বিষাক্তফুলের আসক্তি পর্ব-০৭+০৮

0
1022

#বিষাক্তফুলের আসক্তি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-০৭+০৮

একটা চেয়ারে হাতপা বাঁধা অবস্থায় সেন্সলেস হয়ে আছে ডক্টর রাজিব হোসেন। তার ঠিক সামনে বসে আছে তাজ। এসব করতে তার মোটেও ভালো লাগছে না৷ পর্দায় একশন মুভি করলেও বাস্তব জীবনে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে সব ঝামেলা। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে এসব করতে বাধ্য করছে। চোখেমুখে পানির ছিটা দিতেই জ্ঞান ফিরলো রাজিবের। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো সে কোথায় আছে। সামনে তাজকে বসে থাকে দেখে অবাক হলো।

এসব কী তাজ ?

তাজ নির্লিপ্ত গলায় বললো, আমিও সেটাই বলছি আঙ্কেল। এসবের মানে কী ? আপনি আমাদের ফ্যামিলি ডক্টর, বলতে গেলে ফ্যামিলির একজন মেম্বার। আপনি কীভাবে পারলেন নির্দ্বিধায় এমন একটা মিথ্যা বলতে।

এবার মাথা নিচু করে ফেললো রাজিব।

তাজ বললো, টাকার জন্য এতো বছরের বিশ্বাস বিক্রি করতে একবারও বিবেকে বাঁধলো না।

রাজিব এবার তাকালো তাজের দিকে, পৃথিবীতে টাকার থেকে অধিক মূল্যবান অনেক কিছু আছে তাজ। তার মধ্যে আপনজন একটা। ছোট একটা মিথ্যার জন্য আমি আমার আপনজনদের মৃত্যু দেখতে পারবো না নিশ্চয়ই।

তাজ অনেকটাই অবাক হলো, মানে ?

রাজিব নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো, মিথ্যা বলার জন্য হয়তো তুমি আমাকে শাস্তি দিবে এখন। কিন্তু মিথ্যাটা না বললে আমাকে আমার পুরো পরিবার হারাতে হতো। তুমি আমাকে যা ইচ্ছে শাস্তি দিতে পারো আমার কোনো অভিযোগ নেই।

তাজ গম্ভীর গলায় বললো, লোকটা কে ?

সেটা আমি নিজেও জানি না। তোমাদের বাড়ি থেকে ফোন আসার পর আমি যখন তোমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হই। তোমাদের বাড়িতে পৌঁছানোর পাঁচ মিনিট আগে আমার কাছে কিছু ছবি আর একটা ম্যাসেজ আসে। পরিবারের জীবন বাঁচাতে আমি বাধ্য হই মিথ্যা বলতে।

তাজের মাথা হ্যাং করছে। সে ভেবেছিলো রাজিবের থেকে কিছু অন্তত জানতে পারবে কিন্তু এবারও ফলাফল শূন্য। ম্যাসেজ আর ছবি তাজকে দেখালো রাজিব। পরিবারের প্রতিটা মানুষের গলায় ছুরি ধরে রাখা হয়েছে। সাথে ছোট একটা ম্যাসেজ, সারাদেশের মানুষ যেটা জানে সেটাই যেনো বলে রাজিব। নাম্বারটা নিয়ে কল করে দেখলো বন্ধ। একটা ক্রাইম করে এখনো নাম্বারটা ইউজ করার মতো বোকা নিশ্চয়ই তারা নয়। নাম্বারের ডিটেইলস বের করতে বলে রাজিবকে বাসায় পৌঁছে দিতে বললো তাজ৷ তারপর বের হয়ে গেলো গোডাউন থেকে।

৮.
নিজের ফ্ল্যাটে ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে তিতির। মনে হচ্ছে এখনই বিকট শব্দে বেজে উঠবে তার ফোনটা আর রায়হানের থেকে শুনতে হবে ভয়ংকর কিছু। সারা রুম জুড়ে পাখির টেডিবিয়ার, খেলনা, জিনিসপত্র রাখা। রুমের আনাচকানাচে পাখির হাজারো স্মৃতি। তিতিরের মনে হচ্ছে পাখি বলছে আপুনি আমার কষ্ট হচ্ছে। তোমাকে ছাড়া থাকতে আমার অনেক কষ্ট হয়, আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে।

তিতির নিজের চুল খামচে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো, তোর কিছু হতে দিবো না বোনু। আমি তোর কিছু হতে দিবো না। এতে যা করতে হয় করবো কিন্তু তোর কিছু হতে দিবো না। কেনো এমন করছেন রায়হান চৌধুরী কেনো ? আমি মুক্তি চাই এসব থেকে।

অনেকটা সময় পরেও রায়হানের কোনো ফোন না পেয়ে ভয় বাড়তে লাগলো তিতিরের। রায়হানের তো এতো শান্ত থাকার কথা নয়। এ যেনো ঝড়ের পূর্বাভাস। তিতির দু’হাতে চোখমুখ মুছে উঠে দাড়ালো। নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বের হয়ে গেলো খান ভিলার উদ্দেশ্যে। গতরাতে যে রুমে ছিলো সেই রুমেই গেলো, সে ঠিক করেছে সেখানেই থাকবে। নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। যত সময় যাচ্ছে ভয়ে তিতিরের দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাকি দিন তিতির বন্ধ রুমেই কাটিয়ে দিলো, সার্ভেন্ট খাবার দিয়ে গেলেও গলা দিয়ে তা নামলো না।

বেলকনিতে বসে উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো তিতির। এশারের নামাজ পড়েই বেলকনিতে গিয়ে বসেছে। আকাশে চাঁদ নেই, তবে তারা দেখা যাচ্ছে দুয়েকটা। পাশে রাখা ফোনটা বেজে উঠলে চমকে উঠলো তিতির। স্কিনে রায়হানের নাম দেখে ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে তার। কাঁপা হাতে ফোন তুলে রিসিভ করলেও গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারলো না শত চেষ্টা করেও।

তোকে বলেছিলাম আমার কথার বাইরে গেলে তার চরম মূল্য দিতে হবে তোকে।

রায়হানের শান্ত গলায়ও ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো তিতিরের, আ,,আমার ভুল হয়ে গেছে। দয়া করে পাখির কিছু করবেন না।

আমি ঠিক সময়ে না গেলে আমার দুই বছরের সাজানো খেলা এক মিনিটে শেষ করে দিতি তুই। এমন একটা কাজের শাস্তি তো তোকে পেতেই হবে তিতির। নাহলে তোর সাহস বেড়ে যাবে। আজ মৌকে বলতে গিয়েছিলি কাল সরাসরি তাজকেই বলে দিবি। তোর সাহসটা কমানোর জন্য হলেও শাস্তি তো পেতে হবে।

তিতির ব্যস্ত হয়ে উঠলো, ন,,না না আমি কাউকে কিছু বলবো না আর। মরে গেলেও মুখ খুলবো না, দয়া করে আমার পাখিকে কিছু করবেন না।

রায়হান উচ্চস্বরে হেসে বললো, বড্ড দেরি হয়ে গেলো যে বোনটি। আমি তো যা করার করে ফেলেছি।

তিতিরের কলিজা কেঁপে উঠলো রায়হানের কথা শুনে, ক,,কী করেছেন আপনি ?

ওয়েট এখনি দেখাচ্ছি।

তিতিরের ফোনে একটা ভিডিও সেন্ড করে দিলো রায়হান, এনজয় দ্যা ভিডিও।

তিতির কাঁপা হাতে ভিডিও ওপেন করে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো, পাখি।

পাখির হাত থেকে টপটপ রক্ত পড়ছে। পাখি হাতের দিকে তাকিয়ে ভয়ে কাঁদছে আর আশেপাশে তাকিয়ে আপুনি বলে ডাকছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে হাতটা। তিতিরের নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে। ইচ্ছে ফোনের ভেতরে ঢুকে বোনকে বুকে জড়িয়ে নিতে।

তিতির ফোনের দিকে তাকিয়ে পাগলের মতো কাঁদতে লাগলো, আমার জন্য হয়েছে বোনু। আমাকে মাফ করে দে আমি তোর পঁচা আপুনি। আমি তোকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।

পাখিকে কত অসহায় মনে হচ্ছে, আশেপাশে আপুনিকে খুঁজছে সে। তিতিরের বুক চিঁড়ে যাচ্ছে কষ্টে৷ নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ মনে হচ্ছে তার কাছে। ভিডিও শেষ হলে ফোনটা রেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো তিতির। কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না সে। তিতির পাগলের মতো রুমে ছুটে এলো, কিছু খুঁজতে লাগলো। সাইড টেবিলে পেয়েও গেলো কাংখিত জিনিস। ফলের সাথে রাখা ছুরিটা নিয়ে নিজের হাতে একটা টান দিলো। মুহূর্তে চামড়া কেটে লাল টকটকে তরল বের হয়ে এলো। আরো একবার ছুরি বসাবে তার আগেই বেলকনিতে থাকা ফোনট আবার বেজে উঠলো। ছুরি ফেলে দৌড়ে গেলো বেলকনিতে।

রায়হানের কল দেখে সাথে সাথে রিসিভ করলো, আমি আমার বোনুর সাথে কথা বলতে চাই এখনই। আ,,আমি আর কিছু বলবো না কাউকে। সত্যি বলছি একটা শব্দ বের করবো না মুখ থেকে।

তিতির কথা শেষ করে মুখে হাত চেপে কান্না করতে লাগলো। এদিকে হাতের রক্তে ফ্লোর ভিজে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই তার।

ওয়েট পাখির সাথে কথা বলিয়ে দিচ্ছি আর আজকের মতো ভুল দ্বিতীয়বার করার সাহস করিস না।

তিতির অপেক্ষা করতে লাগলো পাখির সাথে কথা বলার। হাতের কথা তার মাথা থেকেই বের হয়ে গেছে।

৯.
মেয়েটার হাত কাটলো কীভাবে ন্যান্সি ?

ন্যান্সি ভয়ে ভয়ে বললো, রায়হান স্যার সকালে কল করে জানালো পাখিকে নিয়ে বাইরে গিয়ে যেনো একটু হাঁটিয়ে আনি। রুমে থেকে থেকে ডেস্পারেট হয়ে যেতে পারে। আমি সকালে সামনের রাস্তায় হাঁটতে বের হয়েছিলাম তাকে নিয়ে। হঠাৎ একজন আমাকে সে বললো কেউ ডাকছে আমাকে। পাখিকে পাশের বেঞ্চে বসিয়ে আমি সেদিকে এগিয়ে গেলাম। অনেক খুঁজেও কাউকে পেলাম না। ফিরে এসে দেখি পাখির হাত থেকে রক্ত পড়ছে। তাই তাড়াতাড়ি বাসায় নিয়ে এলাম।

আহান রেগে গেলো ন্যান্সির কথা শুনে, কেউ ডাকলো আর মেয়েটাকে একা রেখে আপনি চলে গেলেন।

ন্যান্সি মাথা নিচু করে ফেললো, সরি।

আহান বেডে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকা পাখির দিকে তাকালো। বাসায় আসার পর ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে আহান। হাতের কাটা গভীর না হলেও মেয়েটা ভয় পেয়েছে প্রচুর। শান্ত করতে অনেক কসরত করতে হয়েছে। কিছুক্ষণ আগেই ঘুমিয়েছে মাত্র। ভাগ্য ভালো আহান বাসায় ছিলো নাহলে কী হতো আল্লাহ জানেন। আহানের ফোন বেজে উঠলে স্কিনে রায়হানের নাম্বার দেখে ভয় পেয়ে গেলো। সে তো পাখির খেয়াল রাখতে পারেনি। এখন কী বলবে ভাইকে ?

ভয়ে ভয়ে কল রিসিভ করলো আহান, হ্যালো ভাইয়া।

রায়হান শান্ত গলায় বললো, পাখি কোথায় ?

আহান আমতা আমতা করে বললো, আসলে ভাইয়া।

আমি সবই জানি তাই বাহানা করার প্রয়োজন নেই। তুই পাখির কাছে দে আমি কথা বলবো।

পাখি তো ঘুমাচ্ছে ভাইয়া।

ডেকে বল ওর আপুনি কথা বলবে।

আহান অবাক হয়ে বললো, কিন্তু ?

যেটা বলছি সেটা কর, বেশি কথা পছন্দ নয় আমার।

ন্যান্সি নিচু স্বরে ডেকে তুললো পাখিকে। মেয়েটা এখনো কেমন ভয়ে গুটিয়ে আছে।

রায়হান বললো, ফোনটা পাখির কাছে দিয়ে তোরা চলে যা।

আহান কিছু বুঝতে পারছে না। তবে কথা না বাড়িয়ে পাখির কাছে ফোন দিয়ে চলে গেলো আহান আর ন্যান্সি। ভিডিও কলে পাখি স্কিনে রায়হানকে দেখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।

পাখি ঠোঁট উল্টে বললো, আপনি কে ? আমার আপুনি কোথায় ?

রায়হান কিছু না বলে তিতিরকে এড করে দিলো কলে। তিতিরকে দেখে কেঁদে দিলো পাখি।

আপুনি তুমি আসছো না কেনো ? দেখো আমি ব্যাথা পেয়েছি। একটা পঁচা লোক আমাকে ব্যাথা দিলো তো।

তিতির কেঁদে উঠলো বোনের কথা শুনে। কতদিন পর বোনটাকে দেখতে পেলো।

কাঁদতে কাঁদতে বললো, কাঁদে না সোনা। আমি চলে আসবো তো, তুমি একদম ভয় পাবে না। তুমি গুড গার্ল হয়ে থাকো আমি তাড়াতাড়ি চলে আসবো।

আমি দুষ্টুমি করবো না, তুমি চলে আসো। আমার একা থাকতে ভালো লাগে না তো।

খুব বেশি ব্যাথা লেগেছে বোনু ?

হ্যাঁ তো, ব্যাথা করছে তো। প্লিজ তুমি চলে আসো ব্যাথাও চলে যাবে।

পাখির কথা শুনে কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে তিতিরের। ইচ্ছে করছে বোনকে বুকের ভেতর লুকিয়ে ফেলতে যাতে আর কেউ কেঁড়ে নিতে না পারে, দু’বোনে কাঁদতে লাগলো। আরো কিছু সময় কথা বলার পর রায়হান কেটে দিলো কল। সে চুপচাপ দু’বোনের কথা শুনে গেছে। তবু পাথর মনে একটু দয়া হয়নি তার। তিতির ফোনটা বুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো বেলকনিতে। হাতের রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেলো একাই, শুকিয়ে যেতে লাগলো।

আহান থম মেরে বসে আছে নিজের রুমে। তার মাথায় কিছুই আসছে না। নিজের রুমে থেকে তিতির আর পাখির কথোপকথন শুনেছে সে। রায়হানের মাথা থেকে হয়তো এই ব্যাপারটা বেরিয়ে গেছে। আহান কিছুতেই হিসাব মিলাতে পারছে না। রায়হান তাদের বলেছিলো পাখির আপুনি মারা গেছে তাহলে পাখি কথা বললো কার সাথে। দু’জনের কথায় তো মনে হয়নি অন্যকেউ। ল্যাপটপের স্কিনে তিতিরকেও দেখেছে আহান। পাখির সাথে তার চেহারায়ও অনেক মিল আছে। প্রথম থেকেই পাখিকে চেনা চেনা লেগেছে আহানের কাছে কিন্তু মনে করতে পারেনি কোথায় দেখেছে। রায়হান যখন বললো পাখি তাদের আপন কেউ তখন আর মাথা ঘামায়ন, ভেবেছে আত্নীয় কেউ হবে। আগে দেখেছে তাই চেনা লেগেছে। কিন্তু আহান এখন বুঝতে পারছে পাখিকে তার চেনা চেনা লাগার কারণ। সে পাখিকে নয় বরং তিতিরকে আগে কোথাও দেখেছে আর তিতিরের সাথে পাখির চেহারায় মিল থাকায় পাখিকে চেনা চেনা লেগেছে। আহানের বুঝতে অসুবিধা হলো না এখানে অন্য কোনো গল্প আছে, রায়হান কিছু লুকাচ্ছে তার থেকে। সত্যিটা না জানা পর্যন্ত শান্তি পাবে না আহান।

আহান বিড়বিড় করে বললো, কে এই তিতির আর পাখি ?

গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে পাখির। ন্যান্সি পাখির মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। মেয়েটা জ্বরের ঘোরেও আপুনিকে ডেকে যাচ্ছে। আহান পাখির কপালে হাত রেখে বুঝার চেষ্টা করলো জ্বর কমেছে কিনা।

আহান ন্যান্সির উদ্দেশ্যে বললো, আপনি এবার গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি আছি পাখির কাছে।

ন্যান্সি বললো, কিন্তু স্যার আপনার তো সকালে ভার্সিটি যেতে হবে।

আহান পাখির দিকে তাকালো, আমার সমস্যা হবে না আপনি যান।

ন্যান্সি আর কিছু না বলে পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলো। আহান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পাখির দিকে। আহান কখনো পাখির দিকে বিরক্তির দৃষ্টি ছাড়া তাকায়নি। কিন্তু আজ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে পাখিকে স্নো হোয়াইট নাম দিতে ইচ্ছে করছে। অনেক বছর আগে এই নামটা দিয়েছিলো ছোট একটা পুতুলকে আজ মনে পড়ে যাচ্ছে তার কথা। ধবধবে ফর্সা মুখটায় রক্তগোলাপের মতো রক্তবর্ণ ঠোঁট, কৃষ্ণবর্ণ লম্বা চুল। এক কথায় স্নো হোয়াইটকে যেনো বাস্তবে দেখছে আহান।

আহান বিড়বিড় করে বললো, কে তুমি ? আমাকে যে সেটা জানতেই হবে।

১০.
দু’দিন যাবত ঘরবন্দী তিতির। তাকে কেউ বন্দী করে রাখেনি সে নিজেই বের হয় না রুম থেকে। সার্ভেন্ট খাবার দিয়ে গেলে মন চাইলে খায়, আবার না চাইলে সেভাবেই পড়ে থাকে খাবারগুলো। তাজ দু’দিন বাড়ি ফিরেনি, তার বাবা-মা তার চিন্তায় অস্থির, মনে হয় ভুলেই গেছে বাড়িতে একটা মেয়ে। তিতির রায়হানকে কল দিলো বেলকনিতে গিয়ে।

রায়হান রিসিভ করে বিরক্তি নিয়ে বললো, এতবার বিরক্ত করছিস কেনো তিতির ?

তিতির রাগী গলায় বললো, আমার বোনুকে ফিরিয়ে দিন আপনার মতো লোকের ছায়াও মাড়াবো না আমি।

বলেছি তো সময় হলে ফিরে পাবি।

আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে এই বাড়িতে। দয়া করে আমাকে এবার মুক্তি দিন।

আমার কাজ তো এখনো শেষ হয়নি। শেষ হলে অবশ্যই মুক্তি দিবো তোদের।

আর কী কাজ বাকি আছে ? আপনার উদ্দেশ্য ছিলো স্যারের ক্যারিয়ার ধ্বংস করা, সেটা হয়ে গেছে।

এতো ছোট একটা কাজ করার জন্য এতো কষ্ট করলাম নাকি আমি। আরো অনেককিছু বাকি আছে। তোর এতকিছু জেনে কাজ নেই। বেশি না এক মাস থাকতে হবে তোকে।

তিতির আঁতকে উঠলো, অসম্ভব আমি কিছুতেই এক মাস এখানে থাকতে পারবো না।

রায়হান বাঁকা হেসে বললো, তোর মনে হয় বোনের চিন্তা নেই রে তিতির। তিতিরপাখি শব্দটা থেকে পাখি বাদ দিতে চাইছিস।

তিতির অস্থির হয়ে উঠলো বোনের কথা শুনে, না আমার বোনের কিছু করবেন না। আমি থাকবো যতদিন চাইবেন ততদিন থাকবো।

কার সাথে কথা বলছিস রায়হান ?

মৌয়ের গলা শুনে চমকে উঠলো রায়হান। পরক্ষণে নিজেকে সামলে পেছনে ফিরে মৌয়ের দিকে তাকালো। মৌ সরু চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রায়হান কোনমতে পরে কথা বলছি বলে কল কেটে ফোন পকেটে রেখে দিলো। মৌ তখনো তাকিয়ে আছে রায়হানের দিকে।

রায়হান জোরপূর্বক হেসে বললো, এমনই একটা জরুরি কল ছিলো।

মৌ বললো, তাহলে কথা শেষ না করে রেখে দিলি কেনো ?

কথা শেষ তো, তাই রেখে দিলাম। কিন্তু তুই এখানে কী করছিস ? তোর তো রোগী দেখার কথা এখন।

দম বন্ধ লাগছিলো তাই একটু ব্রেক নিয়েছি।

রায়হান ব্যস্ত হয়ে বললো, তোর শরীর ঠিক আছে ?

মৌ বললো, আমি ঠিক আছি। তবে একটু একা থাকতে চাইছি। এপাশটা নিরিবিলি তাই এলাম।

ঠিক আছে তুই থাক তাহলে, আমি আসছি। আমার আবার একটা অটি আছে কিছুক্ষণ পর।

মৌয়ের উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে গেলো রায়হান। মৌ তাকিয়ে আছে রায়হানের যাওয়ার দিকে। একই হসপিটালে আছে তারা। মৌয়ের সন্দেহ একটু একটু করে গাড়ো হচ্ছে।

মৌ বিড়বিড় করে বললো, সেদিন তোকে দেখে তিতিরের ভয় পাওয়া। আজ তোর বলা কথা সব মিলিয়ে কিছু তো একটা রহস্য আছে রায়হান। তিতিরপাখি শব্দটা থেকে পাখি বাদ দিতে চাইছিস। মানে কী হতে পারে এই কথার ? তিতিরের সাথে তোর কী সম্পর্ক ?

মৌ এসে রায়হানের বলা লাস্ট কথাটুকু শুনেছে। মৌ বুঝতে পারছে রায়হানের সাথে তিতিরের কোনো একটা কানেকশন আছে কিন্তু সেটা কী ধরতে পারছে না।

কিছুক্ষণ এসব চিন্তা করে তাজকে কল দিলো। সে রাতের পর তাজের সাথে আর যোগাযোগ হয়নি মৌয়ের। এবারও ফোন বন্ধ বলছে, সে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। মৌ খোঁজ নিয়েছে দু’দিনে তাজ বাড়িও ফিরেনি।

মৌ ফোন বের কর তাজের পিক দেখে বললো, কোথায় তুমি তাজ ?

স্যার দু’দিনে মেয়েটা বাড়ি থেকেই বের হয়নি। তবে কল লিস্ট বের করে একটা নাম্বার পাওয়া গেছে। কিছুদিন যবত এই একটা নাম্বারে কথা বলে যাচ্ছে। আপনার বিয়ের পাঁচদিন আগেই প্রথম কথা বলে এই নাম্বারে। কিন্তু তার আগে কখনো এই নাম্বার থেকে না কল এসেছে আর না গেছে।

গার্ডের কথা চুপচাপ শুনলো তাজ। তিতিরকে সুযোগ দিতেই তাজ দু’দিন বাড়ি ফিরেনি। তাজ দেখতে চেয়েছিলো তিতির কার সাথে দেখা করে। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। তাই আজ তিতিরের কল লিস্ট বের করতে বলে।

তাজ অনেক ভেবে বুঝতে পেরেছে সত্যি মিথ্যা সামনে আনার জন্য তিতিরের পিছনে সময় নষ্ট না করে, আসল কালপ্রিটকে খোঁজা বুদ্ধিমানের কাজ। আসল কালপ্রিটকে খুঁজে পেলে এমনই সব সামনে চলে আসবে।

ঐ নাম্বার কার তার ডিটেইলস বের করো। মনে হচ্ছে এই নাম্বারের মালিকই আসল কালপ্রিট। তিতিরের উপর আরো কড়া নজর রাখো।

ঠিক আছে স্যার।

তিতিরের পুরো লাইফ ডিটেইলস বের করতে বলেছিলাম তার কী হলো ?

স্যার সেই কাজও হয়ে গেছে। তিতিরের বাবা আবির মাহমুদ। একসময় বেশ বড় পারিবারিক বিজনেস ছিলো। আবির মাহমুদ আর তার স্ত্রী মারা গেছে বেশ রহস্যজনক ভাবে। তারা মারা যাওয়ার পর সেই বিজনেসের মালিক হয়েছে আবির সাহেবের বোন-জামাই আব্দুর রহমান চৌধুরী। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর তিতির বড় হয়েছে তার বাবার এক বিশস্ত গার্ড নুরুলের কাছে।

তাজ অবাক হয়ে শুনছে গার্ডের কথা। তাজ শুধু জানতো তিতিরের বাবা-মা নেই। সে একটা ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে। এর বেশি জানার ইচ্ছে হয়নি কখনো।

তাজ অবাক হয়ে বললো, আত্মীয় স্বজন থাকতে গার্ডের কাছে কেনো বড় হয়েছে।

যতটুকু জানা গেছে আবির সাহেব মারা যাওয়ার পর আত্নীয় স্বজনরা প্রোপার্টি দখলে ব্যস্ত হয়ে যায়, প্রোপার্টির পরিমাণ অনেকটাই বড় ছিলো। তিতিরের খোঁজ কেউ করেনি। নুরুলই বড় করেছে তিতিরকে কিন্তু বছর দুয়েক আগে নুরুল মারা গেছে কার এক্সিডেন্টে। তারপর থেকে একাই আছে তিতির। তবে মাঝে মাঝে তার সাথে আরো একটা মেয়েকে দেখা গেছে কিন্তু সেটা কে জানা যায়নি। তিতির আপনাদের বাড়ি যাওয়ার পর থেকে তার ফ্ল্যাট ফাঁকা পরে আছে।

তাজ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, অন্য মেয়েটা কে সেটা খোঁজে বের করো দ্রুত।

ইয়েস স্যার।

তাজ বের হয়ে গেলো ফার্মহাউস থেকে। গত দুদিন সে এখানেই ছিলো। গাড়ি স্টার্ট করে বাড়ির পথে এগোতে লাগলো।

স্টিয়ারিং হাতে ভাবতে লাগলো, এবার খেলাটা জমবে মিস তিতির উপস সরি মিসেস তিতির। আর তাড়াহুড়ো নয়, এবার সব হবে ঠান্ডা মাথায়। ক্যারিয়ার, ক্যারিয়ার শেষ করে দিয়েছো তাই না। যে ক্যারিয়ারে ঘুণ ধরেছে সেটা তো আর বয়ে বেড়াবে না এই তাজওয়ার খান তাজ। আমার চরিত্রে লাগা দাগতো আমি তুলবো কিন্তু আগের জীবনে আর ফিরে যাবো না। তাই কোনো তাড়া নেই আমার, সবটা সময়ে আনবো আমি। এতে যত সময় লাগুক। তুমি আমার সাথে গেইম খেলেছো এবার আমি তোমার সাথে গেইম খেলবো। তোমরা যত মনে করবে আমি সবটা মেনে নিতে শুরু করেছি তত কাজটা সহজ হবে আমার জন্য। তোমরা যেটা চাইবে আজ থেকে সেটাই হবে। আজ থেকে তোমাদের উড়তে দিবো আমি, উড়তে উড়তে যখন আকাশ ছুঁতে চাইবে ঠিক সেই সময় ডানা কেনে দিবো। মুখ থুবড়ে মাটিতে পরে তড়পাবে তোমরা। শেষ খেলাটা তো এই তাজওয়ার খান তাজ জিতবে, জাস্ট ওয়েট এন্ড সি।

কথাগুলো নিজের মনে আওড়ে বাঁকা হাসলো তাজ।

বাড়ি ফিরে কলিংবেল বাজালে দরজা খোলে দিলো সার্ভেন্ট। সোজা নিজের রুমে গিয়ে লম্বা সময় শাওয়ার নিলো।

১১.
তাজ ডিনার টেবিলে গিয়ে দেখলো তার বাবা-মা বসে খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাজ নিজের চেয়ার টেনে বসলো।

ইকবাল খান ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো, গত দু’দিন কোথায় ছিলে ?

বাবা-মায়ের উপর অভিমানটা জমিয়ে রেখেছে তাজ। সবটা সামনে আসুক তারপর বাবা-মায়ের সাথে বুঝাপড়াটা হবে৷

তাই এখন স্বাভাবিক ভাবে নিজের প্লেটে খাবার তুলে নিতে নিতে শান্ত গলায় বললো, এর আগে মাসের পর মাস বাইরে থেকেছি, তখন তো কৈফিয়ত দিতে হয়নি।

তখনকার সময় আর এখনকার সময়ে অনেক তফাত। তখন তুমি কাজের জন্য বাইরে থাকতে।

তাজ শান্ত গলায় বললো, নিজেকে সময় দিতে গিয়েছিলাম।

তাজ এক সার্ভেন্টের দিকে তাকিয়ে বললো, মেয়েটা আই মিন তিতিরকে ডেকে নিয়ে এসো।

সার্ভেন্ট তিতিরকে ডাকতে গেলে ইরিনা বললো, ওকে কেনো ডাকছিস ?

তাজ বললো, কিছু কথা বলতে চাই সেটা তিতিরেরও জানা প্রয়োজন।

তিতির ফোনে তার আর পাখির ছবি দেখছিলো তখনই দরজায় নক হয়।

তিতির বলে উঠে, কে ?

ছোট স্যার আপনাকে ডাকছে, এখনই যেতে বলেছে।

তিতির বুঝতে পারলো তাজ এসেছে। কিন্তু তাকে কেনো ডাকছে সেটা বুঝতে পারছে না। ভয়ে এক ঢোক গিলে বেড থেকে নেমে গেলো। ওড়না মাথায় দিয়ে দরজা খোলে বের হয়ে এলো। সার্ভেন্টের পিছন পিছন ডাইনিং টেবিলের সামনে হাজির হলো। তাজ একবার তাকালো তিতিরের দিকে।

বেশ শান্ত গলায় বললো, বসো।

তিতির চমকে উঠলো তাজের কথায়। তাজ খুব সাধারণ একটা কথা বলেছে তবু সেটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। সেদিনের পর আজ প্রথম তাজ ভালো করে কথা বললো তার সাথে। তিতির কাঁপা হাতে চেয়ার টেনে বসলো।

তাজ সার্ভেন্টকে উদ্দেশ্য করে বললো, খাবার দিন ওকে।

এবার অনেক বেশি চমকে উঠলো তিতির। কাঁপা গলায় বললো, আ,,আমি খাবো না।

তাজ শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো তিতিরের দিকে। তাজের শান্ত দৃষ্টি তিতিরের গলা শুকিয়ে দিলো, দ্রুত মাথা নিচু করে ফেললো।

তাজ সার্ভেন্টকে বললো, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেনো ? ওকে খাবার দিতে বললাম তো।

সার্ভেন্ট দ্রুত তিতিরের সামনে খাবার রাখলো। ইকবাল আর ইরিনা অবাক দৃষ্টিতে ছেলের কান্ডকারখানা দেখে যাচ্ছে।

তিতিরের সামনে খাবার দিলে তাজ বললো, নাও শুরু করো।

তিতির একবার তাজের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে ফেললো।

তাজ তা দেখে ধমক দিয়ে বললো, কী হলো শুরু করতে বললাম না ?

তিতির কেঁপে উঠলো তাজের ধমকে। কাজ করার সময় তাজ কখনো ধমক দিয়ে কথা বলতো না তিতিরের সাথে৷ তাই তিতির কখনো ভয়ও পেত না তাকে। কিন্তু এখন তাজের দিকে তাকাতেও ভয় লাগে তিতিরের। হাত-পা অস্বাভাবিক হারে কাঁপে।

তিতির কাঁপা হাতেই চামচ তুলে নিলো আর একটু খাবার মুখে দিলো।

তাজ বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, তোমরা বসে আছো কেনো, খাও।

সবাই খাওয়ায় মনোযোগ দিলো, তিতির চামচ দিয়ে খাবার নাড়াচাড়া করছে শুধু। তিতির বুঝতে পারছে না তাজের এমন ব্যবহারের কারণ।

তাজ খেতে খেতে হঠাৎ বললো, অনেক ভেবে দেখলাম যা হওয়ার হয়ে গেছে। এবার সবটা মেনে নেওয়ার চেষ্টা করাই ভালো।

খাওয়া থেমে গেলো সবার, শুধু তাজ নিজের মতো স্বাভাবিকভাবে খেয়ে যাচ্ছে।

ইকবাল খান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, মানে কী বলতে চাইছো ?

তাজ এবার তাকালো বাবার দিকে, মানে খুব সহজ। আমি মেনে নিচ্ছি সবটা, হয়তো আমারই কোথাও ভুল ছিলো। তিতির সবসময় আমার সাথেই থাকতো, হয়তো দূর্বল হয়ে পড়েছিলাম কোনো মুহূর্তে। আমি সবটা মেনে নিয়ে সামনে আগাতে চাইছি।

তিতিরের হাত থেকে চামচটা প্লেটে পড়ে ঝনঝন আওয়াজ তুললো। তিতির হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে তাজের দিকে। মাথা ঠিক আছে তো, কী সব আবোল তাবোল বকছে। তাজ আঁড়চোখে তিতিরের হতবিহ্বল অবস্থা দেখে বাঁকা হাসলো।

মনে মনে বললো, তোমরা তো এটাই চাইছিলে আমি হাড় মেনে নেই, সবটা মেনে নিতে বাধ্য হই। জেতার জন্য নাহয় হাড় মানার অভিনয় টাই করলাম।

তাজ বাঁকা হাসলো পুনরায়। তাজের বাবা-মা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো তাজের কথা শুনে।

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে