বিরহ ভালোবাসা পর্ব-১৫

0
619

#বিরহ_ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter

১৫.

ড্রইংরুমের সোফায় মাথা নীচু করে বসে আছে লতা। পাশে রুপা আপা বসে আছেন। তার ঠিক সামনে রবিন সহ ওর পরিবারের চার সদস্য বসে কথা বলছেন লতার বাবা এবং মায়ের সঙ্গে।

রবিন আড়চোখে কয়েকবার লতার দিকে তাকিয়েছে। লতা রবিনের দৃষ্টি উপেক্ষা করতে পারে না। কারণ, কেউ যখন আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে তখন আমাদের নিউরন সিগনাল করে। সেই সিগনালের বদৌলতে আমাদের লতাও রবিনের দিকে তাকাতে বাধ্য হয়েছেন। যদিও শাদাদ ভাই দোতলায় দাঁড়িয়ে এমন দৃশ্য দেখে হজম করতে পারছেন না।

—- বলছিলাম কি লতা তো আমাদের চেনাজানা মেয়ে। রবিনকে আপনারাও চিনেন। এখন যদি লতার রবিনকে পছন্দ হয় তবে বিয়ের ডেইট ফিক্সড করতে পারলে মন্দ হতো না।

রবিনের বাবা আফতাব সাহেব কথাটি বললেন। লতার বিয়ের ডেইট ফিক্সড শব্দটা শুনে পেটে মোচড় মারছে। লতার বাবা নড়েচড়ে বসলেন তারপর অত্যন্ত বিনয়সহকারে বললেন,

— আসলে হয়েছে কি আমার বড়ো ভাই অর্থাৎ আপনার বেয়াই সাহেব আজ সকালে হুট করে আমাদের গ্রামের বাড়িতে গেছেন। এখন ভাইয়াকে ছাড়া আমি এতবড়ো সিদ্ধান্ত নেই কি করে? তাই বলছিলাম কি ভাইয়া এলে না হয় আমরা এই বিষয়ে কথা বলি? তাছাড়া, লতার কয়েকদিন পর পরীক্ষা। বুঝতেই পারছেন আমি কি বলতে চাচ্ছি?

— জি; জি ; অবশ্যই। বিয়ের ডেইট না হয় ফিক্সড করবো না। কিন্তু, লতাকে আংটি পরিয়ে দিলে তো কোনো প্রবলেম নেই?

রবিনের মা কথাটি বলে ছেলে রবিনের দিকে তাকিয়ে হাসি বিনিময় করলো। লতার বাবা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরলেন। লতা তো বোধহয় মাথা ঘুরে যাবে।

এমন সময় শাদাদ ভাই এলেন ট্রেতে করে শরবতের গ্লাস নিয়ে। ট্রে থেকে একটি গ্লাস নিয়ে রবিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

— বিয়ের মতো এত কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে। হয়তো একটু পর আংটি পড়াবে। শরবতটা খেয়ে নাও রিল্যাক্স ফিল পাবে।

রবিন মুচকি হাসি দিয়ে গ্লাসটি নিয়ে শরবতের গ্লাসে চুমুক দেয়। তারপর, একে একে সবার হাতে শরবতের গ্লাস এগিয়ে দেয় শাদাদ ভাই। শুধুমাত্র লতাকে শরবত দেয়নি শাদাদ ভাই। লতার যদিও ভীষন পানির তেষ্টা পেয়েছিলো। শরবত খেতে পারলে মন্দ হতো না। লতা শাদাদ ভাইয়ের এমন অস্বাভাবিক আচরণ দেখেও কিছু মনে করলো না। কারণ, শাদাদ ভাই মানুষটাই এমন। কখন কি করেন কোনো কিছুই বোধগম্য হয় না!

শরবত খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই রবিনের মা উনার ব্যাগ থেকে আংটির বক্স বের করে আংটি বের করেন। উঠে গেলেন লতার সামনে। রুপা সরে গিয়ে শ্বাশুড়িকে বসতে জায়গা দিলো। ভদ্রমহিলা লতার বাম হাত ধরে টেনে এনে আংটি পরিয়ে দিবে।

এমন সময় রবিন হড়হড় করে বমি করে দেয়। উপস্থিত সকলে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে থাকে রবিনের দিকে। রবিনের মা তো ছেলের অবস্থা দেখে লতার পাশ থেকে উঠে এসে ছেলের মাথা চেপে ধরলেন। লতার পা পানি এনে দিলেন। কিছু সেকেন্ড পর রবিনের বমি কমে আসে। সকলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু, এরপরই শুরু হয় মূল ঘটনা। বেচারা রবিনের পেট মোচড় দিয়ে ওঠে। ইর্মাজেন্সি ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়োজন। কোনোরকমে মুখ খুলে প্রথমে লতার মাকে বললো,

— আন্টি নীচ তলায় ওয়াশরুম আছে?

লতার মা হাতের ইশারায় দক্ষিণের বারান্দার দিকে তাকিয়ে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। রবিন উঠে একপ্রকার দৌঁড়ে সেদিকে চলে যায়।

এদিকে সবাই চিন্তিত হয়ে বসে আছে। হুট করে ছেলেটার কি হলো ভেবে?

রবিন ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসে রিল্যাক্স মুডে কিন্তু আবারও পেট মোচড় দিয়ে ওঠে। বেচারা আবারও দৌঁড়ে ঢুকে পরে ওয়াশরুম। এভাবে একবার নয় দুবার নয় দশবার ওয়াশরুমে আসছে আর যাচ্ছে। একসময় রবিন ক্লান্ত হয়ে ওর মাকে ডাক দেয়। রবিনের মা ছেলের কাছে এলে বুঝতে পারেন ছেলের অবস্থা ভালো নয়।

গাড়ি ডেকে এনে রবিনকে হসপিটালে নিয়ে যায় রবিনের বাবা-মা। এদিকে লতার বাবা-মা হুট করে রবিনের অবস্থা দেখে আফসোসের সুরে বলছিলেন,

— ছেলেটার কি হলো আবার? এই তো একটু আগেও বেশ ভালো ছিল।

লতার বাবা-মা অন্য গাড়িতে করে রবিনদের গাড়ির পিছু পিছু রওনা হয়েছে।

বাড়িতে আছে রুপা আপা, শাদাদ ভাই আর লতা। রুপা আপা সন্দিহান হয়ে শাদাদ ভাইকে প্রশ্ন করেন,

— তুই রবিনের শরবতে কিছু মিশিয়ে টিশিয়ে দিস না তো আবার?

শাদাদ ভাই উত্তর দেয় না আয়েশ করে সোফায় পা তুলে বসে। তারপর, লতাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— যেই ছিল দশবার মলত্যাগ করে ক্লান্ত হয়ে যায় সেই ছেলেকে আমাদের লতা বিয়ে করবে! এই ছেলে তো ফার্মের মুরগী সরি মোরগ রে মধু!

কথাগুলো বলে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে শাদাদ ভাই। লতা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় শাদাদ ভাইয়ের দিকে। কারণ, রবিনের এভাবে হুট করে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পেছনে শাদাদ ভাইয়ের হাত আছে হয়তো। রুপা আপা শাদাদ ভাইয়ের দিকে একটা কুশন বালিশ ছুঁড়ে দিলো। শাদাদ ভাই তা ক্যাচ তুলে কোলের ওপর নিয়ে বসে বসে শিস বাজাচ্ছে।

রুপা লতাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— আমি হসপিটালে যাচ্ছি। সব এই শাদাদের জন্য হয়েছে বুঝলি। মাথার মধ্যে খালি শয়তানি বুদ্ধি কিলবিল করে। শয়তান একটা, বাঁদর।

রুপা আপা শাদাদ ভাইকে বকতে বকতে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন।

লতা আর শাদাদ ভাই তখন সম্পূর্ণ একা। ড্রইংরুমে কেউ নেই। সবকিছু নিশ্চুপ। যেন তারাও চুপ থাকার পণ করেছে। লতা মাথা নিচু করে শাদাদ ভাইকে বললো,

— কাজটা কি ঠিক হলো শাদাদ ভাই? একটা মানুষকে শারীরিকভাবে কষ্ট দেয়া কি আপনাদের রুলসের মধ্যে পরে?

শাদাদ ভাই লতার প্রশ্ন শুনে চট করে উঠে দাঁড়ায়। লতার যেখানে বসে আছে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। লতার সামনে উপুড় হয়ে লতার চোখে চোখ রেখে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

— কেন রে কষ্ট হচ্ছে তোর? বিয়ে হতে না হতেই এত মায়া! গ্রেট; কিন্তু তোর এত মায়া ওই বিড়ালটার জন্য দেখে কেন যেন আমার সহ্য হচ্ছে না।

— তুমি আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছো। উত্তর দাও কেন এমন করলে? রবিন সাহেবের দোষটা কোথায়?

— দোষটা রবিনের। কারণ, ও তোকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে।

লতা যে সোফায় বসে ছিল সেই সোফায় লাথি মেরে কথাটি বলে লতাকে চেপে ধরে শাদাদ ভাই। লতা শাদাদ ভাইয়ের এমন আক্রমণাত্মক আচরণ দেখে লতা আঁতকে উঠল ভয়ে। শাদাদ ভাই শান্ত গলায় লতার কাঁপাকাপা চোখের পাতায় নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বললো,

— যেদিন থেকে বুঝতে পারলাম তুই আমার বিশেষ কেউ। সেদিন থেকে বিরহের আগুনে দগ্ধ আমি। আজও সেই পোড়া ঘা নিয়ে ঘুরছি এই আশায় তোকে একদিন না একদিন আমি জয় করব। কিন্তু, সেই আশায় গুড়ে বালি দিয়ে অন্যকেউ এসে তোকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে তা হতে দেয়া যায় না। বিরহ ভালো লাগছে না আমার; একটুখানি ভালোবাসা চাই আমার। তাও তোর ভালোবাসা চাই আমার। তোর আর আমার ভালোবাসা মাঝে যে আসবে তাকে এত সহজে ছেড়ে দেই কি করে?

কথাটি বলে লতার বন্ধ চোখের পাতায় চুমু খেয়ে সরে আসে শাদাদ ভাই। লতা তখনও বসে আছে। নড়াচড়ার করার জন্যেও যেন ওর শরীরে কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই। সবটা শুষে নিয়েছে শাদাদ ভাই।

শাদাদ ভাই লতার অবস্থা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এগিয়ে এসে লতাকে কোলে তুলে নেয়। লতা শাদাদ ভাইয়ের হুটহাট আচরণ দেখলে অবাক হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এখনও হলো তাই।

— নামান আমাকে। ইদানীং অসভ্য হয়ে গেছেন আপনি। যখন তখন উল্টাপাল্টা কাজ করছেন।

লতা কথাগুলো বলছে আর নামার জন্য জোরাজুরি করছে। কিন্তু, শাদাদ লতার কোনো কথায় কান না দিয়ে নিজ মনে এগিয়ে যাচ্ছে দোতলায়। শাদাদ ভাইয়ের কোনো ভাবান্তর না দেখে একসময় লতা শান্ত হয়ে যায়। শাদাদ ভাই লতাকে শান্ত হতে দেখে এবার মুখ খুললো,

— এই যে তুই বললি ইদানীং আমি অসভ্য হয়ে গেছি। অসভ্য কার জন্য হলাম? তোর জন্য। কারণ, তোকে দেখলে আমার অনেক কিছু করতে ইচ্ছে। যেমন ধর ঠাস করে দরজা বন্ধ করে ঠুসঠাস দুয়েকটা চুমু খেতে ইচ্ছে করে তোর এই টমেটোর মতো গালে। এই যে তোকে কোলে নিলাম মনে হচ্ছে তোকে কোল থেকে না নামিয়ে সোজা কাজি অফিসে চলে যাই। বিয়ে করে তোকে বৌ বানিয়ে একবারে বাসর ঘরে ঢুকে পরি। তারপর, তোর আদরে আদরে মরব আমি । তোর আদরে ফের জাগ্রত হবো আমি ।

কথাগুলো বলতে বলতে শাদাদ ভাই লতাকে একটু উঁচুতে ধরে লতার থুতনির দেবে খাঁজে শব্দ করে চুমু খেয়ে লতাকে ওর ঘরের দরজার সামনে নামিয়ে দেয়। লতা তো ছাড়া পেয়ে ঘরে ঢুকে দরজা আঁটকে দেয়। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে লতার। লোকটা এমন কেন? বুকে কাঁপন ধরে যায় তার দেয়া স্পর্শ আর কথাগুলো শুনলে। তার কাছ থেকে এমন ভালোবাসা পেলে তাকে ছেড়ে অন্য কারো সঙ্গে ঘর বাঁধবে কি করে ?

দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে শাদাদ ভাই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চলে যাচ্ছে। ভাবছে কি করে নিজের মনের কথাগুলো পরিবারকে জানানো যায়? সবাই যখন জানবে তখন কি উনারা মানতে চাইবে?

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে