দিগন্ত তুমি কোথা থেকে আসলে?
-মিমিকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিলাম। আসলে কিছুদিন ধরে মিমির শরীরটা খারাপ যাচ্ছে। ক্ষুধামন্দা, বমি মাথা ঘুড়ানো সহ আরো নানা সমস্যায় ভুগছে। তাই ওকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিলাম।
-ডক্টর কি বলল।
– চিন্তার কোন কারন নেই। রিপোর্ট কাল দিবে বলেছে। দিগন্তের কথা শুনে মৃদু হাসলো ভূমিকা। তারপর মিমি আর দিগন্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
-কনগ্রেচুলেশন মিস্টার এন্ড মিসেস। অধর চেপে হেসে প্রস্থান করলো ভূমিকা। আরাভ ওদের বিদায় জানিয়ে ভূমিকার পিছনে ছুটলো। কি হচ্ছে না হচ্ছে তার কিছুই বুঝতে পারছে না দিগন্ত। সে তাকিয়ে আছে ওদের দুজনের দিকে। কিছুদূর আসতেই আরাভ ভূমিকার হাত ধরে টেনে রাস্তার একপাশে দাঁড় করায়।
-ভূমিকা প্লিজ আমার কথাটা শুনুন।
-আপনার কোন কথাই শুনতে চাইনা আমি। হাত ছাড়ুন আমার। আমাকে যেতেদিন নাহলে আমি চিৎকার করবো।
-যত খুশি চিৎকার করো। বাট আই উইল নট লেট গো অফ দিস হ্যান্ড। আমার কথা আপনাকে শুনতেই হবে।
-আর কি বলবেন আপনি?
-উইল ইউ মেরি মি ভূমিকা। ভূমিকার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে শান্ত গলায় বলল আরাভ। আরাভের কথা শুনে ভূমিকা আরাভকে সজোরে ধাক্কা দেয়। ঘটনাক্রমে আরাভ কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ায়।
-পাগল হয়ে গেছেন আপনি।কি বলছেন আপনি জানেন?
-হ্যাঁ পাগল হয়ে গেছি আমি। তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছি সেদিন থেকেই তোমার প্রেমে পাগল হয়েগেছি। তোমাকে পাগলের মতোই ভালোবেসেছি আমি। তারপর যখন জানতে পারলাম তুমি দিগন্তের ওয়াইফ। শত চেষ্টা করেছি তোমাকে ভুলে যাওয়ার। কিন্তু পারিনি। তারপর তুমি নিজে থেকেই আমার কাছে ধরা দিলে। আমার অফিসে আমার চোখের সামনে। সর্বক্ষণ তোমাকে দেখায় ব্যস্ত আমার দুটি আখি তার কি নাম দিবে তুমি। পাগলামি এটা। হাত বলে দুহাত বাড়িয়ে তোমাকে আলতে করে ছুয়ে দেই এটাই কি পাগলামি। যদি তাই হয় তাহলে পাগল আমি।তোমার এক বিন্দু ভালোবাসা পাওয়ায় জন্যে পাগল আমি। এই পাগলের পাগলামির জন্যে যে তোমাকে চাই। জানো বড্ড ইচ্ছে করে সবার মতো তোমাকে ভূমি বলে ডাকতে। কিন্তু সেই অধীকারটাও নেই আমার। আই লাভ ইউ ভূমিকা। লাভ ইউ সো মাচ।
-আমি আপনাকে কখনো ভালোবাসতে পারবো না। কথাটা বলেই দু কদম এগিয়ে যায় ভূমিকা। ওমনি খপ করে আরাভ ভূৃমিকার হাত ধরে বলে,
-ভালোবাসতে হবে না। তুমি আমাকে নাই ভালোবাসলে, আমাকে একটা সুযোগ দাও আমি তোমাকে আজিবন ভালোবেসে যাব।
পিচনের দিকে ঘুরে তাকায় ভূমিকা। আরাভের মুখের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় আরাব অসহায় মুখ করে ভূমিকার দিকে তাকিয়ে আছে। ভূমিকা ওর দৃষ্টি নামিয়ে হাতের দিকে রাখে। যে হাতটা আরাভ ধরে রেখেছে। হাতের দিকে তাকিয়ে শক্তগলায় বলে, হাত ছাড়ুন।
-আগে আমার প্রশ্নের জবাব দাও। বিয়ে করবে আমাকে??
-সরি স্যার। ভূমিকার জবাব শুনে হাত আলগা হয়ে আসে আরাভের। সে ভূমিকার হাত ছেড়ে দেয়। আর যাই হোক জোড় করে কারো কাছ থেকে ভালোবাসা পাওয়ায় যায় না। ভূমিকা চলে যায়। আরাভ তাকিয়ে থাকে হয়তো ভূমিকা এক বার পিছনে ফিরে তাকাবে। কিন্তু ফিছনে ফিরে না ভূমিকা। ভূমিকার চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর। হাতের মুঠি শক্ত করে নেয় আরাভ। চোখ মুখ শক্ত করে কাকে যেন কল করে। কথা বলার পর চোখ দুটো লাল বর্ণ ধারন করে।
তারপর থেকে কয়েকদিন অফিসে যাওয়া হয়নি ভূমিকার। আর না সে কলেজে গিয়েছে। আরাভ সারাদিন কাজের মধ্যে ডুবে থাকলেও বেলা শেষে সে ঠিকই ভূমিকার বাসায় পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ভূমিকাকে এক পলক দেখার জন্যে সে রাতের অন্ধকারে ভূমিকার বাড়ির পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ভূমিকা যখন বারান্দায় আসতো তখন ওকে দেখে প্রান জুড়াত আরাভের। আজ সকাল সকাল অফিসে যাওয়ার জন্যে রেডি হচ্ছে ভূমিকা। নিতুর ওর পাশে এসে চুলের বেনুনি করতে করতে বলল,
-অফিসে যাচ্ছিস??
-হুম।
-কেন?? আরাভ ভাইকে না দেখে থাকতে পারছিস না বুঝি।
-রিজাইন লেটার জমা দিতে যাচ্ছি।
-এটা ঠিক করছিস না তুই। দেখ আরাভ ভাই তোকে সত্যিই ভালোবাসে না হলে তোকে দেখার জন্যে রাতের পর রাত আমাদের বাসার সামনে দাড়িয়ে থাকতো না।
-আমি কি করবো??
-কি করবি মানে!!! আরাভ ভাইয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।
-সেটা সম্ভব না। ওনার সাথে আমার কোন দিক দিয়েও যায় না। তাছাড়া আমি একজন ডিভোর্সি মেয়ে। আমাকে বিয়ে করলে ওনার এতদিনের গড়া এক্সিমিশন নষ্ট হয়ে যাবে। আর চাইনা আমার কারনে সমাজে কারো সম্মান নষ্ট হোক। আমি আসছি। ভূমিকা বেড়িয়ে যায় অফিসের উদ্দেশ্যে।
অফিসে এসে রিজাইন লেটার আরাভের হাতে দিলে সেটা ছিড়ে ফেলে আরাভ। টুকরো কাজগগুলো ফেলে দিয়ে ভূমিকার হাত ধরে টেনে বাহিরে নিয়ে যেতে থাকে আরাব। ভূমিকা ব্যস্ত ভঙ্গিতে আরাভের থেকে নিজের হাত ছাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্ত আরাভের শক্তির সাথে পেরে উঠছে না ভূমিকা। অফিসের বাকি স্টাফগুলো তাকিয়ে আছে আরাভ আর ভূমিকার দিকে। সেদিকে খেয়াল নেই কারোরই।
ভূমিকাকে নিয়ে আরাভ তার বাড়িতে এসে পৌছায়। আরাভের সাথে ভূমিকাকে দেখতে পেয়ে জুবাইদা যেন হাতে চাদ পেয়েছে। এমন খুশি সে। জুবাইদা ব্যস্ত ভূমিকার আদর আপ্নায়নে। আদনান মাহবুব কলেজে গেছেন। আর আজহারের মওদুদ এতক্ষণ তার রুমে ছিলেন। আরাভের চিৎকার শুনে তার রুম থকে বেড়িয়ে আসে। সবাই যখন ড্রয়িংরুমে বসে পিনপতন নিরবতা অবলম্বন করছে তখন আরাভ আজহারের কাছে গিয়ে বলে,
-দাদু ওকে একটু বুঝিয়ে বলো না ওকে নিয়ে আমাদের মধ্যে কোন প্রবলেম নেই। তাহলে ও কেন এত গিল্টি ফিল করছে।
-ওটা ভূমিকা। আজহারের প্রশ্নে আরাভ ভূমিকার দিকে তাকিয়ে কিৎচিত মাথা নাড়িয়ে বলল, হ্যা এটাই ভূমিকা। আজহার ভূমিকার পাশে গিয়ে বসলো। অতঃপর বলতে লাগলো,
-দেখ ভূমিকা তোমার সম্পর্কে আমরা সবাই সবটা জানি। গত পরশু আরাভ আমাদের সবটা বলেছে। আমরা আমার নাতির পছন্দকে সম্মতি জানিয়েছি। আমরা সবাই চাই তুমি আমাদের আরাভের বউ হয়ে এসে। দেখ অতীত তো অন্দকার বেলুনের মতো। তাকে মনে রেখে নিজের জিবনটা কেন নষ্ট করবে তুমি। তোমার সাথে যা হয়েছে তাতে তো তোমার কোন দোষ নেই। তাহলে তুমিই কেন সেক্রিফাইস করবে। তোমার তো একটা ভবিষ্যৎ আছে। আচ্ছা তোমার লাইফ থেকে তোমার কিছু চাওয়া পাওয়া নেই। আরাভ তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চায়। তোমাকে সম্মানের সাথে বিয়ে করে তোমার দায়িত্ব নিয়ে ভবিষ্যৎ এর পূর্ন নিরাপাত্তা দিতে চায়। তাহলে তুমি কেন ওকে মেনে নিতে পারছো না।
-আমি কখনো ওই ভাবে ভাবিনি স্যার। ভূমিকার জড়ানো গলায় বলা কথা শুনে আজহার আবার বলে উঠলো,
-ভাবোনি তো কি হয়েছে এবার থেকে ভাববে। দেখ তোমার বয়স ই বা কত?? সারাজিবন তো আর এভাবেই কাটাবে না তুমি। কাওকে না কাওকে তো বিয়ে করতেই হবে তাইনা। আজহারের এই কথা শুনে আরাভের দিকে তাকায় ভূমিকা। আরাভ তখনো ভূমিকার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। ভূমিকার মুখে কখন বলবে সে বিয়ে করতে রাজি। ভূমিকা তার দৃষ্টি নামিয়ে নিচের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ মৌনতা অবলম্বন করে বলে,
-স্যার আমাকে একটু সময় দিন।
-তোমার যতসময় লাগে ভাবতে পারো। বাট সবশেষে এ্যনসারটা যেন হ্যাঁ হয়। আজহারের কথায় মৃদু হাসলো ভূমিকা। তারপর উঠে দাঁড়ায় চলে যাওয়ার। তখন আজহার আরাভকে বলে,
-ভূমিকাকে তার বাসায় পৌছে দিয়ে এসো দাদুভাই।
-আমি চলে যেতে পারবো। [ভূমিকা]
-তোমার মতামত জানতে চাইনি। দাদুভাই যাও ভূমিকাকে তার বাসায় পৌছে দিয়ে এসো।
-সে কি কথা। কিছু না খেয়েই চলে যাবে নাকি। আমি ওর জন্যে কতকি রান্না করলাম। ইনোসেন্ট মুখ করে বলল জুবাইদা।
-না না আন্টি আমি কিছু খাবো না।
চলে যায় ভূমিকা। আর ভূমিকাকে এগিয়ে দিয়ে আসে আরাভ। গাড়ির কাছে এসে যখন ভূমিকাকে ডাক দেয় তখন ভূমিকা বলে, প্লিজ স্যার আমি আপনার কোন কথাই শুনতে চাচ্চি না এখন। আরাভও কোন কথা বাড়ায় না। ভূমিকাকে পৌছে দেয় তার বাসায়।
-তারপর, তারপর কি হয়েছিলো, আরাভ আর ভূমিকার বিয়েটা হয়েছিল কি?? পাঁ বছরের ছেলে অভির প্রশ্নে বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে জুবাইদা। তারপর চেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, হ্যাঁ। ওদের বিয়েটা হয়েছিলো।
জুবাইদা কোলে মাথা রেখে ছোট্ট অভি গল্প শুনছিলো এতক্ষণ। এখন সে জুবাইদার কোল থেকে মাথা উঠিয়ে জুবাইদার মুখোমুখি হয়ে বসলো। তারপর সে জিগ্যেস করলো,
-তাহলে আরাভ আর ভূমিকা এখন কোথায়?? অভির করা প্রশ্নে জুবাইদার চোখ ছলছল করে উঠলো। সে দু-চোখ বন্ধকরে চোখের পানি লুকিয়ে নিলো।
চলবে,,,,,,,
#লেখিকা- মাহফুজা আফরিন শিখা।
[রিচেক করা হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]