বেলা শেষে পর্ব-২২

0
1213

#বেলা_শেষে। [২২]

বাড়ির উঠোনে মাদুর পেতে বসে আছে ভূমিকা নিতু নিলা ইভান নয়না রাকিব আর আরাভ। উঠোনের পাশে হাসনাহেনা ফুলের সুভাসে মো মো করছে চারিদিক। হাসনাহেনার মন মাতানো সৌরভে আজকের রাতটা আরো বেশী মধুময় হয়ে উঠেছে। মাথার উপরের চাঁদ মামা যেন আজ তার সমস্ত আলো বিলিয়ে দিয়েছে। চাদের জ্যোৎস্নার চারিদিক স্নিগ্ধ লাগছে। শহরের মতো গ্রামে হয়তো আকাশ ছোয়া দালান নেই। নাই রকমের লাইটিং। কিন্ত গ্রামের মতো স্নিগ্ধ সুন্দর পরিবেশ সাধারণত শহরে হয় না। কিছুক্ষণ আগেই নয়না আর রাকিবের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। তখন যখন নয়না সকলের সমনে রাকিবকে জড়িয়ে ধরলো। তখনি সকলে নয়নার নামে বাজে মন্তব্য করা শুরু করে দেয়। চারিদিকে সবাই যখন নয়নার নামে হাজারো কথা বলছিল তখন নয়নার বাবা হাতের মুঠি শক্তকরে চেপে ধরে জিহ্বা কামড়িয়ে শুনছিলো। এক পর্যায়ে তার ধর্যের রেখা অতিক্রম করে। আর সে নিজেকে সামলাতে না পেরে নয়নার গালো সজোরে চড় বসায়। টাল সামলাতে না পেরে নিচে পরে যায় নয়না। রাকিব ওকে উঠাতে চাইকে তার গালেও চড় বসায় নয়নার বাবা।

-এভাবে অপমান করলি আমাকে। কেন করলি এটা নয়ন। বলেই নয়নার বাবা আবারও নয়নার গালে চড় বসায়। নয়নার মা আটকাতে চাইলে তাকেও মারার জন্যে হাত উঠায় নয়নার বাবা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে মারতে পারে না

-কি করছো তুমি এটা? এত বড় মেয়ের গায়ে হাত তুলছো। মাথাটা কি একেবারেই খারাপ হয়ে গেছে তোমার? নয়নার মায়ের কথা শুনে নয়নার বাবা দিগুণ রেগে গেলে। সে ঝাঁঝালো গলায় বলল,

-আমার মাথা ঠিক আছে। এখনো যে ওকে কেটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়নি। সেটা ওর বাপের ভাগ্য ভালো। জিগ্যেস করো ওকে কেন আমাদের মান সম্মান এভাবে ধূলয় মিশিয়ে দিলো।

বাবার কথা শুনে ভয়ে কাঁপছে নয়না। তার বাবার রাগের সম্পর্কে সে আগে থেকেই অবগত। এই মেয়েটা কোন দিনও তার বাবার সামনে মাথা উচু করে কথা বলে দেখে নি। ছোট বেলায় একবার নয়নার পা ভেঙে ছিলো। আম গাছ থেকে আম পারতে গিয়ে গাছ থেকে পরে গিয়েছিল। সেদিনও নয়নার বাবা আদর করার পরিবর্তে ওকে মেরেছিলো। নয়নার একটাই অপরাধ সে কেন গাছে উঠলো। নিচের দিকে তাকিয়ে সমান তালে কেপে যাচ্ছে নয়না। তার বাবার কোন কথাই তার কান পর্যন্ত পৌছাচ্ছে না। ভূমিকা দূরে দাঁড়িয়ে নয়নাকে দেখে যাচ্ছে। এই নয়না কে বড্ড অচেনা লাগছে তার কাছে। একদিন এই নয়না তাকে সাহস যুগিয়েছিল। দিগন্তর থেকে আলাদা হওয়ার মতো একটা কথাও বলেছিলো সে। অথচ আজ সেই মানুষটা নিজের ভালোবাসার কথা মুখ ফুটে বলতে পারছে না ।

নয়নার বাবা মেয়েকে মেরে কিছু কথা শুনিয়ে শান্ত হয়ে চেয়ার বসে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলেন। হয়তো কিছু ভাবছেন তিনি। আরাভ এতক্ষণ ওনার রাগ দেখছিলেন। আর নয়নার দিকে তাকাচ্ছিল, হয়তো নয়না কিছু বলবে। না, নয়না সেটা করলো না। সে যে নিচের দিকে তাকাচ্ছে তো তাকাচ্ছে, মাথাতুলে সামনে তাকানোর মত অপরাধ সে কিছুতেই করবে না। হয়তো এটাই পণ করে নিয়েছে সে। রাকিব নয়নার পাশেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এভাবেই বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আরাভ দু-হাতে নয়না আর রাকিবের হাত ধরে নয়নার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর রাকিব আর নয়নার সম্পর্কের কথা তাকে বললেন। নয়নার বাবা কোন প্রতিক্রিয়া করলো না। এখনো আগের ন্যায় মাথা নিচু করে বসে রইলো। অতঃপর আরাভ বলল,

-এভাবে চুপ করে থাকবেন না আংকেল। হয় ওদের শাস্তি দেন আর নয়তো ওদের মাফ করে দেন। আরাভের কথা শুনে মাথা তুলে সামনে তাকালো নয়নার বাবা।অতঃপর আরাভ আবারও বলে উঠলো,

-প্লিজ আংকেল, ডোন্ট বি সাইলেন্ট। মানছি ওরা ভুল করেছি। ওরা তো দুজনেই ছেলে মানুষ। আপনি তো বাবা ওদের মাফ করে দিন। আপনার উচিৎ ওদের ভূলগুলো মাফ করে ওদের সঠিক পথ দেখানো।

-ওরা যে ভুল করছে তার কোন ক্ষমা হয়না। নয়নার বাবার কথায় আশাহত হলো আরাভ। ভেবেছিলো সে ওদের ভালোবাসাকে মেনে নিবে। রাকিব গিয়ে নয়নার বাবার সামনে হাটুগেরে বসে পরলো। তারপর সে হাত জোড় করে তার কাছে মাফ চাইতে লাগলো। আর নয়না আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। কেননা তার সহস নেই বাবার সামনে নিজের ভালোবাসার কথা বলার।

অবেশেষে অনেক বুঝানোর পর নয়নার বাবা ওদের ভালোবাসা মেনে নেয়। ওদের বিয়েও দেয়। শর্ত একটাই। বিয়ের পর নয়না রাকিব কেওই ওনার বাড়িতে থাকতে পারবে না। আরাভ ও কম কিসে। সে সিদ্ধান্ত নেয় যতক্ষণ না নয়নার বাবা ওদের দুজনকে মেনে নিবে ততক্ষণ ওরা এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না। তাইতো উঠোনে মাদুর পেতে বসে আছে।

চাঁদের স্নিগ্ধ ভূমিকার মুখে পরে ওর মুখটাকে আরো বেশী মায়াবি করে তুলেছে। আরাভ আড় চোখে বারবার ভূমিকাকে দেখছে। ওর মনে হচ্ছে সে এই মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে কাটাতে পারবে কয়েক যুগ। এত মায়া কেন এই চোখ দুটিতে। এই চাহনিতে যে আমি খুন হয়ে যাই বারংবার। সে কি জানে সেই কথা। তার প্রতিটা হাসিতে খুন হই আমি। মুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে সে ভূমিকার দিকে।

সবাই চুপচাপ বসে আছে দেখে নীলা বলে উঠলো, সবাই কি এভাবে মুখে আঙ্গুল দিয়া বইসা থাকবা নাকি। আমাদের আসরটাকে একটু জমাও। বর বউ নিয়ে বসে আছি আমরা এভাবে চুপচাপ থাকলে চলে নাকি।

শহরে মানুষ আসর জমানো বলতে তারা একটা বুঝে ড্রিংক করা ওয়াইন, রাম ওয়িস্কি, বিয়ার ছাড়া যেন তাদের আসর জমেই না। তাই রাকিব বলে উঠলো,

-কি দিয়ে আসর জমাবো?? এখানে তো কিছু নেই।

-কি দিয়ে আসর জমাবো মানে। চলুন আমরা ট্রুথ আর ডেয়ার গেম খেলি। তবেই দেখবেন আমাদের আসর জমে উঠছে। নিলার কথায় সম্মতি দেয় সবাই।

গিন্নী ছেলেমেয়েগুলো কি এখনো উঠোনে বসে আছে?? বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে জিগ্যেস করলো নয়নার বাবার। তার কথার প্রতিউত্তরে নয়নার মা বলল,

-কি আর করবো, তুমি তো ঘরে থাকতে দিলা না। আজ রাগটুকু উঠোনে থেকে, শুনছি কাল নাকি শহরে চইলা যাইবো। আমার মেয়েটাকে এভাবে পর কইরা দিলা তুমি।

-ওগো সবাই রে ঘরে আইয়া শুইতে কও। শহরে থাকে, ডরভয় পাইলো পরে আমাগোই বিপদ অইবো। কথাটা বলেই বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে দিয়ে শুয়ে রইলেন তিনি। তার কথায় নয়নার মা মৃদু হাসলো অতঃপর বলল,

-মানুষটা নিজেকে যতটা কঠিন দেখয়। ভেতরে ঠিক ততটাই নরম।

চারিদিকে গোল হয়ে বসে আছে সবাই। ওদের মাঝখানে রয়েছে একটা বোতল। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বোতলের দিকে। ইভান বোতলটা ঘুড়িয়ে দিয়ে। সেটা গিয়ে থামলো নিতুর দিকে। নিতু আগেই ট্রুথ নিয়ে বসলো। আর ওকে প্রশ্ন করলো নীলা,

-তোর বয়ফ্রেন্ডের নামটা যেন কি?? ভ্রু নাড়িয়ে জিগ্যেস করলো নীলা।

-এসব প্রশ্ন করার কি মানে? একটু রেগে গিয়ে বলল নিতু।

-নিতু তোর বয়ফ্রেন্ড আছে। অবাক হয়ে জিগ্যেস করলো নয়না। ওর সাথে তাল মিলিয়ে বলল, ভূমিকা।

-আগে তো কখনো বলিস নি আমাদের।

নিতু আড় চোখে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল, ইভান ই তো বলতে নিষেদ করেছে। আর ওই আমার বয়ফ্রেন্ড।নিতুর কথা শুনে নয়না নীলা আর ভূমিকা বড় বড় চোখ করে তাকালো। ওদের চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম। ইভার ইভার অন্যদিকে ঘুরে তাকালো। সে এই মুহূর্তে কারো কথা শুনতে নারাজ।

-কত দিনের রিলেশন তোদের? [নীলা]

-আমার ট্রুথ পালন করা শেষ। তাই দ্বিতীয় কোন প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য নয় আমি। ইভান আবারও বোতলটা ঘুড়িয়ে দিলো। এবার বোতল থামলো দিয়ে রাকিবরে দিকে। ভূমিকা আগেই বলে উঠলো, আমি ডেয়ার দিবো।

-কিন্ত আমিতো ডেয়ার চুজ করিনি।

-করতে হবেও না। শুধু আপনার আর নয়না আপুর একটা কাপল ডান্স দেখতে চাই। ভূমিকার কথায় তাল মিলালো নিতু ইভান আর নিলা। রাকিব আড় চোখে আরাভের দিকে তাকালো। সেই চোখের ইশারায় রাকিবকে ডান্স করতে বলল।। রাকিব ইনোসেন্ট মুখ করে বলল ওকে ডান। তারপর নয়নাার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। নয়না লজ্জায় মাখা মুখ নিয়ে রাকিবের হাতে হাত রাখে অতঃপর তারা দুজনে মিলে কাপল ডান্স করে। তৃতীয়বারের মতো বোতল ঘুরে গিয়ে আরাভের দিকে। তখনি রাকিব বলে উঠে আমি প্রশ্ন করবো।

আরাভ ভেবেছিল সে ডেয়ার নিবে। কিন্ত আগেই রাকিব বলে উঠে সে প্রশ্ন করবে। তাই তাকে ট্রুথই নিতে হলো।

-আজকাল তোর কথা বার্তা চালচলন দেখে মনে হয় তুই কারো প্রেমে পরেছিস। এটা কি সত্যি। আর যেই সুভাগ্যবতির প্রেমে পরেছিস তার সম্পর্কে কিছু বল। আমারও জেনে নেই কেমন আমাদের ভাবি। [রাকিব]

-একজনকে খুব করে ভালোবেসেছি আমি। তার চোখে দিকে যখন তাকাই মনে হয় পুরো পৃথীবিটা কত সুন্দর। কারন তার চোখে আমি আমার পৃথীবি দেখতে পাই। তার হাসি দেখলে আমার মনটা এমনিতেই হেসে উঠে। কারন সব চাওয়ার মধ্যে তার হাসিটাই আমার কাছে প্রধান। তার হাসিতে আমি এক পৃথীবি সমান সুখ খুজে পাই। কথাগুলো বলেই উঠে দাঁড়ালো আরাভ। সবার থেকে কিছুটা দূরে এসে দাঁড়ালো। পকেটে দু-হাত গুজে তাকিয়ে রইলো ও জ্যোৎস্নাময় চাদের দিকে। আরাভের পিছু পিছু রাকিবও এসে দাঁড়ালো ওর পাশে। সে আরাভের কাদে আলতো করে হাত রাখলো। তারপর বলল,

-সেই সৌভাগ্যবতীটা কে যাকে আমার বন্ধু এতটা ভালোবাসে।রাকিবের কথা শ্রবণ করতেই পিছন ফিরে তাকায় আরাভ। ভূমিকার দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে আনমনেই বলে ফেলে,

-আমার মায়াবতী।

আরাভের দৃষ্টি বারবার রাকিব তার দৃষ্টি রাখে। যখনি তার দৃষ্টিতে ভূমিকার মুখ পরে তখনি সে আরাভের দিকে তাকিয়ে বলে,

-এটা তুই কি করছি আরাভ। আগুন জেনেও ঝাপ দিচ্ছিস। কয়লা হয়ে উঠবি। রাকিবের কথা শুনে মৃদু হাসে আরাভ। অতঃপর সে রাকিবের গালে আলতো করে স্পর্শ করে বলে,

-দহন না হলে প্রেমিক হবো কি করে।

চলবে,,,,,,

#লেখিকা- মাহফুজা আফরিন শিখা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে