বৃষ্টি থামার শেষে পর্ব-০৮

0
453

#বৃষ্টি থামার শেষে
পর্ব-৮

তূর্য চলে যাওয়ার পর পর সব ঠিক ই ছিলো। মাঝেমধ্যে ওরা ফোন করলে তূর্য স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলতো। এই সময়ের মধ্যে ইশা অন্তত হাজারবার স্যরি চেয়েছে টেক্সট করে। হঠাৎই বলা নেই কওয়া নেই তূর্য ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ সব গায়েব। ইশা পাগলের মতো হয়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি জানতাম তূর্য হারিয়ে যাবে। অনিক ইশার মতো অতটা অস্থির হলো না। অপেক্ষা করলো আর ও কিছুদিন। মতিঝিলে থাকা তূর্যর বড়বোনের বাসায় ছুটে গেলে সে অস্বীকার করলো তূর্যর খোঁজ দিতে। ফিরে এসে ইশা গম্ভীর গলায় বলেছিল, তারমানে বুঝেছিস?

অনিক শীতল গলায় বলল, তূর্য আমাদের সাথে সম্পর্ক রাখতে চাইছে না!

“হ্যাঁ “।

অনিক চুপ করে থাকে। ইশা জিজ্ঞেস করে, এবার কী করবি?

“অপেক্ষা করব”।

“আর যদি তূর্য না আসে? ”

“তূর্য আসবে। আমাদের জন্য ওর ভালোবাসা যদি সত্যি হয় তবে ও আসবে”।

দেখতে দেখতে তিনটি বছর কেটে গেলেও তূর্য ফিরে আসে নি। অনিক ইশা অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারে নি। তূর্য কোথায় আছে, কেমন আছে সেটা জানার জন্য অনেক হাপিত্যেশ করেও কোনো খবর পায় নি। এক পর্যায়ে অনিক হাল ছেড়ে দিয়েছে।

এদিকে অভিমানী তূর্য ভেবে বসে আছে যে অনি আর ইশা এতোদিনে বিয়ে করে চুটিয়ে সংসার করছে। কিন্তু সে জানলো ই না যে তাকে ছাড়া ওদের প্রেম টা ই জমে নি। নামকেওয়াস্তে প্রেমের সম্পর্ক ছিলো ইশা আর অনিকের। দুজন একসঙ্গে দেখা করতে এলেই দুজনের মন খারাপ থাকতো। বেশী মন খারাপ থাকতো ইশার। বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতো, আমার জন্য সব শেষ হয়ে গেল।
অনিক প্রথম প্রথম মন খারাপ করলেও পরে প্রচন্ডরকম বিরক্ত হতো। এই বিরক্তি একসময় দুজনের মধ্যে পাহাড় সমান দূরত্ব সৃষ্টি করেছে।

——————- ———— ———- ——-

বর্ধমানে তূর্য এসেছে সিন্থিয়াকে না জানিয়ে। ভেবেছিল সিন্থিয়া খুশি হবে ওকে দেখে। কিন্তু সেরকম কোনো কিছুই হলো না। দুপুরে একসাথে লাঞ্চ করার পর সিন্থিয়া বলল, তুমি কী একটু রেস্ট নেবে?

তূর্যর মনে হলো সিন্থির মন খারাপ। বলল, আর ইউ ওকে সিন্থি?

“ইয়েস আই এম ওকে”।

“তোমাকে কেমন যেন একটু আপসেট লাগছে”।

সিন্থিয়া হেসে বলল, আই এম অ্যাবসুলেটলি ওকে। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি ওকে নও”।

তূর্য হেসে বলল, আমি একদম ঠিক আছি বলেই কিন্তু তোমার সাথে দেখা করতে এলাম।

সিন্থিয়া বিল পে করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে বলল, চলো একটু হেটে আসি।

দুজন একসাথে হাটছে। অথচ কেউ কিছু বলছে না। সিন্থিয়া প্রথমে বলল,

” তূর্য তুমি কী জানো সাইকোলজি আমার মেজর সাবজেক্ট ছিলো? ”

তূর্য হেসে ফেলে বলল, হঠাৎ?

“আমি তোমার মন বুঝতে পারি তূর্য। ”

“সেটা তো স্বাভাবিক। মন বুঝতে হলে সাইকোলজি সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হয় না। দুজন মানুষের মধ্যে চেনাজানা থাকলেই সেটা বোঝা যায়। ”

সিন্থিয়া অদ্ভুত ভাবে হেসে বলল, তোমার কথায় লজিক আছে। কিন্তু আমি অন্য ব্যাপারে বলছি।

“যেমন? ”

“যেমন আমি তোমাকে লাইক করি, প্রপোজ করার পর তুমি রিজেক্ট ও করে দিয়েছ। হিসেব মতো তোমার আমাকে ইগ্নোর করার কথা। বাট তুমি কন্টিনিউসলি ফ্রেন্ডলি রিলেশন মেইন্টেইন করেছ”।

তূর্য গম্ভীর গলায় বলল, তুমি আমার ভালো বন্ধু সিন্থি। আই মিন আমার দিক থেকে আমি সেরকম ই মনে করি।

“আই থিংক নট”

“তুমি তাহলে কী ভাবো?”

“তোমার শুনতে ভালো নাও লাগতে পারে। ”

“তবুও আমি শুনতে চাই”

“আমি যদি ভুল না হয়ে থাকি তাহলে তুমি আমার মধ্যে অন্য কাউকে খুঁজে বেড়াও। মানে কেউ একজন তোমার জীবনে ছিলো যাকে তুমি প্রচন্ডরকম মিস করো কিন্তু ইগোর জন্য তার সাথে কানেকটেড হতে পারছ না।

তূর্য মোটামুটি একটা ধাক্কা খেল। সিন্থিয়া বলল, আমি কী ঠিক বলেছি তূর্য?

তূর্য জবাব দিলো না। পশ্চিমাকাশে সূর্য তখন অস্ত যাবার পালা। গোধূলির আলো ক্রমশ ই নিভে যাচ্ছে। দুজনে নিঃশব্দে হেটে চলছে। সিন্থিয়া বলল, তূর্য তুমি আদ্যোপান্ত একজন নিঃসঙ্গ মানুষ। যে জীবন কে তুমি ভালো বলছ সে জীবনে আসলে তুমি একটুও ভালো নেই। তোমার মনের গভীরে জমাট বাধা এক ভয়ংকর কষ্ট আছে। তুমি চাইলে আমায় বলতে পারো। আমি খুব ভালো একজন শ্রোতা।

ইশার সাথে অনিকের সম্পর্ক তিক্ত হতে শুরু করেছিল বিয়ের প্রসঙ্গে। অনিক চেয়েছিল চাকরি পাওয়ার পর পর ই বিয়ে করে ফেলবে। কিন্তু ইশা বলেছিল, তূর্য কে ছাড়া কিছুতেই ও বিয়ে করবে না।

অনিক অবাক হয়ে বলেছিল, এসব বুঝেশুনে বলছিস তো?

“মানে?”

“মানে খুব সোজা। তূর্য তোকে প্রপোজ করায় খুব রাগ হয়েছিল। কিন্তু যেই তূর্য চোখের আড়াল হয়ে গেল অমনি তূর্য তূর্য করছিস!”

আধখাওয়া ফুচকার প্লেট টা ছুড়ে ফেলে গটগট করে হেটে এসেছিল ইশা। উত্তর দেবার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পায় নি সেদিন। কিভাবে বলবে যে অপরাধবোধ কুরে খাচ্ছে ওকে। একটা রাত ও ঘুমাতে পারে না। বারবার মনে পরে তূর্যর বলা সেই কথাগুলো, আমার দোষ টা কোথায় সেটা বলবি?

নাহ! তূর্যর আসলেই কোনো দোষ ছিলো না। ইশা যত টা ক্লোজ অনির সাথে ছিলো তারচেয়ে বেশি ছিলো তূর্যর সাথে। হঠাৎ পুরান ঢাকার বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে হলে তূর্যকে ফোন করতো, দই চিড়া খাওয়ার বাহানায় ছুটে যেত রেলগেট। অনি ব্যস্ত থাকতো তার মধ্যবিত্ত টানাটানির জীবনে। সেখানে দিনশেষে তূর্য ই ছিলো সময় কাটানোর একটা ভরসার জায়গা। যখন ই কোনো দরকার পড়ত তখন ই ওকে ডেকে নিতো। তাতে যদি ও অন্যকিছু ভাবে সেটা ওর দোষ না।

এরপর অনির খোঁজ মিলল অনেক দিন পর। রাগ করে ইশা যোগাযোগ করে নি বলে অনি ও ইশার অভিমান ভাঙায়নি। শেষমেস না থাকতে পেরে ইশা ছুটে গিয়েছিল অনির বাসায়। বাসার পরিবেশ সেদিন বেশ থমথমে ছিলো। অনি সেদিন এক প্রকার জোর করেই ইশাকে পাঠিয়ে দিলো। দিন দুয়েক পর দেখা করে উদভ্রান্তের মতো আচরণ করলো ইশার সাথে। এমন আচরণ করছে যেন ইশাকে চিনতেই পারছে না। ইশা জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে?

অনি বিড়বিড় করে বলল, এতোদিন যা জানতাম সব মিথ্যে।

ইশা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, কি বলছিস?

অনি বোকার মতো তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলো, আমায় সত্যিই ভালোবাসিস তো।

অন্যান্য সময় এক সেকেন্ড সময় ও লাগে না ইশার হ্যাঁ বলতে। কিন্তু এবার ইশা জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে বলবি তো?

অনিক হো হো করে হাসলো। এই হাসি মোটেও স্বাভাবিক হাসি না সেটা ইশা টের পেল যখন ওর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। ইশা আর্তচিৎকার করে বলল, তুই স্বাভাবিক না। বল কী খেয়েছিস? মদ খেয়েছিস?

অনিক কাতর গলায় বলেছিল, তোরা সবাই আমাকে ঠকিয়েছিস। তুই, মা, বাবা, আপা, অভি। আর তূর্য ও।

ইশা সেদিন যেন অন্য এক অনিক কে দেখেছিল। এরপর দিন দুয়েক পর ইশা ওর অফিসে গেলে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলেছিল। তবে ইশা খেয়াল করেছে যে কিছু একটা ঘটেছে! তার পরের সপ্তাহে অনির পাঠানো সাদা খাতাটা পেয়েছে ইশা।

এরপর কেটে গেছে একবছর সাতটা মাস। ইশা জানেনা যে অনি কেন ওকে ছেড়ে গেছে আর কোথায় ই বা গেছে।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে