বিরহ ভালোবাসা পর্ব-১৬

0
657

#বিরহ_ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter

১৬.

প্রায় সাতদিন রবিন সাহেব হসপিটালে ছিলেন। ফুড পয়জিনিং সাথে নাকি প্রসাবে ইনফেকশন ধরা পরেছিল রিপোর্টে।

এদিকে আমার পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। মাথায় তখন শুধু পড়াশোনার চাপ। শাদাদ ভাই কিংবা রবিন সাহেব কে তাদের ভেবে অযথা দুশ্চিন্তা করা বাদ দিয়েছি।

পরীক্ষার বদৌলতে হোস্টেলে ফিরতে দেয়নি মা। তাই বাড়িতে বসে পড়াশোনা। সময়মতো গিয়ে পরীক্ষার হলে উপস্থিত হওয়া সবটাই চলছিল নিয়মমাফিক।

পরীক্ষা যখন শেষ হলো তখন নভেম্বর মাস। গা চিমটানো শীত। মৃদু বাতাস গায়ে লাগলে গায়ে কাটা দিয়ে যায়। একদিন হুট করে সকালের নাশতার পর চায়ের পর্ব চলছিল। বড়ো জেঠু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— বলছিলাম কি তৌহিদ সবাই মিলে আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে এলে কেমন হয়? আমি তো কিছুদিন আগেও ঘুরেফিরে এলাম। কিন্তু তোরা বছরখানিক হলো গ্রামে যাস না। লতার ভার্সিটি বন্ধ। একা একা বাসায় বসে ছুটি উপভোগ করা যায়?

বাবা জেঠুর কথা শুনে কিছুটা সময় নিয়ে কি যেন ভাবলেন। তারপর, আমাকে এবং মাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— ব্যাগ গুছিয়ে ফেলো আজ রাতের ট্রেনে আমরা সবাই গ্রামের বাড়িতে যাবো।

আমি খুশি হয়ে জেঠুকে ধন্যবাদ জানালাম। সেই সাথে বাবাকেও। নিজের ঘরে এসে চার-পাঁচটা থ্রী-পিছ আর পছন্দের ক্যামেরাটা নিয়ে নিলাম। কারণ, গ্রামের প্রাকৃতিক দৃশ্য একমাত্র ছবির মাধ্যমে আঁটকে রাখা যায়। নয়তো, এত সুন্দর দৃশ্য একসময় স্মৃতির পাতায় ঝাপসা হয়ে যায়।

দুপুরে খাওয়ার পর আমার ঘুমানোর অভ্যেস আছে। ঘুমাতে না পারলে বিকালের পর মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। তাই জানালার পর্দা লাগিয়ে ঘরের লাইট অফ করে পুরো ঘরকে রাতের আঁধার বানিয়ে বালিশে মাথা রেখে শান্তির ঘুম দেয়ার জন্য চোখ বুজে ফেললাম।

লাল সুতির শাড়ি পরে একহাত ঘোমটা দিয়ে নাকের পানি চোখের পানি এক করে কাঁদছে আমাদের লতা। কারণটা হলো গ্রামের আসার পর ওর বাব এবং জেঠু মিলে ওকে বিয়ে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। শেষমেশ সক্ষম হয়েছেন লতার বিয়ে সম্পন্ন করে।

লতা বাসরঘরে বসে হিচকি তুলছিল এমনসময় ওর স্বামী এসে ওকে দিলো এক রামধমক। একধমকে লতা আঁতকে উঠল। ভয়ে চোখের কান্না শুকিয়ে গেছে। পিটপিট করে নিজের স্বামীর দিকে তাকিয়ে আমাদের লতা ভয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে।

লতার পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে। লতা শোয়া থেকে উঠে বসে। বেডসাইড টেবিল থেকে জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। মাথাটা ঘুরছে। বোধহয় প্রেশারটা ফল করেছে। লতা কোনেরকম বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে যায়। চোখেমুখে পানি দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসে। খাটের ওপর বসে ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় তাকাতেই নিজেকে আবিস্কার করলো দুপুরের সেই কালো রঙের থ্রী-পিছে। তারমানে এতক্ষণ সে দুঃস্বপ্ন দেখছিল। লতার কারো সাথেই বিয়ে হয়নি।

লতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বালিশে মাথা রেখে চুপটি করে শুয়ে রইলো। একসময় লতার চোখের পানি গড়িয়ে বালিশে পরে।

— শাদাদ ভাই স্বপ্নে নিজের বিয়ে অন্যকারো সাথে হতে দেখে আমি পাগলের মতো কেঁদেছি। যদি বাস্তবে আপনাকে না পাই তবে আমি পাগল হয়ে যাব।

লতার দুচোখের পানি বালিশে গড়িয়ে পড়ছে। না পাওয়ার যন্ত্রনা বড্ড পীড়াদায়ক। না কাউকে মুখ ফুটে বলা যায় আর না সহ্য করা যায়!

——————–

রাত দশটার ট্রেনে খ নাম্বার বগিতে বসে আছে লতার পুরো পরিবার। রুপা আপা এবং উনার স্বামী জাভেদ ভাই আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন। একসপ্তাহ হলো জাভেদ ভাই ছুটিতে বাড়িতে এসেছেন।

আমি জানালার কাছে বসতে চেয়েছিলাম কিন্তু মা আমাকে চোখ রাঙানি দিয়ে বললো কি, জানালার পাশে বসলে চোর এসে গলায় ছুড়ি মেরে চেইন নিয়ে যাবে। মায়ের কথা শুনে সাহস হলো না জানালার কাছে বসার। বাবা এসে জানালার পাশে বসলো।

ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। ধীরে ধীরে ট্রেনে গতি বাড়ছে। ব্যস্ততম শহরের বুক থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে যাচ্ছে আমাদের ট্রেন।

ট্রেন যখন পুরোদমে চলতে শুরু করলো তখন রুপা এসে আমাকে বললো চল আমাদের সীটে গিয়ে বসি তোর জাভেদ ভাই কথা বলবে তোর সাথে। মায়ের কাছ থেকে চোখের ইশারায় অনুমতি পেয়ে রুপা আপাদের সীটে গিয়ে বসলাম। জাভেদ ভাই আমাকে দেখে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো,

— মানুষ চিকন থেকে মোটা হয়। আর তুমি মোটা থেকে চিকন হচ্ছো। ব্যাপারটা কি প্রেমে অসফল হয়ে দেবদাস হলে নাকি?

জাভেদ ভাইয়ের কথা শুনে মনে মনে দীর্ঘশ্বাস চেপে বললাম,

—- আপনার শালার জন্যই তো আজ আমার এই অবস্থা। তাকে না পাওয়ার যন্ত্রণা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আমায়। যদিও অসুরটার এই ব্যাপারে কোনো হেলদোল নেই। দূরে গেলে লতা কে এটাই হয়তো মনে রাখে না। আর কাছে এলে উনার প্রেম বেড়ে যায়। গরম দুধের ন্যায় উতলে পরে নীচে।

— কি শালি সাহেবা কিছু জানতে চেয়েছি আপনার কাছে? আপনি তো আমার প্রশ্ন শোনার আগে কল্পনার জগতে চলে গেলেন।

কথাটি বলে জাভেদ ভাই হাসতে লাগলেন। আপা জাভেদ ভাইয়ের পেটে কনুই দিয়ে গুতো মারে অমনি তার হাসি বন্ধ। জাভেদ ভাই অসহায় চোখে তাকালেন নিজের অর্ধাঙ্গিনীর মাঝে কিন্তু আপা উল্টো চোখ রাঙানি দিয়ে বললো,

— তোমাকে এত কথা বলতে বলেছি আমি। কাজের কথা না বলে ফাও আলাপ শুরু করেছো। শোন লতা?

— জী আপা।

— তুই চাচির কাছে চলে যা। অযথা, এখানে বসে ওর বিরহ মার্কা কথাবার্তা শোনার দরকার নেই।

এই একটা কথায় অপেক্ষায় ছিলাম। মায়ের কাছে ফিরে এলাম। এসে দেখি মা বসে বসে রবি ঠাকুরের “শেষের কবিতা” বইটি পড়ছেন। আমি বিড়াল ছানার মতন মায়ের কোল ঘেসে বসে পড়লাম। মা একবার আমার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায় কিন্তু আমি হাসিমুখ করে কিছু না বলে মায়ের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রইলাম। মা আমাকে কিছু না বলেই আবারও বইয়ে মনোযোগী হলেন

মায়ের কাঁধে মাথা রেখে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি বুঝতেই পারিনি!

ঘুম ভাঙলো রুপা আপার ডাকে। চোখ কচলে ঘুমঘুম চোখে আপার দিকে তাকিয়ে আছি। আপা আমার ব্যাগটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,

— চল এসে পড়েছি আমরা। নাকি ট্রেনে থাকবি?

আমি মাথা নাড়িয়ে চট করে ব্যাগটা হাতে নিয়ে মাথায় খুব ভালো করে ওড়না জরিয়ে রুপা আপার পেছনে পেছনে নেমে এলাম ট্রেন থেকে।

হুট করে শীতল বাতাস এসে আমাকে ছুঁয়ে দিয়ে গেলো। নভেম্বর মাসের শীত শহরে সকালে লাগলেও গ্রামে এর প্রকট দিনভর পাওয়া যায়। এমনসময় বাবা নিজের গায়ের শালটা আমার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বললো,

— খুব ভালো করে শরীরে জড়িয়ে নে নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে।

মা এবং বাবার কান্ড দেখলে আমার মাঝে মাঝে ভীষন অবাক লাগে। তারা আমায় ভুল করলে যেভাবে বকে তার চেয়ে বেশি স্নেহ দিয়ে আগলে রাখেন। এই যে মায়ের কাঁধে মাথা গুঁজে ঘুমালাম মা কিন্তু একটুও উফফ শব্দ করেনি। আর বাবা নিজের ঠান্ডা লাগার চিন্তা না করে আমাকে শালটা দিয়ে দিলেন। হয়তো, বাবা-মায়েরা এমনই সন্তানের অসুবিধা বোধহয় বাবা-মায়ের বেশি বুঝে।

তিনটা রিকশা ডাকা হলো। একটায় বাবা আর জেঠু। অন্যটায় আমি এবং মা। সর্বশেষ জাভেদ ভাই এবং রুপা আপা।

ধীরে ধীরে রিকশা এগিয়ে যাচ্ছে গ্রামের মেঠোপথ ধরে। আঁকাবাঁকা রাস্তা। রাস্তার কোল ঘেসে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বিশাল গাছ। গ্রামের ছোট বড়ো অনেকেই দেখলাম রাস্তার কিনারা দিয়ে হেটে যাচ্ছে নিজ গন্তব্য। কারো হাতে আবার বাজারের ব্যাগ।

এমন সময় রিকশা থামলো মোল্লাবাড়ির সামনে। আমাদের পৈতৃক ভিটা ডালিকান্দিতে। একে একে সবাই নেমে পড়লো। আমি নামলাম সবশেষে। বাবা রিকশা ভাড়া মিটিয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে সর্বপ্রথম বাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন। তারপর, জেঠু, মা আমরা সবাই।

বাড়ির প্রতিবেশীরা এগিয়ে এলেন আমাদের দেখে। সবাইকে হাসিমুখে সালাম দিয়ে বাবা-জেঠু আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন তাদের সাথে।

তারপর, আমরা গেলাম নিজেদের চারবিশিষ্ট চৌচালা ঘরে। টিনের ঘর। মনে মনে উত্তেজনা নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। আহ্ আনন্দ হচ্ছে ভীষন।

ঘরে ব্যাগ রেখে কলপাড়ে গিয়ে টিউবওয়েল চেপে হাতমুখ ধুয়ে ফেললাম রুপা আপা, আমি আর জাভেদ ভাই মিলে। ঘরে এসে দেখলাম প্রতিবেশী চাচী আমাদের পিঠা রুটি এবং আলুভাজি দিয়ে গেছেন। বেশ আয়েশ করে আমরা সকলে খেয়ে নিলাম। স্বাদ পেলাম অমৃতের মতো।

এমন সময় অনুভব করলাম আরেকটু ঘুমানের প্রয়োজন। তাই চট করে একটি রুমে ঢুকে কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা শুরু করলাম।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে